বাগানের মুখে দুই পাল্লার বিশাল এক কালো লোহার দরজা, মাঝখানে শোভা পাচ্ছে মাথার খুলি, আর তার নিচে আড়াআড়িভাবে রাখা দুটো হাড় বা ক্রসবোনের চিহ্ন। মানে একটাই- এখানে ঘোরাফেরা করছে মৃত্যু, সাবধান!
কিন্তু কেন এই চিহ্ন? উত্তর মিলবে দরজায় টাঙিয়ে রাখা সতর্কবাণীতে, “এখানকার গাছপালা হতে পারে মৃত্যুর কারণ!” এমনি এমনি দর্শনার্থীদের ভয় দেখানো হয়নি! বাগানের কোনো গাছের সাথে সামান্য স্পর্শ লাগলে চামড়ায় হয়ে যেতে পারে দগদগে ঘা, আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ ফল খেলে চলে যেতে পারে প্রাণটাই। আবার কারো সামান্য গন্ধেই হারিয়ে যেতে পারে বুদ্ধি বিবেচনা। সাধারণ কোনো বোটানিক্যাল গার্ডেন তো নয় এটা, বড় ভয়ঙ্কর ‘পয়জন গার্ডেন’!
আনউইক গার্ডেন
উত্তর ইংল্যান্ডের একটি কাউন্টি নর্থাম্বারল্যান্ড। এখানে অবস্থিত আনউইক গার্ডেন এই অঞ্চলের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। ১৪ একর এলাকা জুড়ে নানারকম গাছপালা, ফুলের বাগান আর ঝর্ণার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াতে প্রতিবছরই ছুটে আসেন প্রায় ছয় লাখ অতিথি।
এই আনউইকের একাংশে, চারদিকে পাঁচিলঘেরা এক বাগান। এর লোহার দরজা সবসময় বন্ধ রাখা হয়, কেবল গাইডের সাথেই দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারেন। ঢোকার আগে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়- কোনো ফুলের গন্ধ শোঁকার মতো কাজ যাতে না করেন কেউ। এই বাগানকেই বলা হয় পয়জন গার্ডেন, যেখানে রাখা আছে নানা প্রজাতির বিষাক্ত গাছ। এগুলো মানুষের জন্য প্রাণসংহারী হতে পারে।
পেছনের কথা
১৯৯৫ সালের কথা। নর্থাম্বারল্যান্ডের একাদশ ডিউক মৃত্যুবরণ করলেন। রীতি অনুযায়ী তার ভাই বুঝে পেলেন সম্পত্তি, পরিণত হলেন দ্বাদশ ডিউকে। তার স্ত্রী, লেডি জেন পার্সির উপাধি হলো ডাচেস অব নর্থাম্বারল্যান্ড। উত্তরাধিকার সূত্রে পার্সিরা আনউইক দুর্গ এবং তার পার্শ্ববর্তী বাগান অধিকার করলেন। বাগানের ছিল ভগ্নদশা। নতুন ডিউক তার স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন একে সাজিয়ে তোলার জন্য।
পরবর্তীতে ডাচেস বলেন, তার মনে হচ্ছিল সময় দিলে খুব ভালো কিছু করতে পারবেন তিনি। ফলে তিনি নিয়োগ দেন বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট জ্যাকুইস উইর্টজকে। ছেলে পিটারকে নিয়ে তিনি বাগান ঢেলে সাজানোর নকশা করেন। সেই অনুযায়ী আনউইক গার্ডেন পরিষ্কার করে নতুন গাছ লাগানো হয়; তৈরি করা হয় ভাস্কর্য, ঝর্ণাসহ আরো নানারকম আকর্ষণ। বলা হয়, যুক্তরাজ্যে ইউরোপিয়ান গাছের সর্বোচ্চ সংগ্রহ আছে এখানেই।
ডাচেসের মন অবশ্য খুঁতখুঁত করছিল। কী যেন নেই! তার মনে হলো, আলাদা করে একটা ওষধি গাছের বাগান করলে কেমন হয়! আইডিয়া নিতে ইউরোপে ভ্রমণ শুরু করলেন তিনি। ইতালির পাদুয়া শহরে এসে তার মনোভাব বদলে গেল, এখানে তিনি খুঁজে পান মেদিচি পরিবারের এক বাগান।
কারা এই মেদিচি? এরা পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইতালির অত্যন্ত প্রভাবশালী এক পরিবার। ব্যাঙ্কিংয়ের ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে প্রচণ্ড রকমের প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল তারা। বলা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিতে নানারকম কায়দাকানুন করত তারা, এর একটা ছিল বিষ ব্যবহার করে একেবারে তাদের জানে মেরে ফেলা। সেই বিষের উৎস নাকি ছিল তাদেরই নিজস্ব বাগানের উদ্ভিদ। মেদিচিদের বাগানের দরজায় মাথার খুলি আর ক্রসবোনের চিহ্নও দেখে আসেন ডাচেস।
স্কটল্যান্ড ভ্রমণের সময় লেডি পার্সি ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মধ্যযুগীয় হাসপাতাল দেখতে যান। এখানে তাকে শোনানো হয় তৎকালীন অ্যানেসথেসিয়ার গল্প। অঙ্গচ্ছেদ করতে হবে এমন রোগীকে আফিম, হেমলক ইত্যাদি গাছের রসে সিক্ত কাপড় শুকিয়ে মোটামুটি দুই-তিন দিনের জন্য নাকি অজ্ঞান করে ফেলা হতো, এরপর অপারেশন। এজন্য হাসপাতালে সংলগ্ন বাগানেই চাষ হতো এসব উদ্ভিদের। ডাচেস এবার ওষধি গাছের বাগানের পরিকল্পনা থেকে সরে এলেন। তার মনে হলো ভিন্ন কিছু করা দরকার। বিষাক্ত উদ্ভিদ সাজিয়ে বাগান করার কাজ আরম্ভ করলেন তিনি। সব কাজ শেষ হলে ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে পয়জন গার্ডেন।
তবে নিজের কাজের পেছনের ধারণা ডাচেস দিয়েছেন একটু ভিন্নভাবে। “আমার মনে হয়েছে এভাবে বাচ্চাদের উদ্ভিদের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব,” বলেছেন তিনি, “অ্যাস্পিরিন গাছের ছালবাকল থেকে আসে সেই তথ্য জানতে বাচ্চারা যতটা আগ্রহী, তার থেকে বেশি আগ্রহী কীভাবে একটা গাছ আপনাকে হত্যা করতে পারে!”
উল্লেখযোগ্য সদস্য
একশোর মতো গাছ আছে পয়জন গার্ডেনে। অনেকগুলোর কথাই বলা যায়। সবচেয়ে বিষাক্ত গাছ সম্ভবত রাইসিন, যা সাধারণ মানুষ চেনে ক্যাস্টর তেলের উৎস হিসেবে (castor oil plant)। গার্ডেনের এক ট্যুর গাইড ডিন স্মিথ জানিয়েছেন, গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডস একে চিহ্নিত করেছে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বিষাক্ত গাছ হিসেবে। এর বাস্তব প্রয়োগের উদাহরণও আছে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েতবিরোধী বুলগেরিয়ান নাগরিক জর্জি মার্কভঁকে কেজিবির এক স্পাই নাকি রাইসিন প্রয়োগ করেই হত্যা করেছিল।
আরেকটি গাছকে একটু অদ্ভুত নামেই ডাকা হয়, ‘দেবদূতের শিঙ্গা’ (Angel’s trumpet)। পুরো গাছের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে বিষ, সামান্য অংশই ঘটাতে পারে সাময়িক মস্তিষ্কবিকৃতি। সৃষ্টি হয় হ্যালুসিনেশন, এমনকি চরম পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারেন। লেডি পার্সির প্রিয় গাছ অবশ্য আমাদের অতিপরিচিত ধুতরা শ্রেণীর। আরেকটা গালভরা নাম আছে, ‘শয়তানের বাঁশি’ (Devil’s trumpet)। হতভাগ্য বন্দীদের বুক ছিড়ে হৃদপিণ্ড বের করে আনার আগে নাকি অ্যাজটেকরা তাদের খাইয়ে দিত এই ধুতরার ফুল। ভিক্টোরিয়ান যুগে চায়ের সাথে মিশিয়ে এই ফুল পান করা হতো মস্তিষ্কে উদ্দীপনা যোগাতে।
খুব পরিচিত একটি গাছ রডোডেনড্রন। অনেক বাগানেই হয়তো পাওয়া যেতে পারে এর দেখা। এই গাছের কোনো অংশ খেয়ে ফেললে স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে যেতে পারে। ল্যাবার্নাম নামে আরেক ধরনের গাছের উল্লেখ করা যায়, যা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বিষাক্ত গাছে তালিকায় দ্বিতীয়। সেখানে অনেক মানুষই ঘরের পাশে এই গাছ লাগান সুন্দর হলুদ ফুলের জন্য। কিন্তু এতটাই বিপদজনক এই ল্যাবার্নাম যে, বলা হয়- যদি গাছের ডালের কোনো অংশ ভেঙে কয়েক মাস পড়ে থাকে, আর তারপরে কোনো প্রাণী এসে তা মুখে তুলে নেয়, তবে সেই প্রাণীর জীবিত থাকার সম্ভাবনা খুব কম।
হেনবেন, যা আগাছা হিসেবেই পরিচিত, তার পাতা বা শিকড় খেলে বমি, খিঁচুনি, দৃষ্টিভ্রম ইত্যাদি দেখা দেয়। ফুল ফুটলে যে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে তা নাকে গেলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
মঙ্কসহুডের কথাও বলা যায়, উলফ’স বেইন (wolf’s bane) নামেই যা সমধিক পরিচিত। এই উদ্ভিদে আছে অ্যাকোনিটিন (aconitine), যা স্নায়ু এবং হৃদযন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষমতা রাখে। ২০০৪ সালে আন্দ্রে নোবল নামে এক কানাডিয়ান অভিনেতা ভুলক্রমে মঙ্কসহুড খেয়ে মারা যান। ২০১০ সালে লন্ডনে এক মহিলা সাবেক প্রেমিক হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন । সরকারি উকিল প্রমাণ করেছিলেন- প্রেমিকের তরকারিতে মঙ্কসহুডের বীজ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
চেরি লরেল (cherry laurel or English laurel) নামে পয়জন গার্ডেনের গাছটির পাতা ছাটতে গেলে মৃত্যু হতে পারে, কারণ তাদের মধ্যে রয়েছে এমন দুটো উপাদান যা কোনোভাবে মিশে গেলে উৎপত্তি হয় সায়ানাইড গ্যাসের। ঊনবিংশ শতকে বাচ্চারা ছোট ছোট বোতলে এই গাছের পাতা পিষে রেখে দিত, এরপর পোকামাকড় ধরে পুরে ফেলতো সেখানে। উৎপন্ন বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারা পড়তো পোকা, যা বন্ধুবান্ধবদের দেখিয়ে বাহবা নেয়ার চল ছিল।
আরো বহু রকমের বিষাক্ত গাছ আছে পয়জন গার্ডেনে। হেলেবোর নামে এক প্রজাতির গাছের শিকড় হৃদযন্ত্র বন্ধ করে দিতে পারে, এর রস লাগলে সৃষ্টি হয় ঘা। সক্রেটিসকে হত্যা করতে যে হেমলকের রস ব্যবহার করা হয়েছিল তারও দেখা মিলবে এখানে। মাদক হিসেবে ব্যবহার হয় এমন উদ্ভিদ, যেমন- গাঁজা, পপি, কোকেন ইত্যাদিও চাষ করা হয় এখানে। এসবের জন্য অবশ্য আলাদা করে সরকারি লাইসেন্স নিতে হয়, এবং বছর শেষে সেই বছরের সব গাছ নষ্ট করে ফেলতে হয়।
শিক্ষা কার্যক্রম
পয়জন গার্ডেনকে কেবল বিনোদনের স্থান বললে ভুল হবে, কারণ শিক্ষামূলক নানা কাজও করে থাকনে তারা। বিশেষ করে বাচ্চাদের মাদক বিষয়ে সচেতন করতে বেশ কিছু প্রোগ্রাম আছে তাদের। এই কার্যক্রমের প্রধান ক্লেয়ার মিশেল জানান যে ইংল্যান্ডের এই অঞ্চলে ড্রাগ নিয়ে মৃত্যুর ঘটনা অনেক, কাজেই ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের সচেতন করার কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তাদের বাগানের সেই অংশে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে মাদকের গাছগুলো রয়েছে। এরপর সেগুলোর কুপ্রভাব সম্পর্কে জানানো হয় তাদের।
পরিচর্যাকারী দল
এতশত বিষাক্ত গাছের পরিচর্যার জন্য দরকার দক্ষ আর বড় কর্মিবাহিনী। ট্রেভর জোন্সের নেতৃত্বে আছে তেমনই একটি দল। প্রজাতিভেদে গ্লাভস, ফেস মাস্ক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা বিশেষ রকমের স্যুট বা হ্যাজম্যাট স্যুট পরে কাজ করেন তারা। অ্যামি থর্প নামে এক কর্মচারী জানান, ঝুঁকি থাকলেও এ কাজ করে মজাই পান তারা। তবে যথোপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে থাকেন তারা। জরুরি হচ্ছে প্রত্যেকটি গাছ সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নেয়া।
বাগানে অবশ্যই গাইডের সাথে ঢুকতে হবে, অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে তার কথা। প্রতি বছর প্রায় আট লাখ পর্যটক ঘুরে যান এখান থেকে, তাদের মধ্যে ফুলের বিষাক্ত গন্ধে কেউ কেউ মাথা ঘুরে পড়েও যান। ২০১৪ সালে এমন হয়েছিল অন্তত সাতজনের সঙ্গে। যদি সুযোগ হয়, ঘুরে আসতে পারেন পয়জন গার্ডেন থেকে। তবে দুর্ঘটনার জন্য লেখককে দায়ী করা যাবে না কিন্তু!