আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। এ দেশের প্রসঙ্গ উঠতেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে কলকাতা, দিল্লি কিংবা মুম্বাইয়ের মতো বহুল পরিচিত শহরগুলোর চিত্র। সে তুলনায় ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুকে নিয়ে আলোচনা বা চর্চা খুব কমই হয়। অথচ দাক্ষিণাত্যের মালভূমির অন্তর্গত, ভারতের তৃতীয় জনবহুল এই শহরেরই কিন্তু একটি সম্মানজনক পরিচিতি গড়ে উঠেছে বহির্বিশ্বের কাছে। একসময় ‘পেনশনার’স প্যারাডাইস’ কিংবা ‘গার্ডেন সিটি’ হিসেবে খ্যাত এ শহরকে এখন অভিহিত করা হচ্ছে ভারতের সিলিকন ভ্যালি হিসেবে!
শুনে হয়তো অনেকেই অবাক হচ্ছেন, কিন্তু সশরীরে বেঙ্গালুরুতে পা রাখার পর আপনার বিস্ময় চাক্ষুষ বাস্তবতায় রূপান্তরিত হতে বাধ্য। সাপ্তাহিক কর্মদিবসগুলোতে সকাল ৮টা বাজা পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে। তার আগেই বাইরে বেরিয়ে দেখতে পাবেন লম্বা যানজট লেগে গেছে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে। ১ কোটি ২০ লক্ষ অধিবাসীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে নগরী। কিংবা একটু যদি আশেপাশে তাকান, দেখবেন বিলাসবহুল সব রেস্তোরাঁ ও বার, যা ভারতের মতো রক্ষণশীল একটি দেশের জন্য চমকপ্রদই বটে।
আপনি যদি আরো গভীর পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী হন, তাহলে অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে আপনার সামনে দৃশ্যমান হবে দুইটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ: ইঞ্জিনিয়ার আর উদ্যোক্তা। আর তাদের অভিধানের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পরিভাষাটি হলো ‘স্টার্টআপ’। প্রতি সপ্তাহেই এ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করিডোর এবং হোস্টেল রুম থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন সব স্টার্টআপ, যার মাধ্যমে শহরটি পরিণত হয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে।
শুধু ২০১৮ সালের ১২ মাসেই এ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৫৩টি সফল স্টার্টআপ, যাদের প্রত্যেকটিতেই ছিল প্রয়োজনীয় মাত্রার মেধা ও মূলধনের সুষম সমাবেশ। সেজন্যই তো, ২০১৯ গ্লোবাল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম রিপোর্ট এ শহরকে রেখেছে ১৮তম অবস্থানে, যে তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে সিলিকন ভ্যালি, দ্বিতীয় স্থানে নিউ ইয়র্ক, আর তৃতীয় স্থানটি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে লন্ডন ও বেইজিং। এছাড়া জেএলএল ২০১৭ সিটি মোমেন্টাম ইনডেক্স তো প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বেঙ্গালুরুকে দিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় শহরের খেতাবও।
যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত আসল সিলিকন ভ্যালিতে রয়েছে অ্যাপল, ফেসবুক, গুগলের মতো বিশ্বসেরা তথ্য-প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর হেডকোয়ার্টার, যে কারণে সেটিকে বিবেচনা করা হয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর আঁতুড়ঘর হিসেবে। ভারতের প্রেক্ষাপটে একই কথা বলা যায় বেঙ্গালুরুর ক্ষেত্রেও। তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের যে অগ্রযাত্রা, তার বেশিরভাগই সংগঠিত হয়েছে এই বেঙ্গালুরুকে কেন্দ্র করেই। এখানেই ভারতীয় শাখা রয়েছে অ্যামাজন, আইবিএম, মাইক্রোসফট, টেসকো, নকিয়া, সিমেন্স, অ্যাপল, ইনটেল, সিসকো, অ্যাডোবি, গুগল প্রভৃতির।
ভারতে তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের সাথে যুক্ত রয়েছে প্রায় এক কোটি মানুষ, যাদের মাধ্যমে প্রতি বছর বিদেশে রপ্তানি হয় ৮৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্য ও পরিষেবা। এই বিপুল আয়ের ৪০ শতাংশেরই যোগান দেয় বেঙ্গালুরু। ২০১৯ সালে ভারত পরিণত হয়েছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে, যার মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়েছে কেবল শেষ পাঁচ বছরেই। এখন ভারতের লক্ষ্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে উত্তীর্ণ হওয়া। এই চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য যদি আসলেই বাস্তবায়ন করতে হয়, সেক্ষেত্রে বেঙ্গালুরুকে রাখতে হবে বড় অবদান। কেননা আসল সিলিকন ভ্যালি অবস্থিত যেই স্যান ফ্রান্সিসকো বে অঞ্চলে, শুধু সেটিই কিন্তু একটি ৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি, অর্থাৎ গোটা ভারতের চেয়ে এগিয়ে।
নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন রাখছে, ঠিক কবে ও কীভাবে বেঙ্গালুরুতে শুরু হয়েছিল তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ৮০’র দশকে।
১৯৮৩ সালে ভারতীয় প্রযুক্তিনির্ভর কিছু কর্পোরেশন যেমন উইপ্রো ও ইনফোসিস বেঙ্গালুরুতে তাদের প্রাথমিক কার্যালয় স্থাপন করে এবং ভারতীয় প্রোগ্রামারদের নিয়োগ দেয়া শুরু করে। ভারতের তথ্য-প্রযুক্তি শিল্প নিয়ে বড় কিছু করার তাদের এ প্রচেষ্টা আরো বেগবান হয় ১৯৮৪ সালে, নতুন কম্পিউটার ও সফটওয়্যার নীতিমালা প্রণীত হলে। এর ফলে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আমদানি-রপ্তানির পথ প্রশস্ত হয়।
এই সুযোগে আমেরিকান কোম্পানিগুলো জোট বাঁধতে শুরু করে ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর সাথে, এবং তাদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন সব প্রযুক্তি ও ব্যবস্থা দিয়ে সাহায্য করতে থাকে ভারতকে। স্বভাবতই এতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয় ভারতীয়দের জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে আমেরিকানদের কী লাভ? তাদের লাভ হলো, তারা কম খরচে ভারতীয় মেধাদের যেমন কাজে লাগাতে পারছিল, তেমনই ভারতের মাটিতে সফটওয়্যার উদ্ভাবনের নতুন কেন্দ্রও গড়ে তুলতে পারছিল। আর সবচেয়ে বড় লাভ অবশ্যই এই যে, ভারতীয়দেরকে নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাদের মনে এসবের হালনাগাদ সংস্করণ প্রাপ্তির চাহিদা সৃষ্টিরও বীজ বপন করে দিচ্ছিল তারা। এভাবেই তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পশ্চিমের সাথে প্রাচ্যের এক মেলবন্ধন ঘটছিল, যাতে প্রাচ্য লাভবান হচ্ছিল তো বটেই, তবে তারচেয়েও কয়েকগুণ লাভবান হচ্ছিল পশ্চিমই।
১৯৮৫ সালে প্রথম বহুজাতিক কর্পোরেশন হিসেবে টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্ট ইঙ্ক একটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপন করে বেঙ্গালুরুতে, যার পথ ধরে এমন আরো অনেক ডেভেলপমেন্ট সেন্টারই গড়ে উঠতে থাকে। তবে এখানে একটি কথা অনস্বীকার্য যে, ৮০’র দশকে তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছেই দ্রুত অর্থলাভ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য হতো, যে কারণে তারা কম খরচে সফটওয়্যার তৈরির চেষ্টা করত। এর ফলে ভারতে উৎপাদিত বেশিরভাগ সফটওয়্যারই হতো মানহীন বা নিম্নমানের। ভারতীয় তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের জন্য এটি খুবই দুর্নামের একটি বিষয় ছিল, যে দুর্নাম পেছনে ফেলতে ভারতকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ভারতে তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবে সেই যে একবার অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা প্রকাশ্যে চলে এসেছিল, সে থেকে শুরু করে চলতি শতকের শুরুর দশক পর্যন্ত ভারতীয় তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পকে পশ্চিমের কাছে মাথানত করেই থাকতে হয়েছে। ভারতে ব্যক্তিবিশেষের মেধার উৎকর্ষ নিয়ে কোনোদিনই কোনো সন্দেহ ছিল না, কিন্তু সেই মেধাগুলোকে নিজ দেশেই যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বড় মঞ্চ না থাকায়, সেগুলো ব্রেইন ড্রেইনের মাধ্যমে চলে যেত পশ্চিমে। তাই তো আজ গুগল, নকিয়া, অ্যাডোবি, মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় পদে ভারতীয়দের দেখতে পাওয়াটা মোটেই আশ্চর্যের মনে হয় না।
সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত যে, একটা সময় পর্যন্ত মাইক্রোসফট কিংবা গুগলে চাকরি পাওয়া ভারতীয় সর্বোচ্চ মেধাবীদের কাছে যতটা সম্মানজনক বলে মনে হতো, নিজ দেশের কোনো উঠতি তথ্য-প্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করাকে তা মনে হতো না। তবে এই পরিস্থিতিরও একসময় পরিবর্তন হতে শুরু করে।
আগেও ভারত থেকে তথ্য-প্রযুক্তি কিংবা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত মেধাবীর কোনো কমতি না থাকলেও, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে হয় তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করে তাদের মেধার সর্বোচ্চ বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারত না, নয়ত দেশের বাইরে চলে যেত। কিন্তু গত দশক থেকেই ভারতে তথ্য-প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রকে আরো সুপরিশীলিত করে তোলা হয়, এবং নিজ দেশেই তাদেরকে কাজ করবার পর্যাপ্ত সুযোগ করে দেয়ারও প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। সে কারণেই এখন ভারতীয় গ্র্যাজুয়েটদের কাছে গুগল কিংবা ফেসবুকে চাকরি করাই একমাত্র বড় লক্ষ্য নয়, বরং নিজ দেশেই গুগল কিংবা ফেসবুকের মতো কিছু করে দেখানোর স্বপ্নও দেখতে শুরু করে দিয়েছে তারা।
এমন স্বপ্নচারী কিছু মানুষই বর্তমানে চাকা ঘোরাচ্ছে ভারতের সফল স্টার্টআপগুলোর। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি ওলার কথা। ভারতে তারা পেছনে ফেলে দিয়েছে তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী উবারকে। আবার ভারতে অ্যামাজনের প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্লিপকার্টের বাজারমূল্য ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার, তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে সরাসরি ৩০,০০০-এরও বেশি মানুষের। এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে মাত্র দশ বছরের মধ্যে, এবং বলাই বাহুল্য, দুইটি কোম্পানিরই উদ্ভব কিন্তু বেঙ্গালুরুতে।
এখনই আসল সিলিকন ভ্যালির সাথে বেঙ্গালুরুর তুলনা দেয়াটা হয়তো কোনোভাবেই সমীচীন নয়, কেননা সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলো ছড়ি ঘোরাচ্ছে গোটা বিশ্বব্যাপী। তবে শুধু ভারতের বাজারে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে যে বেঙ্গালুরুর কোম্পানিগুলো সমানে সমানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, এবং কখনো কখনো নিরঙ্কুশ বিজয়ও লাভ করছে; সে তো খুব পরিষ্কারভাবেই দৃশ্যমান। আর এটিও কিন্তু কম কথা নয়, যেহেতু ভারত কোনো ছোট দেশ নয়, জনসংখ্যাও প্রায় দেড়শো কোটি ছুঁই ছুঁই।
বেঙ্গালুরুর আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো, বাইরে থেকে কর্মী আনার পরিবর্তে, নিজ শহরেই দক্ষ কর্মী সৃষ্টির প্রতি তারা বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ শহরে আইটি কলেজের সংখ্যা অনেক আগেই ৫০ ছাড়িয়ে গেছে, এবং যে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এ শহরকে তাদের বাড়ি মনে করে, তাদের মধ্যে ১০ লক্ষই ডেভেলপার। সময়ের সাথে সাথে ডেভেলপারের সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না।
আরো নানা দিক থেকেই এগিয়ে রয়েছে শহরটি। শিক্ষা ও গবেষণাকে এ শহরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, যার প্রমাণ মেলে এখানে প্রায় সকল বিষয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যাপীঠের উপস্থিতি থেকে। এছাড়াও এ শহরে রয়েছে অ্যারোস্পেস ও এয়ারক্র্যাফট উৎপাদন কারখানা, এবং বায়োটেকনোলজি, মেশিন মেকিং ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিশাল সমাহার। এই সবকিছুর সমন্বয়ে এ শহরে নতুন নতুন ধারণার বিকাশ ঘটছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, স্টার্টআপের পরিমাণ-প্রভাবও ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁতে শুরু করছে।
এভাবেই এশিয়ার দ্রুতবর্ধনশীল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গভীরতা ও ব্যাপকতায় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং একদিন যদি ভারতের তথাকথিত এই সিলিকন ভ্যালি প্রকৃত সিলিকন ভ্যালির সমপর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাতেও কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/