৩রা মে, ২০০৭; পর্তুগালের এক অবকাশযাপন কেন্দ্র প্রেইয়া ডা লুয। জেরি আর কেটি ম্যাককান দম্পতি রাতের খাবার খেতে বসেছেন এক রেস্টুরেন্টে। মাত্র ২০০ গজ দূরে তাদের অবকাশকালীন অ্যাপার্টমেন্ট, রেস্টুরেন্টের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে। বড় মেয়ে তিন বছরের ম্যাডেলিন আর তার এক বছরের ছোট যমজ দুই ভাই-বোনকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছেন তারা, রেস্টুরেন্ট খুব কাছে হওয়ায় সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নন।
রাত দশটার দিকে ঘরে ফিরলেন ম্যাককানরা। তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সম্ভবত যেকোনো বাবা-মায়ের জন্য অন্যতম ভীতিকর এক দৃশ্য। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে দুই বছরের যমজ সন্তানেরা। কিন্তু দেখা নেই ম্যাডেলিনের! ঘরের জানালা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে।
অনতিবিলম্বে পর্তুগিজ পুলিশকে ফোন করা হলো। তারা তল্লাট চষে বেড়াতে লাগল ম্যাডেলিনের খোঁজে। ইংল্যান্ডে ম্যাককানদের আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল হাহাকার। মেয়ের দাদা ব্রায়ান হিলি লিভারপুল থেকে সাক্ষাৎকারে তাদের উৎকণ্ঠার কথা জানালেন।
এই ঘটনার পর পার হয়ে গেছে এক দশকেরও বেশি সময়। আজও নিখোঁজ ম্যাডেলিন। এমনকি কীভাবে ঘর থেকে উধাও হয়ে গেল সে তারও কোনো কূলকিনারা এখন অবধি করতে পারেনি পুলিশ। বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এলেও আসলে কী হয়েছিল তা আজও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
ম্যাডেলিন ম্যাককান
জেরি আর কেট ম্যাককান দুজনেই চিকিৎসক, থাকেন ইংল্যান্ডের লিস্টারশায়ারের রথলি গ্রামে। তাদের তিন বছরের মিষ্টি মেয়ে ম্যাডেলিন। প্রতিবেশী পেনি নোবল জানান, ম্যাককানরা অত্যন্ত চমৎকার একটি পরিবার এবং অসাধারণ প্রতিবেশী। সন্তানদের নিয়ে প্রায়ই গ্রামের রাস্তায় সাইকেল চালাতে বের হতো তারা। তাদের বড় মেয়েটি উড়ে বেড়াত প্রজাপতির মতো। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুল শুরুর কথা ছিল তার, কিন্তু তার আগেই পরিবারটিকে ঘিরে ধরল দুর্ভাগ্যের চাদর।
সেই বছর মে মাসে ম্যাককানরা সপরিবারে ছুটি কাটাতে উড়াল দেন পর্তুগালে। সঙ্গী ছিল আরও তিনটি ব্রিটিশ পরিবার। থাকার জন্য তারা বেছে নেন সেদেশের পশ্চিম আলগ্রেভ অঞ্চলের জনপ্রিয় এক অবকাশ কেন্দ্র প্রেইয়া ডা লুযে। মাছ ব্যবসায়ীদের বসবাসের জন্য পরিচিত এই এলাকা, সাগরের ঠিক পাশেই এর অবস্থান। ম্যাককানরা মার্ক ওয়ার্নার হোটেলের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। নিচতলার এই ঘর থেকেই ৩রা মে নিখোঁজ হয় তাদের মেয়ে ম্যাডেলিন।
পুলিশি তৎপরতা
অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে পুলিশ প্রথমেই যেটা খেয়াল করেছিল তা হলো ঘরে জোরপূর্বক প্রবেশের কোনো লক্ষণ নেই। ধস্তাধস্তি বা অন্য কোনো চিহ্নও নেই যা দেখে হয়তো কী হয়েছে ধারণা করা যেতে পারত।
ম্যাককানরা পুলিশকে জানালেন- তারা রাত আটটার বাচ্চাদের ঘরে রেখে দিকে বের হয়েছিলেন। নয়টার সময় একবার ঘরে ফিরে সবকিছু ঠিক আছে দেখতে পান। এরপর তারা চলে যান পাশের রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে। কিছুক্ষণ পর পরই তারা জানালা দিয়ে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে খেয়াল করছিলেন। ঘুণাক্ষরেও এই দম্পতি বুঝতে পারেননি যে, এত কাছাকাছি থাকার পরেও এমন কিছু হতে পারে।
কুকুর ব্যবহার করে পুলিশ অভিযান আরম্ভ করে। পুরো হোটেল আর গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজল তারা। গোয়েন্দারা অন্য অতিথিদের সাথেও কথা বলেন।কেউই কোনো সূত্র দিতে পারল না।
হোটেলের মুখপাত্র দ্রুত নিজেদের সুনাম রক্ষা করতে সচেষ্ট হন। আকারে-ইঙ্গিতে দোষ চাপান ম্যাককানদের ঘাড়েই। জানান যে, তারা অতিথিদের জন্য রাত সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বেবি সিটিং সার্ভিস দিয়ে থাকেন, যাতে তারা বাইরে গেলে সন্তানদের সেখানে রেখে যেতে পারেন। ম্যাককানরা কেন সেই সার্ভিস নেননি সেটা তার অজানা বলে উল্লেখ করেন এই মুখপাত্র।
জিল রেনউইক নামে ম্যাককানদের এক পারিবারিক বন্ধু পরে জানান যে, প্রথম থেকেই ম্যাককানরা মেয়ে অপহৃত হয়েছে বলে সন্দেহ করেন, যদিও পুলিশ প্রমাণ না পেয়ে তেমন কিছু বলতে রাজি ছিল না। ম্যাককানরা পর্তুগিজ পুলিশের কাজে খুশি নন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। রেনউইক বলেন, ফোনে কথা বলার সময় ম্যাককানরা তার কাছে অেভিযোগ করে যে পুলিশ তাদের অভিযান শুরু করেছে ঢিমেতালে। সময়মতো পদক্ষেপ নিতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।
তবে রেনউইকের দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করেন পুলিশের তৎকালীন প্রধান হিল। তার মতে, পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। ভোর সাড়ে চারটা অবধি হোটেলের কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে পুরো এলাকা খুঁজেছে তারা, একইসময় সতর্ক করেছে সীমান্তরক্ষীদের। প্রতিবেশী স্প্যানিশ পুলিশ আর বিমানবন্দরগুলোর কাছেও পাঠানো হয়েছে বার্তা।
হিল আরও জানান, অন্তত ২০ জন অফিসারকে তিনি ম্যাডিলনের কেসে দায়িত্ব দিয়েছেন, তবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি স্বীকার করেন যে, ম্যাডেলিনের মা-বাবার জায়গায় হলে মেয়েকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টাও যথেষ্ট মনে হতো না।
কয়েকজন সন্দেহভাজন
৩৩ বছর বয়স্ক রবার্ট মুরাত ছিলেন পর্তুগিজ পুলিশের প্রথম সন্দেহভাজন। এই ব্রিটিশ-পর্তুগিজ নাগরিক থাকতেন ম্যাককানদের অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই। রাত সোয়া নয়টার সেখান থেকে একজনকে একটি বাচ্চা নিয়ে তার বাসার দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায় বলে পুলিশের কাছে তথ্য ছিল। সমস্যা হলো- ম্যাডেলিন ঠিক কোন সময় উধাও হয়ে যায় তা জানা ছিল না। যে বাচ্চার কথা বলে হচ্ছে সে ম্যাডেলিন কিনা তারও কোনো প্রমাণ নেই। মুরাত যে ঘটনায় জড়িত সেরকম আর কোনো তথ্যই পুলিশ উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। ফলে ২০০৮ সালে তার নাম তালিকা থেকে কেটে দেয় গোয়েন্দারা।
তবে এই সময়টা মুরাতকে যেতে হয়েছিল দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে। মিডিয়া ট্রায়ালে তিনি অপরাধী বনে যান। আইন যখন তার নির্দোষিতা প্রত্যয়ন করে, তখন তিনি পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে দেন। রায় হয় তার পক্ষেই, ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি পান অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ড।
পুলিশের সন্দেহভাজন তালিকায় ম্যাডেলিনের মা-বাবাও ছিলেন। অন্তর্ধানের চার মাস পর থেকে তারা তাদের ব্যাপারে তদন্ত আরম্ভ করে। গোয়েন্দারা ধারণা করেন যে, এমন হতে পারে ম্যাডেলিনকে ঘুম পাড়াতে সেই রাতে তার বাবা-মা ওষুধ দিয়েছিলেন। মাত্রা বেশি হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনাবশত মেয়েটির মৃত্যু হয়। আতঙ্কিত ম্যাককানরা মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে অপহরণের নাটক সাজান।
পর্তুগিজ পুলিশের অনুরোধে ব্রিটিশ পুলিশ বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুটি কুকুর পাঠায়। এরা মৃতদেহের গন্ধ, রক্ত ইত্যাদি খুঁজে বের করতে পারদর্শী। এদের নিয়ে ম্যাককানদের অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান চালায় পুলিশ। ম্যাডেলিন হারিয়ে যাবার ২৪ দিন পর জেরি আর কেট একটি গাড়ি ভাড়া করেন, সেটাও কুকুর দিয়ে শোঁকানো হয়। কোনো কোনো গোয়েন্দা মনে করেছিলেন- এই গাড়ি ব্যবহার করে পরে ম্যাডেলিনের মৃতদেহ সরানো হয়েছিল।
কুকুর দুটি অ্যাপার্টমেন্ট আর গাড়িতে সন্দেহজনক কিছু থাকার দিকে ইশারা দেয়। সেখান থেকে পাওয়া চুল আর ফাইবার ল্যাবে পরীক্ষা করে ম্যাডেলিনের ডিএনএ-র সাথে মিল পাওয়া যায়। তবে আইনের চোখে তা যথেষ্ট ছিল না। কুকুরের আচরণ থেকে পাওয়া কোনো তথ্য আদালত খুব সতর্কভাবে যাচাই করে, যেহেতু অনেকক্ষেত্রেই এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ডিএনএ-র ব্যাপারেও সন্দেহ থেকে যায়। ইংল্যান্ডের ফরেনসিক সার্ভিসের কর্মকর্তা জন লোয়ের মতে, গাড়ির মধ্যে পাওয়া ডিএনএ যে ম্যাডেলিনেরই তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। ফলে মুরাতের সাথে তাদেরকেও তদন্ত থেকে বাদ দেয় গোয়েন্দারা।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ম্যাককানরা আবার পর্তুগালে ফিরে যান, প্রকাশ্যে জনতার কাছে আহ্বান জানান ম্যাডেলিনের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহায়তার জন্য। এ সময় রেমন্ড হিউলেট নামে এক ব্যক্তির নাম উঠে আসে। শিশু নির্যাতনকারী হিসেবে তার নাম পুলিশের নথিভুক্ত ছিল, এবং ম্যাডেলিনের ঘটনার সময় সেই অঞ্চলে ছিল এই ব্যক্তি। তবে অন্তর্ধানের সময় সে ভিন্ন স্থানে ছিল বলে প্রমাণিত হয়। জেরি আর কেট প্রাইভেট ডিটেকটিভও ভাড়া করেন। তারা কিছু সূত্র নিয়ে কাজ করলেও শেষপর্যন্ত কোনো ফলাফল আসেনি।
এর মধ্যেই হস্তক্ষেপ করেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। মেট্রোপলিটান পুলিশ পর্তুগালের সহযোগীদের সাথে তখনই কাজ করছিল, ম্যাডেলিনকে খুঁজে বের করতে তাদের অভিযান ‘অপারেশন গ্র্যাঞ্জ’ আজও চলমান। ক্যামেরন আলাদা করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে অনুরোধ করেন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। ২০১১ সালে আলাদা তদন্ত চালু করে তারা।
অন্তর্ধান বিষয়ক নানা তত্ত্ব
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন ডালপালা মেলছে গুজব। নানা থিওরি ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে। একটি হলো- কোনো চোর অ্যাপার্টমেন্টে চুরি করতে ঢুকেছিল, এ সময় ম্যাডেলিন জেগে গেলে ধরা পড়ার ভয়ে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এরকম হলে অকুস্থলে কিছু না কিছু চিহ্ন থাকার কথা, যা ছিল না।
ম্যাডেলিন যখন হারিয়ে যায়, তখন অ্যালগ্রেভের পুলিশের কাছে সেখানকার ৩৮ জন শিশু নির্যাতনকারীর নাম ছিল। ধারণা করা হয়, এদের কেউ হয়তো এই অঘটন ঘটিয়েছে। তবে এরকম লোকদের কাজের ধারার সাথে ম্যাডেলিনের ঘটনার মিল পাননি গোয়েন্দারা, উপযুক্ত কোনো সন্দেহভাজনও পাওয়া যায়নি।
কেউ কেউ দাবি করেন- ম্যাডেলিন ঘুম থেকে উঠে বাইরে চলে এসেছিল, তখন কোনো গাড়ি তাকে আঘাত করে। গাড়িচালক এরপর অপরাধ ঢাকতে লাশ লুকিয়ে ফেলে। তবে ম্যাডেলিনের পরিবারের মতে, বন্ধ দরজা-জানালা খোলার শক্তি ম্যাডেলিনের ছিল না। তাছাড়া এই তত্ত্বে অনেক ত্রুটি থাকায় পুলিশের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
খুব প্রচলিত একটি মতবাদ ছিল- শিশু পাচারকারী চক্রের শিকার হয়েছে ম্যাডেলিন। অনেক মানুষ ইউরোপ আর আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে তার মতো শিশুকে দেখতে পাবার কথা জানায়, যদিও সব ভুল প্রমাণিত হয়। ২০০৮ সালে বেলজিয়ামকেন্দ্রিক একটি চক্র ম্যাডেলিনকে অপহরণের সাথে জড়িত- এমন ধারণা নিয়ে তদন্ত করে পুলিশ। ফলাফল সেই শূন্য।
তবে তারপরেও শিশু পাচারের থিওরি বন্ধ হয়নি। গুজব রটে যে ম্যাডেলিনকে হোটেলের কাছাকাছি এক বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় (Lagos Marina), সেখান থেকে নৌকায় পরবর্তী গন্তব্য হয় মরক্কো। সেদেশের বেশ কিছু লোক ম্যাডেলিনকে দেখেছে বলেও জানায়। ম্যাককানরা এতটাই প্রভাবিত হন যে তারা সোজা মরক্কো চলে যান, তবে সন্তানের খোঁজ পেতে ব্যর্থ হন তারা।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ম্যাককানরা ম্যাডেলিনের অন্তর্ধান রহস্য সমাধানে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। মেয়ের ইস্যুকে কখনও হারিয়ে যেতে দেননি তারা। বারবার জনগণের কাছে আবেদন করেছেন তথ্যের জন্য, বিভিন্ন মিডিয়াতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। চাপ অব্যাহত রেখেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর।
তদন্তে নতুন মোড়
ম্যাডেলিনের ঘটনা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার পেয়েছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশের পুলিশের কাছেও বার্তা দেয়া ছিলো, যাতে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া গেলে সাথে সাথেই তদন্ত করা হয়। ২০২০ সালের ৪ঠা জুন এর সুফল মেলে। জার্মান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়- ম্যাডেলিনের অন্তর্ধান বিষয়ে ক্রিশ্চিয়ান ব্রাকনার নামে এক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে খোঁজখবর করছে তারা।
কে এই ব্রাকনার? ৪৩ বছর বয়স্ক এই লোক দাগি অপরাধী। জার্মানির কিয়েলে ২১ ড্রাগ চোরাচালানের দায়ে ২১ মাসের জেল খাটছিলেন তিনি।ধর্ষণের অভিযোগে এর সাথে যুক্ত হয় আট বছরের কারাদণ্ড। ১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ব্রাকনার আলগ্রেভে বসবাস করতেন। স্থানীয়ভাবে শিশু নির্যাতন, চুরিসহ আরো নানা অভিযোগে মাঝে মাঝেই গ্রেফতার হতেন তিনি। যেদিন ম্যাডেলিন হারিয়ে যায় সেদিন ব্রাকনার আর তার বান্ধবীর ফোনালাপ উদ্ধার করে পুলিশ। সেখানে ব্রাকনার বান্ধবীকে বলেন যে, শীঘ্রই খুব ভয়ানক একটি কাজ করতে যাচ্ছেন তিনি। এই ঘটনা নাকি ম্যাডেলিন উধাও হবার মাত্র ঘন্টাখানেক আগের।
জার্মানরা তাদের পর্তুগিজ আর ব্রিটিশ সহযোগীদের সাথে বার্তা বিনিময় করে। ২০২২ সালের ৩রা মে ম্যাডেলিনের অন্তর্ধানের ১৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। পর্তুগালের আইনানুযায়ী এরপর কাউকে আর তার অপহরণের অভিযোগে দোষী করা যাবে না। ফলে তাদের অনুরোধে জার্মান পুলিশ ম্যাডেলিনকে জড়িয়ে ব্রাকনারের নাম প্রকাশ করে। পর্তুগিজরাও তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ কিন্তু এখনো গঠন করা হয়নি।
কিন্তু এতদিন পরে ব্রাকনারের বিরুদ্ধে কি শক্ত কোনো কেস দাঁড়া করানো যাবে? আসামী স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আবার, ম্যাডেলিনের কোনো চিহ্ন না পাওয়াতে পুলিশ যাকে বলে মোক্ষম প্রমাণ, সেরকম কিছু তাদের হাতে নেই। সেক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে পারিপার্শ্বিকতার উপর। কিন্তু এর উপর ভিত্তি করে কি ম্যাডেলিন রহস্য সমাধান হবে?
জার্মান সরকারি উকিল ক্রিশ্চিয়ান উল্টার মনে করেন, হবে। ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য মিররে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ম্যাডেলিন নিঃসন্দেহে মৃত বলে মত প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছেন যে, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (Circumstantial Evidence) ব্রাকনারের বেলায় যথেষ্ট শক্ত। তবে তারা তদন্ত অব্যাহত রাখবেন, আদালতে যখন ব্রাকনারকে ম্যাডেলিনকে অপহরণ আর খুনের দায়ে দাঁড়া করানো হবে, তখন নিশ্চিত হয়েই তারা তা করবেন। আগামী বছর নাগাদ এর একটা সুরাহা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জিম গ্যাম্বল, যিনি অতীতে এই তদন্তের সাথে যুক্ত ছিলেন, তিনিও উল্টারের সাথে একমত। বিবিসি রেডিও ফোরকে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ব্রাকনারের ফোনালাপ তাকে শুধু অকুস্থলে প্রতিষ্ঠিত করেনি, বরং অনেকটা স্বীকারোক্তির মতো কাজ করেছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত কিন্তু ব্রাকনারকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। এটাও মাথায় রাখতে হবে- যত যা-ই হোক না কেন, ম্যাডেলিনের দেহ না পেলে আসলে সত্যিকারার্থে এই রহস্যের সমাধান করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
ম্যাডেলিনের ঘটনা নিয়ে এর মধ্যেই মিডিয়াতে বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। তন্মধ্যে নেটফ্লিক্সের ‘দ্য ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স অভ ম্যাডেলিন ম্যাককান‘ উল্লেখযোগ্য। তবে জেরি আর কেট ম্যাককান ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে বলে এর বেশ সমালোচনা করেছেন।
ম্যাককান দম্পতি একই কারণে মামলা করেছিলেন ডিটেকটিভ গণকালো আমারালের নামে। পর্তুগিজ এই অফিসার প্রাথমিকভাবে ম্যাডেলিনের তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন। ব্রাকনারের বিষয় পত্রপত্রিকায় আসার পর পর্তুগালের টিভিতে হাজির হয়ে তাকে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। প্রথম থেকেই ম্যাককান দম্পতি আমারালের বিরুদ্ধে তদন্তে অবহেলার অভিযোগ তুলে আসছিলেন। তিনি ম্যাডেলিনকে নিয়ে বই লেখায় তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। এই মামলা অবশ্য আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।
বলা হয়, নিখোঁজ মানুষদের মধ্যে ম্যাডেলিন ম্যাককানের মতো এত প্রচার আর কেউ পায়নি। এই মে মাসে তার বয়স হতো উনিশ। তাকে ফিরে পাবার আশা যদিও জেরি আর কেট করেন না, তবে তারা অন্তত এটুকু জানতে চান যে মেয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছিল। এই প্রশ্নের উত্তর যেদিন মিলবে, সেদিন হয়তো কিছুটা শান্তি পাবেন তারা।