গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের ধারণা: দেশের নামে ‘প্রজাতন্ত্র’ যুক্ত করা হয় কেন?

দ্য পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না (গণপ্রজাতন্ত্রী চীন), দ্য পিপল’স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, দ্য ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকা, কিংবা গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত- নামগুলো শুনে যে কারো মনে হতে পারে- প্রজাতন্ত্র আসলে কী? ইউনাইটেড স্টেটস একটি প্রকৃত প্রজাতন্ত্র এটা মেনে নেয়া যেমন সহজ, তেমনই বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে- চীন কি আসলেই একটি রিপাবলিক? বাংলাদেশ ও ভারত কি একইসাথে একটি গণতন্ত্র আবার প্রজাতন্ত্র হতে পারে? 

গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট পার্থক্য। আবার, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও একনায়কতান্ত্রিক দেশ উত্তর কোরিয়ার অফিসিয়াল নাম গণতান্ত্রিক 'গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া' (উত্তর কোরিয়া)। এটা সত্যিই কি প্রজাতন্ত্র?

গণতন্ত্র

সাধারণত গণতন্ত্র বলতে জনগণের দ্বারা শাসিত সরকারকে বোঝায়। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স থেকে শুরু হয়ে বর্তমান বিশ্বের মানুষের আলোচনা, জল্পনা-কল্পনায় সবচেয়ে সমাদৃত বিষয় গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের সূচনা প্রাচীন গ্রীসে। গ্রীক ‘ডেমোক্র্যাটিয়া’ থেকে উৎপত্তি, যার অর্থ জনতার বা জনগণের শাসন। তবে গ্রীসে তখন সবার অংশগ্রহণ ছিল না। 

৫ম শতাব্দী পর্যন্ত গণতন্ত্র বলতে গ্রীক নগররাজ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝানো হতো। এথেনীয় গণতন্ত্রে কিছু অসাধু লোক নাগরিকদের সমর্থন আদায়ের জন্য বক্তৃতাকৌশল এবং চাটুকারিতা ব্যবহার করে। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিস প্রায়ই এথেনীয় গণতন্ত্রের সমালোচনা করতেন। আধুনিককালের গণতন্ত্র এবং এথেনীয় গণতন্ত্রের মাঝে বিস্তর‍ ফারাক রয়েছে।
গণতন্ত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের উপর ন্যস্ত করা হয়; image source: ThoughtCo
গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক সরকারব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের উপর ন্যস্ত করা হয়, এবং একটি অবাধ নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে তাদের বা তাদের নির্বাচিত এজেন্টদের দ্বারা সরাসরি শাসনকার্য পরিচালিত হয়, সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এথেন্সকে প্রথম গণতন্ত্র বলা হয়, কারণ সেখানে ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল জনগণের উপর, এবং তারাই সিদ্ধান্ত নিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিফেন লিককের ভাষায়, “গণতন্ত্র মানে রাষ্ট্রের জনগণের হাতে সমস্ত সর্বোচ্চ (সার্বভৌমত্ব) ক্ষমতা দেওয়া।” আমেরিকার ষোড়শ রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ ভাষণে গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন করেন এভাবে, “গণতন্ত্র হলো জনগণের, জনগণের দ্বারা, এবং জনগণের জন্য সরকার।

ভিন্ন অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন। তবে মূল বিষয় হচ্ছে- গণতন্ত্রে শাসনকার্যের যেকোনো সিদ্ধান্ত আসবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ থেকে। এখানে সিদ্ধান্ত আসতে পারে সরাসরি জনগণের কাছ থেকে, আবার জনগণের প্রতিনিধি থেকেও। সরাসরি জনগণের থেকে গণভোট বা অন্য উপায়ে সিদ্ধান্ত নেয়াকে প্রত্যক্ষ (ডিরেক্ট) গণতন্ত্র বলে। আবার, জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়াকে বলা হয় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র।

প্রজাতন্ত্র

প্রজাতন্ত্র হলো এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র শাসিত হয় নাগরিকের প্রতিনিধিদের দ্বারা। অনেকটা প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের মতো শোনাচ্ছে? প্রজাতন্ত্রের সাথে অলিগার্কি, আভিজাততন্ত্র, এবং রাজতন্ত্রের পার্থক্য হচ্ছে- এসব ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধান হন বংশগতভাবে বা ভিন্নভাবে, প্রজাতন্ত্রে তা হন না। প্রজাতন্ত্রে মূলত সরকারের (বা রাষ্ট্র) নেতা বা প্রধান বংশানুক্রমিক রাজা নয়, বরং একজন রাষ্ট্রপতি যিনি নির্বাচিত বা প্রতিষ্ঠিত। প্রজাতন্ত্রের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন নির্বাচিত ও তাদের নিকট দায়বদ্ধ। 
প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্র শাসিত হয় নাগরিকের প্রতিনিধিদের দ্বারা; Image source: Google cite
প্রজাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে। রোমান সাম্রাজ্য ছিল প্রথম প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্র শব্দটি মূলত ল্যাটিন শব্দ 'রিপাবলিকা' থেকে উৎপন্ন যার অর্থ 'পাবলিক থিংস' বা 'জনগণের বিষয়'। যার মানে একটি রাষ্ট্র রাজা বা স্বৈরাচারী শাসকের দ্বারা শাসিত না হয়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে শাসিত হবে, সরকারের প্রধান হবেন নির্বাচিত বা প্রতিষ্ঠিত। চার শতাব্দী ধরে রোমান সাম্রাজ্যে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু জুলিয়াস সিজারের উত্থান রোমান প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটায়। প্রজাতন্ত্রে ক্ষমতা কোনো একক ব্যক্তির হাতে থাকবে না, যেমনটা থাকে স্বৈরতন্ত্রে। সিজারের হাতে সকল ক্ষমতা নিয়ে নেয়া পতন ঘটায় রোমান প্রজাতন্ত্রের।

গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মূল পার্থক্য

গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। গণতন্ত্রে ক্ষমতা থাকে সরাসরি জনগণের হাতে। অন্যদিকে, প্রজাতন্ত্রে ক্ষমতা থাকে পৃথক নাগরিকদের হাতে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হতেও পারেন আবার না-ও পারেন। কিন্তু একটি প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপ্রধানকে নির্বাচিত হতে হবে। গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে। প্রজাতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা। 
প্রজাতন্ত্রে বংশানুক্রমিক রাষ্ট্রপ্রধান নয়, বরং নির্বাচিত প্রধান থাকেন; Image source: Cilpart Liberty
গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছা বা জনমত অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়, যেখানে প্রজাতন্ত্রে তা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। অর্থাৎ, গণতন্ত্রে জনমত চাইলে কোনো বিষয়ে তাদের অধিকার পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রে সংবিধানের দেয়া অধিকারকে জনমত ছাড়িয়ে যেতে পারে না। ব্রিটেন একটি গণতন্ত্র হলেও প্রজাতন্ত্র না। কারণ প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রের প্রধানকে অবশ্যই নির্বাচিত হতে হয়। তেমনি চীন গণতান্ত্রিক না হলেও প্রজাতন্ত্র, কারণ দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত।

কোনো দেশ একইসাথে প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র হতে পারে?

গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মূল বিষয়ে তেমন পার্থক্য নেই বললেই চলে। বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই গণতন্ত্র। একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা মূলত জনগণের উপর ন্যস্ত। জনগণ তাদের শাসক নির্বাচন করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান যিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, তিনি অবশ্যই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি না-ও হতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধান কোনো কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত, আবার কোথাও বংশানুক্রমিকভাবে আসেন। যদি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন, তাহলে বলাই যায় দেশটি একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক দেশ। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রজাতন্ত্র, আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; Image source: Civic Nebrasaka
উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূলত রিপ্রেজেন্টেটিভ ডেমোক্রেসি বা প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত; যেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত, সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি, যিনি ইলেক্টোরাল কলেজের দ্বারা নির্বাচিত। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রজাতন্ত্র, আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

চীন, উত্তর কোরিয়া, ও ভারত

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশ চীনের রাষ্ট্রীয় নাম 'গণপ্রজাতন্ত্রী চীন'। আবার কিম জং-উনের একনায়তান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার নামের সাথে যুক্ত আছে প্রজাতন্ত্র। রাষ্ট্রগুলো কি আসলেই প্রজাতন্ত্র?
উত্তর কোরিয়াতে প্রত্যেক নাগরিক ভোট দেন, তবে একজন প্রার্থীকে, অর্থাৎ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন রাষ্ট্রপ্রধান। প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন- এই নীতি অনুযায়ী উত্তর কোরিয়াকে বলা যায় একটি প্রজাতন্ত্র। বাস্তবিকভাবে একজন প্রার্থীকে ভোট দেয়া কতটা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া তা সবার জানা। একদলের শাসনের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন চীনের পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি)’ দ্বারা। পার্লামেন্টের থাকে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্বাচনের পাশাপাশি অপসারণেরও ক্ষমতা। এনপিসির বিধিবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি মনোনীত হন এনপিসি প্রেসিডিয়াম দ্বারা। চীনের রাষ্ট্রপতি যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান, সুতরাং চীন একটি প্রজাতন্ত্র। ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্রের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করে যারা দেশ পরিচালনা করেন। ভারতের রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী এটি একটি প্রজাতন্ত্র।
প্রকৃত প্রজাতন্ত্রে সবকিছুর উর্ধ্বে রাষ্ট্রের নাগরিক; Image source: People | HowStuffWorks
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন- একটি রাষ্ট্র তখনই প্রজাতান্ত্রিক যখন রাষ্ট্রটি সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দেয় জনগণকে। এখানে পার্থক্য করার বিষয় হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের ভিত্তিতে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। ওদিকে, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলবে সংবিধান অনুযায়ী, কিন্তু জনগণকে সবকিছুতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। যদি কোনো সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র কাকে গুরুত্ব দেবে, তখন অবশ্যই জনগণকে গুরুত্ব দিতে হবে প্রজাতন্ত্রে। সেজন্য এই ধারার চিন্তকরা ভারকে প্রজাতন্ত্র বলতে অনাগ্রহী, যেখানে কাশ্মীরের উপর নিয়মিত সামরিক শাসন কায়েম করা আছে। 
রাষ্ট্রের প্রধান বিভিন্ন উপায়ে নির্বাচিত হলেই তা জনগণের রাষ্ট্র হয়ে যায় না, জনগণ তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার পায় না। বরং, প্রকৃত প্রজাতন্ত্র সেটাই যেখানে সবকিছুর উর্ধ্বে আছে রাষ্ট্রের নাগরিকরা।

This article is written in Bangla about the basic idea of Democracy and Republic. This article also discussed the democratic and republican status of some states. All references have been hyperlinked inside.

Related Articles

Exit mobile version