“মিথ্যা সুখের চেয়ে আমি কষ্টকর সত্যকে বেছে নিতে চাই”
বক্তব্যের প্রতিটা শব্দ বাণী প্রদানকারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। অনলাইনে চ্যাটিং করার সময় একবার এই বক্তব্য দেন গার্ডিয়ানের ২০১২ সালের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব চেলসি ম্যানিং।
তথ্য মানুষকে কতটা মুক্তি দেয়? পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ দেশেই জনগণের জন্য ‘তথ্য জানার অধিকার’ সম্বলিত আইন রয়েছে। সেসব আইন আনুযায়ী, রাষ্ট্রের গোপনীয়তা নষ্ট করে এবং সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানে এমন তথ্য ব্যতীত বাকি সকল তথ্য পাওয়ার অধিকার জনগণ রাখে। ১৭৬৬ সালে সর্বপ্রথম সুইডেনে প্রেসের স্বাধীনতা আইন চালু করা হয়। তখন বিভিন্ন দেশে তা আন্দোলন আকারে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এখন তথ্যের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন হতে দেখা যায়। এসব আন্দোলনের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয় যে, তথ্য এখনও সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়।
বলা হয়ে থাকে, অধিক তথ্যের মাধ্যমেও মানুষকে মিথ্যার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা সম্ভব। এমন হাজারো তথ্য আছে, যেসব দেখলে যেকোনো মিথ্যাকেও মানুষের কাছে সত্য মনে হতে পারে। বিকল্প ধারার কোনো তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যম না থাকলে প্রাপ্ত তথ্যের শুদ্ধতা নিশ্চিত করার কোনো উপায় থাকেনা। কিন্তু তারপরও যুগে যুগে বিভিন্ন মানুষ অসত্য লক্ষ তথ্যের ভিড়েও সত্য ঠিকই ফাঁস করেছেন। সমাজে এদের বলা হয়ে থাকে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’। যারা কোনো এক সময়ে ঠিকই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বিশ্ববাসীকে জাগ্রত করেন। এমনই একজন হুইসেল ব্লোয়ার ব্র্যাডলি ম্যানিং, যিনি পরবর্তীতে লিঙ্গ পরিবর্তন করে হন চেলসি ম্যানিং।
মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগদান
ছোটবেলা থেকেই ম্যানিং ছিলেন অস্থির প্রকৃতির। কম্পিউটারের প্রতি তার পারদর্শিতা তখন থেকেই পরিলক্ষিত হচ্ছিল আর পাশাপাশি একাডেমিক দিকেও তিনি ধারাবাহিকভাবে ছাপিয়ে গেছেন সকলকে। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার কারণে কিছুদিন ছিলেন ওয়েলসে। পরবর্তীতে তিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন এবং একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে যোগ দেন। প্রোগ্রামার হিসেবে তার ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পরলেও ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন খুবই অসামাজিক। তার সহকর্মীদের সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ রক্ষা করতেন না বলেও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে এবং ফলাফল হিসেবে তার চাকুরি খোয়া যায়। তারপর প্রায় সারা দেশ ঘুরে বেড়ান তিনি এবং অবশেষে ২০০৭ সালে যোগ দেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে।
সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি বেশ কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং সর্বোচ্চ গোপনীয় নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স পান। ২০০৮ সালের অগাস্টে সেসব প্রশিক্ষণ শেষ করে নিউ ইয়র্কের ফোর্ট ড্রামে সেকেন্ড বিগ্রেড, ১০ম মাউন্টেইন ডিভিশনে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। সে বছরের অক্টোবরে ইরাকের বাগদাদের একটি বিশেষ অপারেটিং বেইজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্যের সুবিশাল ভাণ্ডারের মাঝে মার্কিন বাহিনীর গোয়েন্দা বিশ্লেষক হিসেবে তাকে মোতায়েন করা হয়। গোয়েন্দা বিশ্লেষক হবার সুবাদে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নথি ঘাঁটাঘাঁটি করবার সুযোগ পান এবং ধারণা করা হয়, সে মাসেই তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসম্মুখে উন্মোচনের লক্ষ্যে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাথে যোগাযোগ করেন।
পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইসল্যান্ডের মার্কিন অ্যাম্বাসির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে উইকিলিকস এবং এপ্রিলে বাগদাদে ২০০৭ সালে নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকের উপর মার্কিন হামলার স্পর্শকাতর ভিডিও ছেড়ে দেয় তারা। এতেই সমগ্র বিশ্ব ওলট-পালট হতে শুরু করে। এ ঘটনায় মার্কিন যুদ্ধ বাণিজ্য সরাসরি জনগণের সামনে চলে আসে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ইয়েমেন মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও এবং আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের গণহত্যা ও ধর্ষণের তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হয় সমগ্র পৃথিবীময়। ইতোমধ্যে ম্যানিংয়ের চাকরি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়ে যায় এবং একসময় তিনি তার চাকরি হারান।
তথ্য ফাঁসের অপরাধে গ্রেফতার
২০১০ সালের মে মাসে ম্যানিং হ্যাকার আদ্রিয়ান ল্যামোর সাথে যোগাযোগ করেন এবং অনলাইনে তার সাথে যোগাযোগ তৈরি করেন। সরকারি গোপন কম্পিউটার থেকে প্রায় লাখখানেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উইকিলিসকসের কাছে সরবরাহ করার বিষয়টি অনলাইনেই স্বীকার করেন ল্যামোর কাছে। ল্যামো এ কথা মার্কিন সেনাবাহিনীকে অবহিত করলে সে মাসেই ম্যানিংকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করে তাকে কোর্ট মার্শালের অধীনে নেয়া হয় এবং গুপ্তচরবৃত্তি, কূটনৈতিক ও সামরিক দলিল ফাঁসসহ সবমিলিয়ে প্রায় ২ ডজনেরও বেশি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
২০১০ সালের জুলাই থেকে ম্যানিং প্রায় ৯ মাস ভার্জিনিয়ায় মার্কিন মেরিন পুলিশের অধীনে থাকেন। সেখানে তার সাথে খুবই খারাপ আচরণের অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রায় এক হাজারেরও বেশি দিন কারাভোগের পর ম্যানিং গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ গোপন তথ্য ফাঁসসহ প্রায় ২০টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। কোর্ট মার্শালে আনীত শত্রুপক্ষকে সহায়তার অভিযোগে অবশ্য তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। তবে সবমিলিয়ে তার শাস্তি হয় ৩৫ বছরের কারাদণ্ড, যা মার্কিন আইন অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শাস্তি।
আদালতে যখন তার বিচার চলছিল, বাইরে তখন তার পক্ষের সমর্থন ভারি হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জনগণ প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং তার সুবিচার কামনা করেছে আদালতের নিকট। সুবিচার প্রার্থনাকারীদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অ্যান রাইট, যিনি ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেন, “ওবামা প্রশাসন ম্যানিংয়ের সঙ্গে যা করেছে, সেটি আইনের লঙ্ঘন। তাঁর সঙ্গে গুয়ানতানামো বে কারাগারের বন্দীদের মতো আচরণ করা হচ্ছে”।
অ্যান রাইটের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও ম্যানিংয়ের পক্ষে প্রতিবাদ জানান এবং তার প্রতি সুবিচার করার দাবি জানান। তার মুক্তির দাবিতে এক লাখেরও বেশি মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি হোয়াইট হাউজে জমা দেয়া হয়েছে।
ম্যানিংয়ের মুক্তি
গ্রেফতারের একদিন পরেই ম্যানিং নিজেকে নারী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং পুরুষ বন্দীদের সাথে থাকতে আপত্তি প্রকাশ করেন। তিনি লিঙ্গ ডিসফোরিয়ার (জেন্ডার আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার) চিকিৎসা দাবি করেন, যদিও কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৪ সালে তার পক্ষ থেকে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন এ বিষয়ে একটি মামলা করে। ২০১৬ সালে তিনি চিকিৎসা দাবি করে অনশনে বসেন। প্রায় ১০ দিন অতিবাহিত হলে সেনা কর্মকর্তারা তার দাবি মেনে নেয় এবং তাকে চিকিৎসা প্রদান এবং লিঙ্গ পুনঃনির্মাণ সার্জারি করানোর দায়িত্ব নেয়। এরই মাধ্যমে ব্র্যাডলি ম্যানিং থেকে তিনি চেলসি ম্যানিংয়ে রূপান্তরিত হন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার দায়িত্বের একেবারে শেষ দিনগুলোতে যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তার মধ্যে একটি হল চেলসি ম্যানিংয়ের মুক্তি। ৩৫ বছরের শাস্তি কমে সাত বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ১৭ই মে ক্যানসাসের লিভেনওর্থের সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি পান চেলসি ম্যানিং। মুক্তি পেয়ে একজন মুক্ত নারী হিসেবে প্রথম যে বাক্যটি তিনি বলেন, “অতীত থেকেও সামনে যা কিছু আছে তা আমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ”।
পুনরায় গ্রেফতার
সম্প্রতি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রসঙ্গে গ্র্যান্ড জুরির সামনে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে এ বছরের মার্চে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। প্রথম যাত্রায় প্রায় ৬২ দিন কারাবন্দী রেখে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ দিনের মধ্যে জবানবন্দী না দিলে শাস্তি হিসেবে প্রতিদিন ৫০০ ডলার এবং ৬০ দিন পর এক হাজার ডলার জরিমানাও গুণতে হবে তাকে। তবে এ বিষয়ে ম্যানিং বলেন, জবানবন্দি দেয়ার চেয়ে মৃত্যুকেই বেছে নেবেন।
হিরো নাকি ভিলেন?
পৃথিবীবাসীর কাছে তথ্য পৌঁছে দিয়েছিলেন ম্যানিং। এসব তথ্য প্রকাশ করেই উইকিলিকস সর্বপ্রথম সমগ্র বিশ্বের সামনে আলোচনায় আসে। মার্কিন সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পাশাপাশি চেলসি ম্যানিংয়ের অবদানও অবিস্মরণীয়। তবে স্বজাতির অনেকের কাছেই তিনি ভিলেন আকারে উপস্থাপিত হয়েছেন। নিজের দেশের তথ্য ফাঁস করায় তাকে অনেকে ভিলেনও মনে করছেন। সে দায়ও অনেকটা নিজের ওপর নিয়েছেন তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। তবে ক্ষমা প্রার্থনা করেও তিনি বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস আমি মানুষকে সাহায্য করতে যাচ্ছিলাম, আঘাত করতে নয়।