আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি: কে কী পেলো?

২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তুরস্কের সক্রিয় সমর্থনে আজারবাইজান আর্মেনীয়–কর্তৃত্বাধীন আর্তসাখের ওপর আক্রমণ চালায়, এবং এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধ আরম্ভ হয়। যুদ্ধ চলাকালে আজারবাইজানি সৈন্যরা আর্মেনীয়/আর্তসাখ সৈন্যদের পরাজিত করে আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে নেয়। আজারবাইজানি সরকার এই যুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধ’ (আজারবাইজানি: İkinci Qarabağ müharibəsi, ‘ইকিঞ্জি কারাবাগ মুহারিবাসি’), ‘আর্মেনিয়ায় শান্তি স্থাপন অভিযান’ (আজারবাইজানি: Ermənistanı sülhə məcburetmə əməliyyatı, ‘এরমানিস্তান সুলহা মাজবুরেতমা আমালিয়্যাত’) এবং ‘প্রতি–আক্রমণ অভিযান’ (আজারবাইজানি: Əks-hücum əməliyyatı, ‘আকস-হুজুম আমালিয়্যাত’) নামে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে, আর্মেনীয় প্রচারমাধ্যম এই যুদ্ধকে ‘আজারবাইজানি আগ্রাসন’ (আর্মেনীয়: ադրբեջանական ագրեսիա, ‘আজরবেজানাকান আগ্রেসিয়া’) বা ‘আজারবাইজানি–তুর্কি আগ্রাসন’ (আর্মেনীয়: ադրբեջանա-թուրքական ագրեսիա, ‘আজরবেজানা-তুর্কাকান আগ্রেসিয়া’) হিসেবে অভিহিত করেছে।

গত অক্টোবরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় দুইটি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি, মোট তিনটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ করার এই প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়। অবশেষে গত ৯ নভেম্বর রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যস্থতায় আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এবং আর্মেনীয় প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান একটি চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, এবং আর্তসাখের রাষ্ট্রপতি আরায়িক হারুতিউনিয়ানও এই চুক্তির প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রায় দেড় মাস ধরে চলে আসা আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধের অবসান ঘটে।

চুক্তিটিতে মোট ৯টি ধারা রয়েছে, এবং এই চুক্তির সুদূরপ্রসারী ভূরাজনৈতিক ও ভূঅর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। চলুন, চুক্তিটির ধারাগুলো এবং এগুলো তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেয়া যাক।

রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন এবং আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন; Source: Apa.az/Eurasia Daily Monitor

চুক্তিটির প্রথম ধারা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর মস্কো সময় রাত ১২টা থেকে নাগর্নো–কারাবাখের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে পূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে, এবং আর্মেনীয় ও আজারবাইজানি সৈন্যরা তাদের বর্তমান অবস্থানে স্থির থাকবে।

এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে সমস্ত সামরিক কার্যক্রম স্থগিত হয়েছে, এবং এর ফলে এ পর্যন্ত আজারবাইজান যে সমস্ত অঞ্চল অধিকার করেছে সেগুলো আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে যুদ্ধ থামার আগ পর্যন্ত আজারবাইজান আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ৫টি বৃহৎ শহর, ৪টি ক্ষুদ্র শহর ও ২৪০টি গ্রাম দখল করেছে, এবং ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।

১৯৮৮–১৯৯৪ সালের আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধের সময় আর্মেনীয় সৈন্যরা ‘নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে’র সিংহভাগ (৪,৩৮৮ বর্গ কি.মি.–এর মধ্যে ৪,০৮৮ বর্গ কি.মি.) এবং এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলার (কালবাজার, লাচিন, কুবাদলি, জাব্রাইল, জাঙ্গিলান, আগদাম ও ফুজুলি) সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ দখল করে নিয়েছিল। এদের মধ্যে আগদাম জেলার প্রায় তিন–চতুর্থাংশ, ফুজুলি জেলার প্রায় এক–তৃতীয়াংশ এবং বাকি ৫টি জেলার সম্পূর্ণ অংশ আর্মেনীয়দের অধিকারে ছিল। ২০২০ সালের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আর্তসাখের আয়তন ছিল প্রায় ১১,৭২২ বর্গ কি.মি., যা ছিল আজারবাইজানের মোট আয়তনের প্রায় ১৩.৬%।

সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় আজারবাইজানি সৈন্যরা আর্তসাখ–অধিকৃত ৭টি আজারবাইজানি জেলার অংশবিশেষ (যার মধ্যে রয়েছে ফুজুলি, জাব্রাইল, জাঙ্গিলান ও কুবাদলি শহর) এবং মূল নাগর্নো–কারাবাখের অংশবিশেষ (যার মধ্যে রয়েছে কৌশলগত ও সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শুশা শহর) অধিকার করে নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, আর্তসাখ/আর্মেনিয়া এই অঞ্চলগুলো আর ফিরে পাবে না। বিশেষত আজারবাইজানি সৈন্যদের শুশা অধিকার আর্মেনীয়দের জন্য একটি বড় পরাজয়। আর্মেনিয়া ও নাগর্নো–কারাবাখের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ‘লাচিন করিডোরে’র অংশবিশেষ শুশার মধ্য দিয়ে গেছে, এজন্য আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়ের জন্যই শহরটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি, একদিকে আজারবাইজানিরা শুশাকে আজারবাইজানি সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করে, অন্যদিকে আর্মেনীয়দের জন্যও শুশার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অপরিসীম।

আজারবাইজানি সৈন্যদের শুশা দখলের পর আজারবাইজানি জনসাধারণ আজারবাইজানি ও তুর্কি পতাকা হাতে উল্লাস করছে; Source: TRT World

চুক্তির এই ধারাটির মাধ্যমে আজারবাইজান লাভবান হয়েছে, কারণ এখন পর্যন্ত অধিকৃত কোনো অঞ্চলই তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে না। অন্যদিকে, আর্মেনিয়ার জন্য এটি একটি বড় ধরনের পরাজয়। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি আর্মেনিয়ার জন্যও আংশিকভাবে লাভজনক, কারণ দেড় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে আর্মেনীয়/আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবং তাদের পক্ষে আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ চলতে থাকলে নাগর্নো–কারাবাখের বাকি অংশও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যুদ্ধবিরতির ফলে তারা নাগর্নো–কারাবাখের অধিকাংশ অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হয়েছে, এটি তাদের জন্য লাভজনক। অবশ্য, যুদ্ধে আজারবাইজানের ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি, এবং যুদ্ধবিরতি হওয়ায় তারাও অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

চুক্তিটির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বরের মধ্যে আর্তসাখ–অধিকৃত আগদাম জেলা আজারবাইজানের নিকট হস্তান্তর করা হবে।

আগদাম জেলার মোট আয়তন ১,০৯৪ বর্গ কি.মি., যার মধ্যে ৮৪২ বর্গ কি.মি. আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে আজারবাইজানি সৈন্যরা এই অঞ্চলে বিশেষ অগ্রসর হতে পারেনি, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী আর্তসাখকে এই অঞ্চল আজারবাইজানের নিকট হস্তান্তর করতে হবে। এটি আজারবাইজানের জন্য একটি সাফল্য, এবং আর্মেনীয়দের ব্যর্থতা।

সাম্প্রতিক যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দক্ষিণ ককেশাসের মানচিত্র; Source: Financial Times

চুক্তিটির তৃতীয় ধারা অনুযায়ী, ‘নাগর্নো–কারাবাখ সংযোগরেখা’ এবং ‘লাচিন করিডোর’ বরাবর রাশিয়া একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করবে। এই বাহিনীটিতে ১,৯৬০ জন সৈন্য থাকবে, এবং বাহিনীটি হালকা অস্ত্র, ৯০টি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার এবং ৩৮০টি অটোমোবাইল ও বিশেষ সরঞ্জামে সজ্জিত থাকবে।

ইতোমধ্যে রুশ শান্তিরক্ষীরা আর্তসাখে পৌঁছেছে, এবং চুক্তিতে বর্ণিত সামরিক সরঞ্জাম ছাড়াও তারা এতদঞ্চলে হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে আজারবাইজান ও আর্তসাখের মধ্যে যে সংযোগরেখা ছিল, যুদ্ধের ফলে সেটি বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে আর্তসাখ/আর্মেনীয় এবং আজারবাইজানি সৈন্যদের মধ্যে নতুন একটি সংযোগরেখার সৃষ্টি হয়েছে, যেটি আজারবাইজানিদের অনুকূলে। রুশ শান্তিরক্ষীরা এই সংযোগরেখা বরাবর অবস্থান করবে এবং দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ যাতে না শুরু হয়, সেটি নিশ্চিত করবে।

এর পাশাপাশি রুশ সৈন্যরা ৫ কি.মি. প্রশস্ত ‘লাচিন করিডোরে’র নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। আর্মেনিয়া এবং নাগর্নো–কারাবাখের মধ্যে সরাসরি কোনো সীমান্ত নেই, এবং তাদের মধ্যে আজারবাইজানি অঞ্চল অবস্থিত। লাচিন করিডোরের মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও নাগর্নো–কারাবাখের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত লাচিন করিডোরের আশেপাশের আজারবাইজানি অঞ্চল আর্মেনীয়দের কর্তৃত্বাধীনে ছিল, সুতরাং নাগর্নো–কারাবাখের জন্য ‘লাইফলাইন’ হিসেবে পরিচিত এই করিডোরটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক যুদ্ধে আজারবাইজানি সৈন্যরা করিডোরটির দক্ষিণের বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, এবং চুক্তি অনুযায়ী আর্তসাখকে করিডোরটির উত্তরের আজারবাইজানি অঞ্চল ও দক্ষিণের অবশিষ্ট আজারবাইজানি অঞ্চল আজারবাইজানের নিকট হস্তান্তর করতে হবে। ফলে লাচিন করিডোর সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে এবং আজারবাইজান চাইলেই আর্মেনিয়া ও নাগর্নো–কারাবাখের মধ্যবর্তী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে।

আজারবাইজান যেন এটা করতে না পারে, সেজন্য করিডোরটির নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সেখানে রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হবে। করিডোরটির একাংশ শুশা শহরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু শুশা এখন আজারবাইজানি সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এজন্য আর্মেনিয়া পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে আর্তসাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ত থেকে লাচিন করিডোর বরাবর একটি নতুন রাস্তা নির্মাণ করবে।

রাশিয়ার উলিয়ানভস্ক থেকে রুশ শান্তিরক্ষীরা নাগর্নো–কারাবাখের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে; Source: Sputnik News

এই শর্তটি আর্মেনীয়দের জন্য লাভজনক, কারণ এর মধ্য দিয়ে তারা নাগর্নো–কারাবাখের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারবে। অন্যদিকে, এতদঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন রাশিয়ার জন্য কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ, এবং এর ফলে রাশিয়ার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, রাশিয়ার জন্যও এই ধারাটি বিশেষভাবে লাভজনক।

প্রথমত, এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া নাগর্নো–কারাবাখ এবং আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত লাচিন করিডোরে সরাসরি সৈন্য মোতায়েনের সুযোগ লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ, অন্যদিকে আর্মেনীয়দের জন্য অঞ্চলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায় এই অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েনের মাধ্যমে রাশিয়া উভয় রাষ্ট্রের ওপরেই প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। আর্তসাখের স্বাধীন অস্তিত্ব এখন বহুলাংশে রুশদের ওপর নির্ভর করবে এবং একই সঙ্গে আর্মেনিয়াও রাশিয়ার ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলে রুশ সৈন্য থাকায় আজারবাইজান এখানে আক্রমণ চালিয়ে রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইবে না, ফলে এবার তারা যেভাবে যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়াকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল, ভবিষ্যতে সেটা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নাগর্নো–কারাবাখের অবশিষ্ট অংশ ফিরে পেতে হলে এখন আজারবাইজানকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে, অন্যথায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে।

অর্থাৎ, আর্তসাখে ‘শান্তিরক্ষী’ মোতায়েনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া দক্ষিণ ককেশাসে নিজস্ব রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক উপস্থিতি উভয়ই বৃদ্ধি করেছে।

নাগর্নো–কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্তে রুশ শান্তিরক্ষীরা; Source: Apa.az/Eurasia Daily Monitor

চুক্তিটির চতুর্থ ধারা অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর্মেনীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সমান্তরালে ঐ অঞ্চলে রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হবে। রুশ শান্তিরক্ষীরা পাঁচ বছর পর্যন্ত এই অঞ্চলে অবস্থান করবে। যদি পাঁচ বছর শেষ হওয়ার ৬ মাস আগে কোনো পক্ষ চুক্তিটির এই ধারা বাতিল করার আগ্রহ প্রকাশ না করে, তাহলে রুশ শান্তিরক্ষীদের অবস্থানের মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি পাবে।

আপাতদৃষ্টিতে, চুক্তিটির এই ধারা আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়কে তাদের ইচ্ছেমতো পদক্ষেপ নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেছে। তাত্ত্বিকভাবে, পাঁচ বছর শেষ হওয়ার ৬ মাস আগেই আজারবাইজান রাশিয়া ও আর্মেনিয়াকে এই অঞ্চল থেকে রুশ শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রস্তাব জানাতে পারে, এবং রুশদের প্রস্থানের পর পুনরায় আর্তসাখের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। অনুরূপভাবে, তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পাঁচ বছর পর আর্মেনিয়াও অনুরূপ প্রস্তাব করতে পারে, এবং এই অঞ্চল থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের পর আক্রমণ চালিয়ে সাম্প্রতিক যুদ্ধে হারানো অঞ্চল পুনর্দখলের চেষ্টা করতে পারে।

তাত্ত্বিকভাবে উপরের দুইটি সম্ভাবনাই রয়েছে। কিন্তু যদি আজারবাইজান বা আর্মেনিয়ার অনুরোধের পরও রুশ সৈন্যরা এই অঞ্চল ত্যাগ না করে, সেক্ষেত্রে কী হবে? আজারবাইজানের অনুরোধে যদি রুশরা এই অঞ্চল ত্যাগ না করে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে বলপূর্বক অপসারণ করা আজারবাইজানের পক্ষে সম্ভব হবে না, এবং আজারবাইজানও সেই ঝুঁকি নিতে চাইবে না। অন্যদিকে, আর্মেনিয়ার অনুরোধে যদি রুশরা এই অঞ্চল ত্যাগ না করে, সেক্ষেত্রে তারাও এই অঞ্চলে তাদের একমাত্র সমর্থক রুশদেরকে বলপূর্বক এই অঞ্চল থেকে সরানোর চেষ্টা করবে না। বরং তারা চাইবে রুশ সমর্থন নিয়ে আজারবাইজানের ওপর আক্রমণ চালাতে।

অর্থাৎ, চুক্তিটির এই ধারায় আপাতদৃষ্টিতে এতদঞ্চলে রুশ সৈন্যদের উপস্থিতি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তবে এটি রাশিয়ার নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে, এবং এই অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহারকে রাশিয়া যদি নিজস্ব স্বার্থের অনুকূল হিসেবে বিবেচনা করে, তবেই কেবল রুশরা এই অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এতদঞ্চলে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যাতে নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু না হয়, সেটি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে এতদঞ্চলে রুশ সৈন্যদের উপস্থিতি নতুন একটি যুদ্ধের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক।

৯ নভেম্বরের চুক্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত মানচিত্র; Source: The Cyber Shafarat

তদুপরি, আগেকার রুশ ‘শান্তিরক্ষী’ মিশনগুলোর কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে একটি প্যাটার্ন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশরা বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ ওসেতিয়া, আবখাজিয়া, ট্রান্সনিস্ত্রিয়া ও তাজিকিস্তানে ‘শান্তিরক্ষী’ মোতায়েন করেছে, এবং এখন পর্যন্ত এর কোনোটি থেকেই রুশ সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়নি। আর্তসাখেও অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। অবশ্য এর একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এর ফলে হয়তো নতুন একটি আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

চুক্তিটির পঞ্চম ধারা অনুযায়ী, বিবদমান পক্ষ দুইটির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির বাস্তবায়ন কার্যকর করার জন্য এবং যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ‘শান্তিরক্ষা কেন্দ্র’ মোতায়েন করা হবে।

চুক্তিটির এই ধারাটি অস্পষ্ট। এই ধারা অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ও চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি ‘শান্তিরক্ষা কেন্দ্র’ বা ‘যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপিত হবে। কিন্তু ঠিক কোথায় এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে, এখানে সেই বিষয়টি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে এই ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’টি স্থাপিত হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুরস্কের প্রত্যক্ষ ও বিস্তৃত সহযোগিতার ফলেই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজানি সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ৯ নভেম্বর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেটিতে তুরস্ক সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, তুরস্ক যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলেও কূটনৈতিক ফ্রন্টে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

অবশ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ প্রচারমাধ্যমকে জানান যে, নাগর্নো–কারাবাখে রুশ শান্তিরক্ষীদের পাশাপাশি তুর্কি শান্তিরক্ষীদেরও মোতায়েন করা হবে। তুর্কি সরকারও অনুরূপ বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কার্যত চুক্তিতে ‘তুর্কি শান্তিরক্ষী’ সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই, এবং আর্মেনীয়রা নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে তুর্কি সৈন্য মোতায়েনের ঘোর বিরোধী। এমতাবস্থায় রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, এবং এর শর্তানুযায়ী, আর্মেনীয়–আজারবাইজানি চুক্তিতে যে ‘যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপিত হওয়ার কথা, সেটিতে রুশ সামরিক পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি তুর্কি সামরিক পর্যবেক্ষকরাও অংশগ্রহণ করবে। এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে স্থাপিত হবে। অর্থাৎ, নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে এবং আজারবাইজানি ভূমিতে অবস্থিত লাচিন করিডোরে যে রুশ শান্তিরক্ষীরা অবস্থান করবে, তাদের সঙ্গে তুর্কি সৈন্য মোতায়েন করা হবে না।

আজারবাইজানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাকির হাসানভ এবং তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার। সাম্প্রতিক যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে বিস্তৃত সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে; Source: Hurriyet Daily News

অবশ্য তুর্কি প্রচারমাধ্যমে এই বিষয়গুলো এত বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না, এবং আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে মোতায়েনকৃত তুর্কি সামরিক পর্যবেক্ষকদেরকেই তারা কারাবাখে মোতায়েনকৃত শান্তিরক্ষী হিসেবে বর্ণনা করছে, যেটির মূল লক্ষ্য নিজেদেরকে এতদঞ্চলে রুশদের সমকক্ষ হিসেবে দেখানো। কিন্তু কার্যত এটি তুরস্কের জন্য বিশেষ কোনো অর্জন নয়, কারণ যুদ্ধের আগে থেকেই তুর্কি সৈন্যরা আজারবাইজানের মাটিতে অবস্থান করছে।

চুক্তিটির ষষ্ঠ ধারা অনুযায়ী, আর্মেনিয়া আজারবাইজানকে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে কালবাজার অঞ্চল এবং ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে লাচিন অঞ্চল ফিরিয়ে দেবে। ৫ কি.মি. প্রশস্ত লাচিন করিডোর, যেটি আর্মেনিয়ার সঙ্গে নাগর্নো–কারাবাখের সংযোগ নিশ্চিত করে, রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এবং শুশা শহরের ক্ষেত্রে এই শর্ত প্রযোজ্য হবে না। পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে আর্মেনিয়া ও নাগর্নো–কারাবাখের মধ্যে যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য লাচিন করিডোর বরাবর একটি নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হবে, এবং রুশ শান্তিরক্ষীদের এই নতুন পথ বরাবর মোতায়েন করা হবে। আজারবাইজান লাচিন করিডোর দিয়ে যাতায়াতরত নাগরিক, যানবহন ও পণ্যসামগ্রীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করবে।

কালবাজার অঞ্চলের আয়তন ১,৯৩৬ বর্গ কি.মি. এবং লাচিন অঞ্চলের আয়তন ১,৮৩৫ বর্গ কি.মি.। সাম্প্রতিক যুদ্ধে আজারবাইজানি সৈন্যরা লাচিন অঞ্চলের অল্প কিছু অংশ দখল করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু লাচিনের অধিকাংশ ও কালবাজারের অধিকাংশ আর্মেনীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, অঞ্চল দুইটিকে আজারবাইজানের নিকট হস্তান্তর করা হবে। এটি আজারবাইজানের জন্য বড় একটি সাফল্য। লাচিন করিডোর সম্পর্কে ইতোপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।

চুক্তিটির সপ্তম ধারা অনুযায়ী, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে নাগর্নো–কারাবাখ এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে শরণার্থীরা প্রত্যাবর্তন করবে।

১৯৮৮–১৯৯৪ সালের যুদ্ধের সময় একদল আজারবাইজানি শরণার্থী; Source: Karabakh Realities

১৯৮৮–১৯৯৪ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ৫ লক্ষ আজারবাইজানি নাগর্নো–কারাবাখ ও এর আশেপাশের জেলাগুলো ত্যাগ করে আজারবাইজানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই শরণার্থীরা নাগর্নো–কারাবাখ পুনর্দখলের জন্য বরাবরই আজারবাইজানি সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী তারা নাগর্নো–কারাবাখে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাবে।

উল্লেখ্য, চুক্তি অনুযায়ী নাগর্নো–কারাবাখ ও এর আশেপাশের আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত জেলাগুলোর পাশাপাশি নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশেও আজারবাইজানি শরণার্থীরা প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাবে। অবশ্য আর্মেনীয়–আজারবাইজানি জাতিগত বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে আজারবাইজানিরা আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে বসবাস করতে আগ্রহী হবে কিনা, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। অন্যদিকে, নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে আজারবাইজানিদের প্রত্যাবর্তন আর্মেনীয়দের জন্য একটি নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, একদিকে যেমন এই আজারবাইজানিরা ‘গুপ্তচর’ হিসেবে কাজ করতে পারে, অন্যদিকে তেমনি সেখানে আজারবাইজানিদের প্রতি ‘বৈষম্যমূলক’ আচরণ করা হচ্ছে, এই অজুহাত ব্যবহার করে আজারবাইজান ভবিষ্যতে পুনরায় আর্তসাখের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।

চুক্তিটির অষ্টম ধারা অনুযায়ী, উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবন্দি, জিম্মি ও অন্যান্য বন্দি বিনিময় করবে, এবং উভয় পক্ষে নিজ নিজ পক্ষের নিহত সৈন্যদের মৃতদেহ বিনিময় করবে।

চুক্তিটির নবম ধারা অনুযায়ী, অঞ্চলটির সমস্ত অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ সংক্রান্ত সংযোগ উন্মুক্ত করা হবে। আর্মেনিয়া আজারবাইজানের পশ্চিমাঞ্চল এবং নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের মধ্যে যোগাযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এবং এতদঞ্চলের উভয় দিক থেকে মানুষ, যানবাহন ও পণ্যসামগ্রী যাতায়াত করতে পারবে। রাশিয়ার এফএসবির নিয়ন্ত্রণাধীন বর্ডার গার্ড সার্ভিস এই যোগাযোগ পথটির নিয়ন্ত্রণে থাকবে। উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ও আজারবাইজানের পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে নতুন যোগাযোগের পথ নির্মিত হবে।

চুক্তির এই ধারাটি আজারবাইজানের জন্য বিশেষভাবে লাভজনক। ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র’ ৫,৫০২.৭৫ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট একটি আজারবাইজানি অঞ্চল, যেটি আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে আর্মেনীয় ভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। সোভিয়েত শাসনামলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল, এবং এজন্য আজারবাইজান ও নাখচিভানের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৮৮–১৯৯৪ সালের আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধের পর আর্মেনিয়া এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, এবং এর ফলে নাখচিভান আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নাখচিভানের উত্তর ও পূর্বে আর্মেনিয়া, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ইরান এবং উত্তর–পশ্চিমে তুরস্ক অবস্থিত।

চুক্তি অনুযায়ী আজারবাইজান ও নাখচিভানের মধ্যে একটি করিডোর স্থাপিত হবে; Source: BBC

আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অঞ্চলটির অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন যেহেতু আজারবাইজান ও নাখচিভানের মধ্যে একটি করিডোর স্থাপিত হবে, সেহেতু অঞ্চলটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন ঘটার সুযোগ রয়েছে। এই করিডোর অর্জন আজারবাইজানের জন্য একটি বড় লাভ।

বিশ্লেষকদের মতে, চুক্তির এই ধারাটি তুরস্কের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে তুরস্ক স্থলপথে নাখচিভান হয়ে সরাসরি আজারবাইজানের সঙ্গে যুক্ত হবে, এবং আজারবাইজানের হয়ে কাস্পিয়ান সাগরের মাধ্যমে মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হবে। ব্রিটিশ বিশ্লেষক এবং কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো থমাস ডি ওয়ালের মতে, এর মাধ্যমে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে কিরগিজস্তানের বিশকেক পর্যন্ত সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তদুপরি, এর মাধ্যমে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এর ফলে আজারবাইজান এবং মধ্য এশীয় তুর্কি প্রজাতন্ত্রগুলোতে তুরস্কের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। তাতার জাতিভুক্ত রুশ বিশ্লেষক গেরমান সাদুলায়েভের মতে, তুর্কি রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান একইসঙ্গে একটি ‘নব্য ওসমানীয়’, ‘ইসলামি’ ও ‘বৃহত্তর তুর্কি’ সাম্রাজ্য স্থাপন করতে আগ্রহী। এমতাবস্থায় নাখচিভান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী করিডোর তুর্কিদের জন্য একটি বিরাট ভূরাজনৈতিক সাফল্য। কিন্তু বাস্তবতা এতটা সরল নাও হতে পারে।

প্রথমত, নাখচিভান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী করিডোরটি আর্মেনিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। তদুপরি, রুশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’র নিয়ন্ত্রিত সীমান্তরক্ষীরা, যারা তুর্কি–আর্মেনীয় ও ইরানি–আর্মেনীয় সীমান্ত পাহারা দেয়, তারাই এই করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সেক্ষেত্রে এই করিডোরটি তুর্কিদের বাণিজ্যের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হবে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তুর্কি সামরিক প্রভাব কতটুকু বৃদ্ধি পাবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। আর্মেনিয়া ও রাশিয়ার সম্মতি ছাড়া তুরস্ক এই করিডোরটিকে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না, এবং যদি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হয়, রুশ/আর্মেনীয়রা সহজেই করিডোরটি বন্ধ করে দিতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, নাখচিভান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী করিডোরটি কার্যত আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক প্রভাব বিস্তারের জন্য খুব একটা প্রয়োজনীয় নয়। এই করিডোর ছাড়াই সাম্প্রতিক যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে, এবং আজারবাইজান যেহেতু একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, এটি চাইলেই নিজস্ব ভূমিতে তুর্কি ঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই করিডোরটির গুরুত্ব মূলত ভূরাজনৈতিক নয়, ভূঅর্থনৈতিক।

আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ এবং তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান পরস্পরকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে থাকেন; Source: AP News

তৃতীয়ত, আজারবাইজান ও তুরস্কের মধ্যে বর্তমানে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান, এবং আজারবাইজানি জনসাধারণ তুর্কিদেরকে নিজেদের আপন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু তুরস্ক যেমন অন্যান্য প্রতিটি রণাঙ্গনে তার ‘মিত্র’দের (যেমন: সিরিয়ায় এসএনএ, লিবিয়ার জিএনএ, তুর্কি সাইপ্রাস) ওপর নিজস্ব আধিপত্য চাপিয়ে দিয়েছে, আজারবাইজানের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব হবে না। সাম্প্রতিক যুদ্ধে বিজয় আজারবাইজানিদের মধ্যে নতুন করে জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করেছে, এবং এটি তুর্কি আধিপত্য স্বীকার করে নেয়া থেকে আজারবাইজানিদের বিরত রাখবে।

আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন আলিয়েভ পরিবার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল নয়, এবং ৯ নভেম্বরের চুক্তিতেও আজারবাইজান চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে। তারা নিজেদের স্বার্থে তুর্কি সামরিক সহায়তা গ্রহণ করেছে এবং তুর্কিদের সন্তুষ্ট করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ‘কারাবাখে তুর্কি শান্তিরক্ষী মোতায়েন’ করা হবে এরকম ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এটির বাস্তবায়ন করার জন্য তারা রুশদের জোরাজুরি করেনি, ফলে রুশরা নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে তুর্কি সৈন্যদের মোতায়েন করতে দেয়নি। এমনকি চুক্তিতেও তুরস্ক সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই, যেটি আজারবাইজানের মৌন সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়।

তদুপরি, বিশ্লেষকদের মতে, তুরস্ক আজারবাইজানকে সম্পূর্ণ নাগর্নো–কারাবাখ দখল করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, কিন্তু আজারবাইজান তুরস্কের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছে এবং রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এই যুদ্ধ চলাকালে তুরস্কের একটি অন্যতম প্রধান দাবি ছিল, নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার সমাধানের জন্য তুরস্ককে রাশিয়ার সমমর্যাদা প্রদান করতে হবে। কিন্তু তুরস্ককে আলোচনার টেবিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাইরে রেখে রাশিয়া ও আজারবাইজান কার্যত তুরস্কের মূল দাবিটিকেই উপেক্ষা করে গেছে। এছাড়া, এতদিন নাখচিভান অঞ্চলটি আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং বহুলাংশে তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন এটি করিডোরের মাধ্যমে আজারবাইজানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এই অঞ্চলের ওপর আজারবাইজানি কর্তৃত্ব পুনরায় স্থাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে, যেটি স্বাভাবিকভাবেই তুর্কি প্রভাব হ্রাস করবে। সুতরাং এমতাবস্থায় আজারবাইজান ও তুরস্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকবে ঠিকই, কিন্তু আজারবাইজানের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি তুর্কিঘেঁষা হবে এই সম্ভাবনা কম।

সর্বোপরি, রাশিয়া মধ্য এশিয়াকে নিজস্ব ‘ব্যাকইয়ার্ড’ হিসেবে বিবেচনা করে ঠিকই, কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলো এখন স্বাধীন এবং এগুলোর ওপর মস্কোর আধিপত্য যে আগের মতো থাকা সম্ভব না, সেটি রুশ নীতিনির্ধারকরা অনুধাবন করতে পারেন। এজন্যই রাশিয়া মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষেত্র মূলত চীনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু অঞ্চলটিতে চীনের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব রাশিয়ার জন্য পছন্দনীয় নয়, সুতরাং এই অঞ্চলে তুর্কি অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার কার্যত রাশিয়ার জন্য লাভজনক হবে, কারণ চীনের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এটি বাধার তৈরি করবে।

এমতাবস্থায় নাখচিভান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী করিডোর ভূঅর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে তুর্কিদের জন্য একটি বড় অর্জন, কিন্তু এটির সামরিক তাৎপর্য তুলনামূলকভাবে নগণ্য।

আজারবাইজানি বিজয় ইলহাম আলিয়েভের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে; Source: Tofik Babayev/AFP/Getty Images via Al-Monitor

৯ নভেম্বরের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি চুক্তির আরো বহুসংখ্যক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।

প্রথমত, আজারবাইজানের জন্য এই চুক্তিটি একটি বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে কর্তৃত্ববাদী আলিয়েভ পরিবারের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের ফলে ইলহাম আলিয়েভের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আজারবাইজানের অবস্থান উন্নত হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত আজারবাইজান একটি পরাজিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন তারা একটি ‘বিজয়ী রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিগণিত হবে।

দ্বিতীয়ত, আর্মেনিয়ায় এই চুক্তিটিকে বিরাট একটি পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, এবং এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের রাজনৈতিক অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিরোধী দলগুলো তার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে, এবং বিক্ষোভকারীরা আর্মেনীয় আইনসভাও আক্রমণ করেছে।

পাশিনিয়ানের বিপর্যয়ে মস্কোর অখুশি হওয়ার কথা নয়। পশ্চিমাপন্থী হিসেবে পরিচিত পাশিনিয়ান ‘রঙিন বিপ্লবে’র মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, এবং তার পতন ঘটে তদস্থলে একটি মস্কোপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সেটি রুশদের জন্য লাভজনক হবে। কিছু কিছু বিশ্লেষক এমনও ধারণা করছেন, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এই যুদ্ধে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ থেকে বিরত ছিল, যাতে তুর্কি–আজারবাইজানি জোট আর্মেনীয়দের পরাস্ত করতে পারে এবং পাশিনিয়ান বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। এটি ভবিষ্যৎ আর্মেনীয় নেতাদের জন্য মস্কোর একটি ইঙ্গিত যে, অতিরিক্ত পশ্চিমাপন্থী অবস্থান নিলে তার পরিণতি ভালো হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া আর্মেনিয়ার জন্য কোনো বিকল্প নেই।

তৃতীয়ত, আজারবাইজান বিজয়ী হয়েছে, এবং আর্মেনিয়া পরাজিত হয়েছে। কিন্তু উভয় পক্ষের জন্য সামনে নতুন কিছু সমস্যা অপেক্ষা করছে। চুক্তি অনুযায়ী আজারবাইজান নাগর্নো–কারাবাখের দক্ষিণাংশ এবং এর আশেপাশের আজারবাইজানি অঞ্চল ফিরে পেয়েছে, কিন্তু এই অঞ্চলে শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও বিধস্ত অবকাঠামো পুনঃনির্মাণের জন্য তাদেরকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। তদুপরি, আর্মেনিয়ার ওপর সামরিক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য আজারবাইজানকে তার সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়ন চালিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে, চুক্তির ফলে আর্মেনিয়া নাগর্নো–কারাবাখের আশেপাশের ‘সিকিউরিটি বাফার জোন’ হারিয়েছে এবং নাগর্নো–কারাবাখের যে অবশিষ্ট অংশ তাদের কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে, সেটির নিরাপত্তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। আর্তসাখের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবং বিধ্বস্ত সশস্ত্রবাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য আর্মেনিয়াকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে, এবং আর্মেনিয়ার স্থবির অর্থনীতির ওপর এটি অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করবে।

৯ নভেম্বরের চুক্তির পর আর্মেনিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে; Source: Los Angeles Times

চতুর্থত, এই চুক্তিতে নাগর্নো–কারাবাখের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার প্রকৃত সমাধান এখনো হয়নি। আর্মেনীয়রা এখনো নাগর্নো–কারাবাখের মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইনে এটি এখনো আজারবাইজানের অংশ। বস্তুত, আজারবাইজান যে নাগর্নো–কারাবাখের বাকি অংশ দখলের চেষ্টা করেনি, এর একটি কারণ ছিল, এই অংশ দখল করলে এই অঞ্চলে বসবাসকারী আর্মেনীয়দের নিয়ে আজারবাইজানকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। হয় তাদেরকে বিস্তৃত মাত্রায় সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হত, যেটি আজারবাইজানের কাম্য নয়, অথবা আর্মেনীয়দের বহিষ্কার করতে হত, যেটি করলে আজারবাইজানের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হত। তদুপরি, নাগর্নো–কারাবাখের ভবিষ্যৎ চূড়ান্ত না হলে ভবিষ্যতে আবার এই অঞ্চলে সংঘাত আরম্ভ হতে পারে।

পঞ্চমত, আলোচনার টেবিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থান না পাওয়া এবং আজারবাইজানের মৌখিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত নাগর্নো–কারাবাখে তুর্কি সৈন্যদের প্রবেশের শর্ত এই চুক্তিতে না থাকা তুরস্কের জন্য কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে। কিন্তু অন্যদিকে আজারবাইজান যে হারানো ভূমির অধিকাংশ ফিরে পাচ্ছে, তুরস্কের অভ্যন্তরে এটি তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের জন্য একটি বিরাট বিজয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত তুরস্কে জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তাকে নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি করবে। তাছাড়া, চুক্তিতে তুরস্কের কোনো উল্লেখ না থাকলেও দক্ষিণ ককেশাসে যে তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটি বলাই বাহুল্য।

ষষ্ঠত, এই চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনুপস্থিতি রুশদের জন্য লাভজনক। নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯৯০–এর দশকে ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপ গঠিত হয়েছিল, যেটির সহ–সভাপতি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্স। কিন্তু সাম্প্রতিক চুক্তি থেকে ফরাসি ও মার্কিনিদেরকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা হয়েছে, এবং ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এই যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ দেখায় না। তারা নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল, এবং সম্ভবত রাশিয়ার ‘ব্যাকইয়ার্ডে’ তুর্কিদের হাতে রুশদের বিব্রত হওয়ায় তারা অখুশি হয়নি। কিন্তু মিনস্ক গ্রুপ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন রাশিয়া দুর্বল ছিল এবং সেজন্যই এই অঞ্চলে তাদের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই চুক্তির ফলে কার্যত মিনস্ক গ্রুপের কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে। বস্তুত দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় তুরস্কের প্রভাব রুশদের জন্য লাভজনক, কারণ পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় তুরস্ক দুর্বল।

সর্বোপরি, নাগর্নো–কারাবাখ, লাচিন করিডোর ও নাখচিভান–আজারবাইজান সংযোগ করিডোরে রুশ সৈন্য মোতায়েন একদিকে যেমন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করবে, অন্যদিকে তেমনি রাশিয়ার জন্য বিস্তৃত ভূরাজনৈতিক সুবিধাও নিয়ে আসবে। ট্রান্সককেশাস অঞ্চলে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাকু–তিবলিসি–জেয়হান পাইপলাইন এবং দক্ষিণ ককেশাস পাইপলাইন অবস্থিত, এবং চীন এই অঞ্চলে সিল্ক রোড ট্রানজিট প্রজেক্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এমতাবস্থায় এতদঞ্চলে রুশ সামরিক উপস্থিতি এই অঞ্চলের পাইপলাইন রাজনীতির ক্ষেত্রে রুশদের অবস্থানকে শক্ত করবে।

সামগ্রিকভাবে, একটি জার্মান ম্যাগাজিনের ভাষায় বলা যায়, এই চুক্তিটিকে যদি একটা খেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে পশ্চিমা বিশ্ব এই খেলায় অংশ নেয়নি, রাশিয়া স্বর্ণপদক পেয়েছে, আজারবাইজান রৌপ্যপদক পেয়েছে, তুরস্ক ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে, আর আর্মেনিয়া খেলা থেকে বের হয়ে গেছে!

This is a Bengali article about the Azerbaijani–Armenian Ceasefire Agreement, signed on 9 November 2020.

Sources:

1. Amberin Zaman. "Who really won in south Caucasus?" Al-Monitor, November 11, 2020. https://www.al-monitor.com/pulse/originals/2020/11/turkey-azerbaijan-intervention.html
2. Metin Gurcan. "Russia leaves little room for Turkey in Azeri-Armenian truce." Al-Monitor, November 10, 2020. https://www.al-monitor.com/pulse/originals/2020/11/turkey-russia-armenia-azerbaijan-nagorno-karabakh-deal.html
3. Hasan Selim Özertem. "The New Truce in Karabakh: Implications for Azerbaijan and the Region." Eurasia Daily Monitor, Vol. 17, No. 160, November 12, 2020. https://jamestown.org/program/the-new-truce-in-karabakh-implications-for-azerbaijan-and-the-region/
4. Irina Alksnis. "Azerbaijan looses iron grip of Erdogan." Vzglyad, November 11, 2020. https://m.vz.ru/opinions/2020/11/11/1069838.html
5. Pavel Felgenhauer. "The Karabakh War Ends as Russian Troops Move In." Eurasia Daily Monitor, Vol. 17, No. 160, November 12, 2020. https://jamestown.org/program/the-karabakh-war-ends-as-russian-troops-move-in/?fbclid=IwAR3QUt1EXhE0zRMqM57lpqj0IFqjzQDsflS5QFzRPWtVlCXUyBGjpSk8wrw
6. Vladimir Socor. "Karabakh Armistice: Azerbaijani National Triumph, Russian Geopolitical Victory (Part One)." Eurasia Daily Monitor, Vol. 17, No. 160, November 12, 2020.
https://jamestown.org/program/karabakh-armistice-azerbaijani-national-triumph-russian-geopolitical-victory-part-one/

Source of the featured image: Daily Sabah/Eurasia Daily Monitor

Related Articles

Exit mobile version