২০২৩ সালের ২৭ জুন সকালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের পশ্চিমে অবস্থিত নঁতেরে শহরতলিতে একজন ফরাসি পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নাহেল মারজুক নামক একজন ১৭ বছর বয়সী উত্তর আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক নিহত হয়। নাহেল একটি গাড়িতে চালকের আসনে থাকাবস্থায় ট্রাফিক আইন অমান্য করেছিল এবং রাস্তায় থাকা পথচারীদের জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করেছিল। এমতাবস্থায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করলে সে গাড়ি নিয়ে পালানোর চেষ্টা চালায় এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ফরাসি পুলিশের ভাষ্যমতে, উক্ত পুলিশ কর্মকর্তা আত্মরক্ষার তাগিদে নাহেলের ওপর গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু উক্ত ঘটনার ভিডিও ফুটেজ অনুসারে, তাদের ভাষ্য সঠিক নয়, এবং এটি একটি ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড।
পুলিশের গুলিতে নাহেলের মৃত্যুর ফলে তীব্র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রথমে নঁতেরে, এরপর ইল-দে-ফ্রঁস প্রদেশ, এবং পরবর্তীতে সমগ্র ফ্রান্সে তীব্র বিক্ষোভ ও সহিংসতা আরম্ভ হয়। ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে তো বটেই, ফরাসি গায়ানা, রিইউনিয়ন এবং ফ্রান্সের অন্যান্য উপনিবেশেও অনুরূপ বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ফ্রান্সের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডেও ছোটখাট বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ফ্রান্সে সহিংসতা কার্যত একধরনের শহুরে যুদ্ধে [urban war] রূপ নিয়েছিল। দাঙ্গাকারীরা নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি বহুসংখ্যক পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক, অ্যাসল্ট রাইফেল, সাব-মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করে।
ফরাসি সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্রান্সজুড়ে ৪৫,০০০ পুলিশ মোতায়েন করে। অন্তত ৩,৪০০ জনকে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশ্য এক সপ্তাহব্যাপী সহিংসতার ফলে ফ্রান্সে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে খুবই কম। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে একজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, সহিংসতার ফলে অন্তত ৭২২ জন নিরাপত্তারক্ষী আহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সহিংসতার ফলে ফ্রান্সে প্রাণহানি কম হলেও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। দাঙ্গাকারীরা ফ্রান্সজুড়ে অন্তত ২৫০টি পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ চালিয়েছে, অন্তত ৪০০টি ব্যাঙ্ক কার্যালয় ও ৫০০টি ছোট দোকান ধ্বংস করেছে, অন্তত ১,০০০টি সুপারমার্কেট ও অন্যান্য দোকান লুট করেছে এবং অন্তত ৫,৬৬২টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। এর পাশাপাশি তারা কিছু প্রশাসনিক কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এমনকি গ্রন্থাগারের ওপরেও আক্রমণ চালিয়েছে। ফরাসি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এমইডিইএফ-এর হিসেব অনুসারে, এখন পর্যন্ত সহিংসতার ফলে ফ্রান্সের অন্তত ১,১০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
অর্থাৎ, নাহেল মারজুকের মৃত্যুর ফলে ফ্রান্সে একটি তীব্র সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্রান্সে চলমান সহিংসতার অন্তর্নিহিত কারণ কী?
ফ্রান্সের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিস্তৃত কাঠামোগত বৈষম্য
আফ্রিকার অন্তত ২০টি রাষ্ট্র ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্সের সঙ্গে আফ্রিকার অত্যন্ত বিস্তৃত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ বিদ্যমান। আফ্রিকায় ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন চলাকালে এবং পরবর্তীতে উক্ত রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন হওয়ার পর আফ্রিকা থেকে প্রচুর মানুষ ঔপনিবেশিক নীতির ফলে, কর্মসূত্রে, রাজনৈতিক কারণে, পারিবারিক পুনর্মিলনের উদ্দেশ্যে এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে ফ্রান্সে চলে যায়। তারা এবং তাদের বংশধররা ফ্রান্সের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ফ্রান্সে প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত কতজন ব্যক্তি বসবাস করে, সেটির সঠিক হিসেব পাওয়া কঠিন। এদের মধ্যে একাংশের ফরাসি নাগরিকত্ব রয়েছে, অন্য অংশের নেই।
২০২৩ সালের জানুয়ারির হিসেব অনুসারে, ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ। অন্যদিকে, প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ফ্রান্সে অন্তত ২০ লক্ষ আলজেরীয়, ১৫ লক্ষ মরোক্কান, ৭ লক্ষ তিউনিসীয় এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে আগত অন্তত ৩০ লক্ষ অভিবাসী বসবাস করে। তদুপরি, ফ্রান্সে প্রায় ১০ লক্ষ তুর্কি এবং পশ্চিম এশিয়ার আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে আগত কয়েক লক্ষ অভিবাসী বসবাস করে। অর্থাৎ, ফ্রান্সে বসবাসরত প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষকে আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গ — এই তিনটি শ্রেণির যেকোনো একটি বা দুটি বা তিনটিতেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অর্থাৎ, ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষ বসবাস করছে, যারা জাতিগতভাবে ‘ফরাসি’, বর্ণগতভাবে শ্বেতাঙ্গ বা ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান নয়। সম্প্রতি নিহত নাহেল মারজুক এই শ্রেণিরই অংশ ছিল। সে ছিল আলজেরীয় ও মরোক্কান বংশোদ্ভূত মুসলিম পরিবারের ছেলে, কিন্তু তার ফরাসি নাগরিকত্ব ছিল।
আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে, ফ্রান্স একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সামাজিক রাষ্ট্র, এবং সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার রয়েছে। বহির্বিশ্বে ফ্রান্স সাধারণভাবে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবেই সুপরিচিত। কিন্তু মুদ্রার অপরপিঠে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতিতে জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় বৈষম্য সুস্পষ্ট। একদিকে ফ্রান্স উপনিবেশবাদের যুগের অবসানের এত বছর পরেও আফ্রিকার বহুসংখ্যক রাষ্ট্রে সামরিক-রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেগুলোর ওপর নব্য-উপনিবেশবাদী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার মধ্য দিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বজায় রাখছে। অন্যদিকে, ফ্রান্সের অভ্যন্তরে জাতিগত, বর্ণগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কাঠামোগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। কার্যত ফরাসি সরকার ফ্রান্সে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গকে ফরাসি সমাজে অঙ্গীভূত করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
ফ্রান্সে বসবাসরত আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের সিংহভাগ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে জাতিগত ফরাসিদের তুলনায় পশ্চাৎপদ অবস্থানে রয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ফ্রান্সের শহরগুলোর উপকণ্ঠে দরিদ্র ও অস্থিতিশীল শহরতলিগুলোয় কেন্দ্রীভূত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র সর্বত্র তাদেরকে সামাজিক ও কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাদের তরুণদের বৃহদাংশ হয় কর্মহীন, নয়তো কোনো কায়িক শ্রমমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। তদুপরি, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের অনুমতি প্রদান, মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের ওপর নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ফরাসি সরকার ফ্রান্সে বসবাসরত আরব ও মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে। সর্বোপরি, ডানপন্থী ফরাসি রাজনৈতিক দলগুলো ফ্রান্সে বসবাসরত আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের ফরাসি জাতিসত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
ফ্রান্সের যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান দেশটিতে বসবাসরত আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের ক্ষেত্রে অগ্রণী, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ফরাসি পুলিশ। ফরাসি পুলিশদের বিরুদ্ধে মুসলিমবিদ্বেষ সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিমদের বাড়ি, রেস্তোরাঁ বা মসজিদে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ, নির্বিচার মারপিট, জিনিসপত্র ভাঙচুর, পবিত্র কুরআনের অবমাননা, মুসলিমদের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ প্রভৃতি। তদুপরি, ফরাসি আইন অনুসারে, পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় চলমান যেকোনো গাড়ির চালককে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিতে পারে এবং ২০১৭ সালে প্রণীত একটি আইন অনুসারে, চালক পুলিশের নির্দেশ অমান্য করলে সেক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিস্থিতিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ বৈধ। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফরাসি পুলিশ সদস্যরা এরকম পরিস্থিতিতে ৩৩ জন গাড়িচালকের ওপর গুলি চালিয়েছে, যাদের সিংহভাগ ছিল হয় মুসলিম, নয়তো কৃষ্ণাঙ্গ। উল্লেখ্য, ফরাসি পুলিশ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ উগ্র ডানপন্থী ও কট্টর অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল র্যালির সমর্থক।
এমতাবস্থায় ফ্রান্সে বসবাসরত আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ফরাসি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রতি তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার ঠিক আগের দিন পুলিশের গুলিতে নাহেলের মৃত্যু ফরাসি আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গদের সেই ক্ষোভকে সহিংসতায় রূপান্তরিত করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সে এরকম অন্তত ২১টি বিস্তৃত মাত্রায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং চলমান সহিংসতাকে ফরাসি সমাজের সুপ্ত কিন্তু বিপজ্জনক একটি সঙ্কটের পুনঃবিস্ফোরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
ফ্রান্সে চলমান ক্রমবর্ধমান সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট ও বিভাজন
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফরাসি রাজনীতি ও সমাজ অত্যন্ত বিভাজিত অবস্থায় রয়েছে। ফ্রান্সের জনমত কার্যত বামপন্থী ও ডানপন্থী রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সের ক্ষমতাসীন মূলধারার বামপন্থী (কার্যত লিবারেল) দলগুলো বাহ্যিকভাবে অভিবাসন ও সংখ্যালঘুদের প্রতি তুলনামূলকভাবে নমনীয়, কিন্তু কার্যত জনসমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে এবং নিজেদের অন্তর্নিহিত জাত্যাভিমানের কারণে তারা অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকেই কায়েম রেখেছে। অন্যদিকে, ডানপন্থী দলগুলো অভিবাসন ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং বামপন্থী/লিবারেল দলগুলোকে অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। এখন পর্যন্ত লিবারেলরাই ফ্রান্সের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে, কিন্তু ২০২২ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ফরাসি আইনসভা নির্বাচনে ডানপন্থীদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, ফরাসি জনসাধারণের মধ্যে ডানপন্থীদের অভিবাসনবিরোধী ও সংখ্যালঘুবিরোধী ভাষ্যের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তদুপরি, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফ্রান্সের জনসাধারণ নানাবিধ কারণে সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছে। ২০১৮ সাল থেকে চলমান ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন, ২০২২ সালের অক্টোবর–নভেম্বরে সংঘটিত আন্দোলন এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলমান আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ ফরাসি নাগরিক অংশ নিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানির ওপর করের প্রচলন, চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি, সম্পদ কর বাতিলের বিরোধিতা, ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা, নিও-লিবারেলিজমের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব- প্রভৃতি কারণ এসব আন্দোলন-বিক্ষোভের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে ফ্রান্স কার্যত বেশ কয়েক বছর ধরেই পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে এবং ফরাসি সরকার চাপের মুখে রয়েছে।
চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ফরাসি তরুণদের মধ্যে, বিশেষত ফরাসি আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের মধ্যে, বিদ্যমান অসন্তোষকে তীব্র করেছে। একের পর এক সঙ্কট ফরাসি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি ফরাসি তরুণদের বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে, এবং ফরাসি আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের ক্ষেত্রে এটি অধিকতর প্রযোজ্য। এমতাবস্থায় পুলিশের হাতে নাহেল মারজুকের মৃত্যু বিদ্যমান অসন্তোষের বারুদে অগ্নিসংযোগ করেছে।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরোক্ষ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় ফ্রান্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক-রাজনৈতিক মিত্র এবং মার্কিন-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। একইসঙ্গে ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নে তার নেতৃস্থানীয় অবস্থানকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সের দৃষ্টিতে ফরাসি প্রভাব বলয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত আফ্রিকা মহাদেশে ফ্রান্স উদীয়মান বিভিন্ন শক্তির (রাশিয়া, চীন, তুরস্ক প্রভৃতি) প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে। ফ্রান্সের বৃহৎ শক্তির মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে আফ্রিকায় ফরাসি নব্য-উপনিবেশবাদী নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি রাষ্ট্রপতি জাক শিরাক ২০০৮ সালে খোলাখুলি স্বীকার করেছিলেন, “আফ্রিকাকে ছাড়া ফ্রান্স একটি তৃতীয় শ্রেণির শক্তিতে পরিণত হবে।”
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফ্রিকায় ফ্রান্সের আধিপত্য গুরুতর হুমকি সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষত পশ্চিম আফ্রিকায় রুশ–ফরাসি ছায়াযুদ্ধে ক্রমাগত রুশ সাফল্য এবং অঞ্চলটিতে তীব্র ফরাসিবিরোধী মনোভাবের বিস্তারের ফলে ফ্রান্স একের পর এক পশ্চিম আফ্রিকান রাষ্ট্রে তাদের সামরিক-রাজনৈতিক প্রভাব হারিয়েছে। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মালি এবং সর্বশেষ বুর্কিনা ফাসো থেকে ফ্রান্স সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো তাদের মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করে ফ্রান্সের সঙ্গে তাদের মুদ্রার সংযোগ ছিন্ন করার উদ্যোগ নেয়ায় ফ্রান্সের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ফ্রান্সের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা ফরাসি সরকারকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে এবং ফরাসি জনসাধারণ, বিশেষত ফ্রান্সের আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ফরাসি সরকারের এই দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত।
সর্বোপরি, পশ্চিমা বিশ্বব্যাপী উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের উত্থান যেমন ফরাসি উগ্র ডানপন্থীদের ওপর প্রভাব ফেলেছে, তেমনি পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিরোধ ফরাসি আরব, মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যালঘুদের প্রভাবিত করেছে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি সহিংসতায় কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে একইভাবে তীব্র বিক্ষোভ ও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (বিএলএম) আন্দোলন বেগবান হয়। ২০২০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তদানীন্তন ডানপন্থী রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের ক্ষেত্রে এই ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বর্তমান মার্কিন সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতিগত ও বর্ণগত সংখ্যালঘুদের তুষ্ট রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাক্রম থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাষ্ট্র-প্রণোদিত কাঠামোগত বৈষম্যের বিরোধিতার মাধ্যম হিসেবে সহিংস বিক্ষোভ কার্যকরী হতে পারে। এদিক থেকে নাহেল মারজুকের মৃত্যু-পরবর্তী বিক্ষোভকে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু-পরবর্তী বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
নাহেল মারজুকের মৃত্যু এবং মৃত্যু-পরবর্তী সহিংসতা প্রমাণ করেছে যে, ফ্রান্স তার ভূখণ্ডে বসবাসরত জাতিগত, বর্ণগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ফরাসি সমাজে অঙ্গীভূত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে ফরাসি সরকারের বর্তমান নীতি অপরিবর্তিত থাকলে ভবিষ্যতে ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গুরুতর হুমকির মুখে পড়তে পারে, এরকম সম্ভাবনা প্রবল।