১২ আগস্ট, ১৯১২। নিউজিল্যান্ডের একটি সংবাদপত্রে ১০৬ বছর পূর্বে পৃথিবীর জলবায়ুর উপর কয়লা পোড়ানোর প্রভাব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। ছোট প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, বছরে ২ বিলিয়ন টন কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৭ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরিত হয় প্রতি বছর। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, এই প্রভাব কয়েক শতাব্দীর মধ্যে উপলব্ধি বা দৃশ্যমান হতে পারে।
শত বছর পূর্বের আশঙ্কা অনুযায়ী, ক্রমাগত তাপমাত্রার বৃদ্ধির প্রভাব টের পেতে আমাদের কয়েক শতাব্দীর প্রয়োজন পড়েনি। চাহিদা অনুযায়ী যোগান দিতে, কয়লাসহ অন্যান্য জ্বালানীর ব্যবহার মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যেই আমাদের পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে বিপর্যয়ের মুখে। যা-ই হোক, অতিরিক্ত কয়লার ব্যবহার সাম্প্রতিক সময়ে সমস্যার নতুন রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে সাইবেরিয়ার কুজনেৎসক বাসিন বা সংক্ষেপে কুজবাস অঞ্চলে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা সাইবেরিয়ার তুষারপাত অতি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের তুষারপাতকে অনেকেই দেখছেন মানুষের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় হিসেবে। কারণ অঞ্চলটির কিছু শহর সাদা নয় বরং ঢেকে গিয়েছিল কালো তুষারে।
উত্তোলনের হার ও মজুদ অনুযায়ী রাশিয়া কয়লার চাহিদা আরও প্রায় ৪৪৩ বছর পর্যন্ত সামাল দিয়ে যেতে পারবে! রাশিয়ার বিপুল এই কয়লার মজুদের ৮৬% অবস্থিত সাইবেরিয়ায়। সাইবেরিয়ার কুজবাস অঞ্চলেই রয়েছে ৫৬% কয়লার মজুদ, যেখানে রয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ও পৃথিবীর অন্যতম বড় কয়লার খনি। এই খনি প্রায় ১০,০০০ বর্গ মাইলেরও (২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার) বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে।
সাধারণত রাশিয়ার কয়লার বড় একটি অংশই আসে এই অঞ্চল থেকে এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে ২.৬ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। এই অঞ্চলের প্রকোপিয়াস্ক শহরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কালো তুষারপাত হয়েছে এবং অস্বাভাবিক এই তুষারপাত নিয়ে স্থানীয়রা বেশ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। তাদের মতে, এই ঘটনার পেছনে দায়ী হলো স্থানীয় কয়লার খনি ও কারখানা। তাছাড়া একই অঞ্চলের কিজেলস্ক ও লেনিস্ক-কুজনেজস্কি শহরেও একই ধরনের তুষারপাতের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। যদিও এই ধরনের তুষারপাত এই অঞ্চলে এবারই প্রথম নয়।
২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে সাইবেরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে কালো তুষারপাতের ঘটনা ঘটলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় স্থানীয়দের মধ্যে। সাইবেরিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আকস্মিক এই কালো তুষারপাতের ঘটনার জরুরি ও তাৎক্ষণিক কারণ অনুসন্ধান করে পরিবেশ, শিল্প ও নিউক্লিয়ার রক্ষণাবেক্ষণের ফেডারেল প্রতিনিধি। তাদের মতে, এই ঘটনার জন্য দায়ী ছিল একটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কেন্দ্রটির উপরে অতিরিক্ত চাপের ফলে উল্লেখিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে বিষাক্ত কালো এই তুষারপাতের জন্য মূলত দায়ী স্থানীয় খোলা কয়লা খনি, গর্ত ও প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি অনুসরণ না করা কারখানাগুলো। ঘটনার পর অবশ্য স্থানীয় কারখানার একজন কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন যে, একটি কয়লা চালিত কারখানায় পরিবেশে কয়লার গুঁড়া মিশে যাওয়া রোধ করার প্রক্রিয়ায় সমস্যা হয়েছিল এবং কারখানার এই কালো গুঁড়া ও ময়লা তুষারের সাথে মিশেছে। তবে কালো বিষাক্ত তুষারপাতের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত ঘটতে দেখা যাচ্ছে। তাই পরিবেশবিদরা মাত্র একটি উৎসকে এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী মানতে নারাজ।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা অলাভ জনক সংগঠন ইকো-ডিফেন্সের একজন সদস্য ভ্লাদিমির সিলভাক বলেন, “শীতকালে এখানে কালো তুষারের চেয়ে সাদা তুষার খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।“ তিনি আরও যোগ করেন যে, “বাতাসে এখানে সব সময় প্রচুর কয়লার চূর্ণ বিদ্যমান। এগুলো দৃশ্যমান হয় শুধু তুষার পড়লেই। বছরের বাকি সময়ে আমি দেখতে না পেলেও, এগুলো বাতাসে তখনও থাকে।”
সাইবেরিয়ার পরিবেশ ও জনজীবনের কথা তোয়াক্কা না করে খনি থেকে কয়লার অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন উক্ত অঞ্চলে ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। কয়লা খনি থেকে নির্গত ময়লায় আর্সেনিক ও পারদসহ আরও বিভিন্ন বিপদজনক ভারী ধাতু বিদ্যমান, যেগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। ২০১৫ সালের ইকো-ডিফেন্সের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, কুজবাস অঞ্চলের মানুষদের গড় আয়ু গোটা রাশিয়া থেকে ৩/৪ বছর কম এবং যক্ষ্মা ও শিশুদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও প্রায় দ্বিগুণ!
সমগ্র রাশিয়ার তুলনায় কুবাসের জনগণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনার বেশি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ কয়লার ময়লা, যেগুলো প্রতিনিয়ত কয়লার খনি ও কারখানা থেকে মিশে যাচ্ছে। সমালোচকদের মতে, কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় নিয়ম ও আইন না মেনেই এই বিপদজনক ভাবে জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলেই কাজ চলছে খনি ও কারখানাগুলোর।
অনেকেই মনে করেন, সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাটা স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই সমস্যা তো স্বীকার করছেই না বরং তা নিয়ে লুকোচুরির নির্লজ্জ চেষ্টা চালাচ্ছে। মস্কো টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কালো তুষার ঢাকতে তারা সাদা রঙ ব্যবহার করেছিল।
লন্ডন ও মস্কোর মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়ন থাকলেও দেশটির প্রধান কয়লার যোগানদাতা আবার রাশিয়া! ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের মোট চাহিদার অর্ধেক কয়লা আমদানি করা হয়েছিল রাশিয়া থেকে এবং এই কয়লার ৯০% ছিল কুজবাস অঞ্চলের খনি থেকে উত্তোলিত। এখন আলোচিত অঞ্চলের পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংগঠন দাবি জানিয়ে আসছে যে, পরিবেশগত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এই অঞ্চল থেকে কয়লা রপ্তানি করা যেন যুক্তরাজ্য বন্ধ করে দেয়। দেশটিতে সিমেন্ট, স্টিল ও পাওয়ার স্টেশনগুলোতে কয়লার বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। তবে ব্রিটিশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও, সাইবেরিয়ার সমস্যাগুলো নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য বা প্রতিবাদ হতে খুব একটা দেখা যায়নি। কালো তুষারপাতের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন রহস্যময় ঘটনা এই অঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্যয়ের মারাত্মক দিকগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যেমন ২০১৮ সালের জুলাইতে একটি কারখানার বর্জ্য ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ে বিশাল এলাকা লাল ‘রক্ত বৃষ্টির’ পানিতে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল।
একই বছর পরের মাসেই ইয়াকুইতায় বিশাল ধূলিকণার দেয়াল প্রায় তিন ঘণ্টার জন্য ঢেকে রেখেছিল সূর্য। যদিও কয়লার ব্যবহার পরিবেশ-বান্ধব করার কোনো সহজ উপায় নেই। রাশিয়ার সাইবেরিয়ার এই পরিস্থিতির মতো কালো তুষার পাত যদিও অন্য কোথাও হচ্ছে না, তবুও কয়লার ব্যবহার সংক্রান্ত পরিবেশগত ঝুঁকির এই সমস্যা বিশ্বের আরও অনেক অঞ্চলেই রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইডের বড় একটা অংশ নির্গত হয় কয়লা চলিত বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কারখানা থেকেই।