মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস অঙ্গরাজ্যের ছিমছাম সুন্দর এক শহর লিউড (Leawood)। এখানেই বসবাস কেম্প পরিবারের। ১৯ বছরের উচ্ছল তরুণী অ্যালি কেম্প (Alexandra ‘Ali’ Kemp) বাবা-মায়ের বড় আদরের। মেধাবী অ্যালির চোখেমুখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন-একদিন অসহায় শিশুদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে চায় সে।
পড়ালেখার পাশাপাশি স্থানীয় এক সুইমিং পুলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়েছিল অ্যালি আর তার ছোট ভাই। বাসা থেকে হেঁটে বড়জোড় তিন-চার মিনিট লাগে কর্মস্থলে যেতে। এখানেই ২০০২ সালের ১৮ জুন মেঘাচ্ছন্ন একদিনে চিরতরে থেমে যায় সম্ভাবনাময় এই তরুণীর পথচলা।
নিষ্ঠুর এক হত্যাকান্ড
প্রতিদিনের মতো ১৮ জুনও কাজে এসেছিল অ্যালি। আবহাওয়া অনুকূল নয় বলে সেদিন খুব বেশি মানুষ সাঁতার কাটতে আসেননি, তাই তাই ব্যস্ততা ছিল অল্প। বেলা তিনটার দিকে বান্ধবী লরেলকে (Laurel Vine) ফোন করে অ্যালি, দুই বান্ধবী মিলে গল্পসল্প করে শিফটের বাকি সময়টা পার করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। আরেক বন্ধু ফিল হাওয়েসকেও (Phil Howes) ফোন করেছিল তরুণী, কিন্তু সে ফোন ধরতে পারেনি।
বন্ধুর সাথে দেখা করতে কিছুক্ষণ পর পুলে চলে আসে লরেল। একদম নিরিবিলি ছিল চারদিক, কেবল একজন লোককে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। লরেল ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি অ্যালির খুনিকে চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখছে সে। বান্ধবীকে খুঁজে না পেয়ে সে ধরে নেয় হয়তো জরুরি কোনো কাজে চলে গেছে অ্যালি। আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে লরেল এরপর বাড়ি ফিরে আসে।
এদিকে পরের শিফটের জন্য হাজির হয় অ্যালির ছোট ভাই। বোনের পার্স আর ফোন টেবিলে দেখতে পায় সে, কিন্তু অ্যালির তো দেখা নেই। মাকে বিষয়টা জানানোর পরপরই হাজির হন তাদের বাবা রজার। দুজনে মিলে খুঁজতে থাকেন অ্যালিকে।
রজার প্রথমেই পুলে নেমে দেখলেন দুর্ঘটনাক্রমে সেখানে ডুবে গেছে কিনা মেয়ে। এরপর তিনি খুঁজতে খুঁজতে গেলেন সুইমিংপুলের পাম্প যে ঘরে থাকে সেখানে। নীল রঙের এক তারপুলিনের নিচে দেখতে পেলেন একজন বাবার কাছে সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য- সন্তানের ক্ষতবিক্ষত দেহ। দ্রুত জরুরি নাম্বারে ফোন দেন তিনি, কিন্তু অ্যালিকে বাঁচানো যায়নি।
তদন্ত
পুলিশ কর্মকর্তা মেজর ক্রেগ হিলের মতে, লিউডে এমন ঘটনা ছিল কল্পনাতীত। কোমরবেধে নেমে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অকুস্থল ঘেঁটে তার বুঝতে পারে বড় রকমের ধস্তাধস্তি হয়েছিল সেখানে। নিজেকে বাঁচাতে হত্যাকারীর সাথে প্রাণপণ লড়েছিল তরুণী।
গোয়েন্দারা জানতে পারেন- অ্যালির খুনের অব্যবহিত পরে সেখানকার পার্কিং থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল একটা ফোর্ড পিকআপ ট্রাক। লরেল তাদের জানায় অ্যালিকে খোঁজার সময় একটা লোককে ট্রাকে উঠে চলে যেতে দেখেছিল সে- শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, বয়স ত্রিশের কোঠায়, উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি থেকে ছয় ফুট হবে। তার বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে সন্দেহভাজনের একটি মুখচ্ছবিও তৈরি করা হয়।
খুনির খোঁজে
অ্যালির পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী আর বন্ধুরা সম্ভাব্য খুনির ছবি চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। রজার টেলিভিশনেও এটা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সূত্রের অভাবে এরপর ভাটা পড়ে পুলিশি তদন্তে। অ্যালির বাবা এবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। অ্যালির হত্যাকান্ডের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলে ১,০০০ ডলার পুরষ্কারের ঘোষণা করা হয়। তবে এই অর্থ অপ্রতুল মনে হওয়ায় দ্রুতই সেটা ২৫,০০০ ডলার করে দেন তিনি। লিউডের সিটি কাউন্সিল যোগ করে আরো ২৫,০০০। পুরষ্কারের মোট অর্থ দাঁড়ায় ৫০,০০০ ডলারে। জেমস স্ট্রেইটার (James Straiter) নামে এক লোকের সাথে ছবি অনেকটা মিলে যায়। কিন্তু হত্যাকান্ডের সময় জেমস ছিল কাজে, তার বস নিজেই এটা নিশ্চিত করেন।
কিন্তু ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ আবারো জেমসের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ক্যানসাস আর মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তাকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষা তাকে নিষ্কৃতি দেয় অ্যালিকে খুনের অভিযোগ থেকে।
হত্যাকারী ধরতে বিলবোর্ড
একদিন গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার ধারে টাঙানো বিলবোর্ডের দিকে নজর পড়ল রজার কেম্পের। সাথে সাথেই একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। সন্দেহভাজনের ছবি যদি বিলবোর্ডে দিয়ে দেয়া হয় তাহলে? প্রতিদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শত শত মানুষ এটা দেখবে, তাদের কেউ না কেউ নিশ্চয় চিনবে এই লোককে! তিনি বিলবোর্ড কোম্পানিগুলোর কাছে খরচ জানতে চেয়ে চিঠি দেন। লামার অ্যাডভার্টাইজিং নামে একটি কোম্পানি বিনামূল্যে কেম্পকে তাদের একটি বিলবোর্ড ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
ফল মিলল দ্রুতই। কেউ একজন ফোন করে জানালেন- বিলবোর্ডের লোকটি সম্ভবত টেডি হুভার (Teddy Hoover)। পুলিশ বের করে ফেলল এই ব্যক্তিও সুইমিং পুল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে, এবং লরেল যে ট্রাকটি চলে যেতে দেখেছিল হুভারের অবিকল তেমন একটা গাড়ি আছে। কেসের নথিপত্র ঘেঁটে পাওয়া গেল আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। অ্যালির কর্মস্থলেই কাজ করতো হুভার, এবং হত্যাকান্ডের দিনও দায়িত্ব পালন করেছে সে। পুলিশ তার সাথে কথাও বলেছিল, কিন্তু হুভারের আচার-ব্যবহারে সন্দেহের কিছু পায়নি বলে সন্দেহের তালিকায় ছিল না সে।
গোয়েন্দারা হুভারের ডিএনএ-র নমুনা চাইলে সে তার উকিলের সাথে যোগাযোগ করে। যখন দেখা গেল ডিনএনএ নমুনা না দিয়ে উপায় নেই, তখন পালিয়ে যায় হুভার। প্রায় বছরখানেক তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর একজন ফোন দিয়ে জানায় যে হুভারের নতুন ঠিকানা কানেক্টিকাট, বেঞ্জামিন অ্যাপলবি নাম নিয়ে বান্ধবীর সাথে বসবাস করছে সে। গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে এবার তার দরজায় কড়া নাড়ল পুলিশ।
জেরার মুখে হুভার স্বীকার করে অ্যালিকে খুন করার কথা। তার বক্তব্য অনুযায়ী- তরুণীকে পছন্দ করতো সে। কিন্তু জুনের সেদিন তার অযাচিত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মেয়েটি। হাল না ছেড়ে অ্যালিকে অনুসরণ করে পাম্প ঘরে চলে যায় হুভার, নানাভাবে উত্যক্ত করতে করতে একপর্যায়ে গায়েও হাত দিয়ে বসে। অ্যালি চলে যেতে চাইলে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। রাগের চোটে প্রচন্ড জোরে অ্যালিকে আঘাত করে সে, এরপর অচেতন মেয়েটিক তারপুলিনে ঢেকে বেরিয়ে আসে পালানোর জন্য। তখনই তাকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে দেখেছিল লরেল।
শাস্তি
হত্যা আর ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়ায় হুভার। সকল পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে দোষী সাব্যস্ত হয় সে। বিচারক তাকে কঠিন দণ্ড দেন- ৫০ বছর জেলে কাটাতে হবে হুভারকে, এরপর বেঁচে থাকলে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করতে পারবে সে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল আসামী, কিন্তু ধোপে টেকেনি তা।
অ্যালির স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে তার পরিবার গঠন করেছে অ্যালি কেম্প ফাউন্ডেশন। তাদের নানা কার্যক্রমের মধ্যে মেয়েদের আত্মরক্ষার কায়দাকানুন শেখানোর ক্লাসও অন্তর্ভুক্ত। রজার কেম্পের ভাষায়, তারা চান অ্যালির মতো পরিণতি আর কারো না হোক, খালি না হোক আর কোনো পরিবারের বুক। এই লক্ষ্যে এখন অবধি প্রায় ২,০০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এই ফাউন্ডেশন।
রজার যে অর্থ পুরষ্কার দিতে চেয়েছিলেন তার কী হলো? যার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অ্যালির হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা হয়, এটা ছিল তার প্রাপ্য। কিন্তু সে নিজের পরিচয় গোপন রাখে, এবং পুরো টাকাটা দিয়ে দেয় ফাউন্ডেশনে।