ভবিষ্যত সর্বদাই অনিশ্চিত। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে এবং যৌক্তিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করাই যায়। যেমন- বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হবেই, এটি একটি নিশ্চিত ব্যাপার। আবার ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচায় প্রবেশ করলে আপনি যে বাঘের খাদ্যে পরিণত হবেন- সেটাও আপনি বাঘের খাঁচায় প্রবেশের পূর্বেই যৌক্তিকভাবে আন্দাজ করা যায়।
কিন্তু আজ থেকে দশ বছর পর একজন মানুষ ঠিক কী অবস্থায় থাকবেন, কিংবা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর একটা দেশে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট কোনো বিপর্যয় দেখা দেবে কিনা, সেটা বলা বড় মুশকিল।
ইতিহাসের পাতায় ফরাসী ভবিষ্যৎ-বক্তা নস্ট্রাডামাসকে কিংবদন্তির স্থান দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হয়, নস্ট্রাডামাসের করা অনেকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তব ঘটনার সাথে মিলে গেছে বা মিলে যাচ্ছে। আদৌ তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো মিলে যাচ্ছে, নাকি চাতুর্যপূর্ণভাবে বাস্তবতার সাথে সেগুলোর মিল দেখানো হচ্ছে- সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নস্ট্রাডামাসকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ কিন্তু বিন্দুমাত্র কমেনি।
এই নস্ট্রাডামাস প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগেরকার মানুষ। কিন্তু আজ আমরা এমন একজনের কথা জানবো, যাকে ‘এ যুগের নস্ট্রাডামাস’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; ‘বাবা ভাঙ্গা’ নামে সবাই তাকে চেনে।
পরিচয়
১৯১১ সালে মেসিডোনিয়ার ‘স্ট্রুমিকা’ নামক স্থানে ভেঞ্জেলিয়া প্যানদেভা দিমিত্রোভা নামক এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। অবশ্য স্ট্রুমিকা পরবর্তীতে, প্রথম বলকান যুদ্ধের সময় বুলগেরিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। কথিত আছে, ভেঞ্জেলিয়ার বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখন সে তার সঙ্গীদের সাথে খেলায় মত্ত থাকা অবস্থায় এক ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়ে। সে ঝড় ভেঞ্জেলিয়াকে উড়িয়ে নিয়ে যায় অনেকদূর।
কয়েকদিন পর যখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়, তখন দেখা গেলো তার উভয় চোখের অবস্থাই খুব খারাপ। অক্ষিকোটরে ধুলা-বালি ও ময়লা ঢুকে তার চোখের উপর জমে শক্ত আবরণ তৈরি করে ফেলেছে! এ অসহায় মেয়েটির দরিদ্র পরিবারের সামর্থ্য ছিল না তাকে উন্নত চিকিৎসা করানোর। ফলে ভাগ্যের নির্মম পরিণতি মেনে নিয়ে তাকে আজীবনের জন্য অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হলো।
মূল ঘটনার শুরু এখান থেকেই। ভেঞ্জেলিয়া দাবি করলো, প্রলয়ংকারী ঝড়টি যখন তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো, যখন সে তার দৃষ্টি হারালো, সে বুঝতে পারলো তার মধ্যে ভর করেছে অদ্ভুত কোনো ক্ষমতা; যেন সে তার দৈবদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে নাকি রয়েছে- স্পর্শের মাধ্যমে মানুষকে সুস্থ করে তোলার ক্ষমতা!
এ কারণে তিনি পরবর্তীতে উপাধী পান ‘বলকানের নস্ট্রাডামাস’। হয়ে উঠেন ‘বাবা ভাঙ্গা’ (Baba Vanga)। বুলগেরিয়ান ভাষায় ‘বাবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘দাদিমা’ বা ‘জ্ঞানী মহিলা’। বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যত দর্শন ও মানুষকে সুস্থ করে তোলার ক্ষমতার কারণেই এরূপ নামকরণ।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, বাবা ভাঙ্গা ঠিক কী কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন? তার কথাগুলো কি সত্যি হয়েছিল? কেমন করেই বা তিনি এসব ভবিষ্যদ্বাণী করতেন? আসুন জেনে নেওয়া যাক বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে।
ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ
বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে তিনটি ভাগে আলোচনা করা সুবিধাজনক- (১) যেসব ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ ইতোমধ্যে বাস্তব ঘটনার সাথে মিলে গেছে বা মিলে যায়নি, (২) বর্তমানকালে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাওয়ার কথা রয়েছে এবং (৩) সুদূর ভবিষ্যত নিয়ে তার করা ভবিষ্যদ্বাণী।
ঘটে যাওয়া ঘটনা সমূহ
টুইন টাওয়ারে হামলা
বলা হয়ে থাকে বাবা ভাঙ্গা ১৯৮৯ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী হুবহু এরকম-
Horror, horror! The American brethren will fall after being attacked by the steel birds.
The wolves will be howling in a bush and innocent blood will gush.
তার এ ভবিষ্যদ্বাণীকে অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় অনেকটা এরকম-
ইস্পাতনির্মিত(ধাতব) পাখিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর আমেরিকান ভ্রাতাদের পতন ঘটবে।
নেকড়েরা ঝোপের আড়াল থেকে চিৎকার করতে থাকবে, আর নিরীহদের রক্ত ঝরবে।
এখানে ইস্পাতনির্মিত পাখি বলতে যে ‘বিমান’কে বোঝানো হয়েছে, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আর Brethren শব্দের অর্থটা বিস্তৃত, এটিকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করা যায়, আবার সহকর্মী বা বন্ধু বা সমধর্মী ব্যক্তি হিসেবেও নেওয়া যায়।
তাই বাবা ভাঙ্গার দাবির সপক্ষে থাকা ব্যক্তিদের মতে, Brethren শব্দটির দ্বারা টুইন টাওয়ার বোঝানো হয়েছে এবং ইস্পাতনির্মিত পাখি তথা বিমানহামলায় তার পতনের ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে। অন্যদিকে তার ভবিষ্যদ্বাণীতে যেহেতু Bush শব্দটির উল্লেখ আছে, তাই সেটিকে কাকতাল না ভেবে, বরং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ এর সাথে মেলানো হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট
বাবা ভাঙ্গা ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ তম প্রেসিডেন্ট হবেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান। আশ্চর্যজনকভাবে বারাক ওবামা একজন আফ্রিকান-আমেরিকান এবং তিনিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ তম প্রেসিডেন্ট!
অবাক করার মতোই ব্যাপার, তাই না?
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন
বাবা ভাঙ্গা বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে (১৯৫০-১৯৬০ এর মধ্যে) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন-
শীতল অঞ্চলগুলো উষ্ণ হয়ে উঠবে……এবং আগ্নেয়গিরিরা জেগে উঠবে। সবকিছু বরফের মতো গলে যাবে।
এই ভবিষ্যদ্বাণীটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সাথে মিলে যায় অনেকটা।
বক্সিং-ডে সুনামি
বাবা ভাঙ্গা ১৯৫০ সালে বলেছিলেন-
A huge wave will cover a big coast covered with people and towns, and everything will disappear beneath the water.
অর্থাৎ-
মানুষ ও বসতিতে পরিপূর্ণ এক সমুদ্রতীরে বিশাল বড় এক ঢেউ আছড়ে পড়বে, এবং সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
বক্সিং ডে সুনামির কথা হয়তো অনেকে জেনে থাকবেন। ২০০৪ সালের বক্সিং ডে, অর্থাৎ বড়দিনের পরেরদিন (২৬ ডিসেম্বর) ভারত মহাসাগরের তলদেশে এক ভয়ানক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল, যার মাত্রা ছিল প্রায় ৯.১!
ভূ-গর্ভস্থ নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এত বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, এবং তা সাগরের পানিকে ভয়ানকভাবে উদ্বেলিত করে। ফলস্বরূপ দেখা দেয় প্রবল শক্তিশালী সুনামি। বক্সিং ডে সুনামি যখন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় আছড়ে পড়লো, তখন পানিস্তম্ভের উচ্চতা ছিল প্রায় ১০০ ফুট। আক্ষরিক অর্থেই কিছুই দাঁড়াতে পারেনি এই বিশাল জলরাশির শক্তির সামনে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ইত্যদি দেশ মিলিয়ে, মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে, ঝরে গিয়েছিল প্রায় দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার প্রাণ।
অত্যন্ত অনুমিতভাবেই, বাবা ভাঙ্গার ভক্তরা এ সুনামিকেই বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণী করা সেই প্রলয়ের সাথে মেলান।
আইসিসের উত্থান
বাবা ভাঙ্গার অনুসারীদের দাবি অনুসারে, তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যে, ২০১০ সালের দিকে সিরিয়াতে এক ‘বৃহত্তর মুসলিম যুদ্ধ’ শুরু হব। এতে এক ‘চরমপন্থি মুসলিম শক্তির’ উত্থান ঘটবে এবং তারা ইউরোপ আক্রমণ করবে। আইএস এর উত্থানের ঘটনা এবং ইউরোপের কয়েকটি স্থানে তাদের অনুসারীদের হামলার ঘটনাকে ঐ ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়।
ব্রেক্সিট
বলা হয়, বাবা ভাঙ্গার গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ২০১৬ সালে ইউরোপের পতন হবে। যদি এ দাবি সত্যি হয়ে থাকে, তবুও এখানে ‘পতন’ শব্দটিকে তিনি ঠিক কোন অর্থে ব্যবহার করেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে যারা বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবের সাথে মেলানোর দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন তাদের মতে, ‘পতন’ শব্দটার দ্বারা ইউরোপের ‘ঐক্য বিনষ্ট হওয়া’র কথা বলা হয়েছে।
ব্রেক্সিট বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাটির কথাই কি বাবা ভাঙ্গা বোঝাতে চেয়েছিলেন?
সাবমেরিন ‘কুর্স্ক’ এর অন্তর্ধান
২০০০ সালের ১২ আগস্ট, রাশিয়ার উত্তরে ব্যারেন্ট সাগরের বুকে রুশ নৌবাহিনীর একটি পারমাণবিক-শক্তিচালিত সাবমেরিন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং ডুবে যায়। এটির নাম ছিল ‘কুর্স্ক’।
জানা যায়, এই দুর্ঘটনার বিষয়ে বাবা ভাঙ্গা একদম সময় উল্লেখ করে সতর্ক করে দিয়েছিলেন! তিনি বলেছিলেন-
এ শতাব্দীর শেষভাগে, ১৯৯৯ বা ২০০০ সালের আগস্টে, ‘কুর্স্ক’ পানির আড়ালে থাকবে এবং সারাবিশ্ব এর জন্য শোকাহত হবে।
সাবমেরিন কুর্স্ক ডুবে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে, বাবা ভাঙ্গা কুর্স্ক বলতে রাশিয়ার একটি শহরকে বুঝিয়েছেন, যার নামে ঐ ডুবে যাওয়া সাবমেরিনটির নামকরণ হয়েছিল।
চীনের উত্থান
চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রসঙ্গেও ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে গেছেন বাবা ভাঙ্গা। তিনি বলেছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে নতুন পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বের বুকে আবির্ভূত হবে।
যদিও সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে চীন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে, কিন্তু চীনা অর্থনীতি ইতোমধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকে প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে এবং মোটামুটি সকল স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, চীন সামনের বছরগুলোতে নিশ্চিতভাবেই অর্থ-সম্পদের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। আর একটা শক্তিশালী অর্থনীতিই একটি দেশকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্বৃদ্ধশালী করে তোলে।
বাবা ভাঙ্গা আরো বলেন “শোষণকারীরা হবে শোষিত”। সহজেই ধারণা করা যায় যে, ‘শোষণকারী’ বলতে তিনি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকেই বুঝিয়েছেন।
এছাড়াও তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর সঠিক দিনক্ষণ, চেরনোবিল নিউক্লিয়ার-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপর্যয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন এবং রাশিয়ার শাসক হিসেবে পুতিনের উত্থান এর ব্যাপারেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলে শ্রুতি আছে।
বর্তমানে যা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে
এখন ২০১৯ সাল চলছে। এই বছরটিতে কী কী ঘটতে পারে, তাও বলে গেছেন বাবা ভাঙ্গা।
পুতিনের উপর হামলা
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর এ বছর দুর্ধর্ষ কোনো আততায়ীর হামলা করার কথা রয়েছে। বলা হয়েছে, পুতিনের ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তির যোগসাজশেই এ হামলা হবে এবং পুতিন এ হামলায় প্রাণে বেঁচে যাবেন।
অবশ্য ইতোমধ্যে ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর কয়েকবার হামলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
ট্রাম্পের বিরল রোগ
বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলে এ বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্প বিচিত্র রোগে আক্রান্ত হবেন। এতে করে তার শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে এবং মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন তিনি।
অবাক করা মতো বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের এই ধরনের কোনো উপসর্গের কথা শোনা না গেলেও, চীন ও কিউবায় কর্মরত কয়েকজন মার্কিন কূটনীতিকের ক্ষেত্রে কাছাকাছি ধরনের উপসর্গের কথা জানা যায়। এর কারণ নিয়ে চলছে অনুসন্ধান।
এশিয়ায় বড় ধরনের সুনামি
২০১৯ সালে এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য কিছু অঞ্চলে বেশ বড়সড় সুনামি তথা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে – বলছে বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণী।
ইতোমধ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ ইন্দোনেশিয়ায় ৭.৫ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প সংঘটিত হয় এবং এর পরপরই দেখা দেয় ভয়াবহ সুনামি। প্রায় ২০ ফুট উঁচু জলরাশির আকস্মিক আগমনে বিপর্যস্ত হয়েছিল জনপদ। বারোশ’র অধিক মানুষ মারা যায় এতে।
এটি যদি বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন হয়ে থাকে, তাহলে সেই একই ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে এই বছর চীন, জাপান, পাকিস্তান এবং আলাস্কাতেও আঘাত হানতে পারে শক্তিশালী কোনো সুনামি।
যা ঘটবে ভবিষ্যতে
বাবা ভাঙ্গা সুদূর ভবিষ্যতের বিষয়েও করে গেছেন অনেক আশ্চর্যজনক ভবিষ্যদ্বাণী। সেগুলো মিলে যাবে কিনা, তা দেখার জন্য ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আপাতত কিছু করার নেই। আবার কিছু ভবিষ্যদ্বাণী এতই দূর ভবিষ্যৎকে নিয়ে যে, এই মুহূর্তে যারা লেখাটি পড়ছেন, তাদের কেউই ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন না, এবং দেখে যেতে পারবেন না যে, বাবা ভাঙ্গার কথা সত্যি হলো কিনা। আসুন দেখা যাক, বাবা ভাঙ্গা সামনের বছরগুলো বা শতাব্দীগুলো সম্পর্কে কী বলে গেছেন-
২০২৫-২০২৮ সালের মধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে দুর্ভিক্ষ দূরীভূত হবে। মানবজাতি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং কোনো মানুষ না খেয়ে মারা যাবে না।
২০৩৩-২০৪৫ এর মধ্যে পোলার আইস ক্যাপ, অর্থাৎ দুই মেরুতে জমা বরফ পুরোপুরি গলে যাবে। পূর্বে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যে ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন গত শতকের শেষ দিকে, সেটিরই ষোলোকলা পূর্ণ হবে! সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও স্বাভাবিক কারণেই বৃদ্ধি পাবে এবং পৃথিবীর অনেক অঞ্চল তলিয়ে যাবে এসবের দরুণ।
২০৪৩ সালের পূর্বেই আইএস এর উত্থানের বিষয়ে বাবা ভাঙ্গার ‘তথাকথিত’ ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলা হয়েছে। তিনি একইসাথে এটাও বলেছিলেন যে, আইএস বা এধরনের চরমপন্থী কোনো মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান হওয়ার পর তারা ইউরোপ আক্রমণ করবে। ‘বৃহত্তর মুসলিম যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে ইউরোপে অনেকবছর যাবত সংঘাত চলবে এবং ভেঙে পড়বে ইউরোপের শাসন ব্যবস্থা।
অবশেষে ২০৪৩ সালে ইউরোপে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং রোম হবে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মুসলমানদের অধীনে বিশ্বের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।
২০৪৬ সালের মধ্যে মানুষ অঙ্গ ক্লোনিং বা স্টেমসেল গবেষণায় অনেক উন্নতি লাভ করে কৃত্রিমভাবে অঙ্গ তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করবে। ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভুতপূর্ব পরিবর্তন আসবে এবং মানুষের জীবন বাঁচানো ও অসুস্থ রোগীকে সুস্থ করে তোলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
২০৬৬-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে মুসলিম শাসন থেকে উদ্ধার করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক হামলা চালাবে। এ অস্ত্র তাৎক্ষণিকভাবে কোনোকিছুকে বরফের মতো জমিয়ে ফেলবে এবং পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এ যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র রোম পুনর্দখল করবে এবং পুনরায় খ্রিস্টানদের আধিপত্য ফিরিয়ে আনবে।
২০৭৬ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কমিউনিজম বা সাম্যবাদ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং সারাবিশ্বে সেটি আবারো ছড়িয়ে পড়বে।
২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিম সূর্যের দ্বারা রাতকে আলোকিত করা হবে। তখন সর্বদাই পৃথিবীর বুকে দিন থাকবে, কখনো আঁধার নামবে না।
২১৩০ সালের মধ্যে মানুষ সমুদ্রের নিচে বসতি স্থাপন করে বসবাস করার সক্ষমতা অর্জন করবে। ভিনগ্রহের প্রাণীদের সহায়তা বা প্রযুক্তির সাহায্যে করা হবে কাজটি।
২১৭০ সালে ব্যাপক আকারে খরা দেখা দেবে।
২১৮৭ সালে দুটি বৃহৎ আকৃতির আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থামিয়ে দিতে সমর্থ হবে মানুষ।
২২০১ সালে সূর্যের অভ্যন্তরীণ থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়া কমে গিয়ে এর উত্তাপ হ্রাস পাবে। ফলে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে কৃত্রিম সূর্যের।
২১৭০-২২৫৬ সালের মধ্যে মানুষ মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করবে। মঙ্গলে বসবাস করা মানুষেরা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠবে এবং পৃথিবীর শাসন থেকে মুক্তি, অর্থাৎ স্বাধীনতা চাইবে।
২২৬২-২৩০৪ সালের মধ্যে মানুষ টাইম-ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ করার সক্ষমতা অর্জন করবে।
২৩৫৪ সালে কৃত্রিম সূর্যের মধ্যে একটি দুর্ঘটনা ঘটার ফলে পৃথিবীতে আবারো খরা দেখা দেবে।
২৪৮০ সালে দুটি কৃত্রিম সূর্যের মধ্যে সংঘর্ষ হবে এবং পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।
৩০০৫ সালে পৃথিবীর সাথে মঙ্গল গ্রহের এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে। এতে করে মঙ্গল গ্রহ তার গতিপথ বা কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে।
৩০১০ সালে চাঁদে একটি ধূমকেতু আছড়ে পড়বে। ভেঙে যাওয়া চাঁদের টুকরো হয়ে যাওয়া খণ্ড, ধুলো আর ছাই মিলে পৃথিবীর চারদিকে শনির বলয়ের মতো বলয় গঠন করবে।
৩৭৯৭ সালে পৃথিবী নামক গ্রহের কোনোকিছুই টিকে থাকবে না, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে সে সময়ের মধ্যে মানুষ সৌরজগতের মতো অন্য কোনো নাক্ষত্রিক জগতে গিয়ে বসতি স্থাপন করার মতো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করে ফেলবে।
৪৩০২-৪৬৭৪ এর মধ্যে মানুষ অমরত্ব লাভ করবে এবং বহির্জাগতিক কোনো প্রাণী বা এলিয়েনদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। মহাবিশ্বের জনসংখ্যা তখন হবে প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন। শুধু তা-ই নয়, তখন নাকি তারা ইশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনেও সক্ষম হবে!
৫০৭৯ সালে পুরো মহাবিশ্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
মুদ্রার অপর পিঠ
এতক্ষণ তো অতীত ও বর্তমান নিয়ে বাবা ভাঙ্গার সেসব ভবিষ্যতদ্বাণীগুলোই জানলেন, যেগুলো অতীতে সত্যি হয়েছে, কিংবা বর্তমানে সত্যির আলামত পাওয়া যাচ্ছে, কিংবা ভবিষ্যতে ঘটবে। কিন্তু এটি কেবল মুদ্রার একটি পিঠ। তার সকল ভবিষ্যদ্বাণীকেই বেদবাক্য ভেবে নেওয়ার কারণ নেই। ইতোমধ্যেই তার ভবিষ্যদ্বাণী বেশ কিছুবারই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এবার মুদ্রার সেই অপর পিঠটিই দেখে নেওয়া যাক।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ
বাবা ভাঙ্গা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে যে দুটি দল খেলবে তাদের, আদ্যক্ষর হবে ‘B’। কিন্তু ব্রাজিলের ক্ষেত্রে কথাটি মিলে গেলেও বুলগেরিয়া সেমি-ফাইনালে হেরে যাওয়ায় তার কথা পুরোপুরি ফলেনি।
পারমাণবিক যুদ্ধ
২০১০ সাল এর কিছু আগেপরে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে বলে বাবা ভাঙ্গা অনুমান করেছিলেন। কিন্তু তার এ ভবিষ্যদ্বাণী ইতোমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
বাবা ভাঙ্গার গণনা অনুযায়ী, ২০১৬ নাগাদ সেই‘মুসলিম চরমপন্থী শক্তি’ কর্তৃক ইউরোপে রাসায়নিক হামলা সংঘটিত হওয়ার কথা, যা ধীরে ধীরে ইউরোপের জনবসতি লঘু করে দেবে। এমনকি ইউরোপে ‘কোনোপ্রকার প্রাণের অস্তিত্ব’ থাকবে না বলেও দাবি করেছিলেন বাবা ভাঙ্গা। অথচ আইএস বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা এমন কোনো হামলাও ঘটলো না, আবার ইউরোপও বহাল তবিয়তেই আছে।
উত্তরসুরী ফরাসি বালিকা
বাবা ভাঙ্গা মৃত্যুর পূর্বে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর ১০ বছর বয়সী এক ফরাসী দৃষ্টিহীন বালিকা তার এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা লাভ করবে এবং মানুষ দ্রুতই সে মেয়েটির পরিচয় জানতে পারবে। কিন্তু এ ধরনের কারো কথাই জানা যায়নি।
এরকম আরো অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে, যা বাস্তবের সাথে মেলেনি। সেগুলো হয়তো মানুষ ইচ্ছে করেই ভুলে গেছে, কিংবা সেগুলোকে বাস্তবতার সাথে মেলানো যায়নি বলে হয়তো সেগুলো নিয়ে আলোচনাও করা হয় না আর।
অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা
যারা বাবা ভাঙ্গাকে নিয়ে অনেক আলোচনা করেন কিংবা যারা বাবা ভাঙ্গার ভক্ত, তাদের মুখে প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়- বাবা ভাঙ্গার করা ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ৮০ শতাংশই নাকি বাস্তবের সাথে মিলে গেছে! কিন্তু এই জরিপ কারা করলো, এই জরিপের কোনো ভিত্তি আছে কিনা এবং আদৌ এতে কোনো সুষ্ঠু প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হলো কিনা, তা জানা যায়নি।
তবে ধারণা করা হয়, এধরনের জরিপ উদ্দেশ্যপ্রণীত ও একপাক্ষিক; যাতে শুধু কয়েকটি মিলে যাওয়া বা মিলে গেছে বলে মনে হয়, এমন ভবিষ্যদ্বাণীকেই গোনায় ধরা হয়েছে। যেগুলো মিলে যায়নি, সেগুলো বিবেচনা করা হয়নি, বা সেগুলো ইচ্ছে করে ভুলে যাওয়া হয়েছে।
কীভাবে বাবা ভাঙ্গা এসব ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, তা হয়তো কোনোদিন নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না। কিন্তু এটি নিয়ে বাহ্যিক পর্যালোচনা করতে গেলে আবারো ফিরে যেতে হবে তার ব্যক্তিগত জীবনে; তবে এবার আরেকটু গভীরভাবে আলোকপাত করতে হবে।
অনলাইনে ওপরের ভিডিওটির মতো আরো অসংখ্য ভিডিও দেখা যাবে বাবা ভাঙ্গাকে নিয়ে। তবে এগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খানিকটা একপেশে তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
যখন বাবা ভাঙ্গা দুর্যোগের কবলে পড়ে তার দৃষ্টি হারান, তারপর থেকেই তিনি দাবি করতেন, সেই দুর্যোগের সময় তিনি অলৌকিক ‘কোনোকিছুর’ মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাকে দুটি পছন্দ দেওয়া হয়েছিল- (১) হয় তার দৃষ্টিশক্তি থাকবে, কিংবা (২) তিনি ভবিষ্যত দেখার ক্ষমতা লাভ করবেন।
তার এ দাবি কতটা সত্যি তা যাচাই করার উপায় নেই। এরকম পরিস্থিতি যদি সত্যিই উদ্ভুত হয় কোনো মানুষের জীবনে, তাহলে সে আসলেই তার দৃষ্টির বিনিময়ে অন্যকিছু চাইবে কিনা, তার উত্তর হয়তো মানুষভেদে ভিন্ন ভিন্নই হবে।
তার বয়স যতই বাড়তে থাকলো, তার পরিচয়ও ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারিদিকে। বলা হলো, স্পর্শের মাধ্যমে রোগ সারিয়ে তোলার অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী তিনি। এমনকি বাবা ভাঙ্গা নিজে বলেছেন, তাকে ভিনগ্রহের প্রাণী বা এই জাতীয় কোনো সত্ত্বারা ভবিষ্যত দেখতে কিংবা অতীন্দ্রিয় কোনোকিছু বুঝতে সাহায্য করে!
তার খ্যাতি বাড়তে বাড়তে একসময় এমন পর্যায়ে চলে গেলো যে, বাল্টিক অঞ্চলের আশেপাশে এবং সারাবিশ্বের অনেক স্থান থেকেই তার সাক্ষাতপ্রার্থী লোকের ঢল নামতে লাগলো। সেসব লোকেদের তালিকায় বিভিন্ন দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ অসংখ্য প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। রয়েছেন বুলগেরিয়ার জার(সম্রাট) তৃতীয় বরিস ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ-ও! এ থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় তার জনপ্রিয়তা ও প্রভাব কোন পর্যায়ে ছিল।
বুলগেরিয়ায় বসবাস করার সুবাদে বুলগেরিয়ান রাজপরিবারের সাথে তার সম্পর্ক ছিল বেশ ভালো। রাজপরিবারের সবাই নিয়মিত তার সাথে শলাপরামর্শ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বুলগেরিয়ায় যখন সমাজতন্ত্র কায়েম হলো, তখন বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের পরামর্শক হিসেবে বাবা ভাঙ্গাকে নিয়োগ করা হলো। ধারণা করা হয়, এটি ছিল লোক দেখানো কাজ; সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা তার এই ‘তথাকথিত’ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়ন বা ‘সুদূরপ্রসারী স্বার্থ হাসিল’ করতে চেয়েছিল।
এই ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন, জার্মানিসহ অনেক দেশই চালিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, বিভিন্ন ঐতিহাসিক উৎস থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে, সেগুলোকে অলৌকিক কিছুর সাথে জোড়া দিয়ে, বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে শত্রুপক্ষের পরিণতি সম্পর্কে ভয়ানক কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করা। কাজটি কারো কারো দৃষ্টিতে হাস্যকর ও অবৈজ্ঞানিক মনে হলেও, সাধারণ মানুষের(এমনকি কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামরিক অফিসার ও রাজনীতিবিদদেরও) মনে এটি বেশ প্রভাব ফেলে এবং শত্রুপক্ষের মনোবল ও নৈতিকতাকে অনেকটা দুর্বল করে দিতে পারে।
বলা হয়, বুলগেরিয়ান সিক্রেট সার্ভিস বাবা ভাঙ্গাকে বিভিন্ন লোকের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বহু তথ্য দিতো, এবং সেগুলো ব্যবহার করেই তিনি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতেন। অর্থাৎ বাবা ভাঙ্গার জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলতে এবং সেটিকে ব্যবহার করতে তারা সচেষ্ট ছিল।
বাবা ভাঙ্গার কাছে বাইরের দেশের অনেক রাজনীতিকেরা পরামর্শ চাইতে যেতেন। তাদেরকে বাবা ভাঙ্গা যেসব উপদেশ দিতেন, সেগুলোও সোভিয়েত সমর্থিত বুলগেরিয়ান গোয়েন্দাদের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। এমনকি বাবা ভাঙ্গা যে ঘরে বসবাস করতেন, সেখানেও নাকি গোয়েন্দারা ক্যামেরা, মাইক্রোফোনের মতো নজরদারি করার উপকরণ বসিয়ে রেখেছিল। এগুলোর মাধ্যমে সম্ভবত তার সাথে দেখা করতে আসা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নজরদারি করা যেতো এবং তাদের গোপনীয় তথ্য জানার চেষ্টা করা হতো।
বাবা ভাঙ্গা যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই নস্ট্রাডামাসের করা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো অস্পষ্ট। তাই সেগুলোর অনেকরকম অর্থই দাঁড় করানো যায়।
যেমন, বাবা ভাঙ্গা বলেছিলেন- “ইস্পাতনির্মিত পাখিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর আমেরিকান ভ্রাতাদের পতন ঘটবে”।
এটিকে অনেকে টুইন টাওয়ার হামলার ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে গ্রহণ করতে চান। কিন্তু একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন তো… ধরুন, কয়েক দশক পর আমেরিকা ও এর মিত্র-দেশগুলোৎ সম্মিলিত শক্তিকে ছাড়িয়ে গেলো রাশিয়া ও চীন। দু’পক্ষের মধ্যে বেঁধে গেলো যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছে শত্রুপক্ষ। এমনি করে পরিসমাপ্তিও ঘটলো মার্কিন আধিপত্যবাদের।
এবার বলুন, এই পরিস্থিতির সাথেও কি আপনি ঐ একই ভবিষ্যদ্বাণীকে মেলাবেন না? খুব সম্ভবত বেশিরভাগ মানুষ তখন সেটিই করবে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্টের বিষয়ে বাবা ভাঙ্গা অনেক পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন বলে তার অনুসারীরা দাবি করেন। এটি সত্যিই মিলে গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিরা সাংবিধানিকভাবে সমানাধিকার পাওয়ার পর থেকে যেভাবে তাদের সামাজিক অংশগ্রহণ বেড়েছে, তাতে অনুমান করাটা খুব কঠিন ছিল না যে, একসময় অশেতাঙ্গ, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ কোনো ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতেই পারেন। অবশ্য একদম ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবেই এমন একজন ব্যক্তির সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করাটা একটু আশ্চর্যকরই বটে। তবে বাবা ভাঙ্গারই আরো কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে এই ভবিষ্যদ্বাণীটি স্ববিরোধী।
তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ ওবামাই হবেন শেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এ কথাটি ভুল। শুধু এখানেই শেষ নয়, বাবা ভাঙ্গা আরো বলেছেন, ২০১৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিরল রোগে আক্রান্ত হবেন।
৪৪তম প্রেসিডেন্ট যদি সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে থাকেন, তাহলে ২০১৯ সালে তো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টই থাকার কথা না! বারাক ওবামাও দুই মেয়াদের কোটা পূর্ণ করে ফেলেছিলেন, ফলে ২০১৯-এও তার প্রেসিডেন্ট থাকা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
যদিও অনেকেই ২০০৪ সালের বক্সিং ডে সুনামিকে বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণী করা সেই মহাপ্রলয়ের সাথে তুলনা করেন, কিন্তু তিনি তার সে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভাব্য দুর্যোগের দিনক্ষণ কিছুই উল্লেখ করেননি। তাই যেকোনো প্রলয়ংকারী দুর্যোগের সাথেই সেটিকে মেলানো যায়।
বাবা ভাঙ্গা ইউরোপের ভাগ্য সম্পর্কে অনেকটা বিস্তারিতভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তিনি একদম পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে উত্থান ঘটা ‘মুসলিম চরমপন্থি শক্তি’র দ্বারা ইউরোপে রাসায়নিক হামলার ঘটনা ঘটবে। তিনি যে এটিকেই ইউরোপের ‘পতন’ বলেছেন, তা ধরে নেওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। অনেকে যদিও এটিকে ব্রেক্সিটের সাথে তুলনা করেছেন, কিন্তু এর পক্ষে যুক্তি দুর্বল। কেননা, কেবলমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামক সংগঠন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ায় ইউরোপ মহাদেশের এমন কোনো ধ্বংসপ্রাপ্তিও হয়নি।
আবার খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাবা ভাঙ্গা ‘বৃহত্তম মুসলিম যুদ্ধের’ যে ধারণার কথা বলেছেন, তাতে মুসলিম শক্তির সাথে ইউরোপের সম্ভাব্য সংঘাতের কথা বলা হয়েছে। এখানেও দুইটি স্ববিরোধী ভবিষ্যদ্বাণী খেয়াল করা যায়।
প্রথমত, তিনি বলেছেন, ইউরোপে রাসায়নিক হামলার ফলে ইউরোপ ‘প্রাণশূন্য’ হয়ে পড়বে, অর্থাৎ প্রায় কোনো প্রকার প্রাণীই বেঁচে থাকবে না। যুদ্ধে খুব বড় পরিসরে রাসায়নিক অস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্র অথবা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে সেটি খুবই সম্ভব। সেক্ষেত্রে গোটা অঞ্চল পুরোপুরিই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, তিনিই আবার বলেছেন, মুসলিম শক্তি ইউরোপে হামলা করবে, তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকবে এবং অবশেষে সেখানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে ইউরোপে জীবনের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, সেখানে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধও চলতে থাকবে – এ দুটো বিষয় কি একইসাথে ঘটতে পারে? খুব সম্ভবত উত্তর হচ্ছে, ‘না’।
বলা হয়ে থাকে চীনের উত্থানের ব্যাপারেও বলে গেছেন বাবা ভাঙ্গা। কিন্তু যারা বিশ্বরাজনীতির সামান্য খবর হলেও রাখেন, তারা জানেন যে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো অনেক আগে থেকেই শঙ্কিত ছিল। সে আশঙ্কা এখন সত্যি বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
আরো বলা হয়, বাবা ভাঙ্গা পুতিনের উপর আততায়ী হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। একটু ভেবে বলুনতো, পৃথিবীর কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের উপর আততায়ী হামলার আশঙ্কা থাকে না? আর পুতিন যেখানে বিশ্বরাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড়, তার উপর এমন হামলার আশঙ্কা আরো বেশী। তদুপরি বাবা ভাঙ্গা কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের নাম উল্লেখ করেননি, তিনি সাধারণ অর্থে রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে বুঝিয়েছেন।
আর অনাগত ভবিষ্যতের বিষয়ে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো করে রেখেছেন, সেগুলো কতটা মিলবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই।
শেষকথা
বাবা ভাঙ্গা কী আসলেই একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, অথবা অতিশয় বুদ্ধিদীপ্ত একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টা, নাকি তিনি শুধুই কমিউনিস্টদের হাতের পুতুল- এসব নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু তিনি যে সত্যিই বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর বিভিন্ন পরিমণ্ডলে তিনি যে অনেক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিলেন, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তির আগমন থেকে এই কথার সত্যতাই প্রমাণিত হয়।
বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা এই মানুষটি স্তন-ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন; রেখে যান অসংখ্য ভক্ত-অনুসারী এবং অনেক অনেক রহস্য।