বাবা-মা, অভিভাবকত্ব- এই শব্দগুলো তৈরি হয়েই থাকে। নিজ থেকে বানিয়ে নেওয়ার মতো সুযোগ আমাদের হাতে সেভাবে থাকে না। কিন্তু ‘অ্যাডাল্ট অ্যাডপশন’ বা ‘প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে দত্তক’ নেওয়ার প্রক্রিয়া এই পুরো ব্যাপারটিকেই অন্যভাবে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। অনেক দেশেই এখন প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে নিজের সাথে জুড়ে নিতে পারবেন আপনি দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে। এজন্য আপনি যাকে দত্তক নিচ্ছেন তার বয়স হতে হবে ১৮ বছর বা এর বেশি। আর সাথে থাকতে হবে যে মানুষটিকে আপনি দত্তক নিতে চাইছেন তার সম্মতি। একটু একটু করে আমরা একাকীত্বের গভীরে ডুবে যাচ্ছি। অনেকেই কারো হাত ধরার জন্য, নির্ভর করার জন্য বর্তমানে কাউকে পাচ্ছেন না। এই পুরো ব্যাপারটিকেই কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে দত্তক নেওয়ার এই পদ্ধতি।
আপনি হয়তো ভাবছেন, ইচ্ছে করলেই তো কাউকে দত্তক নিয়ে নেওয়া যায়। তবে, ব্যাপারটি ভাবা যায় নিজের চাইতে কমবয়সী কারো ক্ষেত্রে। এখানে বলা হচ্ছে নিজের চাইতে বয়সে বড় কারো কথাও। এমন তো হতেই পারে যে, একটা সময় গিয়ে কাউকে দেখে আপনার মনে হলো যে, এই মানুষটিকে নিজের ছেলে হিসেবে পেলে মন্দ হতো না। অথবা, কাউকে দেখে আপনার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলে, তাকে মা হিসেবে পেতে ইচ্ছে হলে কী করবেন আপনি? সত্যিই তো, আপনি কী করতে পারেন এই সময়? আফসোস আর ‘ইশ! যদি এমন হতো’ বা ‘যদি আগে এই মানুষটির দেখা পেতাম’ বলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না নিশ্চয়। তবে, কিছু দেশে শুরু হওয়া এই অ্যাডাল্ট অ্যাডপশনে সামনের মানুষটি চাইলে তার সাথে এই সম্পর্ক সত্যিই গড়ে তুলতে পারেন আপনি।
এজন্য আপনি যাকে দত্তক নিচ্ছেন তার বয়স নিয়ে কোনো সমস্যা পোহাতে হবে না। দত্তক নেওয়ার জন্য শুধু বাড়তি কিছু কাগজপত্র তৈরি করতে হবে আপনাকে। দত্তক নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া শেষ হলে যাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে তিনি ইচ্ছে করলে নিজের পদবী পরিবর্তন করতে পারেন, আবার না-ও করতে পারেন। নিজের জৈবিক বাবা-মায়ের সাথে দত্তক নেওয়া ব্যক্তির সম্পর্ককেও পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হবে কাগজপত্রে। তবে সবখানে অ্যাডাল্ট অ্যাডপশন শুধু আবেগীয় কারণে হয় না। এই যেমন- জাপানে এই প্রক্রিয়া উপস্থিত থাকলেও, এখানে বেশিরভাগ মানুষ অ্যাডাল্ট অ্যাডপশন করেন ব্যবসায়িক বিস্তৃতির জন্য। ধরুন, আপনি কোনো একটি সফল প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। আপনি যদি আপনার প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো যোগ্য কোনো মানুষকে খুঁজে না পান, সেক্ষেত্রে যোগ্য কাউকে দত্তক নিয়ে নিতে পারেন। এতে করে আপনার প্রতিষ্ঠানটি ঠিকঠাকভাবে চলতে থাকবে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাপ্তবয়স্ক দত্তক নেওয়ার ব্যাপারটি ঘটে আবেগীয় স্থান থেকেই। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে তৈরি হওয়া এই প্রক্রিয়ায় মানুষ নিজের একাকীত্ব ভোলার এবং নিজেকে পছন্দের মানুষটির পরিবারের অংশ করে নেওয়ার চেষ্টাই করে আসছে।
তবে অ্যাডাল্ট অ্যাডপশন বেশ নিয়ম মেনে সম্পন্ন করার ব্যাপার। এই যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি প্রদেশে প্রাপ্তবয়স্ক দত্তক নেওয়ার প্রচলন থাকলেও, কিছু কিছু স্থানে আছে অবশ্য পালনীয় শর্ত। এই যেমন- অ্যারিজোনায় নির্দিষ্ট বয়সের আগে দত্তক নেওয়ার এই ব্যাপারটি কার্যকর হবে না। এখন, আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, প্রতিবছর ঠিক কতজন এই প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যান? যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দত্তক পরিষদ বা ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অ্যাডপশনের তথ্যানুসারে, বছরে মাত্র কয়েক ডজন এমন প্রাপ্তবয়স্ক দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যান তারা। যেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, বছরে দেশটিতে মোট ১৩৫,০০০ জন বাচ্চাকে দত্তক নেওয়া হয়। সেদিক দিয়ে তুলনা করতে গেলে সংখ্যাটি একেবারেই তলানিতে অবস্থান করছে। তবে আশার কথা হলো, এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
এক্ষেত্রে অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়সের বেশি কাউকে নিজের সন্তান হিসেবে নেওয়ার জন্যই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে শিশুর জৈবিক বাবা-মায়ের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তেমনটা প্রাপ্তবয়স্ক দত্তকের ক্ষেত্রে হয় না। এই পুরো ব্যাপারটির সুবিধা নিয়ে অবশ্য শিশু দত্তকের কাজটিও সেরে ফেলা যায়। যেমন- আপনি যদি দেখতে পান যে, আপনার পাশে এমন কোনো শিশু আছে যার বাবা-মা তার যত্ন নিচ্ছে না। শিশুটিকে আপনি নিজে দেখভাল করতে চাইলে বা তাকে দত্তক নিতে চাইলে শিশুর বাবা-মা যদি অনুমতি না দেন। সেক্ষেত্রে আপনি শিশুটির ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন। এতে করে শিশুটি যদি ইচ্ছুক হয় আপনাকে নিজের অভিভাবক হিসেবে মেনে নিতে, তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তার বাবা-মায়ের সম্মতির আর কোনো দরকার পড়বে না।
শিশু দত্তক নেওয়ার চাইতে প্রাপ্তবয়স্ক দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়া বেশ কম ব্যয়বহুল এবং দ্রুতগতির। এক্ষেত্রে, কোনো অনুসন্ধানের ব্যাপার থাকে না, শিশুটির দায়িত্ব বাবা-মা নিতে পারবেন কি না তা নিয়েও খোঁজ নেওয়া হয় না। কারণ, দত্তক যিনি নিচ্ছেন এবং যাকে নেওয়া হচ্ছে- তারা দুজনেই নিজেদের ভালো বোঝার ক্ষমতা রাখেন। ফলে প্রক্রিয়াটির গতি মন্থর হওয়ারও কোনো অবকাশ থাকে না।
অ্যাডাল্ট অ্যাডপশন ও প্রতারণা
তবে প্রাপ্তবয়স্ক দত্তকের ব্যাপারটি নিয়ে যে প্রতারণা হয় না তা নয়। অনেকসময়, এই কাজটি যুক্তরাষ্ট্রে করা হয়েছে সমলিঙ্গের মানুষকে কাছে পাওয়ার জন্য। এর আগে যখন সমলিঙ্গের কারো বিয়ে এবং একত্রে থাকাকে স্বীকৃতি দেওয়া হতো না, তখন প্রাপ্তবয়স্ক দত্তক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একসাথে থাকতেন অনেকেই।
অন্যদিকে, অনেকসময় এই পুরো ব্যাপারটি খুব জটিল হয়ে উঠেছে। এই যেমন- ৭৫ বছর বয়সী ডোরিস ডিউক নিজের ৩৫ বছর বয়সী বান্ধবী শ্যাডি গেইল হেফনারকে অ্যাডল্ট অ্যাডপশনের মাধ্যমে দত্তক নেন। ডোরিস ও হেফনারের মধ্যকার সম্পর্ক ১৯৯১ সালে তিক্ত হয়ে পড়ে। বছর দুয়েক পর ডোরিস মৃত্যুবরণ করলে দেখা যায় যে, হেফনার ডরিসের পক্ষ থেকে কোনো সম্পদ পায়নি। পরবর্তীতে আইনের সাহায্যে ডোরিসের ৬৫ মিলিয়ন ডলার নিজের করে নেন হেফনার। ব্যাপারটি একদিক দিয়ে যেমন ঝামেলার, ঠিক তেমনি হৃদয়বিদারকও। তবে হ্যাঁ, টাকার লোভে এমনটা কেউ করতেই পারে।
অনেক ক্ষেত্রে, বাবা-মা নিজের কলেজপড়ুয়া সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিচ্ছেন অন্য কারো কাছে। আর সেটাও আর কিছু নয়, কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য। এক্ষেত্রে, সন্তান যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে পড়তে চায় সেটা তাকে দেওয়ার জন্য এবং খরচ যাতে কম হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য এমন উপায় বেছে নেন বাবা-মা। উক্ত স্থানের বাসিন্দা কোনো পরিচিত বন্ধুকে দত্তক দিয়ে দেন তারা সন্তান। কয়েক বছর পর পড়াশোনা শেষ হলে আবার বাবা-মা নিজের সন্তানকে ফিরিয়ে নেন।
আইনের দৃষ্টিতে এটি একরকমের প্রতারণা। ভালোবাসার কোনো স্থান থাকে না এই রকমে দত্তক প্রক্রিয়ায়। তবে, তাই বলে সত্যিই আবেগীয় স্থান থেকে যে কেউ অ্যাডাল্ট অ্যাডপশন করেন না তা নয়। বাংলাদেশে এখনো এই প্রক্রিয়াটি প্রচলিত হয়নি। তবে বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় আমাদের দেশেও যদি এর প্রবেশ ঘটে, তবে তাতে খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।