আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজ: যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট?

আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজ; ডাকনাম এওসি। অনেকেই হয়তো নামটির সাথে পরিচিত নন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সবাই যখন ‘টেন-ইয়ার চ্যালেঞ্জ’ কিংবা ‘গ্লো-আপ চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে মত্ত, ঠিক সেই সময়টাতেই, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই, বিশাল বড় একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন এই নারী। আমেরিকান কংগ্রেসে যোগদানের পর প্রথম হাউজ ফ্লোর ভাষণের মাধ্যমেই রেকর্ড গড়েছেন তিনি। সি-স্প্যান থেকে করা তার বৃহস্পতিবারের ভাষণের টুইট পরিণত হয়েছে চ্যানেলটির এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশিবার দেখা ভিডিওতে। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই টুইটারে ভিডিওটি দেখার পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ লক্ষ ৬০ হাজার। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় রাত পর্যন্ত ভিডিওটি দেখা হয়েছে ২৮ লক্ষ ৮০ হাজারবার। এছাড়াও ভিডিওটিতে পড়েছে ৫০ হাজারের উপর লাইক, তিন হাজারের বেশি কমেন্ট, এবং ভিডিওটি পেয়েছে ১৫ হাজারের মতো রিটুইট।

তবে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিউ, লাইক, কমেন্ট, শেয়ারই এওসিকে নিয়ে এই লেখার মূল কারণ নয়। আল জাজিরার মতো শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমও বিশেষ আর্টিকেল প্রকাশ করে ফেলেছে, যার শিরোনামেই বলা হচ্ছে: আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজ হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট! আর্টিকেলের রচয়িতার মতে, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, সিনেটর কামালা হ্যারিস, অপরাহ উইনফ্রে, মিশেল ওবামা কিংবা হিলারি ক্লিনটনদের মধ্যে কেউ নন, এওসির সামনেই সবচেয়ে বড় সুযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার।

এওসির সামনে সুযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার; Image Source: Business Insider

শুধু আল জাজিরাই নয়, আরও অনেক বড় বড় সংবাদমাধ্যমের নামজাঁদা সাংবাদিক ও বিশ্লেষকই এওসিকে চিহ্নিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এগুলো শুনে আপনাদের নিশ্চয়ই অবাক লাগছে। এতদিন যার নামই শোনেননি, তিনিই কি না হয়ে যাবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট! যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া কি হাতের মোয়া নাকি!

যেভাবে এওসির উত্থান 

প্রকৃতপক্ষেই, পুয়ের্তো রিকান বংশোদ্ভূত এওসির উত্থান খুবই আকস্মিক ও অননুমেয়। এক বছরেরও কম সময় আগে পর্যন্ত তিনি কাজ করতেন ‘ফ্ল্যাটস ফিক্স’ নামের একটি বারের বারটেন্ডার হিসেবে। অথচ সেই তিনিই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বারটেন্ডারের চাকরি ছেড়ে নেমে পড়েন পুরোদস্তুর রাজনীতিতে। জুন মাসে ৫৭.১৩% ভোট পেয়ে তিনি নিউ ইয়র্ক কংগ্রেশনাল প্রাইমারি ইলেকশনে হারিয়ে দেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ জো ক্রাউলিকে। এরপর নভেম্বরে জেনারেল ইলেকশনেও তিনি ৭৮% ভোট পেয়ে জয়ী হন, এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সে পরিণত হন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করা নারীতে। গত ৩ জানুয়ারি, ২০১৯ থেকে তিনি কংগ্রেসে নিউ ইয়র্কের ১৪তম কংগ্রেশনাল ডিসট্রিক্টের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

এওসির উত্থানের টাইমলাইন; Image Source: Business Insider

২০১৮ সালে নির্বাচনে দাঁড়ালেও এওসি যে রাজনীতির অঙ্গনে একদমই নবিশ, তেমনটি বলা যাবে না। বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তখন ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রদান ছাড়াও তিনি ম্যাসাচুসেটসের ডেমোক্রেটিক সিনেটর টেড কেনেডির হয়ে অভিবাসী ইস্যুতে কাজ করেছিলেন। এছাড়াও ২০১৬ সালে তিনি বার্নি স্যান্ডার্সের ক্যাম্পেইনেরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

২০১৭ সালে বারটেন্ডার হিসেবে এওসি; Image Source: Twitter

যেভাবে তুলেছেন আলোচনার ঝড় 

টুইটারে ইতিহাস গড়ারও আগে থেকেই এওসি যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন। আত্মঘোষিত এই গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক (একটি রাজনৈতিক আদর্শ, যেখানে রাজনৈতিক গণতন্ত্র এবং সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করা হয়) অ্যান্ডারসন কুপার উপস্থাপিত ‘সিক্সটি মিনিটস’ অনুষ্ঠানের একটি পর্বে হাজির হন, যেটি ৬ জানুয়ারি প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি কথা বলেন ‘গ্রিন নিউ ডিল’ এর ব্যাপারে। তিনি তার পরিকল্পনার কথা জানান, ২০৩৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির দেশে পরিণত করা হবে। উপস্থাপক কুপার তখন বলেন, এ ধরণের প্রকল্প হাতে নিতে গেলে তো কর বৃদ্ধি করা লাগবে। জবাবে এওসি বলেন, “হ্যাঁ, সেরকম কিছু একটারই ব্যবস্থা করা হবে, যেখানে জনগণকে তাদের ন্যায্য অংশ দিতে হবে।” তার কাছে আরও ‘নির্দিষ্ট’ করে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “যখন আপনি অনেক বেশি ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যাবেন, তখন তো বেশি কর দিতে হবেই। মনে করুন, আপনার ১০ মিলিয়নতম ডলারটির উপর হয়তো ৬০-৭০% কর ধার্য করা যেতে পারে।”

৭০ শতাংশ! সেই অনুষ্ঠানে এওসির মুখে এমন একটি বিবৃতি শোনার পর থেকেই শোরগোল পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতি সচেতন মানুষদের মধ্যে। কেননা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ৭০% কর বিপুল পরিমাণই বটে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদিত সর্বশেষ বিলে সর্বোচ্চ কর হিসেবে ধার্য করা হয়েছিল মাত্র ৩৭%। অথচ এওসি কি না সেটিরই প্রায় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করছেন! তাই পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম এবং টিভির টক-শোতে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় ৭০% কর।

গণমাধ্যমের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে এওসি; Image Source: Getty Images

নিঃসন্দেহেই, এওসি এমন একজন গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক যিনি ধনীদের বেড়ে ওঠা রোধ করে সামাজিক মালিকানা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে কঠিন পন্থা অবলম্বনেও প্রস্তুত। টুইটারে তার যে ২৫ লক্ষের মতো অনুসারী আছে, যারা তার মতো একই মতাদর্শেও বিশ্বাসী, তারা কিন্তু এওসির এমন প্রস্তাব রীতিমতো লুফে নেয়। পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটাতে এটিকেই সর্বোৎকৃষ্ট পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যা দিতে থাকে। অন্যদিকে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে এক শ্রেণীও ৭০% করকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে। তারা বলতে শুরু করে, ১৯৬০’র দশক পর্যন্ত সর্বোচ্চ করের রেঞ্জ এমনকি ৯০% বা এর চেয়ে বেশিও ছিল। তাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে সর্বোচ্চ কর ৭০% করা যেতেই পারে। যারা এওসির সাথে একমত নয়, তারা টুইটারে গালিবর্ষণ শুরু করেছিল বটে, কিন্তু এওসির ঈর্ষণীয় ফ্যান-বেসের পাল্টা আক্রমণে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়।

নাগরিক সমস্যার উপর গুরুত্বারোপ 

এওসির নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতির মধ্যে প্রধান ছিল সকলের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, বৈশ্বিক চাকরির গ্যারান্টি, এবং অভিবাসী সংকট ও অপরাধ-নীতির সংস্কার করা। কংগ্রেসে নিজের প্রথম রেকর্ড গড়া ভাষণটিতেও তিনি উত্থাপন করেছেন আরও একটি নাগরিক সমস্যার বিষয়, যেটি হলো বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়া। ভাষণে তিনি তার নির্বাচনী এলাকা ব্রংকসের একজন ভোটারের কথা তুলে ধরেন, যিনি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাজ করেন, কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারি তহবিল বন্ধ থাকায় তার বেতনও বন্ধ রয়েছে।

তার কাজ হলো তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা বিশ্লেষণ করা এবং সেটির সমাধান করা, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বেরই অন্যতম ব্যস্ত এয়ার স্পেসটিতে যাতায়াতকারী মানুষজন নিরাপদে থাকে। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপারটি হলো, শুধু তিনিই নন, পুরো যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারই বর্তমানে নিদারুণ মানসিক অবস্থার মধ্যে তাদের প্রতিদিনের কাজটি করে চলেছেন, কারণ তাদের কোনো ধারণাই নেই কবে তারা পরবর্তী পে-চেকটি হাতে পাবেন।

সরাসরি ট্রাম্পকে আক্রমণ করেছেন এওসি; Image Source: Huffington Post

এরপর তিনি সরাসরি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন, কারণ ট্রাম্পের পরিকল্পনার সীমান্ত দেয়াল তৈরির জন্য তহবিল পাস না হওয়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই মুহূর্তে এমন সংকটের মুখে পড়েছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ সরকারী কর্মচারীদের।

এটি কেবল একটি দেয়ালের ব্যাপার নয়, এটি একটি সীমান্তের ব্যাপার নয়, এবং এটি অবশ্যই প্রতিদিনের আমেরিকানদের ভালো থাকার বিষয় নয়। সত্যিটা হলো এই যে, এই শাটডাউনটি আসলে আমেরিকার গণতন্ত্রের ক্ষয়ে যাওয়া রূপটিরই প্রতিফলন, এটি দেখাচ্ছে কীভাবে আমাদের সরকার এমনকি তার খুবই প্রাথমিক নীতিগুলোও ঠিকঠাক পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।

এই কংগ্রেসের প্রতিটি সদস্যেরই দায়িত্ব রয়েছে এই জাতির প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের প্রতি, তারা আমাদের ভোট দিক কিংবা না দিক। এবং সেই দায়িত্বের কিছুটা আমাদের প্রেসিডেন্টের উপরও বর্তায়। তার মানে আমি আমার এলাকার যে মানুষটির কথা বললাম, তার দুর্দশার জন্য আমাদের প্রেসিডেন্টও দায়ী।

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট

বলাই বাহুল্য, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ঝান্ডাবাহী এওসি একেবারে নতুন কিছু ধ্যান-ধারণা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে হাজির হয়েছেন, যার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত রাজনীতির কোনো মিলই নেই। এওসি নিজেই নিজেকে ‘র‍্যাডিকাল’ বলে অভিহিত করেন, এবং নিঃসন্দেহে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আপাদমস্তক র‍্যাডিকাল পরিবর্তন আনতেই বদ্ধপরিকর। আর সেজন্যই, অনেকের মতেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট।

তবে একটি বিষয় স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া দরকার, ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট মানে যে এওসি ২০২০ সালের প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনেই ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে মনোনয়ন পাবেন এবং জিতে যাবেন, তেমনটি কিন্তু বলা হচ্ছে না। কারণ ভুলে যাবেন না, তার বয়স সবে ২৯। তাই আগামী প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনের সময়ে তার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতা লাভের বয়সই হবে না! তবে ২০২৪ সালে তার সামনে সত্যিই অনেক বড় একটি সুযোগ থাকবে।

বয়সের কারণে ২০২০ সালে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনে লড়তে পারবেন না এওসি; Image Source: AP

কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তিনি? 

অনেকেই হিলারি ক্লিনটনের ভেতর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্টকে দেখেছিলেন। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। এখন অনেকে এওসিকে নিয়েও একই রকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এওসি হিলারির মতো নন।

২০১৬ সালের জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ঢের এগিয়ে থেকেও, শেষ পর্যন্ত হিলারি হেরে যান গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটগুলোতে (যেসব রাজ্যে প্রধান দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, এবং বিজয়ী ও বিজেতার মধ্যে ব্যবধান থাকে খুবই সামান্য), এবং বিতর্কিত ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেমের কারণে তাকে প্রেসিডেন্সিও খোয়াতে হয়।

এটি অবশ্যই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দুর্ঘটনাগুলোর একটি, কিন্তু এজন্য কেবল ইলেক্টোরাল সিস্টেমকে দায়ী করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এর জন্য সমানভাবে দায়ী হিলারি নিজেও।

জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থেকেও প্রেসিডেন্ট হওয়া হয়নি হিলারির; Image Source: Getty Images

হিলারি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি, এর কারণ তিনি কর্মজীবী-শ্রেণীর ভোটারদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষিত বা আদর্শবাদীরা হিলারির প্রতি অনেকাংশেই সন্তুষ্ট থাকলেও, খেটে-খাওয়া মানুষরা নিশ্চিত হতে পারেনি যে হিলারি আসলেই তাদের সমস্যাগুলো বুঝে, আমলে নিয়ে, সেগুলো দূর করতে পারবেন কি না।

এক্ষেত্রে হিলারির মেটামরফোসিসও একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। হিলারি যখন তার যাত্রা শুরু করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন তরুণ, শিক্ষিত, আদর্শবাদী ও নারীবাদী, যিনি সামাজিক ন্যায্যতা ও সমানাধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পর ধীরে ধীরে তার রূপান্তর ঘটতে থাকে। তিনি ও তার স্বামী মিলে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক বনে যান, যার মধ্যে ২১ মিলিয়ন ডলার তিনি পেয়েছিলেন কেবল ওয়াল স্ট্রিট ও অন্যান্য আগ্রহী গ্রুপের কাছ থেকে, কথা বলার পারিশ্রমিক হিসেবে। এবং এভাবেই তিনি গণমানুষের নেত্রী থেকে, কর্পোরেট আমেরিকার পাপেটে পরিণত হন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে তিনি অনেক ভালো ভালো কথাই বলেছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল তিনি ‘মুখে এক মনে আরেক’। তাই ঠোঁট কাটা ট্রাম্পকেই তাদের কাছে ‘অপেক্ষাকৃত বেশি সৎ’ মনে হয়েছিল।

কিন্তু হিলারি কিংবা অন্যান্য অনেক প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের মতো, এওসি একই পথে হাঁটছেন না। বরং তিনি কর্পোরেট পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটি (প্যাক)-এর থেকে পাওয়া ডোনেশনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি ওয়াল স্ট্রিটের কাছ থেকে মিলিয়ন ডলার গ্রহণ করে গণমাধ্যমের সামনে গৎবাঁধা বুলি আউড়াননি। ‘রাজনৈতিক শুদ্ধতা’ অর্জনের বদলে তিনি যখন যা মনে এসেছে, সেটিই বলে দিয়েছেন, কিংবা টুইট করে দিয়েছেন, যার ফলে কয়েকবার তাকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হলেও, ভক্তকুল তার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি বা তার অভিসন্ধির ব্যাপারে সন্দেহ করতে শুরু করেনি।

১১ ডিসেম্বর, ২০১৮ থেকে ১১ জানুয়ারি, ২০১৯ পর্যন্ত যাদের টুইটার হ্যান্ডলে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে; Image Source: Axios

নবায়নযোগ্য শক্তি, কর, অভিবাসন, চিকিৎসাসেবা, বকেয়া বেতন, অপরাধ-নীতির সংস্কার প্রভৃতির মাধ্যমে এওসি ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে চান। তাই তো সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে আমেরিকানদের মনে অজানা ভয় বা বীতশ্রদ্ধতা থাকলেও, এওসিকে তারা ঠিকই সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে।

এওসি তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে উঠে আসা একজন রাজনীতিবিদ। তাই দৈনন্দিন জীবনে মানুষের সমস্যাগুলো সম্পর্কে তিনি বেশ ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল, যার প্রতিফলন ইতিমধ্যেই তার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে। এছাড়াও তিনি ট্রাম্পের মতোই টুইটারে খুবই সক্রিয়, এবং ট্রাম্পের পর তার টুইটেই সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে খেটে-খাওয়া মানুষের পাশাপাশি তিনি অবগত শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের চাহিদা ও অভিযোগের ব্যাপারেও। আরও একটি বড় বিষয় হলো, তিনি প্রচন্ড মাত্রায় ‘মিডিয়াজেনিক’। ট্রাম্পের মতো তিনিও ‘এনি প্রেস ইজ গুড প্রেস’ নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি খুব ভালো করেই জানেন কীভাবে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। এখন পর্যন্ত এ কাজে তিনি খুবই সফল। গুগলে তার নাম সার্চ দিয়ে দেখবেন শত শত আর্টিকেল। তার সমসাময়িক উঠতি আর কোনো রাজনীতিবিদের ব্যাপারে কিন্তু এর দশ ভাগের এক ভাগ লেখাও আপনি খুঁজে পাবেন না।

এওসি একজন আত্মঘোষিত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক; Image Source: Common Dreams

শেষ কথা 

যেমনটি আগেই বলেছি, বয়সের কারণে এওসি ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতা লাভ করতে পারবেন না। কারণ সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে গেলে বয়স ন্যূনতম ৩৫ হওয়া লাগবে। ডেমোক্রেটিক পার্টি এবার হয়তো সাবেক টেক্সাস কংগ্রেসম্যান বেটো ও’রুর্কের মতো কাউকে মনোনয়ন দেবে, যিনি ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয়-বাম ঘেঁষা নীতিতে অটল থাকবেন, যার মূল কথা হবে: সমঝোতা, সমঝোতা এবং সমঝোতা। এবং তা-ই যদি হয়, তাহলে আরও একবার ট্রাম্পের পক্ষে পতিপক্ষকে তুমুল বাক্যবাণে বিদ্ধ করে জয়ের বন্দরে নোঙর করা কঠিন হবে না।

আরও একবার যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকট বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। ফলে আমেরিকান রাজনীতির কট্টর সমর্থকরাও, সমাজতন্ত্র যাদের দুই চোখের বিষ, তারাও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে একটি একটি মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের, যেটি নিয়ে আসতে পারেন এওসিই।

এওসির পরবর্তী লক্ষ্য হবে নিউ ইয়র্কের সিনেটর হওয়া; Image Source: Reuters

এওসির হাতে এখনও পাঁচ বছর সময় আছে। দুই বছর কংগ্রেস-ওম্যান হিসেবে কাজ করার পর তিনি অবশ্যই চাইবেন নিজের হোম স্টেট নিউ ইয়র্ক থেকে সিনেটর পদে নির্বাচন করার। সেখানেও যদি তিনি সফল হন, তাহলে তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ তো হবেই, পাশাপাশি তিনি ওয়াশিংটনে অনেক মিত্রও জুটিয়ে ফেলতে পারবেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, তিনি হয়তো ততদিনে আমেরিকানদেরকে পুরোপুরি বুঝিয়ে ফেলতে পারবেন যে, শুধু গণতন্ত্র কিংবা শুধু সমাজতন্ত্র নয়, বরং এই দুইয়ের মিশেলে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব আমেরিকাকে আবারও ‘গ্রেট’ করে তোলা। সেক্ষেত্রে জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির থেকে প্রেসিডেন্সি মনোনয়ন পাওয়া, এবং শেষমেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়াও কোনো অলীক কল্পনা থাকবে না।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about Alexandria Ocasio-Cortez, who is being thought as the first woman president of the US. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © The Bulwark

 

Related Articles

Exit mobile version