২০০৮ সালে, আমেরিকান বহুমাত্রিক বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান সাক্স এর মতে, “পানিই হবে আগামী শতাব্দীর পেট্রোলিয়াম।” জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্বন্ধে বিশ্ব নেতারা একমত হতে না পারলেও পরিবর্তন কিন্তু থেমে নেই। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শুকিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে সমুদ্র অঞ্চলের দেশগুলো প্লাবিত হচ্ছে লবণাক্ত পানিতে।
মধ্যপ্রাচ্য কি তবে পানিযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে?
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকার বরফগুলো যে হারে গলছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার বাড়বে। এটি সমুদ্র অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলোর জন্য একটি দুঃসংবাদ। অধিক মাত্রায় এই বরফ গলে যাওয়া সমুদ্রে লবণ পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে এবং এই লবণ পানিই ভূগর্ভস্থ পরিষ্কার পানির সাথে মিশে গিয়ে তাকেও লবণাক্ত করে ফেলবে।
জলবায়ু পরিবর্তন যত দ্রুত হারে হবে তত দ্রুত পৃথিবীর ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ কমে যাবে। শুধুমাত্র পান করার কথা বাদ দিলেও পানির ওপর বৈশ্বিক বাণিজ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিব্যবস্থা পুরোপুরি নির্ভরশীল। অতএব, পানির পরিমাণই যখন দিনকে দিন কমছে তখন বিশ্বনেতারা এই পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে লড়বেন এটা তো অবশ্যম্ভাবী।
২০০৩-১৩ সাল পর্যন্ত GRACE স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমগ্র পৃথিবীর প্রধান ৩৭টি একুইফারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে ১৩টির পানির স্তরের উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। যেগুলোর বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায়।
নীলনদ পরিবেষ্টিত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রায় ১১টি দেশ তাদের পানির উৎসের জন্য নদীটির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। ৬,৬৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদী অববাহিকা বুরুন্ডি, মিশর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা এবং কঙ্গোকে যুক্ত করেছে। এই নদী পরিবেষ্টিত এলাকার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন, যাদের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন মানুষই তাদের খাদ্য ও পানির জন্য সরাসরি নীলনদের ওপর নির্ভরশীল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক প্রয়োজন, দূষণ ও পানির স্তরের নিচে নেমে যাওয়া নীলনদ পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে।
২০১১ সালে ইথিওপিয়া তাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম (Grand Ethiopian Renaissance Dam = GRED) তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প পরিচালকদের মতে, ২০২২ সাল নাগাদ ড্যামটির কাজ শেষ হবে। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় এবং সমগ্র পৃথিবীতে সপ্তম এই বাঁধ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৪.৮ বিলিয়ন ডলার। বহু বছর ধরে নীলনদের পানির ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত খরা প্রবণ দেশটির আমূল পরিবর্তন হবে এই বাঁধটি নির্মাণ হলে। বাঁধ থেকে প্রাপ্ত পানির স্রোত কাজে লাগিয়ে ৫,০০০ মেগাওয়াট বিশিষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব হবে। ফলে বাঁধটি শুধু ইথিওপিয়াই নয় বরং আশেপাশের দেশগুলোকেও পরিবর্তন করে দেবে। তবে ইথিওপিয়ার প্রতিবেশী কেনিয়া, সুদান এবং দক্ষিণ সুদান এই প্রকল্পে অনুমোদন দিলেও মিশর কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বেশ নারাজ।
এবার একটু নীলনদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক। নীলনদের উজানের দিকের দেশ হওয়ার কারণে পানির ন্যায্য বণ্টন হলে মিশর, ইথিওপিয়া এবং সুদান তাদের কৃষিকাজ ও পরিবহন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়াও প্রবাহিত পানির স্রোত কাজে লাগিয়ে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ১৯২৯ সালে তৎকালীন মিশর ও সুদানের (তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ) মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, মিশর নদের পানিকে কাজে লাগিয়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের অনুমোদন পায়। এতে করে ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোতে পানির প্রবাহ আরো কমতে থাকে। এই চুক্তির পেছনের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অনুযায়ী, মিশর কর্তৃক ব্রিটেনকে সুয়েজ খাল ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। কারণ সুয়েজ খাল দিয়েই ঐ সময়ে ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রয়োজনীয় তেল নিজের দেশে পরিবহন করত। এছাড়াও ব্রিটেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভারত উপনিবেশে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল এটি।
পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে মিশর ও সুদানের মধ্যে আরো একটি চুক্তি হয়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো চুক্তিতে নীলনদ অববাহিকার অন্যান্য দেশগুলোর অনুপস্থিতি এবং ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক স্বার্থ সম্পৃক্ত থাকার কারণে এই দুটি চুক্তিই প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ২০১১ সালে যখন মিশর অভ্যন্তরীণ কোন্দল সমাধানে ব্যস্ত তখন ইথিওপিয়ান সরকার এই GRED প্রকল্পে অনুমোদন প্রদান করে।
এই ড্যাম নির্মাণ সম্পন্ন হলে ইথিওপিয়া যেমন একদিকে তাদের উৎপাদনকৃত বিদ্যুৎ দিয়ে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করবে, অপরদিকে মিশরের জন্য এই প্রকল্পটি বয়ে নিয়ে আসবে চরম মানবিক বিপর্যয়। কারণ, মিশর তাদের পানির চাহিদার জন্য পুরোপুরিভাবে নীলনদের ওপর নির্ভরশীল। এরপরেও তাদের বাৎসরিক ১০ বিলিয়ন কিলোলিটার পানির ঘাটতি থাকে। ইথিওপিয়ার এই বাঁধ প্রকল্পে ৭৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি সংরক্ষিত থাকবে, ফলে কায়রোর পানি সংকট আরো ভয়াবহ হবে। গবেষকদের তথ্যমতে, GRED প্রকল্প সম্পন্ন হলে মিশরের ২০০ হাজার একর জমি পুরোপুরি পানিশূন্য হয়ে যাবে এবং প্রায় আড়াই লক্ষ পরিবারকে বাস্তুচ্যুত হতে হবে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে মোকাবেলা করতে ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত মিশর ইথিওপিয়ার সাথে কয়েক দফা আলোচনায় বসে। কিন্তু ইথিওপিয়ার দিকে সুদানের সমর্থন এবং আলোচনার বিরূপ ফলাফল পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। এককথায়, গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম হলো কায়রো ও আদ্দিস আবাবার মধ্যে বিরাজমান টাইম বোম্ব; যার ঘড়ির কাঁটা সেট করা হয়েছে ২০২২-এ।
এবার আসা যাক টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদী অববাহিকার রাজনৈতিক কূটকৌশলে। এই নদী অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলো এবং নদী এলাকায় তাদের অংশের পরিমাণ হলো যথাক্রমে ইরাক ৪৬.৪%, তুরস্ক ২১.৮%, ইরান ১৮.৯%, সিরিয়া ১১.০%, সৌদি আরব ১.৯% এবং জর্ডান ০.০৩%।
ইউফ্রেটিস নদী তুরস্কের ভ্যান লেক ও কালো-সাগরের মধ্যবর্তী পূর্বাঞ্চলীয় উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে সিরিয়া দিয়ে ইরাকে প্রবেশ করেছে। নদীটির বেশিরভাগ অংশ ইরাক দিয়ে প্রবাহিত হলেও প্রবহমান পানির উৎসের ৮৯ শতাংশই আসে তুরস্ক থেকে। টাইগ্রিস নদীর ভাগ্যও অনেকটা ইউফ্রেটিসের মতো, তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে উৎপত্তি হলেও নদীর বেশিরভাগ অংশই প্রবাহিত হয়েছে ইরাক দিয়ে। এই নদীর প্রবহমান পানির বেশিরভাগ অংশই ব্যবহৃত হয় সেচ, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে। তবে নদীর ওপর তুরস্কের একের পর এক বাঁধ নির্মাণ ও দূষণ পানিকে ক্রমেই ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলছে।
১৯৫০-৬০ পর্যন্ত ইরাক অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য ইউফ্রেটিস নদী থেকে খাল খনন কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তীতে, ষাটের দশকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তুরস্ক প্রথম কেভান বাঁধ তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে, যা ১৯৭৩ এ সম্পন্ন হয়। একই বছর সিরিয়াও তাবকা বাঁধ তৈরি করে। তুরস্ক ও সিরিয়ার এই বাঁধগুলো ইরাকের অংশে পানির পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৫ এ প্রথম সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে সিরিয়া বাঁধের কিছু অংশ খুলে ইরাককে আরও পানি দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে আঞ্চলিক উত্তাপ আরো কিছুটা প্রশমিত করতে তুরস্কও ১৯৭৬ সালে ইউফ্রেটিসে অতিরিক্ত ৩৫০ কিউবিকসেক পানি প্রবাহ বাড়ায়।
নব্বইয়ের দশক থেকে তুরস্ক এই পানিকে নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। কারণ নদীগুলোর উজানের দিকে অবস্থিত হওয়ায় পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ভৌগোলিক ক্ষমতা তুরস্কের হাতে। ১৯৮৭ সালে তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ইউফ্রেটিস নদী দিয়ে তুরস্কের ৫০০ কিউবিকসেক পানি ছাড়ার কথা থাকলেও সিরিয়ার অভিযোগ তারা সেই পানি পায়নি। সিরিয়ার ভাষ্যমতে, ইউফ্রেটিস নদীর পানি প্রবাহ বাড়ানোর বিনিময়ে তুরস্ক সিরিয়ান সরকারকে কুর্দিদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে বলে। ১৯৯০ সালে ইরাক তুরস্কের বন্ধু-দেশ কুয়েতে আক্রমণ করলে তুরস্ক রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ইরাকের অংশে পানি প্রবাহ কমিয়ে দেয়। তুরস্কের এই ক্রমবর্ধমান পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ টাইগ্রিস নদীর নিম্ন অববাহিকা, গাল্ফ উপত্যকা এবং শাত-ইল-আরব এর পানিকে আরও লবণাক্ত করে তুলছে। ২০০৯ সালে ইরাক তাদের পার্লামেন্টে টাইগ্রিস নদীর পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য বিল পাস এবং কুর্দি এলাকা নিয়ন্ত্রণে সিরিয়ান সরকারকে তুরস্ক কর্তৃক সহায়তা প্রদান; পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অনুর্বর মরুকরণের প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত করছে ।
এবার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান পানির উৎস জর্ডান নদীর কথায় আসা যাক। ২৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদী ডান, বানিয়াস এবং হাছবানি নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যা ইসরায়েলের উত্তরাংশের থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে। জর্ডান নদী অববাহিকার প্রধান এলাকা এবং তাদের অংশের পরিমাণ যথাক্রমে জর্দান ৪০%, ইসরায়েল ৩৭%, সিরিয়া ১০%, গাজার পশ্চিম উপত্যকা ৯% এবং লেবানন ৪%।
জর্ডান এবং গাজার পশ্চিম তীরবর্তী এলাকাই হলো জর্দান নদী অববাহিকার সবচেয়ে উর্বর ভূমি। তবে জর্ডান নদীর পানি প্রবাহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ইয়ারমুক নদী। জর্ডান থেকে উৎপন্ন এই নদী জর্ডান ও সিরিয়ার সীমানা বরাবর এসে জর্ডান নদীতে পড়েছে। এককথায় বলতে গেলে, ইয়ারমুকের পানিই জর্দান নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়।
১৯৫১ সালে জর্ডান সরকার পূর্ব ঘোড় খাল (East Ghor Canal) তৈরির মাধ্যমে ইয়ারমুকের গতিপথ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে, ইসরায়েল ১৯৫৩ সালে ন্যাশনাল ওয়াটার ক্যারিয়ার (National Water Carrier=NWC) প্রকল্প শুরু করে, যা ১৯৬৪ সালে শেষ হয়। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ১৩৪ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে গালিলি সাগর থেকে পানি প্রবাহিত করে ইসরায়েলের শুষ্ক দক্ষিণাঞ্চলে সবুজ বিপ্লব ঘটানো। কিন্তু এই গালিলি সাগরই ছিল জর্ডান নদীতে পানি প্রবাহের আরেকটি অন্যতম উৎস।
১৯৬৪ সালে NWC চালু হলে যখন জর্ডানের পানি ইসরায়েলের শুষ্ক মরুভূমি শুষে নিচ্ছিল, তখন আরব বিশ্বের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন জর্ডান নদীর গতিপথ এমনভাবে পরিবর্তিত হবে যাতে শুধুমাত্র জর্ডান ও সিরিয়াই এর পানি ব্যবহার করতে পারে। অবস্থা অনুমান করতে পেরে, ১৯৬৫-৬৭ সালে ইসরায়েল প্রতিনিয়ত সিরিয়ায় জর্ডান নদীর অংশে নির্মিতব্য এইবার প্রকল্পগুলোর ওপর হামলা চালায়। এর পরিণতিতে ১৯৬৭ সালে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’। এই যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়ার সবগুলো বাঁধই পুরোপুরি ভেঙে দিতে সক্ষম হয় এবং গোলান উপত্যকা, গাজা ও এর পশ্চিমাংশ দখল করে নেয়; এবার জর্ডান নদী পুরোটাই ইসরায়েলের হাতের মুঠোয়!
তারপরও ১৯৬৯-৮৭ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল ক্রমাগত জর্ডান ও লেবাননের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়। কিন্তু প্রথম অসলো চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়। এতে করে জর্ডান নদীর পানির অংশীদার হয় ফিলিস্তিনিরা। এত কিছুর পরও পানি সংকট মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৫ সালে ফিলিস্তিনিদের সাথে দ্বিতীয় অসলো চুক্তি, ২০০২ সালে লেবাননের সাথে ইসরায়েলের সংঘর্ষ ছাড়াও আরো ছোট-বড় নানা যুদ্ধে ব্যস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তবে প্রত্যক্ষভাবে নদী পরিবেষ্টিত দেশগুলো এই সংঘর্ষে জড়ালেও পরোক্ষভাবে তাদের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এখানে আশার বিষয় হলো, ইসরায়েল যেমন তাদের সামরিক শক্তি ব্যবহার করে জর্ডান নদীর উপর প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়েছে, তেমনি তারা আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে গালিলি সাগরের পানিকে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে পেরেছে। বর্তমানে ইসরায়েলের গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত পানির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই গালিলি সাগরের পানিকে লবণমুক্ত (Desalaination) করে ।
সমগ্র পৃথিবীর সবচেয়ে পানি সংকটপূর্ণ এলাকা হলো মধ্যপ্রাচ্য। মিশর-ইথিওপিয়া, তুরস্ক-সিরিয়া-ইরাক এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন; এদের মধ্যে শেষের জুটিই বর্তমানে খবরের শিরোনাম দখল করে আছে। অধিকাংশ ফিলিস্তিনির জীবনযাত্রা দারিদ্রসীমার অনেক নিচে হওয়ায় তারা কাজ, খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানি এবং আরো নানা মৌলিক চাহিদার জন্য ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের ভাষ্যমতে, ইসরায়েল তাদের দখলদারিত্ব না ছাড়লে তারা ইসরায়েল থেকে পরিপূর্ণ সাহায্য গ্রহণে অপারগ। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়, ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনে ক্রমাগত আগ্রাসন চালায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফিলিস্তিনিরা। আবার ফিলিস্তিনি নেতারা যদি ইসরায়েলের সাহায্য গ্রহণ না করে তাহলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফিলিস্তিনিরা।
আপাতদৃষ্টিতে ভুক্তভোগী দেশগুলোর এই করুণ পরিণতির জন্য আগ্রাসী দেশগুলোকে দায়ী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের এখন প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত ও বিবেচনাবোধ সম্পন্ন নেতার, যিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে বিশ্ববাসীর কাছে তাদের প্রয়োজন এবং আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। নতুবা বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- “রাজার পাপে রাজ্যক্ষয়”, যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ হয়তো হবে ভবিষ্যতের মধ্যপ্রাচ্য।