ইন্ডিয়া টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার চলছিল একটি টক শো’র, যেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন বিখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ এদামারুকুর ছেলে স্যানাল এদামারুকু। তিনি বাবার মতোই একজন প্রগতিশীল এবং যৌক্তিক মানুষ। তার সঙ্গে অতিথি হিসেবে ছিলেন একজন হিন্দু আধ্যাত্মিক বাবা। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। বিপত্তি ঘটলো বাবার একটি অলৌকিক দাবি থেকে। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বাবা দাবি করলেন, তিনি কেবল মন্ত্র পড়ে যে কাউকে মেরে ফেলতে সক্ষম!
বাবার এই দাবিতে যে কেউ সহজেই চমকে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক। চমকে ওঠেননি কেবল স্যানাল। তিনি বরং মুচকি হেসে বাবাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন তাকে মেরে ফেলবার জন্য! ব্যস, বেঁধে গেল গোলমাল। এত স্পর্ধা যে বাবাকে চ্যালেঞ্জ জানায়! বাবা তো রেগে আগুন, স্যানালকে এখুনি শেষ করে দেবেন, এমনই যেন তার হাবভাব! এদিকে অনুষ্ঠানের পরিচালকরা অবস্থা বেগতিক দেখে সরাসরি সম্প্রচার তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দিলেন। তবে বাবা ভাবছিলেন অন্য কিছু। কিছুক্ষণ তর্জন-গর্জন করলেই হয়তো স্যানাল ভয়ে নতি স্বীকার করবেন, এমন ধারণা থেকেই তিনি কিছুটা উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখান। কিন্তু এদামারুকু অনড়। ফলে, আর কোনো উপায় না পেয়ে মন্ত্র জপতে বসলেন বাবা।
স্টুডিওতেই ধুপ জ্বেলে, চোখ বন্ধ করে, যোগাসনে বসে মন্ত্র জপ করতে শুরু করলেন তিনি। স্টুডিওতে তখন ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। বাবা চোখ বন্ধ করে অন্য জগতে আছেন, বাকিরা সামান্য চিন্তিত। তবে যার মৃত্যুর জন্য জপ করা হচ্ছিল, সেই স্যানাল মুচকি মুচকি হাসছিলেন সারাক্ষণ। সময় বাড়ার সাথে সাথে সবার চিন্তা দূর হতে লাগলো আর বাবার অলৌকিক ক্ষমতার দাবির অসারতা প্রমাণ হতে লাগলো। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাবার পর বাবা দাবি করলেন, স্যানালকে কোনো শক্তিশালী দেবতা আগলে রেখেছেন। তখন স্যানাল কী বললেন জানেন? “আমি তো নাস্তিক, আমাকে কেন দেবতারা রক্ষা করবেন!”
স্যানাল এদামারুকুর জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৬ মে, ভারতের কেরালা রাজ্যের থোরুপুঝা গ্রামে। তারা পিতা বিখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিত, লেখক ও সাংবাদিক জোসেফ এদামারুকু, যিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। জোসেফের স্ত্রী সোলি এদামারুকু ছিলেন একজন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। বাবা হিন্দু, আর মা খ্রিস্টান, এর জন্য কিন্তু স্যানালের জীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ তার বাবা-মা তাকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসেই বড় করেননি। বরং, বাবার চেষ্টায় সরকারি শিক্ষা বিষয়ক রেকর্ডে স্যানালের ধর্মীয় পরিচয় দেয়া হয় ‘নো রিলিজিয়ন’! স্যানালই ছিলেন ভারতের প্রথম এরূপ শিক্ষার্থী, যার কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় ছিল না।
প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে কৈশোরেই সবকিছুর যৌক্তিকতা খোঁজার মানসিকতা গড়ে ওঠে স্যানালের। তার যখন ১৫ বছর বয়স, তখন তার বাড়ির পাশে ঘটে যায় একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। পারিবারিক বিশ্বাসের গোঁড়ামির কারণে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এক নারী। তার পরিবার ধরেই নিয়েছিল ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন নেই, বিশ্বাস রাখলেই রোগ সেরে যাবে। এ ঘটনার পর থেকে নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিতে শুরু করেন স্যানাল। কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল সম্পন্ন করেন তিনি। নিজের ডক্টরেট গবেষণা প্রবন্ধ লেখার সময়ই ‘ইন্ডিয়ান র্যাশনালিস্ট এসোসিয়েশন’ এ যোগ দেন। এসময় খণ্ডকালীন সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেন তিনি।
পড়ালেখা শেষ করে ভালো বেতনে চাকরিও পেয়ে গিয়েছিলেন স্যানাল এদামারুকু। কিন্তু চাকরির মতো সহজ রাস্তা তার জন্য মানানসই নয় বলে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক বিশ্বাস আর নানাবিধ সামাজিক ও অতিপ্রাকৃত কুসংস্কারে ভরপুর ভারতের মতো দেশে ‘যৌক্তিকতা’ প্রচার করার মতো বন্ধুর পথ বেছে নিলেন তিনি। মানুষের মন থেকে অন্ধবিশ্বাস দূর করে সেখানে সন্দেহের বীজ বপন করে তাদের প্রশ্ন করতে শেখানোকেই নিজের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিলেন তিনি। তার মতো আরো এক দল নিবেদিতপ্রাণ মানুষকে সাথে নিয়ে শুরু করলেন লক্ষ্য অভিমুখে সে যাত্রা, যেখানে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি এসেছে, এসেছে প্রাণনাশের হুমকিও।
৯০’র দশক থেকে পুরোদমে র্যাশনালিস্ট এসোসিয়েশনের জন্য কাজ শুরু করেন স্যানাল। দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে, মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেন তারা। অন্ধবিশ্বাসে ভীত মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন বিজ্ঞান, আহ্বান করেন যুক্তি দিয়ে ভাবার জন্য। তার এই প্রচেষ্টা কোথাও তাকে এনে দিয়েছে ব্যাপক সাফল্য, কোথাও বা মানুষ তীব্র ঘৃণায় দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তথাপি তিনি দমে যাননি। তিনি জানতেন তার পথ বিপদসঙ্কুল। তাই কোনো বাধাই তাকে নিরুৎসাহিত করতে পারতো না। ফলে গ্রামে-গঞ্জে তিনি আধ্যাত্মিক বাবা কিংবা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ধর্মগুরুদের জন্য সাক্ষাৎ যমে পরিণত হন। যেখানেই তিনি উপস্থিত হতেন, সেখানেই অলৌকিকতাকে নিছক হাতের কারসাজি হিসেবে প্রমাণ করে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন অসংখ্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তির, যারা মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতেন।
ভারতে টেলিভিশনের প্রসার বাড়ার পর স্যানাল এদামারুকুর কাজটা আরো সহজ হয়ে যায়। দ্বারে দ্বারে ঘুরে না বেড়িয়ে টেলিভিশনের মাধ্যমে তিনি সহজেই পৌঁছে যেতে পারতেন লাখো মানুষের কাছে। আর এ ব্যাপারটি পছন্দ করেনি ভারতের বিভিন্ন উগ্র ধর্মীয় সংগঠনগুলো। ইন্ডিয়া টিভিতে সেই ফকিরকে চ্যালঞ্জ করে কুপোকাত করার পর এমনিতেই তার প্রতি বিরূপ ভাব বেড়ে যায়। তবে সে যাত্রা কোনোক্রমে পার পেয়ে গেলেও, ৪ বছর ঠিকই ধরাশায়ী হন উগ্রবাদের কাছে। এ ঘটনা ২০১২ সালের।
“তারা আমাকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতো এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে পাঠিয়ে দিত!”
– কারাবন্দী হওয়া সম্পর্কে স্যানাল এদামারুকু
ঘটনাটি মুম্বাইয়ের ‘আওয়ার লেডি ভেলানকান্নি’ চার্চের। সে বছর চার্চের যীশুমূর্তির পায়ের আঙ্গুল বেয়ে ক্রমাগত ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার এক অদ্ভুত ঘটনায় কথা সমগ্র মুম্বাই জুড়ে ব্যাপক চর্চা হলো। অনেকে ভাবতে লাগলেন, এটি একটি অলৌকিক ঘটনা, যদিও চার্চ কর্তৃপক্ষ সেরকম কোনো দাবি করেনি। দ্রুতই এ চার্চে ক্যাথলিক উপাসকগণ এবং অন্য কৌতূহলী মানুষজন ভিড় করতে শুরু করলেন। অনেকে পানির ফোঁটা পড়ার ঘটনাকে যীশুর কান্না বলে অভিহিত করলেন। কেউ কেউ সে পানি পান করতে শুরু করলেন বিভিন্ন মনোবাসনা পূরণের জন্য!
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, যতদিন না ব্যাপারটা স্যানাল এদামারুকুর কানে পৌঁছুলো। তাকে কেউ একজন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে এ ঘটনার ব্যাখ্যার জন্য। স্যানাল তার এক প্রকৌশলী বন্ধুকে নিয়ে চলে গেলেন সেখানে। কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই তিনি জানিয়ে দিলেন, এখানে অলৌকিকতার কিছু নেই। বরং, একটি ড্রেনের পাইপ লিক করায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে সে পানি পড়ছে! ব্যাপারটা সর্বোচ্চ কদর্য রূপ নিলো, যেদিন একটি সরাসরি টেলিভিশন টক শো-তে একদল ক্যাথলিক ধর্মযাজকের সামনে নিজের যুক্তি উপস্থাপন করলেন স্যানাল। অনুষ্ঠান চলাকালেই স্টুডিওর বাইরে ক্যাথলিক কমিউনিটির শতাধিক মানুষ জড়ো হলো লাঠিসোঁটা নিয়ে। সেদিন পুলিশি পাহারায় সেখান থেকে যেতে হয়েছে তাকে!
এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই জল অনেকদূর গড়ায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত যাজকগণ অপমান বোধ করেছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একটি অলৌকিক ব্যাপারকে ‘ভুল যুক্তি’ দিয়ে খণ্ডন করায় রাগে ফুঁসে ওঠে ক্যাথলিক কমিউনিটির একটা অংশ। অন্যদিকে আরেকটা অংশের কাছে তখন লৌকিক-অলৌকিক বড় কথা নয়, বড় কথা হলো চার্চের ব্যাপারে মন্তব্য করে সমগ্র ক্যাথলিক চার্চকেই অপমানিত করেছেন স্যানাল। এক সপ্তাহের মাথায় স্যানালের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইনের কুখ্যাত ২৯৫ ধারায় মুম্বাইয়ের তিনটি থানায় ব্লাসফেমি মামলা হয়। ১৯২৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমিত করতে ব্রিটিশরা এই কুখ্যাত আইনটি করেছিল, যার প্রয়োগ একবিংশ শতাব্দীতেও হচ্ছে!
যা-ই হোক, ব্লাসফেমি মামলার পর ঘটনার দ্রুত অবনতি হয়। স্যানাল এদামারুকুর ঘরের বাইরে যাওয়াই বিপদজনক হয়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত টেলিফোনে তাকে হুমকি দেয়া শুরু হয়। তিনি জামিনের জন্য আবেদন করেন যেন পুলিশ পর্যাপ্ত তদন্ত করার আগে তাকে গ্রেফতার করতে না পারে। কিন্তু জামিন আবেদন নাকচ হয়ে গেলে সামনে কী ঘটতে চলেছে তা অনুধাবন করতে পারেন স্যানাল। কিছুদিন পরই তার বিশেষ কাজে ইউরোপ যাবার কথা ছিল। তিনি সে কাজে আগেভাগেই দেশত্যাগ করেন। ফিনল্যান্ডে তার কয়েকজন বন্ধু ছিলেন, যারা তাকে আশ্রয় প্রদান করেন।
হেলসিংকিতে বসবাস শুরুর প্রাথমিক দিনগুলোতে স্যানাল দিনরাত কেবল একটাই কথা ভাবতেন, দেশে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলেই ফিরে যাবেন। অথচ দেখতে দেখতে ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সে পরিস্থিতির বদল ঘটেনি। ভারতের ক্যাথলিক গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘ক্যাথলিক সেক্যুলার ফোরাম’ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, স্যানাল যেদিন দেশে ফিরবেন, সেদিনই তাকে গ্রেফতার করতে হবে। দেশে ফেরার আশায় থাকতে থাকতে এখন তিনি ক্লান্ত। নিজের মেয়ে একটি সন্তান জন্ম দিয়েছে, তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। আরো হৃদয়বিদারক ব্যাপার হলো তার মায়ের মৃত্যু, যার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেয়া তার সম্ভব হয়নি। দেশে আর ফিরতে পারবেন বলে মনে করেন না তিনি, যদিও আশা তার ফুরিয়ে যায়নি এখনও।