গত কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলে প্রায় প্রতি বছরই সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে, গত চার বছরে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে পাঁচটি। কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় স্থিতিশীল সরকার আসতে পারছে না, সরকার গঠন করতে হচ্ছে জোটবদ্ধ হয়ে। সর্বশেষ ২০২২ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসেছেন বেনিয়ানিন নেতানিয়াহু। তার সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো। বছর পাঁচেক আগেও নেতানিয়াহুর লিকুড পার্টির দখলে ছিল নেসেটের ৬২টি সিট, এবারের নির্বাচনে সেটি নেমে এসেছে ৩২টিতে। সরকার গঠন করতে লিকুড পার্টি কট্টর ডানপন্থী দলগুলোকে নিয়ে যে সরকার গঠন করেছে, সেটিকে বলা হচ্ছে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ডানপন্থী সরকার।
ইসরায়েলে কেন বাড়ছে ডানপন্থীদের আধিপত্য?
ধর্মের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্নও তাই পুরনো। রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা থেকেও বৈচিত্র্য আছে ইসরায়েলিদের মধ্যে, যেটি সম্প্রতি সাবেক প্রেসিডেন্ট রোবেন রিভলিয়ানের মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে ‘ফোর ট্রাইব’ নামে।
ফোর ট্রাইবের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি মধ্যপন্থী ইহুদিদের নিয়ে গঠিত, যারা নিজেদের সেক্যুলার হিসেবে দাবি করতে পছন্দ করে। ইসরায়েলের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের মতো রয়েছে এই অংশে, এই অংশই দেশকে নেতৃত্ব দেয় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত দলগুলোও এই অংশের মধ্যেই ধরা হয়।
এর পরবর্তী বড় অংশটি পরিচিত ধার্মিক ইহুদি হিসেবে, যারা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, মোট ইহুদির ২০ শতাংশ। রাজনৈতিক জায়োনিজমে বিশ্বাসী এই অংশই রয়েছে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন কার্যক্রমের কেন্দ্রে।
জনসংখ্যার আরেকটি অংশ কট্টর রক্ষণশীল ইহুদি, যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠারই বিরোধিতা করেছিল। জনসংখ্যার এই অংশটি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা চায়নি, চেয়েছিল ‘মাসিহাহ’-এর মাধ্যমে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই অংশটি ডানপন্থীদের সাথে যুক্ত, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তারা দৃশ্যত মেনে নিয়েছে।
চতুর্থ গ্রুপটি হচ্ছে ইসরায়েলি আরবরা, যাদের ভূমি দখল করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসরায়েল। আরব ইসরায়েলিদের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ স্বল্প, তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটে নিয়মিত।
কট্টর ডানপন্থী জনসংখ্যা বৃদ্ধি
ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯ মিলিয়নের বেশি, ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে ৯৫ তম অবস্থানে থাকা ইসরায়েলে বাড়ছে ডানপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা, রাজনীতিতে বাড়ছে তাদের প্রভাব। সেক্যুলার ইহুদি পরিবারগুলোতে গড় সন্তান দুজন, রক্ষণশীল ধার্মিক ইহুদি পরিবারগুলোতে গড় সন্তানের সংখ্যা চারজন। অন্যদিকে, কট্টর ডানপন্থী পরিবারগুলোতে গড় সন্তান সাতজন করে, যেটি জনসংখ্যায় কট্টর ডানপন্থীদের অবস্থান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যেমন- ইসরায়েলের নতুন সরকারের ন্যাশনাল মিশন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সন্তান এগারোজন, গৃহায়ন মন্ত্রীর দশজন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়জন, অর্থমন্ত্রী ও অভিবাসন মন্ত্রীর সাতজন, এবং হেরিটেজ মন্ত্রীর সন্তান আছে ছয়জন।
কট্টর ডানপন্থী পরিবারের সদস্যদের মাঝে বেকারত্বের হার ৪৭ শতাংশ, যেখানে ইসরায়েলে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের নিচে। দারিদ্র্যও কট্টর ডানপন্থী পরিবারগুলোর মধ্যে দ্বিগুণ। সামাজিক এই সূচকগুলোও কট্টর ডানপন্থী পরিবারগুলোতে অধিক সন্তান জন্মদানের ধারণাকে উৎসাহিত করছে।
কট্টর ডানপন্থী পরিবারগুলোর পাশাপাশি তুলনামূলকভাবে অধিক সন্তান নিচ্ছেন রক্ষণশীল ধার্মিক ইহুদি পরিবারগুলোও। জনসংখ্যার এরা দ্বিতীয় বৃহৎ গ্রুপ এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র নিয়ে সচেতনতা এই গ্রুপের মধ্যেই সর্বাধিক। রাজনীতিতে এরা ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র
ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পেছনে মূলভিত্তি ছিল ধর্মীয় পরিচয়, এখনও পৃথিবীর একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। সম্প্রতি ঘন ঘন নির্বাচন আর সরকার গঠনে অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করেছে, একই সাথে বাড়িয়েছে ইহুদিদের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র নিয়ে সংশয়। সর্বশেষ বেনেটের নেতৃত্বাধীন সরকারে বিভিন্ন দল আর মতের সম্মিলন ঘটেছিলো।
বেনেটের নেতৃত্বাধীন সরকারে ডানপন্থী দল ছিলো, ছিলো মধ্যপন্থী আর বামপন্থী দলও। সাথে ছিলো আরব বংশোদ্ভূত আইনপ্রণেতারাও। রাজনৈতিক দিক থেকে এই জোট অস্থিতিশীল সময় পার করে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ করে দিলেও, ইহুদিদের এই সরকার ভিন্নভাবে ভাবায়। ইহুদিরা চিন্তিত হয়ে উঠে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র নিয়ে। বেনেটের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জবাব এবার ভোটাররা নির্বাচনের সময় দিয়েছে, যেটি শক্তিশালী করেছে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল রাষ্ট্রে গঠিত হয়েছে তাদের সাত দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে ডানপন্থী সরকার, যেটি সরকারের বিভিন্ন নীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কট্টর ডানপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই চাচ্ছেন জনসমাগম হয় এমন স্থানে নারী আর পুরুষদের আলাদা রাখতে, চাচ্ছেন ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে ডাক্তাররা যাতে চিকিৎসা দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নতুন সরকারের হাত ধরে রাষ্ট্রের দিক থেকে এসব উদ্যোগ আসতে পারে। আবার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েলই এলজিবিটিকিউ অধিকারবান্ধব একটি দেশ, নতুন সরকারের হাত ধরে পরিবর্তন আসতে পারে সেখানেও।
ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করার আলাপ বেশ পুরনো, বিভিন্ন সময়ে এই আলোচনা শোনা গেছে ইসরায়েলের রাজনীতিতেও। নতুন সরকারের হাত ধরে ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, রাজনীতিতে আরো বাড়বে ধর্মের ব্যবহার।
আর, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন? গত সাত দশকের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেই চলবে নতুন সরকারের অধীনেও চলবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন, নাগরিক স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক অধিকারের হরণ। নতুনভাবে বাড়বে ইসরায়েলের বসতি নির্মাণ।