অনুবাদকের নোট: সমকালীন দুনিয়ার অন্যতম আলোচিত দার্শনিক ও সংস্কৃতি তাত্ত্বিক স্লাভোয় জিজেক ইওরোপিয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক এবং ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের বির্কবেক ইন্সটিটিউট ফর দ্য হিউম্যানিটিজের আন্তর্জাতিক পরিচালক। গত মার্চ ২, ২০২২-এ শরণার্থীদের ব্যাপারে ইওরোপের বর্ণবাদী পক্ষপাতের সমালোচনা করে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে তিনি একটি নিবন্ধ লেখেন। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করা হল।
ইউরোপ যে শরণার্থীদের ব্যাপারে দ্বৈতনীতির অনুসরণ করে, ইউক্রেন যুদ্ধ সেটা আবারও দেখিয়ে দিয়েছে। এই দ্বৈতনীতি নৈতিকভাবে বধির ও ভূরাজনৈতিকভাবে বোবা। ইউরোপের নিজেকে রক্ষা করার সেরা উপায় হলো, অন্য দেশগুলোকে এই ব্যাপারে প্ররোচিত করতে পারা যে, ইউরোপ তাদেরকে রাশিয়া বা চীনের চেয়ে উন্নত কিছু প্রদান করার সামর্থ্য রাখে।
লুবইয়ানা, স্লোভেনিয়া – রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, স্লোভেন সরকার এই মর্মে ঘোষণা দিল যে, তারা শয়ে শয়ে ইউক্রেনীয় শরণার্থী নিতে প্রস্তুত। একজন স্লোভেন নাগরিক হিসেবে এই ঘোষণা শুনে আমি গর্বিত হয়েছি। একইসাথে, ঘোষণাটি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।
এটা তো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ছয় মাস আগে আফগানিস্তান যখন তালেবদের হাতে পড়েছিল, এই একই সরকার আফগান শরণার্থীদেরকে স্বাগত জানাতে অস্বীকার করেছিল। তারা তখন আফগানদেরকে নিজেদের দেশে থেকে লড়াই চালানোর পরামর্শ দিয়েছিল। আর কয়েক মাস আগে, যখন কয়েক হাজার শরণার্থী – অধিকাংশই ইরাকি কুর্দি – বেলারুশ হয়ে পোল্যান্ডে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন, স্লোভেন সরকার দাবি করে ইউরোপ হামলার শিকার হয়েছে। এই শরণার্থীদেরকে সীমান্তের বাইরে রাখতে পোল্যান্ড সরকার যে ইতরসুলভ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, স্লোভেন সরকার তাতে সহায়তা করতে সামরিক সাহায্য পাঠানোর প্রস্তাব দেয়।
পুরো অঞ্চলটি জুড়ে, শরণার্থীদের দুটো প্রজাতি আবির্ভূত হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি স্লোভেন সরকারের একটি টুইট এই ফারাকটি স্পষ্ট করেছে: “ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা এমন একটি পরিবেশ ছেড়ে আসছেন, যা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ও ঐতিহাসিক অর্থে আফগান শরণার্থীদের ছেড়ে আসা পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা।” ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে টুইটটি তড়িঘড়ি করে ডিলিট করে দেয়া হয়। কিন্তু অশ্লীল সত্যটি ইতোমধ্যেই উন্মোচিত হয়ে পড়ে: ইউরোপের নিজেকে ‘অ-ইওরোপ’ থেকে রক্ষা করতে হবে।
এই পদ্ধতিটি ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য চলমান বৈশ্বিক সংগ্রামে ইউরোপের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমাদের সংবাদমাধ্যম আর অভিজাত শ্রেণি উক্ত সংগ্রামটিকে পশ্চিমা ‘উদার’ বলয় ও রুশ ‘ইউরেশীয়’ বলয়ের মধ্যকার একটি সংঘাত বলে চিত্রিত করে। লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অনেক বড় যে গোষ্ঠীটি আমাদেরকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, তারা সেটিকে উপেক্ষা করে যায়।
এমনকি চীনও রাশিয়াকে অন্ধ সমর্থন দিতে প্রস্তুত নয়, যদিও পূর্বোক্ত দেশটির নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরদিন, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনকে একটি বার্তা পাঠান। শি কিমকে বলেন,
‘এক নয়া পরিস্থিতিতে’ চীন-উত্তর কোরিয়া বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে প্রস্তুত আছে চীন। এরকম একটি আশঙ্কা আছে যে, তাইওয়ানকে ‘মুক্ত’ করতে চীন এই ‘নয়া পরিস্থিতি’ কাজে লাগাবে।
যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ, সেটি হলো, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠা র্যাডিকালাইজেশন মোটেই বাগাড়ম্বর নয়। উদার বামপন্থীদের অনেকেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, যেহেতু দু’পক্ষই জানে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের জড়িয়ে পড়ার সঙ্গতি তাদের নেই, ইউক্রেন সীমান্তে সেনা-সমাবেশ ঘটানো পুতিনের একটা ধাপ্পাবাজি মাত্র। পুতিন যখন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে মাদকাসক্ত আর নয়া নাৎসিদের একটি গোত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন, এমনকি তখনো অনেকে এই আশা জারি রেখেছিলেন যে, রাশিয়া কেবল ক্রেমলিন-সমর্থিত রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ দুটিকেই দখল করে নেবে। বা এই দখলদারিত্ব বড়জোর পূর্ব ইউক্রেনের পুরো দনবাস অঞ্চলে সম্প্রসারিত হবে।
আর এখন যারা নিজেদেরকে বামপন্থী বলে দাবি করেন, তাদের কেউ কেউ (আমি তাদেরকে বামপন্থী বলতে রাজি না) পশ্চিমকে এই কারণে দোষারোপ করছেন যে, পুতিনের মতলবের ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সঠিক ছিলেন। যুক্তিটা সুপরিচিত: ন্যাটো ধীরে ধীরে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছিল, দেশটির দূরে ও কাছে উসকে দিচ্ছিল বর্ণিল বিপ্লব, এবং এমন একটি দেশের যুক্তিসঙ্গত ভীতিকে উপেক্ষা করছিল যারা গত শতাব্দীতে পশ্চিমা আক্রমণের শিকার হয়েছে।
এই যুক্তির, নিঃসন্দেহে, একটি সঠিক দিক আছে। কিন্তু শুধু এটুকুই বলা ভার্সাই চুক্তির অন্যায্যতাকে দোষারোপ করে হিটলারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সমতুল্য। আসলে তারচেয়েও খারাপ, কারণ, এর মধ্য দিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রভাব-বলয় তৈরির অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে আর সবাইকে যার সামনে মাথা নোয়াতে হবে। পুতিন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখেন, তা তার এই পুনরাবৃত্ত দাবিতেই প্রতিধ্বনিত হয় যে, তার সামনে ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালানোর কোনো বিকল্প ছিল না।
সত্যিই কি তাই? সমস্যা কি শুধু ইউক্রেনীয় ফ্যাসিবাদ নিয়েই? প্রশ্নটা বরং পুতিনের রাশিয়ার ব্যাপারেই করা যেতে পারে। ভ্লাদিমির পুতিনের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্রুবতারা হলেন ইভান ইলিন। তার বইগুলো আবার মুদ্রণে ফিরে এসেছে, এবং সেগুলো রাষ্ট্রীয় অ্যাপার্টচিক আর বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। ১৯২০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে, ইলিন ফ্যাসিবাদের একটি রুশ সংস্করণ প্রচার করতে শুরু করেন। ফ্যাসিবাদের এই সংস্করণে রাষ্ট্র একটি জৈবিক সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেবেন একজন পিতৃতুল্য রাজা। সে রাষ্ট্রে স্বাধীনতার মানে- নিজ নিজ অবস্থানে থাকা। ইলিনের (ও পুতিনের) পক্ষে ভোট দেয়ার অর্থ হলো, নেতার প্রতি সমষ্টিগতভাবে সমর্থন ব্যক্ত করা, তাকে বেছে নেয়া বা বৈধতা দেয়া নয়।
আলেকসান্দার দুগিন পুতিনের দরবারি দার্শনিক হিশাবে পরিচিত। তিনি ইভান ইলিনের পদচিহ্ন নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছেন। ইলিনের ধারণার গায়ে দুগিন ইতিহাসতাত্ত্বিক আপেক্ষিকতাবাদের একটা উত্তরাধুনিক অলঙ্কার পরিয়ে দিয়েছেন:
সব কথিত সত্যই আসলে একটি বিশ্বাসের ব্যাপার। তাই আমরা যা করি তাতে বিশ্বাস করি, আমরা যা বলি তাতে বিশ্বাস করি। আর এটিই সত্য নির্ধারণ করার একমাত্র উপায়। তাই আমাদের রয়েছে আমাদের বিশেষ ধাঁচের রুশী সত্য, যা আপনাদেরকে মেনে নিতে হবে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা যুদ্ধ শুরু করতে না চায়, তাহলে আপনাদেরকে এই সত্যটা মেনে নিতে হবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক মাতবরির দিন শেষ। আর সিরিয়া ও ইউক্রেন পরিস্থিতির ব্যাপারে রাশিয়া বলছে, ‘না, তুমি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এখন আর মোড়ল না।’ তো, প্রশ্ন হলো, দুনিয়াটাকে কে শাসন করবে? কেবল যুদ্ধই সেটা নির্ধারণ করতে পারে।
কিন্তু সিরিয়া আর ইউক্রেনের জনগণের কী হবে? তারাও কি নিজস্ব সত্য নির্ধারণের অধিকার রাখেন? নাকি তাদের দেশগুলো সম্ভাব্য বিশ্বমোড়লদের লড়াইয়ের ময়দানমাত্র?
সব জীবনব্যবস্থারই নিজস্ব সত্য আছে, এই ধারণাটি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদীদের কাছে আদরণীয় করে তুলেছে, যিনি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনকে একটা বুদ্ধিদীপ্ত কাজ বলে রীতিমতো প্রশংসা করেছেন। আর অনুভূতিটা পারস্পরিক। পুতিন যখন ইউক্রেনে ‘বিনাৎসিকরণের’ কথা বলেন, ফ্রান্সে মারি লো পাঁর ন্যাশনাল র্যালি, ইতালিতে ম্যাত্তিও সালভিনির লেগা, ও অন্যান্য সত্যিকারের নয়া ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলোর প্রতি তার সমর্থনের কথা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে।
‘রুশ সত্য’ পুতিনের সাম্রাজ্যিক রূপকল্পকে জায়েজ করার উপযোগী একটি অতিকথামাত্র। ইউরোপ যদি এটাকে ঠেকাতে চায়, তাহলে তার সেরা উপায় হচ্ছে, উন্নয়নশীল ও উত্থানশীল দেশগুলোর সাথে সেতুবন্ধন গড়া। এই দেশগুলোর মধ্যে অনেকের হাতেই পশ্চিমা উপনিবেশায়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অভিযোগের একটি লম্বা তালিকা আছে। ‘ইউরোপকে রক্ষা করা’-টাই যথেষ্ট নয়। আসল কাজ হচ্ছে, অন্য দেশগুলোকে এই ব্যাপারে প্ররোচিত করা যে, ইউরোপ তাদেরকে রাশিয়া বা চীনের চেয়ে ভালো কিছু প্রদান করার সামর্থ্য রাখে। আর সেটা অর্জন করার একটাই উপায় আছে। নয়া উপনিবেশবাদকে ক্ষমাহীনভাবে উপড়ে ফেলার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেদেরকে পাল্টে ফেলতে হবে। এমনকি সেই নয়া উপনিবেশবাদ যদি মানবিক সাহায্যের প্যাকেজ আকারেও হাজির হয়ে থাকে, তখনো।
আমরা কি এটা প্রমাণ করতে প্রস্তুত যে, ইউরোপকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে আমরা সর্বত্র স্বাধীনতার জন্য লড়ছি? (ইওরোপীয় ও অ-ইওরোপীয়) শরণার্থীদের সাথে সমান আচরণ করার ব্যাপারে আমাদের যেই লজ্জাজনক অসম্মতি, তা বিশ্বকে খুবই ভিন্ন একটা বার্তা দিচ্ছে।
মূল লেখা: https://www.project-syndicate.org/commentary/europe-unequal-treatment-of-refugees-exposed-by-ukraine-by-slavoj-zizek-2022-03