২০০৭ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জার্মানির মিউনিখে বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলনে এক ভাষণ দেন, যা খুব বিখ্যাত হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও বাণিজ্য, সামরিক বিষয়গুলো নিয়ে বেশ কিছু সাহসী বক্তব্য রাখেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক। ইউক্রেন যুদ্ধের কিছুটা পূর্বাভাসও পাওয়া যায় তার এই বক্তব্য থেকে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য পুতিনের মিউনিখ ভাষণের লিখিত অংশটি বাংলায় রূপান্তর করা হলো।
ধন্যবাদ মাননীয় ম্যাডাম চ্যান্সেলর (অ্যাঙ্গেলা মার্কেল), জনাব তেলতচিক (জার্মান রাজনীতিবিদ), ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ!
এরকম এক সম্মেলনে একজন প্রতিনিধি হিসাবে আমন্ত্রিত হতে পেরে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ, যেখানে ৪০টিরও বেশি দেশের রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞগণ এসে জড়ো হয়েছেন।
এই সম্মেলনের কাঠামো আমাকে মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতা দেখিয়ে তির্যক মন্তব্য করা আর ফাঁপা কূটনৈতিক বক্তব্য দেওয়া পরিহার করার সুযোগ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে আমি প্রকৃত অর্থে কী ভাবি, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ দেবে এই সম্মেলনের ফরম্যাট। আমার বক্তব্য যদি অযথা বিতর্কিত মনে হয়, আমাদের সহকর্মীরা যদি মনঃক্ষুণ্ণ হন, তাহলে আমি অনুরোধ করব আপনারা আমার প্রতি রাগান্বিত হবেন না। শেষ পর্যন্ত এটা কেবল একটা সম্মেলনই। আমি আশা করব, আমার বক্তৃতা দেওয়ার প্রথম দুই বা তিন মিনিট পর, জনাব তেলতচিক ওখানের লাল বাতি জ্বালিয়ে উঠবেন না।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সামরিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার সাথে জড়িত ব্যাপারগুলোর চেয়েও বেশি কিছু, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। এর সাথে বিশ্ব অর্থনীতি, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং বিভিন্ন সভ্যতার যোগাযোগ রক্ষার মধ্যে স্থিতিশীলতাও অন্তর্ভুক্ত।
“একজনের নিরাপত্তাই সকলের নিরাপত্তা”- নিরাপত্তার সর্বজনীন ও অবিভাজনীয় বৈশিষ্ট্যকে এই মৌলিক নীতি দ্বারাই প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট যেমন বলেছিলেন, “যখন কোনো অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত হয়, তখন সব দেশের শান্তি পরিস্থিতিই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।”
এই বাণীগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। ঘটনাক্রমে আজকের সম্মেলনের বিষয়বস্তু- বৈশ্বিক সংকট, বৈশ্বিক দায়িত্ব- এর উদাহরণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
মাত্র দুই দশক আগেই বিশ্ব অর্থনৈতিক ও আদর্শগত দিক দিয়ে বিভাজিত ছিল। তখন দুই পরাশক্তিই কৌশলগত দিক দিয়ে শক্তিশালী থাকায় বৈশ্বিক নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।
দুই পরাশক্তির মাঝে একটা ভারসাম্য থাকায় গুরুতর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিশ্বের আলোচ্যসূচিতে প্রান্তের দিকে রাখলেও চলত। অন্য যেকোনো যুদ্ধের মতো স্নায়ুযুদ্ধও আমাদের হাতে সক্রিয় অস্ত্র রেখে গিয়েছে; কথাটা রূপক অর্থে বলছি। আমি বোঝাতে চাচ্ছি আদর্শগত গতানুগতিক চিন্তা, দ্বিচারিতা এবং স্নায়ুযুদ্ধ ঘরানার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিগুলো।
স্নায়ুযুদ্ধের পর যে এক মেরুর বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেটা বাস্তবায়িত হয়নি।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে অবশ্যই এক মেরুর সময় এসেছে এবং বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা দেখা গেছে। বিশ্ব ইতিহাসে কী ঘটেনি?
যা-ই হোক, এক মেরুর বিশ্ব আসলে কী? এই পরিভাষাকে যে কেউ আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। তবে দিনশেষে তা নির্দেশ করে এমন এক পরিস্থিতিকে, যেখানে এককেন্দ্রিক কর্তৃত্ব থাকে, এককেন্দ্রিক সামরিক শক্তি থাকে, এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে।
এটা এমন এক বিশ্ব, যেখানে একটা রাষ্ট্রই প্রভু, একটা রাষ্ট্রই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। দিন শেষে এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত সকলেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন নয়, সার্বভৌম রাষ্ট্রটি নিজেও ক্ষতির শিকার হয়; কারণ এই ব্যবস্থায় থেকে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করতে থাকে।
এর সাথে অবশ্যই গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায় না। কারণ, আপনারা জানেন, গুটিকয় লোকের স্বার্থ আর মতামতের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের শক্তিই গণতন্ত্র।
ঘটনাক্রমে রাশিয়াকে, মানে আমাদেরকে ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছু কারণে আমাদের যারা শেখাতে আসেন, তারা নিজেরা আবার শিখতে চান না।
আমি মনে করি, একমেরু বিশ্বের মডেল কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, আজকের দুনিয়ায় তা অসম্ভব। এর পেছনে কারণ কেবল আজকের বিশ্বের স্বতন্ত্র নেতৃত্বের উপস্থিতিই নয়। এতে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদও পর্যাপ্ত হবে না। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই মডেলটিই ত্রুটিপূর্ণ, কারণ যে ভিত্তির ওপর এই ব্যবস্থা দাঁড়ানো তা আধুনিক সভ্যতার নৈতিক ভিত্তি হতে পারে না।
এর সাথে আজকের বিশ্বে পরীক্ষামূলকভাবে এই ধারণাটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোতে স্থাপন করার চেষ্টা করছি- একমেরু বিশ্বের ধারণা- যেটা নিয়ে আমরা কেবল আলোচনা শুরু করেছি।
এর ফলাফল কী?
একতরফা এবং ঘন ঘন অবৈধ কার্যক্রম কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। বরং, তারা নতুন মানব বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নতুন বিভিন্ন সংকটের কেন্দ্র তৈরি করেছে। আপনারাই বিচার করে দেখুন- যুদ্ধ এবং স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংকটগুলো দূর হয়নি। জনাব তেলতচিক এই প্রসঙ্গটা অনেক ভদ্রভাবে উল্লেখ করেছেন। এই সংঘর্ষগুলোতে কম মানুষ প্রাণ হারায়নি; এমনকি আগেকার সময় থেকেও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি!
আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোতে প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে সামরিক শক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বিশ্ব একটা স্থায়ী সংঘর্ষের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে। ফলে এসব একটা সংকটেরও কোনো সর্বাঙ্গীন সমাধান খুঁজে পাওয়ার পর্যাপ্ত শক্তি আমাদের নেই। রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করাও অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিমালাগুলোর প্রতি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। প্রত্যেক স্বাধীন দেশের আইনগতভাবে যে অধিকারগুলো থাকার কথা, তা কেবল একটা রাষ্ট্রের কব্জাতেই চলে যাচ্ছে। এই রাষ্ট্রটা দিয়ে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের কথা বোঝাচ্ছি; তারা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেদের জাতীয় সীমানা অতিক্রম করেছে। অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষানীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ দেখলেই এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এগুলো কেউ পছন্দ করে? এসব নিয়ে কি কেউ খুশি?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংকটগুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে তথাকথিত রাজনৈতিক সুবিধার প্রসঙ্গ ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে।
এটা অবশ্যই অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে কেউই নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। আমি জোর দিয়ে বলতে বলতে চাই- কেউই নিজেকে নিরাপদ মনে করে না! কারণ, কেউই ভরসা করতে পারে না যে, আন্তর্জাতিক আইন তাকে রক্ষা করতে পারবে। এ ধরনের একটা নীতি অবশ্যই অস্ত্রের প্রতিযোগিতাকে ত্বরান্বিত করবে।
সামরিক বাহিনীর দৌরাত্ম্য কিছু দেশকে অবধারিতভাবে গণবিধ্বংসী অস্ত্র যোগাড় করতে উৎসাহ দেবে। তাছাড়া বর্তমানে উল্লেখযোগ্যভাবে নতুন নতুন হুমকির আগমন ঘটেছে, যদিও এসবের অস্তিত্ব আগেও ছিল। আজ সন্ত্রাসবাদের মতো হুমকিগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
আমি বিশ্বাস করি, আমরা এমন জায়গায় পৌঁছেছি, এখন আমাদের বিশ্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অবশ্যই গুরুতর চিন্তা করা উচিৎ।
আন্তর্জাতিক সংলাপগুলোর ক্ষেত্রে সকল পক্ষের স্বার্থে যেন যুক্তিসঙ্গত ভারসাম্য থাকে, সেটা খোঁজার জন্য আমাদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি যেখানে অনেক বৈচিত্র্যময় এবং এর খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়।
ম্যাডাম ফেডারেল চ্যান্সেলর ইতোমধ্যে বলেছেন, ভারত ও চীনের মোট জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে ব্রিক দেশগুলোর ক্ষেত্রেও; ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের জিডিপি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিকে অতিক্রম করে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই পার্থক্য সামনে আরো বাড়বে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন কেন্দ্রগুলো একসময় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অবস্থানে আসবে এবং বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। এটা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বহুপাক্ষিক কূটনীতির প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনীতিতে উন্মুক্ততা, স্বচ্ছতা এবং অনুমানযোগ্যতার নীতি উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয়। সামরিক বাহিনীর ব্যবহার হতে হবে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে। একে বিভিন্ন দেশের বিচার ব্যবস্থার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সাথে তুলনা করা যায়।
যা-ই হোক, আমরা বর্তমানে এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশে খুনিদেরও মৃত্যুদণ্ড দিতে বারণ করা হচ্ছে। বিপজ্জনক সন্ত্রাসীরা স্বাচ্ছন্দ্যে সামরিক অভিযানে অংশ নিচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া কঠিন। এতে এ ধরনের সংঘর্ষে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে।
একই সময়ে এই প্রশ্নও ওঠে যে, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট, কর্তৃত্ববাদী সরকার, স্বৈরাচারী শাসক, এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার নিয়ে আমরা উদাসীন ও নির্লিপ্ত থাকব কিনা। আমাদের প্রিয় সহকর্মী জনাব লিবারম্যানও ফ্যাডারেল চ্যান্সেলরকে এমন প্রশ্নই করেছেন। আমি যদি আপনার প্রশ্ন ঠিকভাবে বুঝে থাকি (লিবারম্যানকে উদ্দেশ্য করে), তাহলে এটা অবশ্যই একটা গুরুতর বিষয়। আমরা কি এ বিষয়ে পাত্তা নিয়ে বসে থাকব? আমিও আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব- অবশ্যই না।
কিন্তু আমাদের কি এসব হুমকি দূর করার সামর্থ্য আছে? অবশ্যই আছে। এটা প্রমাণের জন্য সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। আমাদের দেশ কি শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়নি? বস্তুত, আমরা সোভিয়েত রেজিমের একটা শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের স্বাক্ষী হয়েছি- একটা শান্তিপূর্ণ রূপান্তর! আর সোভিয়েত রেজিমটা কী শক্তিশালীই না ছিল! তাদের ছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের সমাহার, তার মাঝে পারমাণবিক অস্ত্রও ছিল! আমরা এখন কেন একটু সুযোগ পেলেই বোমা আর গুলি চালানো শুরু করে দেই? পারস্পরিক ধ্বংসের হুমকি না থাকলে কি আমাদের যথেষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি মর্যাদা আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে না?
আমি মনে করি, সামরিক বাহিনী প্রয়োগ করাকে সর্বশেষ পন্থা হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র মাধ্যম হতে পারে জাতিসংঘ সনদ। এই প্রসঙ্গে আমাদের সহকর্মী ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাত্রই যা বললেন, তা হয় আমি বুঝতে পারিনি, নয়তো তিনি ভুল বলেছেন। আমি যেটা বুঝেছি, তিনি বলতে চাইছেন সামরিক শক্তি ব্যবহার করা তখনই বৈধ হবে, যদি সিদ্ধান্তটা আসে ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বা জাতিসংঘ থেকে। তিনি যদি সত্যিই এমনটা ভেবে থাকেন, তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য আছে। অথবা, আমি বিষয়টি সঠিকভাবে ধরতে পারিনি।
সামরিক বাহিনীর ব্যবহার তখনই বৈধ বিবেচনা করা হবে, যখন তা জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হবে। জাতিসংঘের বিকল্প হিসাবে আমাদের ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে টেনে আনার প্রয়োজন নেই। জাতিসংঘ যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামরিক বাহিনীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবে এবং বিভিন্ন দেশের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় প্রকৃত অর্থেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হবে, যখন আমরা আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা দূর করতে পারব, তখনই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে। অন্যথায় পরিস্থিতি একটা কানাগলির দিকে গড়াবে, এবং গুরুতর ভুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। একইসাথে আন্তর্জাতিক আইন যেন ধারণা ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
এটা অবশ্যই কারো ভুলে গেলে চলবে না যে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কার্যক্রমসমূহ আলোচনা ও গঠনমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
প্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ!
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অস্থিতিশীলতার সম্ভাব্য বিপদের সাথে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার স্থবিরতার বিষয়টি জড়িত।
রাশিয়া এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করার বিষয়টি সমর্থন করে। অস্ত্রের ধ্বংসকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো অনুযায়ী কাজ করা জরুরি।
আমেরিকার সাথে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম, ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মাঝে আমরা একত্রে কৌশলগত পারমাণবিক মিসাইল ক্ষমতা হ্রাস করে সংখ্যাটা ১,৭০০-২,০০০ পারমাণবিক ওয়ারহেডে নিয়ে আসব। রাশিয়া তার দায়িত্ব পালনে কঠোরভাবে সংকল্পবদ্ধ। আমরা আশা করি, আমাদের অংশীদাররাও তাদের কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখবে এবং দুর্দিনের জন্য অতিরিক্ত কয়েকশ পারমাণবিক ওয়ারহেড জমিয়ে রাখা থেকে নিজেদের বিরত রাখবে। আজ যদি নতুন আমেরিকান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্র এই অতিরিক্ত অস্ত্রগুলো ওয়ারহাউজে, কিংবা বালিশ বা কম্বলের নিচে লুকিয়ে রাখবেন না, তাহলে আমি প্রস্তাব দিচ্ছি, আমরা সকলে দাঁড়িয়ে তার ঘোষণাকে অভিবাদন জানাব। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হবে।
রাশিয়া যথাযথভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি এবং মিসাইল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া মেনে চলে। এসব দলিলের অন্তর্ভুক্ত সকল নীতিমালাই সার্বজনীন।
এই প্রসঙ্গে আমি আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নিকট পাল্লা ও মধ্যম পাল্লার মিসাইল ধ্বংসের চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। কিন্তু তখনকার চুক্তির দলিলগুলো সার্বজনীন প্রযোজ্য ছিল না।
আজ অন্যান্য অনেক দেশেই এমন মিসাইল আছে; যাদের মাঝে গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া (উত্তর কোরিয়া), গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া (দক্ষিণ কোরিয়া), ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও ইসরায়েল অন্তর্ভুক্ত। অনেক দেশই এই প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে এবং তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডারে যোগ করার পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু এই ধরনের অস্ত্র উৎপাদন না করার দায়িত্বটা নেয় শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।
এসব শর্ত পূরণে আমাদের অবশ্যই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে। একইসাথে নতুন, অস্থিতিশীল, উচ্চপ্রযুক্তির অস্ত্রের আগমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা অসম্ভব। আমাদের যে নতুন যুগের মুখোমুখি সংঘর্ষ প্রতিরোধে কাজ করতে হবে তা বলাই বাহুল্য, বিশেষ করে মহাকাশে। স্টার ওয়ার্স আর ফ্যান্টাসি নয়, এটা এখন বাস্তব। আমাদের আমেরিকান সহকর্মীরা আশির দশকের মাঝামাঝি সময়েই নিজেদের স্যাটেলাইটের পথ রোধ করতে পারত।
রাশিয়ার মতে, মহাকাশে সামরিকীকরণ করা হলে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অপ্রত্যাশিত পরিণতি নিয়ে আসতে পারে, এবং এটা আরেকটা পারমাণবিক যুগের সূচনায় উসকানি দিতে পারে। মহাকাশে অস্ত্র ব্যবহার প্রতিরোধের লক্ষ্যে আমরা একাধিকবার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছি।
আজ আমি আপনাদের বলতে চাই, মহাকাশে অস্ত্রের বিস্তার রোধে একটা চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আমরা একটা প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছি। নিকট ভবিষ্যতে এটা আমাদের অংশীদারদের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা হিসাবে পাঠানো হবে। আসুন আমরা এটা নিয়ে একত্রে কাজ করি।
ইউরোপে অ্যান্টি-মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন উপকরণের বিস্তারের যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা আমাদের জন্য বিরক্তির উদ্রেক ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। এর পরবর্তী ধাপে যে অবশ্যম্ভাবী অস্ত্রের প্রতিযোগিতা আসবে তা আসলে কে চায়? আমার মনে গভীর সংশয়, খোদ ইউরোপীয়রাই তা চায় কিনা।
ইউরোপের জন্য প্রকৃত অর্থে হুমকি সৃষ্টি করে এমন পাঁচ থেকে আট হাজার কিলোমিটার পাল্লার মিসাইল অস্ত্র তথাকথিত সমস্যা সৃষ্টিকারী কোনো দেশেই নেই। নিকট ভবিষ্যতে এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এমনকি এরকম কোনো পূর্বাভাসও দেখা যাচ্ছে না। তাত্ত্বিকভাবে উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, একটা উত্তর কোরীয় রকেট পশ্চিম ইউরোপ পার হয়ে আমেরিকান অঞ্চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে তা স্পষ্টত ক্ষেপণাস্ত্র আইনের পরিপন্থী ঘটনা হবে। রাশিয়াতে আমরা যা বলি, এটা হবে ডান হাত দিয়ে বাম কান ধরার মতো।
আজ জার্মানিতে আমি ইউরোপের প্রচলিত সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত চুক্তির দুঃখজনক অবস্থা নিয়ে কথা না বলে পারছি না।
ইউরোপের প্রচলিত সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৯ সালে। এতে নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনা করা হয়, যেখানে ওয়ারশ জোটকে নির্মূল করা হয়। সাত বছর পেরিয়ে গেছে, মাত্র চারটি রাষ্ট্র ওই দলিলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে, যাদের মাঝে রুশ ফেডারেশনও আছে।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা এই চুক্তি অনুমোদন করবে না। তারা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নির্দিষ্ট সংখ্যক সশস্ত্র বাহিনী মোতায়ন করার বিষয়টিও সীমিত করতে রাজি নয়, যদি না জর্জিয়া ও মলদোভা থেকে রাশিয়া তার সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে আনে। আমাদের সেনাবাহিনী জর্জিয়া ত্যাগ করছে, এমনকি তা নির্ধারিত সময়ের আগেই। আমরা আমাদের জর্জিয়ার সহকর্মীদের সাথে সব মীমাংসা করে নিয়েছি, তা সকলেই জানে। মলদোভায় এখনো ১,৫০০ সেনা আছে শান্তিরক্ষা অভিযান পরিচালনা করার জন্য এবং সোভিয়েত আমলে ফেলে আসা অস্ত্রভর্তি ওয়ারহাউজগুলো সুরক্ষা করার জন্য। আমরা এই বিষয়ে জনাব সোলানার সাথে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করে আসছি, তিনি আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানেন। আমরা এই বিষয়ে আরো কাজ করতে প্রস্তুত।
কিন্তু একইসাথে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? তথাকথিত ফ্লেক্সিবল ফ্রন্টলাইন আমেরিকান ঘাঁটিগুলোর প্রতিটিতে প্রায় পাঁচ হাজার করে সেনা আছে। দেখা যাচ্ছে ন্যাটো তাদের ফ্রন্টলাইন বাহিনীগুলোকে আমাদের সীমানার কাছে নিয়ে আসছে, আর আমরা চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণ করছি এবং কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছি না।
আমি মনে করি, ন্যাটোর সম্প্রসারণের সাথে তাদের জোটের আধুনিকায়ন কিংবা ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং, এটা একটা গুরুতর উসকানি সৃষ্টি করে, যা পারস্পরিক আস্থার জায়গা নষ্ট করে দেয়। আমাদের এই প্রশ্নটা তোলারও অধিকার আছে- কাদের বিরুদ্ধে এই সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে? আর ওয়ারশ প্যাক্ট বিলুপ্ত করার পর আমাদের পশ্চিমা সহকর্মীরা যে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল, তার কী হলো? সেই ঘোষণাগুলো আজ কোথায়? এমনকি কেউ এসব মনেও করতে পারে না। কিন্তু আমি এই দর্শকদের মনে করিয়ে দিতে চাই সেখানে কী বলা হয়েছিল। আমি ১৭ মে ১৯৯০ সালে ব্রাসেলসে ন্যাটো মহাসচিব জনাব ওয়েরনারের বক্তৃতার অংশ পড়ে শোনাচ্ছি। তিনি ওই সময় বলেছিলেন, “আমরা ন্যাটো বাহিনীকে জার্মানির বাইরে স্থানান্তরিত করছি না, যা সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটা সুষ্ঠু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়।” কোথায় গেল সেই নিশ্চয়তাগুলো?
বার্লিন দেওয়ালের পাথর আর কংক্রিটগুলো স্যুভেনির হিসাবে সাজানো হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, বার্লিন দেওয়ালের পতন সম্ভব হয়েছিল এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের কারণে, যার পেছনে আমাদের রাশিয়ার জনগণেরও অবদান ছিল। সেটা এমন সিদ্ধান্ত ছিল যা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, উন্মুক্ততা, এবং বৃহত্তর ইউরোপীয় পরিবারের সকল সদস্যের সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্কের পক্ষে ছিল।
এখন তারা আমাদের ওপর নতুন করে বিভিন্ন দেওয়াল গড়ে তুলছে। এই দেওয়ালগুলো দৃশ্যমান না হলেও তা আমাদের মহাদেশ জুড়ে বিভেদ সৃষ্টি করছে। এই নতুন দেওয়ালগুলো ভেঙে ফেলার জন্য কয়েক দশক ধরে অপেক্ষা করা আর কয়েক প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কাজ করা কি এখন সম্ভব?
প্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ!
আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে অস্ত্র বিস্তাররোধের পক্ষে আছি। বর্তমান আন্তর্জাতিক আইনি নীতিমালা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের জন্য আমাদেরকে প্রযুক্তি উন্নয়নের অনুমতি দেয়। অনেক দেশই জ্বালানি ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য সৎ উদ্দেশ্য থেকেই নিজেদের পারমাণবিক জ্বালানি কেন্দ্র তৈরি করতে চায়। কিন্তু আমাদের এটাও মাথায় রাখতে রাখতে হবে, এই প্রযুক্তিগুলো দ্রুতই পারমাণবিক অস্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে।
এতে গুরুতর আন্তর্জাতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ইরানি পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে যে পরিস্থিতি চলছে, তা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এই স্বার্থের সংঘাত মেটানোর জন্য যুক্তিসঙ্গত সমাধান না বের করে, তাহলে বিশ্বকে এরকম অস্থিতিশীল সংকট ভোগ করে যেতে হবে, কারণ ইরান ছাড়াও আরো অনেক দেশ প্রান্তিক পর্যায়ে আছে। আমরা উভয় দেশই এই বিষয়ে অবগত। গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তারের হুমকির বিরুদ্ধে আমাদের সার্বক্ষণিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য আন্তর্জাতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গত বছর রাশিয়া একটা প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছিল। আমরা এই আন্তর্জাতিক কেন্দ্র শুধু রাশিয়াতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না; বরং, বেসামরিক পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের আইনি ভিত্তি অনুযায়ী অন্যান্য দেশগুলোতেও এই কেন্দ্র থাকতে পারে। যে দেশগুলো পারমাণবিক জ্বালানিনির্ভর হতে চায়, তারা এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে জ্বালানি নিতে পারবে। এই কেন্দ্রগুলো অবশ্যই আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার কঠোর তত্ত্বাবধানে থাকবে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কর্তৃক সর্বশেষ যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, তা রুশ প্রস্তাবনার মানদণ্ড অনুসরণ করে। আমি মনে করি, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তাররোধ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্যগত দিক দিয়ে সমানভাবে আগ্রহী। নতুন কঠোরতর বিস্তাররোধী উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমরা যে দুই দেশ পারমাণবিক ও মিসাইল সক্ষমতায় এগিয়ে আছি, তাদেরকে অবশ্যই নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। রাশিয়া এই উদ্যোগের জন্য প্রস্তুত। আমরা আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করি।
সাধারণভাবে, আমাদের একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রণোদনার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা দরকার, যেখানে নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতার বিষয়টি রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে না, কিন্তু তাদের তখনো পারমাণবিক জ্বালানি উন্নয়ন ও জ্বালানি সক্ষমতা মজবুত করার সুযোগ থাকবে।
এই প্রসঙ্গে আমি আন্তর্জাতিক জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলব। মাননীয় ফেডারেল চ্যান্সেলরও এই বিষয়ে বক্তব্য রেখে গিয়েছেন। জ্বালানি খাতে রাশিয়া সকলের জন্য একই বাজার নীতিমালা এবং স্বচ্ছ চুক্তির ব্যবস্থা করতে চায়। জ্বালানি মূল্য অবশ্যই বাজারের দ্বারা নির্ধারিত হবে; সেখানে রাজনৈতিক জল্পনা, অর্থনৈতিক চাপ, কিংবা ব্ল্যাকমেইলের অস্তিত্ব থাকবে না।
সহযোগিতার জন্য আমাদের দ্বার উন্মুক্ত। আমাদের সকল বৃহৎ জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলো অংশ নেয়। বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার প্রায় ২৬ শতাংশ তেল উত্তোলন হয় বিদেশি বিনিয়োগে; দয়া করে সংখ্যাটা মাথায় রাখুন- প্রায় ২৬ শতাংশ তেল উত্তোলনের কাজে বিদেশি বিনিয়োগ জড়িত। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোতে রাশিয়ার ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব এতটা আছে কিনা আমাকে খুঁজে দেখানোর চেষ্টা করুন। এমন উদাহরণের কোনো অস্তিত্বই নেই! এমন দৃষ্টান্ত আর নেই।
রাশিয়াতে বিদেশি বিনিয়োগ আর বিদেশে রাশিয়ার আয়ের অনুপাতটাও আমি মনে করিয়ে দিতে চাই। অনুপাতটা প্রায় ১৫:১। রুশ অর্থনীতি কতটা উন্মুক্ত আর স্থিতিশীল, এটাই তার প্রমাণ।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমাদের সকলকে অবশ্যই অভিন্ন নীতিমালায় আসা উচিত। আমরা ন্যায্যভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত আছি।
এই কারণে রুশ অর্থনীতিতে উত্তরোত্তর সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এবং আমাদের পশ্চিমা সহকর্মীরা বস্তুনিষ্ঠভাবে এই পরিবর্তনগুলো মূল্যায়ন করছেন। রাশিয়ার ওইসিডি সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিংয়ে উন্নতি হয়েছে; রাশিয়া চতুর্থ গ্রুপ থেকে তৃতীয় গ্রুপে উন্নীত হয়েছে। আজ মিউনিখে এই অনুষ্ঠানে আমাদের জার্মান সহকর্মীদের ধন্যবাদ দিতে চাই উপরোক্ত সিদ্ধান্তে তাদের সাহায্য করার জন্য।
অধিকন্তু, আপনারা জানেন রাশিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে চলা কঠিন আলোচনার একটা বিষয় সম্পর্কে আমি বলতে চাই, যেখানে আমরা বাক-স্বাধীনতা, মুক্ত বাণিজ্য, এবং সমান সম্ভাবনার কথা একাধিকবার শুনেছি; কোনো কারণে সেগুলো নির্দিষ্টভাবে রুশ বাজারকে উল্লেখ করে বলা হয়েছে।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। আজ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আসলে হচ্ছেটা কী? একদিকে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর প্রকল্পের জন্য আর্থিক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এবং যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এর সাথে কিছু দাতা দেশের কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত, যা এখানের অনেকেই জানেন। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো একইসাথে তাদের কৃষিখাতে ভর্তুকি দিচ্ছে এবং উচ্চপ্রযুক্তির পণ্য থেকে কিছু দেশকে বঞ্চিত করছে।
আসুন পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা যেমন, তেমনটাই বলি- এক হাত দিয়ে তারা দাতব্য সাহায্য করছে এবং অন্য হাত দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর অবস্থাই ধরে রাখছে না, সেখান থেকে মুনাফাও তুলে আনছে। আর্থিক দিক দিয়ে অনগ্রসর অঞ্চলগুলোতে ক্রমবর্ধমান সামাজিক চাপা উত্তেজনার কারণে চরমপন্থী কার্যক্রম, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, এবং স্থানীয় সংঘাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এটা যদি মধ্যপ্রাচ্যের মতো কোনো অঞ্চলে হয়, তাহলে সেখানে ধারণা জন্মাবে বিশ্ব বৃহত্তরভাবে অন্যায্য আচরণ করছে। তখন বৈশ্বিক অস্থিরতার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর যে এই হুমকির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তাদের উচিত বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্পর্কের আরো গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য কাঠামো গঠন করা, যেখানে সকলের সুযোগ থাকবে এবং উন্নতি করার সম্ভাবনা থাকবে।
প্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, নিরাপত্তা নীতিনির্ধারণী সম্মেলনে ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার (ওএসসিই/অস্কি) কার্যক্রম নিয়ে কথা না বললেই নয়। সুপরিচিত এই সংস্থা গঠন করা হয়েছিল নিরাপত্তার সকল ক্ষেত্র নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য; আমি এখানে জোর দিয়ে বলতে চাই নিরাপত্তার সকল ক্ষেত্রের জন্য। সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক, এবং বিশেষ করে এই ক্ষেত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক পরীক্ষা করার কাজ অস্কির।
আমরা আজ কী দেখছি? আমরা দেখছি এখানে স্পষ্টভাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু লোক অস্কিকে একটা নোংরা অস্ত্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে, একটা নির্দিষ্ট দেশ বা জোটবদ্ধ কয়েকটা দেশের বৈদিশিক নীতিনির্ধারণীর স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে। আর এই কাজের জন্য অস্কির আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মোটেও প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রদের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কথা নয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং তথাকথিত এনজিওর অন্তর্ভুক্তি এই কার্যক্রমের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন, কিন্তু তাদেরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অর্থায়ন করে নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠাকালীন নথি অনুযায়ী, মানবিক বিষয়ের ক্ষেত্রে অস্কিকে গঠন করা হয়েছে সদস্য দেশগুলোর অনুরোধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান পর্যবেক্ষণে তাদের সাহায্য করার জন্য। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আমরা এটা সমর্থন করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, একে অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হবে; বিশেষ করে এই রাষ্ট্রগুলো কীভাবে জীবনধারণ করবে আর উন্নতি করবে, তার জন্য বেধে দেওয়া নিয়ম আরোপ করা উচিত নয়।
এরকম হস্তক্ষেপ কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করে না। বরং, এতে তাদেরকে আরো নির্ভরশীল করে তোলা হয়; ফলে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
আমরা আশা করি অস্কি তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করবে এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্মান, বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
প্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ!
আমি এই কথাগুলো বলে শেষ করতে চাই। আমরা প্রায়ই আমাদের সহকর্মীদের আর্জি শুনে থাকি, রাশিয়ার উচিৎ বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ বাড়ানো, তাদের মাঝে আমাদের ইউরোপীয় সহকর্মীরাও আছেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রায়ই এটা শুনতে হয়।
এই প্রসঙ্গে আমি ছোট একটা বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদেরকে এর জন্য উদ্দীপিত করার খুব একটা প্রয়োজন নেই। রাশিয়া এমন একটা দেশ, যার এক হাজার বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস আছে। রাশিয়া সবসময়ই একটা স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসেছে।
আমরা বর্তমান সময়ে এই ঐতিহ্য পরিবর্তন করতে চাই না। একইসাথে বিশ্ব কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা সম্পর্কে আমরা সম্যক ধারণা রাখি। নিজেদের সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের বাস্তবসম্মত ধারণা আছে। আমরা অবশ্যই দায়িত্ববান ও আত্মনির্ভরশীল অংশীদারদের সাথে কাজ করতে চাই, যাদের নিয়ে আমরা একটা ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব- যেখানে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি কেবল গুটিকয়েক রাষ্ট্রের জন্যই হবে না, বরং সকলের জন্য নিশ্চিত করা হবে।
ধন্যবাদ আপনাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য।