[১ম পর্ব পড়ুন]
২০২১ সালে পশ্চিম এশিয়ার দুই শিয়া–অধ্যুষিত রাষ্ট্র ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ৩০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে কোনোভাবেই ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ হিসেবে অভিহিত করা চলে না। বরং ২০২১ সালে ইরানি ও আজারবাইজানি সরকারদ্বয় প্রথমবারের মতো সরাসরি একে অপরের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য প্রদান আরম্ভ করেছে এবং পাল্টাপাল্টি সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছে। এর মধ্য দিয়ে বিগত তিন দশক জুড়ে ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, সেটি প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
বস্তুত ১৯৯১ সালে আজারবাইজানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বিভিন্ন কারণে ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। কিন্তু উভয়পক্ষ এই দ্বন্দ্বকে যতদূর সম্ভব পর্দার অন্তরালে রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। বাকু ও তেহরানের এরকম নীতি অনুসরণের কারণ ছিল সহজবোধ্য: আজারবাইজান ছিল একটি সদ্য স্বাধীন ও তুলনামূলকভাবে দুর্বল রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী আর্মেনিয়া ও আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত আর্তসাখের সঙ্গে এক তিক্ত সংঘাতে লিপ্ত, অন্যদিকে ইরান মার্কিন–নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব, ইসরায়েল ও উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এমতাবস্থায় বাকু বা তেহরান কেউই নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে নিজেদের সমস্যার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে আগ্রহী ছিল না।
কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে ইরান প্রথমবারের মতো ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের নিকটে একটি বৃহৎ মাত্রার সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। ‘ফাতেহান–এ খায়বার’ নামক এই মহড়ার প্রথম ধাপ ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে এবং দ্বিতীয় ধাপ ১ অক্টোবরে আরম্ভ হয়। ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিট, ড্রোন, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার ইউনিট এবং আর্মি হেলিকপ্টার বহর উক্ত মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। তদুপরি, উক্ত মহড়া চলাকালে ইরানিরা বেশ কিছু নতুন সামরিক সরঞ্জাম পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে। ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কের ইতিহাসে এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা এবং স্বাভাবিকভাবেই আজারবাইজানি সরকার ইরানি মহড়াটির প্রতি নিজেদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কিন্তু ইরান কেন অকস্মাৎ এই মহড়ার আয়োজন করল?
প্রথমত, ২০২০ সালে দক্ষিণ ককেশাসের ভূরাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। এসময় পশ্চিম এশিয়ার আরেক উদীয়মান শক্তি তুরস্কের সক্রিয় সহায়তায় আজারবাইজান আর্মেনিয়া ও আর্তসাখকে যুদ্ধে পরাজিত করে এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটি দক্ষিণ ককেশাসের প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই বিজয়ের ফলে আজারবাইজানি সরকারের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইরানের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। এসময় বাকু ক্রমশ তাদের ইরানিবিরোধী অবস্থানকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে শুরু করে এবং স্বভাবতই তেহরানও বাকুর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে। ইরান কর্তৃক আয়োজিত উক্ত মহড়াকে এই প্রক্রিয়ার যৌক্তিক সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার মাত্রা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তুর্কি সামরিক বিশ্লেষক জান কাসাপোলুর ভাষ্যমতে, তুর্কি ও আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনীদ্বয়কে কার্যত ‘দুই রাষ্ট্র, এক সশস্ত্রবাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তুর্কি ও আজারবাইজানি সৈন্যরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তুর্কি ও আজারবাইজানি সৈন্যরা আজারবাইজানি ভূখণ্ডে এমন দুটি মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে, যেগুলোকে ইরান এতদঞ্চলে নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে।
২০২১ সালের ৬-১১ সেপ্টেম্বর তুর্কি ও আজারবাইজানি সৈন্যরা ২০২০ সালে আজারবাইজান কর্তৃক আর্তসাখের কাছ থেকে অধিকৃত লাচিন অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র মাত্রার যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। প্রায় একই সময়ে তুর্কি ও আজারবাইজানি নৌ কমান্ডোরা কাস্পিয়ান সাগরের আজারবাইজানি জলসীমায় একটি যৌথ নৌ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। দুটি মহড়াকেই, বিশেষত উক্ত নৌ মহড়াকে, ইরান নিজেদের জন্য পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত আজারবাইজানের লাচিন জেলা আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু যুদ্ধের পর এটি আজারবাইজানি নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে। লাচিন করিডোরের মাধ্যমে আর্তসাখ আর্মেনিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত, এবং বর্তমানে রুশ শান্তিরক্ষীরা উক্ত করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। ২০২০ সালের যুদ্ধের পর লাচিনে অনুষ্ঠিত যৌথ মহড়াটি ছিল উক্ত যুদ্ধে আজারবাইজান কর্তৃক অধিকৃত ভূখণ্ডে অনুষ্ঠিত প্রথম মহড়া, যেটিতে তুর্কি সৈন্যরা অংশ নিয়েছে। উক্ত মহড়াটি যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখান থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে রুশ শান্তিরক্ষীদের ঘাঁটি অবস্থিত। এই পরিস্থিতিতে সামরিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, উক্ত যৌথ মহড়ার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য নতুন কোনো সংঘাতের সময় দ্রুতগতিতে লাচিন করিডোর দখল করে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের মধ্যকার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া। ইরানের সঙ্গে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ইরান উক্ত মহড়াকে দক্ষিণ ককেশাসে তাদের স্বার্থের প্রতি পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে।
অন্যদিকে, ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদেহ সরাসরি কাস্পিয়ান সাগরে অনুষ্ঠিত তুর্কি–আজারবাইজানি মহড়ার নিন্দা জানান এবং একে ২০১৮ সালে সম্পাদিত ‘কনভেনশন অন দ্য লিগ্যাল স্ট্যাটাস অফ দ্য কাস্পিয়ান সি’র লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করেন। ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট কাজাখস্তানের আক্তাউয়ে কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী ৫টি রাষ্ট্র (রাশিয়া, ইরান, কাজাখস্তান, আজারবাইজান ও তুর্কমেনিস্তান) উক্ত কনভেনশনে স্বাক্ষর করে এবং উক্ত কনভেনশন অনুযায়ী কাস্পিয়ান সাগরে উক্ত ৫টি রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিষিদ্ধ। কিন্তু আজারবাইজানি সরকার এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করে যে, রুশ, কাজাখস্তানি, আজারবাইজানি ও তুর্কমেনিস্তানি আইনসভা উক্ত কনভেনশনটি অনুমোদন করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত ইরানি আইনসভা উক্ত কনভেনশন অনুমোদন করেনি এবং এজন্য কনভেনশনটি এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
আর্তসাখ ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সংযোগ বিলোপ এবং কাস্পিয়ান সাগরে বহিঃশক্তিদের সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের সম্ভাবনা – এগুলোর কোনোটিই ইরানের স্বার্থের জন্য অনুকূল নয়। এমতাবস্থায় ইরান কর্তৃক আয়োজিত উক্ত মহড়াটিকে ক্রমবর্ধমান তুর্কি–আজারবাইজানি সামরিক সহযোগিতা এবং আজারবাইজানে তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধির প্রতি ইরানি প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের পর আজারবাইজান, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা লাভ করেছে এবং বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন যে, বাকু, আঙ্কারা ও ইসলামাবাদের মধ্যে কার্যত একটি ‘কৌশলগত ত্রিভুজ’ (strategic triangle) বা ‘অনানুষ্ঠানিক আঁতাত’ (unofficial entente) গড়ে উঠছে। উল্লেখ্য, আজারবাইজান, তুরস্ক ও পাকিস্তান সকলেই ইরানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, কিন্তু কারো সঙ্গেই ইরানের সম্পর্ক বিশেষ সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। আজারবাইজান ও ইরানের মধ্যে শুরু থেকেই প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব চলে আসছে, পশ্চিম এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তুরস্ক ও ইরান পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে (যেমন: আফগান ও বালুচ সমস্যা এবং সৌদি–ইরানি প্রক্সি যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা) সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এমতাবস্থায় বাকু, আঙ্কারা ও ইসলামাবাদের মধ্যে কথিত ‘কৌশলগত ত্রিভুজ’ স্থাপনের প্রক্রিয়াকে ইরান তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করছে এবং একে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে।
তদুপরি, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের পর আজারবাইজান, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ্য ত্রিপক্ষীয় সামরিক সহযোগিতার মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র তিনটির স্পেশাল ফোর্স আজারবাইজানি ভূখণ্ডে ‘থ্রি ব্রাদার্স–২০২১’ নামক একটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে এবং এসময় আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিকমাত মির্জায়েভ খোলাখুলিভাবে ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজানি বিজয়ের পশ্চাতে তুর্কি ও পাকিস্তানি অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। ইরান কর্তৃক আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে আয়োজিত মহড়াকে উক্ত যৌথ মহড়ার এবং ক্রমবর্ধমান তুর্কি–পাকিস্তানি–আজারবাইজানি মৈত্রীর প্রত্যুত্তর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
চতুর্থত, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইরান আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং তুরস্ক ও আজারবাইজান কর্তৃক অবরুদ্ধ আর্মেনিয়ার (ও আজারবাইজানের অভ্যন্তরে অবস্থিত আর্তসাখের) জন্য ‘অর্থনৈতিক লাইফলাইন’ হিসেবে কাজ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে, নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্বে ইরান নিরপেক্ষ থেকেছে এবং আর্তসাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু আজারবাইজান বরাবরই এই দ্বন্দ্বে ইরানকে আর্মেনিয়ার প্রতি সমর্থন প্রদানের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের পর বাকুর এই মনোভাব আরো সুদৃঢ় হয়েছে।
আজারবাইজানি সরকার বরাবরই দাবি করে এসেছে যে, তারা আর্মেনিয়ার কোনো ভূখণ্ড দখল করতে আগ্রহী নয় এবং তারা কেবল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত (কিন্তু কার্যত আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত) আজারবাইজানি ভূখণ্ডগুলোর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। কিন্তু ২০২০ সালের যুদ্ধে বিজয় লাভের পর আজারবাইজানি সরকার আর্মেনীয় ভূখণ্ডের ওপর নিজেদের দাবির কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছে। আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ বেশ কয়েকবার মন্তব্য করেছেন যে, আর্মেনিয়ার ইয়েরেভান ও সিউনিক (আজারবাইজানিদের ভাষ্যমতে, ‘জাঙ্গেজুর’) অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে আজারবাইজানি ভূখণ্ড ছিল। তদুপরি, ২০২০ সালের ১০ নভেম্বরে সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী আর্মেনিয়া সিউনিক প্রদেশের মধ্য দিয়ে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড ও নাখচিভানের (আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র’) মধ্যে করিডোর প্রদান করতে সম্মত হয়েছে এবং প্রস্তাবিত এই করিডোরটি ‘সিউনিক করিডোর’ বা ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
কিন্তু আর্মেনীয় জনমত আজারবাইজানকে উক্ত করিডোর প্রদানের তীব্র বিরোধী এবং এজন্য আর্মেনীয় সরকার এখন পর্যন্ত এই করিডোর সৃষ্টির জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আজারবাইজান হুমকি প্রদান করেছে যে, চুক্তি মোতাবেক আর্মেনিয়া উক্ত করিডোর খুলে না দিলে আজারবাইজান বলপূর্বক উক্ত করিডোর দখল করে নেবে। এই বিষয়ে আর্মেনিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ২০২১ সালের মে মাসে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার সিউনিক ও গেঘারকুনিক প্রদেশের সীমান্তবর্তী কিছু ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে এবং এখন পর্যন্ত একে কেন্দ্র করে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘাত চলছে। উক্ত ঘটনাবলির ফলে ইরান নিজেদের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
ইরানি প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে, আজারবাইজান সিউনিক প্রদেশ দখল করে নিতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, সিউনিক প্রদেশের মাধ্যমে ইরান ও আর্মেনিয়া পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। ইরানি গবেষক ফারদিন এফতেখারির ভাষ্য অনুযায়ী, আজারবাইজান কেবল সিউনিকের মধ্য দিয়ে একটি করিডোর স্থাপন করেই সন্তুষ্ট হবে না, বরং তারা সমগ্র সিউনিক প্রদেশ দখল করে নিতে আগ্রহী। এর ফলে ইরান ভূরাজনৈতিকভাবে একটি অসুবিধাজনক অবস্থানের মুখোমুখি হবে। আজারবাইজান সিউনিক দখল করে নিলে ইরান ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে, দক্ষিণ ককেশাসের সঙ্গে ইরানের সংযোগপথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আর্মেনিয়ার পরিবর্তে শত্রু ইসরায়েল কর্তৃক সমর্থিত আজারবাইজান ইরানের দক্ষিণ ককেশাসে প্রবেশের একমাত্র পথে পরিণত হবে।
তদুপরি, ইরানি–মার্কিন গবেষক ও প্রাক্তন কূটনীতিক শিরিন হান্টারের ভাষ্যমতে, সিউনিক/জাঙ্গেজুর করিডোর সৃষ্টি বা আজারবাইজান কর্তৃক সিউনিক দখলের ফলে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে সরাসরি স্থল সংযোগ স্থাপিত হবে এবং তুরস্ক আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে মধ্য এশীয় ‘বৃহত্তর তুর্কি’ রাষ্ট্রগুলো ও বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত উত্তর–পশ্চিম ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। এর ফলে একদিকে দক্ষিণ ককেশাসে ইরানের প্রবেশপথ ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে, অন্যদিকে মধ্য এশিয়া ও খোদ ইরানের বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে তুরস্ক সরাসরি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। ইতিপূর্বে তুরস্ককে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য ইরানি ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হতো এবং এজন্য ইরান তুরস্কের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শুল্ক আদায় করতে পারত ও উক্ত পথ ব্যবহার করে তুরস্কের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারত। তুরস্ক আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ পেলে ইরান এই ভূরাজনৈতিক ও ভূ–অর্থনৈতিক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হবে।
তদুপরি, তুরস্ক আজারবাইজানি ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ইরানি আজারবাইজানের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারলে এতদঞ্চলে তুর্কি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে এবং তুরস্ক এতদঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্তার ঘটাতে ও এর মাধ্যমে ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। এটি ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি। এজন্য ইরান সিউনিক/জাঙ্গেজুর করিডোর সৃষ্টির সম্ভাবনাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং আজারবাইজান কর্তৃক সিউনিক দখলের সম্ভাবনার তীব্র বিরোধিতা করছে। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর রাশিয়া সফরকালে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির–আব্দোল্লাহিয়ান মস্কোয় একটি সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন, ইরান দক্ষিণ ককেশাসে কোনো ভূরাজনৈতিক বা মানচিত্রগত পরিবর্তন সহ্য করবে না। এই প্রেক্ষাপটে ইরান কর্তৃক আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে আয়োজিত সাম্প্রতিক মহড়াকে আজারবাইজানের প্রতি ইরানি সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
পঞ্চমত, ইরান কর্তৃক আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে আয়োজিত মহড়ার আনুষ্ঠানিক কারণ ছিল আজারবাইজান ও ইসরায়েলের মধ্যেকার ঘনিষ্ঠ সামরিক–রাজনৈতিক মৈত্রী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে আজারবাইজান ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আর্মেনীয় লবির বিস্তৃত প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে মার্কিন ইহুদি লবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করেছে। ইসরায়েলের জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৪০% আজারবাইজান সরবরাহ করে থাকে এবং আজারবাইজান ইসরায়েলের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয় করে। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আজারবাইজান ইসরায়েলের কাছ থেকে অন্তত ৮২ কোটি ৫০ লক্ষ (বা ৮২৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র ক্রয় করেছে। বস্তুত আজারবাইজান বর্তমানে ইসরায়েলি সামরিক সরঞ্জামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার এবং ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজানি বিজয়ের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি–নির্মিত ‘আইএআই হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তদুপরি, ইরানিরা ইসরায়েলি–আজারবাইজানি মৈত্রীকে ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। আজারবাইজানি সরকার ইসরায়েলকে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে অবস্থিত একটি সোভিয়েত–নির্মিত বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেছে বলে ধারণা করা হয় এবং ইরানের ওপর নজরদারির উদ্দেশ্যে ইসরায়েল ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের আজারবাইজানি অংশে লিসনিং পোস্ট স্থাপন করেছে বলেও বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম উল্লেখ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল ইরানি পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য আজারবাইজানি ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে। তদুপরি, ২০১৮ সালে ইসরায়েলি গুপ্তচররা ইরানের পারমাণবিক আর্কাইভ চুরি করে এবং এই অভিযান পরিচালনার জন্য তারা আজারবাইজানি ভূখণ্ড ব্যবহার করেছে বলে ধারণা করা হয়।
বস্তুত সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আজারবাইজানকে ‘ইসরায়েলি লেবানন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তাদের মতে, ইরান যেভাবে ইসরায়েলের ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী লেবাননে শিয়া সংগঠন ‘হিজবুল্লাহ’কে অস্ত্রসজ্জিত করছে এবং সংগঠনটিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিজেদের ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহার করছে, সেভাবে ইসরায়েল ইরানের ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী আজারবাইজানকে অস্ত্রসজ্জিত করছে এবং তারা ইরানের বিরুদ্ধে আজারবাইজানকে নিজেদের ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। তদুপরি, ইরানি সরকার আশঙ্কা করছে যে, ইসরায়েল আজারবাইজানের মাধ্যমে ইরানি আজারবাইজানে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দিতে পারে এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে উত্তর–পশ্চিম ইরানে বিদ্রোহের সৃষ্টি করতে পারে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের উক্তি ‘ইরানকে হাজার আঘাতের মাধ্যমে খুন করা উচিত’– এক্ষেত্রে বিশেষ ইঙ্গিতবহ।
এমতাবস্থায় ইরান ক্রমবর্ধমান ইসরায়েলি–আজারবাইজানি মৈত্রী নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং প্রচ্ছন্ন মার্কিন সমর্থনে তুর্কি–ইসরায়েলি–আজারবাইজানি অক্ষ কর্তৃক ইরানি আজারবাইজানে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্তার ঘটানোর সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইরানি সরকার এটিকে তাদের এই মহড়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির–আব্দোল্লাহিয়ান এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ককেশাসে ইসরায়েলি উপস্থিতি ইরানের জন্য উদ্বেগজনক এবং ইরান এতদঞ্চলে ‘জায়নবাদী ও সন্ত্রাসবাদী’দের উপস্থিতি সহ্য করবে না।
ষষ্ঠত, ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘জায়নবাদী’দের উপস্থিতি বলতে ককেশাস অঞ্চলে ইসরায়েলি উপস্থিতিকে বুঝিয়েছেন, কিন্তু এতদঞ্চলে ‘সন্ত্রাসবাদী’দের উপস্থিতি সংক্রান্ত তার মন্তব্যের অংশটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। রুশ ও আর্মেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় আজারবাইজানকে সহায়তা করার জন্য, তাদের লোকবল বৃদ্ধি করার জন্য এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করার জন্য তুরস্ক হাজার হাজার তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় মার্সেনারিকে আজারবাইজানে স্থানান্তর করেছিল। যুদ্ধের পর আজারবাইজান থেকে উক্ত মার্সেনারিদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে কিনা, এই প্রসঙ্গে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, উক্ত মার্সেনারিরা সিরিয়ায় তুর্কি–অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে সক্রিয় বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপের সদস্য এবং সিরীয় যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানি সৈন্য ও ইরানি–নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়ারা (সিরিয়া ও রাশিয়ার পাশাপাশি) উক্ত মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ইরান এই মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে বিবেচনা করে।
ইরানি সীমান্তের দোরগোড়ায় উক্ত তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত মিলিট্যান্টদের উপস্থিতি ইরানের মোটেই পছন্দনীয় নয় এবং উক্ত মিলিট্যান্ট/মার্সেনারিরা যে তুর্কিদের নির্দেশে বা নিজেদের উদ্যোগে ইরানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করবে না বা করার চেষ্টা করবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বস্তুত ইরানের বিরুদ্ধে চলমান প্রক্সি যুদ্ধে উক্ত মিলিট্যান্ট/মার্সেনারিরা বাকু ও আঙ্কারার একটি ‘সস্তা কিন্তু কার্যকর’ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। ইরানি সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, অনুরূপ হুমকি থেকে ইরানি ভূখণ্ডকে রক্ষা করা আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে আয়োজিত ইরানি মহড়ার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
সর্বোপরি, ইরান কর্তৃক উক্ত মহড়া আয়োজনের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল আজারবাইজান কর্তৃক দুজন ইরানি ট্রাকচালককে গ্রেপ্তার। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর মাধ্যমে ইরান সরাসরি আর্তসাখের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারত এবং রাশিয়া ও ট্রান্সককেশিয়ার অন্যান্য অংশের বাজারে প্রবেশ করতে পারত। কিন্তু ২০২০ সালের যুদ্ধের সময় আজারবাইজানি সৈন্যরা ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং এর ফলে ইরান ও আর্তসাখের মধ্যকার উক্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আজারবাইজানি সৈন্যরা উক্ত অঞ্চলে নিজেদের চেকপোস্ট স্থাপন করে এবং উক্ত অঞ্চল দিয়ে আর্তসাখে যাতায়াতকারী ইরানি ট্রাকগুলোর কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতে শুরু করে। ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানি সীমান্তরক্ষীরা দুজন ইরানি ট্রাকচালককে ‘অবৈধভাবে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে প্রবেশে’র দায়ে গ্রেপ্তার করে।
এরপর আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ তুর্কি রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, বহু আগে থেকে ইরানি ট্রাকবহর অবৈধভাবে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে প্রবেশ করে আসছে এবং ২০২১ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ৬০টি ইরানি ট্রাক অবৈধভাবে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। বস্তুত ইরানি ট্রাকচালকদের গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে আজারবাইজান ইরানকে এই বার্তা প্রদান করে যে, তারা ইরানি–আর্তসাখ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করতে আগ্রহী এবং এর মধ্য দিয়ে আর্তসাখকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে রাখতে ইচ্ছুক। ২০২০ সালের যুদ্ধে পরাজয় ও অন্যান্য কারণে আর্তসাখের আর্থ–সামাজিক অবস্থা ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, এবং এমতাবস্থায় আর্তসাখের সঙ্গে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল প্রজাতন্ত্রটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে বলে আজারবাইজানি সরকার বিবেচনা করছে। বর্তমানে রুশ শান্তিরক্ষীরা আর্তসাখের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে এবং এজন্য সামরিক শক্তিবলে আর্তসাখ দখল করা আজারবাইজানের পক্ষে সম্ভব নয়, এজন্য আর্তসাখের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বাকু প্রজাতন্ত্রটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে।
আর্তসাখের সঙ্গে ইরানের বাণিজ্যিক সম্পর্কে ব্যাঘাত, আর্তসাখের মাধ্যমে রাশিয়া ও ট্রান্সককেশিয়ায় ইরানি প্রবেশপথ রুদ্ধ হওয়া এবং এসবের মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলে ইরানি ভূরাজনৈতিক প্রভাব সঙ্কুচিত হওয়া– এগুলোকে স্বাভাবিকভাবেই ইরান ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেনি। এই প্রসঙ্গে ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খাতিবজাদেহ মন্তব্য করেন যে, আজারবাইজানের উচিত ইরানি নাগরিকদের সঙ্গে আরো সম্মানজনক আচরণ করা। বস্তুত আজারবাইজান কর্তৃক ইরানি ট্রাকচালকদের গ্রেপ্তার এবং ইরান ও আর্তসাখের মধ্যবর্তী বাণিজ্যিক সম্পর্কে বিঘ্ন ঘটানো ছিল ইরান কর্তৃক ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে বিস্তৃত সামরিক মহড়া আয়োজনের তাৎক্ষণিক কারণ।
উক্ত মহড়া শুরুর পর ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং উভয় রাষ্ট্র একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য প্রদান করতে শুরু করে ও বিভিন্ন শত্রুতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অবশ্য পরবর্তীতে উভয় পক্ষই এই দ্বন্দ্বের মাত্রা প্রশমনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু কার্যত এখনো এই দ্বন্দ্ব স্তিমিত হয়নি। এই নিবন্ধের পরবর্তী পর্বে ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের সাম্প্রতিক দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করা হবে।