মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালা

ইরফান খানের ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ সিনেমার কথা মনে আছে? সেই সিনেমায় টিফিন-বক্সের ভুল ঠিকানায় চলে যাওয়ার কারণে গড়ে ওঠে সুন্দর এক সম্পর্ক। তবে আমাদের আলোচনা সেই সিনেমা নিয়ে নয় বরং তার ছোট্ট একটা অনুঘটক নিয়ে, লাঞ্চবক্স বা ডাব্বা নিয়ে; আরো নির্দিষ্ট করে বললে সেই ডাব্বা যারা পৌছে দেয় গন্তব্যে, সেই ডাব্বাওয়ালাদের নিয়ে।

লাঞ্চবক্স সিনেমার দৃশ্যে ইরফান খান; Image Source: IMBD

পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত শহর ভারতের মুম্বাই, যেখানে জীবিকার জন্য মানুষকে ছুটতে হয় উদয়াস্ত। যাত্রা করতে হয় লোকে লোকারণ্য লোকাল ট্রেনে, কাকডাকা ভোরে। যেখানে পা রেখে ভালোমত দাঁড়াবার জায়গা পর্যন্ত থাকে না, সেখানে হাতে টিফিনবক্স ঝুলিয়ে, সেটাকে সামলে কর্মস্থল পর্যন্ত আস্ত নিয়ে যাওয়া এক অসম্ভব কাজই বটে। আবার অত সকালে রান্নাবান্না সেরে খাবার প্রস্তুত করাও এক অগ্নিপরীক্ষা। তাহলে কি নিজগৃহে থেকেও প্রিয়জনের তৈরি সুস্বাদু খাবার দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারা হবে না? কীভাবে খাবার পৌঁছবে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে? সেই পৌঁছে দেওয়ার কাজই করেন ডাব্বাওয়ালারা। শুধুই পৌঁছে দেয়া, এর বেশি কিছুই নয়। বাড়ির খাবার আর কর্মস্থলের মাঝের যোগসূত্র স্থাপনই তাদের একমাত্র কাজ।

একসময় ডাব্বাওয়ালারা মুম্বাইয়ের পরিচায়ক ছিল; Image Source: Pinterest

সেই ১৮৯০ সালের কথা, ভারতবর্ষে তখনও রমরমা অবস্থা ব্রিটিশদের। তাদেরই প্রয়োজনে মুম্বাইয়ের অফিসগুলোতে বাড়িতে তৈরি খাবার পৌঁছে দেবার জন্য যাত্রা শুরু করে ডাব্বাওয়ালারা। ১০০ জন লোকবল নিয়ে কাজ শুরু করেন মহাদেব হাভাজি বাচ্চে। সেই ১০০ জন থেকে বেড়ে একসময় ডাব্বাওয়ালার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,৫০০-তে; যাদের মোট গ্রাহক ছিলেন প্রায় ২,৫০,০০০। এই ডাব্বাওয়ালাদের কল্যাণেই কর্মব্যস্ত দুপুরের মধ্যে মধ্যাহ্নভোজের ছোট্ট বিরতিতে মানুষ অনায়াসে বাসায় তৈরি খাবারের স্বাদ নিতে পারে।

মুম্বাইয়ের ১০০ বছরের ঐতিহ্য; Image Source: Four Seasons

তবে ডাব্বাওয়ালাদের বিশেষত্ব শুধু খাবার পৌঁছে দেয়াতে নয়, তাদের মূল দক্ষতার জায়গা হলো যে নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতার সাথে তারা তাদের কাজ করে। সিক্স সিগমা রেটিংয়ে তাদের নম্বর হলো ৯৯.৯৯৯৯। এর অর্থ তাদের ব্যর্থতার অনুপাত হলো প্রতি ষাট লাখে একবার! সেই ব্যর্থতা মানে কিন্তু আবার ভুল ঠিকানায় খাবার পৌঁছুনো নয়। এই ব্যর্থতা মানে হচ্ছে ঠিক সময়ে খাবার তার গন্তব্যে পৌঁছায়নি। ভাবা যায়! পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত শহরে কোনো আধুনিক যানবাহন ব্যবহার না করে, শুধু সাইকেল, ট্রেন আর পদব্রজে প্রতিদিন কাঁটায় কাঁটায়, বছরের পর বছর ধরে তারা সেই ডাব্বা বা লাঞ্চবক্স পৌঁছে দেবার কাজ করে আসছেন তা-ও খুবই নামমাত্র মূল্যে। যেখানে অর্ধেক দূরত্বে আধুনিক ফুড ডেলিভারি সার্ভিসগুলো নেয় ৬০ রূপি, সেখানে ডাব্বাওয়ালারা নেয় মাত্র ৫ রূপি! কীভাবে তারা এতদিন ধরে নিপুণ দক্ষতার সাথে, সময়মতো কাজ করে যাচ্ছে, তা-ও একদম শতভাগ পরিবেশসম্মত উপায়ে; যেখানে কিছু পরিমাণে ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ হলেই আধুনিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের সেবা/পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে, সেখানে কীভাবে পারছে তারা দশকের পর দশক ধরে নামমাত্র মূল্যে তাদের সেবা প্রদান করতে?

এর পেছনে রয়েছে খুবই চমৎকার একটি কাঠামো, যে কাঠামো ধরে পুরো মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালারা কাজ করে। কাঠামোটি আসলে খুবই সহজ, যার মূলে রয়েছে ‘টিম-ওয়ার্ক’। ডাব্বাওয়ালারা কখনো এককভাবে কাজ করে না, তারা কাজ করে একটি সম্পূর্ণ দল হিসেবে, এমনকি তাদের মধ্যে কোনো উঁচু-নিচু পদও নেই। তারা সবাই ডাব্বাওয়ালা, লাভের সমান অংশীদার। এ কারণেই তাদের এই ঈর্ষণীয় কর্মদক্ষতা। এত সংখ্যাক কর্মীর মধ্যে এমন নিষ্ঠা ও সমন্বয় শুধু ভারত কেন সম্পূর্ণ বিশ্বেই অদ্বিতীয়। তাদের নিয়ে তাই বিস্তর গবেষণা করেছে হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ডসহ নামি-দামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ফোর্বসের মতো সংস্থা।

নিখুঁত নিয়ম মেনে চলে প্রত্যেক ডাব্বাওয়ালা; Image Source: SAJJAD HUSSAIN/AFP/Getty Images)

ডাব্বাওয়ালারা তদের কাজ শুরু করে সকাল ৯টার দিকে। তারা প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনেন খাবারভর্তি ডাব্বাগুলো। প্রত্যেক ডাব্বাওয়ালার এলাকা নির্দিষ্ট করা থাকে, একজন ডাব্বাওয়ালা গড়ে ৪০-৫০টি ডাব্বা সংগ্রহ করেন। তারপরে সেগুলোকে নিজের ক্যারিয়ার লাগানো বাই-সাইকেলে চাপিয়ে প্যাডেলযোগে চলে যান নিকটস্থ রেল স্টেশনে। সেখানে অন্যান্য এলাকা থেকে আরো অনেক ডাব্বাওয়ালা এসে পৌঁছায়। তারপরে তারা সবগুলো ডাব্বা একত্র করে তাদের গন্তব্য অনুযায়ী ডাব্বার গায়ে থাকা ‘কালার কোড’ অনুযায়ী সাজায়। প্রথম ধাপে ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে আনা ডাব্বাগুলোকে অফিস অনুযায়ী সাজিয়ে একটি বিশেষ কাঠের পাটাতনে চাপিয়ে তুলে দেওয়া হয় সেই একই অফিস বা কাছাকাছি ভিন্ন ভিন্ন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাব্বাওয়ালার মাথায়। এবার একজন ডাব্বাওয়ালা গড়ে ৬০টি খাবারভর্তি টিফিনবক্স বহন করেন। একেকজন ডাব্বাওয়ালা তাদের গন্তব্যের ডাব্বাগুলো নিয়ে উঠে পড়েন লোকাল ট্রেনে, এটা হলো দ্বিতীয় ধাপ।

মাথায় খাবারের বোঝা নিয়ে রেল স্টেশনে এক ডাব্বাওয়ালা; Image Source: Satyaki Ghosh/BBC

নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর হয় আরেকদফা সর্টিং। এখানে আবার অফিস অনুযায়ী ডাব্বাগুলো ট্রলিতে সাজিয়ে ডাব্বাওয়ালারা ছুটে চলেন। রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, ফুটপাতে পথচারীর ভীড়- সবকিছু উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে থাকেন ডাব্বাওয়ালারা। দুপুর একটার আগেই, মানে লাঞ্চ আওয়ারের আগেই আড়াই লক্ষাধিক কর্মজীবীর কাছে পৌঁছে যায় ঘরে তৈরি সুস্বাদু খাবার। তবে শুধুমাত্র খাবার পৌঁছে দিয়েই কিন্তু ডাব্বাওয়ালাদের দায়িত্ব শেষ নয়। তারা আবার একই পদ্ধতিতে খালি ডাব্বাগুলো বিভিন্ন অফিস থেকে সংগ্রহ করে পৌঁছে দেন বাসা-বাড়িতে, ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা ৬টা ছোঁবার আগেই। এভাবেই সারাদিনে নিরন্তর ছুটে চলে সাদা সাফারি, মাথায় গান্ধী টুপি পরা ডাব্বাওয়ালারা অসংখ্য কর্মজীবীর রসনা পরিতৃপ্ত করতে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রাখেন।

ডাব্বাওয়ালার শূন্য ক্যারিয়ার কি আবার ভরে উঠবে লাঞ্চবক্স দিয়ে? Image Source: India Today

তবে সম্প্রতি ডাব্বাওয়ালারা খুবই সংকটে দিনাতিপাত করছেন। যথারীতি অন্য সকল পেশার মতো এই পেশাতেও কোভিড তার করাল থাবা চালিয়েছে। দুই দফায় সমগ্র ভারত লকডাউনের কারণে কার্যত সকল ডাব্বাওয়ালা কর্মহীন হয়ে পড়েন। যেখানে অফিস বন্ধ, সেখানে আর অফিসে খানা খাবে কে! তবে কোভিড ছেড়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ডাব্বাওয়ালারা তাদের জৌলুস পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। অনেকেই দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে অন্য কাজে নিয়োজিত হয়েছেন, কেউ কেউ চলে গিয়েছেন মুম্বাই ছেড়ে, তাদের আদি নিবাসে। ডাব্বাওয়ালারা তাদের পুরনো কাজে আবার স্বমহিমায় ফিরতে পারবেন কিনা তার উত্তর পাওয়া যাবে সময়ের সাথেই তবে, শতাধিক বছর ধরে তারা যে নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার সাথে মানুষের পাতে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন, তা নিশ্চয়ই কেউ ভুলবে না।   

This is an article about the Dabbawalas of Mumbai

Feature Image Credit: Paypal

References:
1. মুম্বাইয়ের ‘ডাব্বাওয়ালা’, যাঁদের কাছে হার মানে ঘড়ির কাঁটাও - The Wall
2. We are bringing Mumbai’s Dabbawalas to the mainstream economy - Paytm Bank
3. Dabbawalas: How India's 130-year-old food delivery system works - Global News
4. A Day In The Life Of Mumbai’s Dabbawalas - BQ Prime
5. Mumbai’s Models of Service Excellence - HBR
6. Mumbai Dabbawala – Since 1890 - mumbai7.com

Related Articles

Exit mobile version