এই বছরের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর জানা হয়ে গেছে। কী বিষয়ে পেল, তা সম্পর্কেও সকলের কম-বেশি ধারণা তো আছেই। আর অর্থনীতিতে যাদের বেশ আগ্রহ, তারা তো এ বিষয়ে একটু আধটু তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করে ফেলেছে। এবারের গবেষণার বিষয় এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা আমাদের জন্য একটু আলাদাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ বছর অর্থনীতিতে নোবেলজয়ীরা হলেন- অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি, এস্থার ডুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো- পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিজিৎ একজন বাঙালি। অমর্ত্য সেনের পর অর্থনীতিতে আবার ইতিহাস রচনা করলেন একজন বাঙালি, যা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। আরেক নোবেলজয়ী এস্থার ডুফলো হলেন অর্থনীতিতে নোবেলপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ বিজয়ী এবং গত ৫০ বছরে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত দ্বিতীয় নারী। তাদের গবেষণার বিষয় ছিল- বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ করা। দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সসের মতে তাদের গবেষণা বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র দুই দশকেই তারা তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সাড়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের একটি বিষয়, যা গবেষণার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। তারা দারিদ্র্যের সমস্যার পাশাপাশি সমাধান নিয়েও কাজ করেছেন। তাদের গবেষণা ও তথ্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে সারাবিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে শতকরা ২১.৮ ভাগ (২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে) মানুষ দরিদ্র, সে দেশে এরকম গবেষণার মূল কৌশল সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তা অবশ্যই আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
এই গবেষণার একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং নোবেলজয়ী এস্থার ডুফ্লোকে নিয়েই আজকের এই লেখা।
এস্থার ডুফ্লো ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর)-এর একজন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং দ্য ব্যুরো ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যানালাইসিস অব ডেভেলপমেন্ট (বিআরইএডি)-এর একজন বোর্ড মেম্বার। তাছাড়া ‘দ্য সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চস ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস’ প্রোগ্রামের পরিচালক। তার গবেষণার বিষয়গুলো মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাইক্রোইকোনমিক বিষয়ভিত্তিক। এর মধ্যে রয়েছে- দারিদ্র্য, শিক্ষা, নীতি মূল্যায়ন, হাউজহোল্ড বিহেভিয়ার এবং অ্যাক্সেস ট্যু ফিনান্স। তার লেখা বই, জার্নাল কিংবা যেসব রিসার্চ পেপারে তিনি কাজ করেছেন, সেগুলোও এসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই সম্পাদন করা হয়েছে৷
এস্থার ডুফ্লো একাধারে আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউয়ের সম্পাদক, ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের একজন সদস্য এবং তিনি ব্রিটিশ একাডেমিতেও কর্মরত আছেন। তিনি অভিজিৎ ব্যানার্জি, ডিন কার্লান, ক্রেমার, জন এ. লিস্ট এবং সেনধিল মুলাইনাথানের সাথে কাজ করছেন যেন অর্থনীতিতে সাধারণ সম্পর্ক ও বিহেভিয়ার ব্যাখা করা যায়৷ পাশাপাশি ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টে একটি ‘ড্রাইভিং ফোর্স’ তথা চালক শক্তি উন্নত করার চেষ্টা করছেন। অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং এস্থার ডুফ্লোর ‘গুড ইকোনমিকস ফর হার্ড টাইমস’ এ বছরের নভেম্বর মাসেই প্রকাশ হওয়ার কথা।
অনুপ্রেরণা
ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের মতো বিষয় ২০০০ সালের আগে অর্থনীতির কোনো আলোচ্য বিষয়ই ছিলো না। অর্থাৎ বিষয়টির বয়স খুব কম। আর এরকম একটি বিষয়ের জন্য দু’দশক শেষ হতে না হতেই নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা সহজ কোনো কথা নয়। তথ্য-উপাত্তের অভাব এবং এই বিষয়টি নতুন হওয়ায় অনেকটাই গোড়া থেকেই কাজ শুরু করতে হয়েছে। ডুফ্লো আশা করেন যে, নোবেল পুরস্কারের কারণে বিষয়টি সকলের নিকট সমাদৃত হবে। তাছাড়া নারীরাও এই সেক্টরে আসতে অনুপ্রাণিত হবে। অর্থনীতি বা গবেষণার কাজে প্রায়ই পুরুষদেরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার মনে নারীদের অংশগ্রহণ এ ধরনের অসমতা কমাবে। ডুফ্লো কলেজে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতেন। তবে অর্থনীতির দিকে তিনি ঝুঁকতে শুরু করলেন যখন তিনি তার মায়ের কাছ থেকে বৈশ্বিক অসমতার গল্পগুলো জানতে পারলেন। ডুফ্লোর মা ছিলেন একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। কর্মসূত্রে তার মাদাগাস্কার, এল সালভাদর এবং রুয়ান্ডায় যাওয়ার সুযোগ হয়। আর এসব জায়গার অসমতা ও বৈষম্য তিনি তার মেয়ে ডুফ্লোকে প্রায়ই বলতেন। ডুফ্লোর তখন থেকেই এই ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আর তিনি সেই পথ খুঁজে বের করার জন্য ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তার প্রচলিত ইকোনমিকস বা অর্থনীতির মতো বিষয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না।
ডুফ্লোর বক্তব্য অনুসারে,
“আমি অর্থনীতিতে পড়তে তখনই আসি, যখন আমি জানতে পারি যে ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস বলে কিছু আছে। তবে আমার ম্যাক্রো পড়ার ইচ্ছা ছিল না। ফাইন্যান্স পড়ারও ইচ্ছা ছিল না”।
উল্লেখ্য যে, সাধারণত ইকোনমিকস বা অর্থনীতির মতো বিষয়ে পড়তে হলে ম্যাক্রো ইকোনমিকস, ফাইন্যান্সের মতো কোর্স করতে হয়। তবে এগুলো পড়ার ইচ্ছা ডুফ্লোর ছিল না।
ডুফ্লোকে অর্থনীতির এই ক্ষেত্রে আসতে অনুপ্রাণিত করে বিশ্বের পরিস্থিতি এবং তার মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো। ডুফ্লো চান, অন্তত তাকে দেখে নারীরা যেন এই ক্ষেত্রগুলোতে আরো বেশি অংশগ্রহণ করুক। যেমনটা আগেই বললাম, তার মতে- নারীদের অংশগ্রহণ এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অর্থনীতি বা এ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণায় নারীদের প্রায়ই অবমূল্যায়ন করা হয়। যদি নারীরা এ ক্ষেত্রে আসে, তাহলে তারা নিজেদের অবস্থান ঠিকমতো তুলে ধরতে পারবেন। ডুফ্লো আশা করছেন যে অন্তত এই নোবেলের কারণে ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
পুরস্কার ও গবেষণা
ডুফ্লো বেশ কিছু একাডেমিক পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন। যেমন- দ্য প্রিন্সেস অভ অসচুয়ারিয়াস অ্যাওয়ার্ড ফর সোস্যাল সায়েন্সেস (২০১৫), দ্য এ.এসকে সোস্যাল সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড (২০১৫), ইনফোসিস প্রাইজ (২০১৪), দ্য ডেভিড এন. কারশো অ্যাওয়ার্ড (২০১১), এ জন বেটস ক্লার্ক মেডেল (২০১০) এবং এ ম্যাকারথর ‘জিনিয়াস গ্র্যান্ট’ ফেলোশিপ (২০০৯)। ডুফ্লো ২০০৩ সালে ‘বেস্ট ইয়াং ফ্রেঞ্চ ইকোনমিস্ট’ প্রাইজের জন্য মনোনীত হন এবং ২০০৫ সালে তিনি এই প্রাইজটি জিতে নেন।
অভিজিৎ ব্যানার্জির সাথে তিনি ‘প্যুর ইকোনমিকস: এ র্যাডিক্যাল রিথিংকিং অব দ্য ওয়ে ট্যু ফাইট গ্লোবাল পোভার্টি’ নামক বইটি লেখেন। এটি ২০১১ সালে ফিনানশিয়াল টাইমস ও গোল্ডম্যান সাচ বিজনেস বুক অভ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড পায়। এই বইটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। যেমন- ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ, ডাচ, জার্মান, ক্যান্টোনিজসহ মোট ১৭টি ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়। তার লেখা আরো তিনটি বই হলো- ‘ল্যু ডেভলপমো ত্যুমা’ (লুত্যেখ কন্তখ লে প্যভখ্যাত, ভলিউম-১) (২০১০), ‘লা পলিক দ্যো লোতোনোমি’ (লুত্যেখ কন্তখ লে প্যভখ্যাত, ভলিউম-২) (২০১০), এক্সপেখিয়স স সে ল্যুত কন্তখ লা প্যভখ্যাত (২০০৯)।
প্যুর ইকোনমিকস- আ র্যাডিক্যাল রিথিংকিং অভ দ্য ওয়ে ট্যু ফাইট গ্লোবাল পোভার্টি
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি এবং এস্থার ডুফ্লো পাঁচটি মহাদেশের বিভিন্ন দেশের দরিদ্র মানুষদের নিয়ে কাজ করেছে। আর তাদের বই, ‘প্যুর ইকোনমিকস- আ রেডিক্যাল রিথিংকিং অভ দ্য ওয়ে ট্যু ফাইট গ্লোবাল পোভার্টি’-তে তাদের এসব গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। এই বইটি শুধু দারিদ্র্যের সমস্যাগুলো নিয়েই নয়, বরং এর যৌক্তিক ও ব্যবহারযোগ্য সমাধানের উপরও জোর দিয়েছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তাদের ল্যাব, আব্দুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
ডুফ্লো ও অভিজিৎ দেখান যে সমান যোগ্যতা ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের জীবনমান আলাদা হয়। কিছু আশ্চর্যজনক বিষয়, যেমন- একদিনে ৯৯ পয়সার কমে কীভাবে কোনো মানুষ বেঁচে থাকে; কিংবা মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্ররা কেন নেশা জাতীয় দ্রব্য বা এমন কোনো কিছুর পেছনে পড়ে থাকে, যা তাদের কোনো দরকার নেই- ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন। প্যুর ইকোনমিকসে জোর দিয়ে বলা হয় যে, দারিদ্র্য না কমার পেছনে কারণ হলো ঠিকমতো বিশ্লেষণ ও গবেষণা না করে দারিদ্র্য দূরীকরণের পলিসি বানানো। ডুফ্লো ও অভিজিতের মতে, দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়া অবশ্যই অত্যন্ত যত্নসহকারে ও সুষ্ঠুভাবে গবেষণার পর করা লাগবে।
ডুফ্লো ও অভিজিৎ সমাজে পরিবর্তন আনার প্রেক্ষিতে গবেষণাটির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর ডুফ্লো যে তার কাজের মাধ্যমে নারীদেরকে অনুপ্রাণিত করছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) নোবেল ভাষণ, এলিয়ট থেকে গুন্টার গ্রাস
২) নোবেল ভাষণ : লাগের্লোফ্ থেকে য়োসা