পাখিপ্রেমীদের জন্য পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু জায়গা

পৃথিবীতে এমন কোনো শহর পাওয়া যাবে না, যেখানে পাখি দেখতে পাওয়া যায় না। সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতি তো বটেই, পৃথিবীর অনেক ধর্মেই পাখিকে সম্মানজনক অবস্থানে আসীন করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতের, রঙের ও গড়নের পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা অভিভূত হয়ে যাই, মানসিক তৃপ্তি লাভ করি। কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গায় কি বিরল প্রজাতির কিংবা মনোমুগ্ধকর পাখিগুলোর দেখা পাওয়া যায়? না। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ কিংবা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পরিবেশ ও জলবায়ুর পার্থক্য রয়েছে। একেক পরিবেশে একেক রকমের পাখি দেখতে পাই আমরা।

বিশ্বায়নের এই সময়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। পাখিপ্রেমীরা এখন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ নেই, তারা ঘুরতে যান পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশ্বজুড়ে কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে বিশেষ কিছু পাখি দেখা যায় বা বিভিন্ন জাতের পাখি পর্যবেক্ষণ করার জন্য সেসব জায়গার কোনো বিকল্প নেই। আজ এমন কিছু জায়গা সম্পর্কেই আমরা জানবো।

১) হাওয়াই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ২,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত এই প্রদেশে চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ করায় সারাবছর ধরে পাখি দেখা যায়। এই দ্বীপরাজ্যের জীববৈচিত্র্য প্রাণীবিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এখানে বেশ বিরল প্রজাতির কিছু পাখি দেখতে পাওয়া যায়। সেই সাথে প্রতিবছর অসংখ্য পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে এই প্রদেশে।

ওতওগপগেহে
রেড-ক্রেস্টেড কার্ডিনাল, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ; image source: hawaiipicturesoftheday.com

পাখিপ্রেমীরা প্রধানত হাওয়াই প্রদেশের চারটি দ্বীপে হাজির হন। কাওয়াই, ওয়াহু, মাউয়ি ও ‘বিগ আইল্যান্ড অব হাওয়াই– এই চারটি দ্বীপে পাখিপ্রেমীরা বেড়াতে আসেন মূলত। ওয়াহু প্রদেশের অবকাঠামো পর্যটনসহায়ক হওয়ায় পর্যটকেরা অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় এখানে একটু বাড়তি সুবিধা লাভ করেন।

বিভিন্ন দুর্লভ ও স্থানীয় পাখির পাশাপাশি এখানকার একটি পাখি আলাদা করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। লাল মাথাবিশিষ্ট ‘রেড-ক্রেস্টেড কার্ডিনাল’ নামের এই পাখি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসলেও বর্তমানে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের প্রায় সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। এটি শুধু সুন্দরই নয়, এর ওড়ার ভঙ্গি পর্যটকদের বেশ আনন্দ দেয়।

২) কোস্টা রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা

ল্যাটিন আমেরিকা বরাবরই পাখিপ্রেমীদের জন্য স্বপ্নের জায়গা। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর জলবায়ু বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বসবাসের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এজন্য এই অঞ্চলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখিগুলো দেখতে পাওয়া যায়। ল্যাটিন আমেরিকার একটি দেশ হলো কোস্টা রিকা। এখানে পাখিপ্রেমীদের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়েছে, যেখানে অসংখ্য প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া সম্ভব। ধারণা করা হয়, আয়তনে তূলনামূলক ছোট এই দেশে প্রায় সাড়ে আটশো প্রজাতির পাখি আছে।

কোস্টা রিকায় উনিশ প্রজাতির পাখি রয়েছে যেগুলোকে শুধু সেদেশেই দেখতে পাওয়া যায়। আট প্রজাতির পাখি পুরো বিশ্বজুড়েই হুমকির মধ্যে রয়েছে। প্রায় দুশো প্রজাতির পাখি ‘পরিযায়ী পাখি’ হিসেবে কোস্টা রিকায় মৌসুমের সময়ে এসে থাকে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল- এই সময় আবহাওয়া ভালো থাকায় বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। পৃথিবীবিখ্যাত হামিংবার্ড, লম্বা ঠোঁটের টোউকান কিংবা ‘স্বর্গীয় পাখি’ হিসেবে পরিচিত ‘রেসপ্লিডেন্ট কুয়েটজাল’ এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

তয়ুতপগপগপগ
কোস্টা রিকার বিশ্ববিখ্যাত লম্বা ঠোঁটের টোউকান পাখি; image source: vacationscostarica.com

৩) দক্ষিণ জর্জিয়া

আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে দক্ষিণ জর্জিয়া। এখান থেকে এন্টার্কটিকা খুব বেশি দূরে নয়, তাই প্রচুর ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজমান থাকে এখানে। পেঙ্গুইন ঠান্ডা আবহাওয়া ছাড়া বাঁচতে পারে না, তাই এখানকার আবহাওয়া পেঙ্গুইনদের বসবাসের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এন্টার্কটিকা থেকে খুব বেশি দূরত্ব না হলেও এখানকার আবহাওয়া এন্টার্কটিকার মতো চরম ঠান্ডা নয়, এখানে পানি একেবারে জমে বরফ হয়ে যায় না। তাই সারাবছর পেঙ্গুইনরা এখানে অবস্থান করতে পারে, শীতকালে তাদের বিকল্প খুঁজতে হয় না।

পেঙ্গুইন ক্যাম্প দেখার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্দান্ত জায়গাগুলোর একটি হচ্ছে দক্ষিণ জর্জিয়া। হাজার হাজার পেঙ্গুইন আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে– এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ দক্ষিণ জর্জিয়ায় বেড়াতে আসেন।

জআওগপগে
দক্ষিণ জর্জিয়ার পেঙ্গুইন ক্যাম্পে একজন পর্যটক; image source: elstonhill.com

৪) ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকার বনাঞ্চল সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিশাল সম্ভারের জন্য একটি বিখ্যাত দেশ এটি। এই দেশটির একটি মোট ভৌগলিক পরিসরের বড় অংশ বনাঞ্চল হওয়ায় এখানে বিভিন্ন প্রাণী নিরাপদে বংশবিস্তার করতে পারে। তবে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা বিখ্যাত হলেও এই দেশে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে, যেগুলো অসংখ্য পাখিপ্রেমীকে আকৃষ্ট করে।

ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক খ্যাতি লাভ করেছে মূলত ‘বিগ সিক্স’-এর জন্য। বিগ সিক্স বলতে এখানে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া বিখ্যাত পাঁচটি পাখিকে বোঝায়। কোরি বাস্টার্ড, মার্শাল ঈগল, ল্যাপেট-ফেসড শকুন, ফিশিং পেঁচার মতো পাখিগুলো পর্যবেক্ষণ করতে অনেক পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। অন্য পাখিগুলো সচরাচর দেখা গেলেও নিশাচর ফিশিং পেঁচার দেখা পাওয়া এত সহজ নয়।

৫) পাপুয়া নিউ গিনি

জীববৈচিত্র এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির সম্মীলনে গড়ে ওঠা পাপুয়া নিউ গিনি পাখিপ্রেমীদের জন্য বিখ্যাত একটি জায়গা। শুধু পাখিই নয়, এখানকার সমুদ্রসৈকত ও কোরাল রিফগুলো উপভোগ করতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটে এই দেশে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অসংখ্য সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এই দেশটির মতো পৃথিবীতে আর খুব কম দেশই রয়েছে।

‘বার্ডস অব প্যারাডাইজ’ গোত্রের প্রায় ৩৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে অনেক প্রজাতির অসংখ্য অনিন্দ্য সুন্দর পাখির দেখা মেলে এই দেশে। প্রতিবছর জুন থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় এই দেশে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজমান করায় এই সময়ে বেশিরভাগ পাখিপ্রেমী বেড়াতে আসেন। র‍্যাগিয়ানা নামের একটি পাখি হচ্ছে পাপুয়া নিউ গিনির জাতীয় পাখি, যেটি শুধু এই দেশেই দেখতে পাওয়া যায়। চমৎকার এই পাখি তার সঙ্গীকে আকর্ষণ করার জন্য মনোমুগ্ধকর অঙ্গভঙ্গি করে থাকে, যেটি পাখিপ্রেমীদের চোখে শীতলতা এনে দেয়।

পাপুয়া নিউ গিনির একটি অনিন্দ্যসুন্দর পাখি; Image Courtesy: Wikimedia Commons

৬) মানু ন্যাশনাল পার্ক, পেরু

পেরুতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মিলনমেলা ঘটেছে। ল্যাটিন আমেরিকার আর দশটা দেশের মতো এখানেও অসংখ্য প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলো প্রতিবছর অসংখ্য পাখিপ্রেমীর আগমন ঘটায়। মানু ন্যাশনাল পার্কে প্রায় এক হাজার প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর অনেক দেশেও এত বেশি পরিমাণ পাখির দেখা মেলে না।

এন্টিপিট্টা, কক অব দ্য রক কিংবা ট্যানাজার্সের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখিগুলোর দেখা মিলবে এই পার্কে। তবে এই পার্কের একটা বড় অংশে মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ, কারণ তাতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আগমনের আশঙ্কা রয়েছে। এই পার্কসহ পুরো অঞ্চলের অনেক স্থানে মানুষের আগমন না ঘটায় এখানে প্রচুর পাখির দেখা পাওয়া যায়।

মাত্র ছয়টি স্থানের কথা উল্লেখ করলেও শুধু এগুলোতেই বিচিত্র সব পাখির দেখা মেলে– এমনটা ভাবলে ভুল হবে। কেনিয়ার ‘দ্য গ্রেট রিফট ভ্যালি’, আমেরিকার নিউ জার্সি কিংবা ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জও পাখিপ্রেমীর স্বপ্নের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর যত পাখি রয়েছে, তার খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ আমরা আমাদের শহর বা গ্রামে দেখতে পাই, তাতেই আমরা এসবের সৌন্দর্যে অভিভূত হই। যদি কখনও এসব স্থানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় তবে এসব দেখে বিস্ময়ে আপনার চোখ যে কপালে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।

Related Articles

Exit mobile version