২০২২ সালের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সীমান্তে রুশ সৈন্য সমাবেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের সীমান্তে ইউক্রেনীয় সৈন্য সমাবেশকে কেন্দ্র করে একদিকে রাশিয়া, দনেৎস্ক ও লুগানস্ক এবং অন্যদিকে ইউক্রেন ও ন্যাটোর মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুগানস্কের বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযান শুরু করে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যেকার উত্তেজনার মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের এবং রাষ্ট্রদ্বয়ের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রুশ জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত একটি ভাষণে এই ঘোষণা প্রদান করেন এবং ইউক্রেনে চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে সবিস্তারে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।
উক্ত ভাষণটিতে ইউক্রেনীয় সঙ্কট, রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্ক এবং ইউক্রেনীয় সঙ্কটে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা সম্পর্কে পুতিনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুটিত হয়েছে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ এবং রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে চলমান নতুন স্নায়ুযুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবন করার জন্য পুতিনের এই ভাষণটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এই নিবন্ধে উক্ত ভাষণটির অনুবাদ করা হয়েছে এবং ভাষণটির বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও মতামত প্রদান করা হয়েছে। নিচের ইটালিক অক্ষরে প্রদত্ত অংশগুলো পুতিনের প্রদত্ত ভাষণের অংশ এবং তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে আবদ্ধ বিবরণগুলো উক্ত ভাষণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা/মতামত।
ভাষণ
[৫ম পর্বের পর]
আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, সেটির ভিত্তিতে আমাদের এটি বিশ্বাস করার জোরদার কারণ রয়েছে যে, ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদান ও পরবর্তীতে সেখানে ন্যাটোর স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি যে, এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার প্রতি সামরিক হুমকির মাত্রা নাটকীয়ভাবে, বহুগুণে বেড়ে যাবে। এবং আমি এই বিষয়ের ওপর জোর দিতে চাই যে, আমাদের দেশের ওপর আকস্মিকভাবে আঘাত হানার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাবে।
আমি ব্যাখ্যা করতে চাই যে, শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তথাকথিত প্রি–এম্পটিভ স্ট্রাইক পরিচালনার বিষয়টি মার্কিন কৌশলগত পরিকল্পনা সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা এটাও জানি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর মূল শত্রু কে। এটি হচ্ছে রাশিয়া। ন্যাটোর নথিপত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের দেশকে ইউরো–আটলান্টিক নিরাপত্তার প্রতি মূল হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইউক্রেন এরকম একটি আক্রমণের অগ্রবর্তী কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। যদি আমাদের পূর্বপুরুষরা এই ব্যাপারে শুনতেন, তারা হয়তো এটি বিশ্বাস করতেই চাইতেন না। আমরাও এটি বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু এটিই বাস্তবতা। আমি চাই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের জনসাধারণ বিষয়টি অনুধাবন করুক।
অনেকগুলো ইউক্রেনীয় বিমানঘাঁটি আমাদের সীমানার কাছে অবস্থিত। প্রেসিশন অস্ত্রবাহী বিমানসহ সেখানে মোতায়েনকৃত ন্যাটোর ট্যাকটিক্যাল বিমানবহর ভলগোগ্রাদ–কাজান–সামারা–আস্ত্রাখান রেখা বরাবর গভীরতা পর্যন্ত আমাদের ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম হবে। ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে রিকনিস্যান্স রাডার স্থাপনের মাধ্যমে ন্যাটো উরাল পর্বতমালা পর্যন্ত রাশিয়ার আকাশসীমা সুদৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
সর্বোপরি, আইএনএফ চুক্তি ধ্বংস করার পর পেন্টাগন খোলাখুলিভাবে নানা ধরনের ভূমিভিত্তিক আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি করছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫,৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ইউক্রেনে মোতায়েন করা হলে এরকম সিস্টেমগুলো রাশিয়ার পুরো ইউরোপীয় অংশ জুড়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে। মস্কো পর্যন্ত টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছাতে ৩৫ মিনিটের কম সময় লাগবে; খারকভ থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছাতে সাত থেকে আট মিনিট সময় লাগবে; আর হাইপারসনিক অস্ত্র পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচ মিনিট লাগবে। এটি গলায় ধরে থাকা ছুরির মতো। আমার এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, তারা এইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে চায়, যেমনটা তারা অতীতে বহুবার করেছে, ন্যাটোকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত করা, রুশ সীমান্তের কাছে সামরিক অবকাঠামো স্থাপন করা এবং আমাদের উদ্বেগ, প্রতিবাদ ও সতর্কবার্তা উপেক্ষা করার মাধ্যমে। মাফ করবেন, কিন্তু তারা এসব বিষয়ে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি এবং তাদের যেটা দরকার মনে হয়েছে সেটা করেছে।
অবশ্যই তারা ‘কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করতে থাকে কিন্তু কাফেলা এগিয়ে যায়’ এই প্রসিদ্ধ প্রবাদ অনুসরণ করে ভবিষ্যতেও একই রকম আচরণ করতে থাকবে। আমি সরাসরি বলতে চাই – এই ধরনের আচরণ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং ভবিষ্যতেও গ্রহণযোগ্য হবে না। তা সত্ত্বেও রাশিয়া বরাবরই এই অতি জটিল সমস্যাগুলোকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে, আলোচনার টেবিলে সমাধান করার পক্ষে ছিল।
[ভাষণের এই অংশে পুতিন ইউক্রেনের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তির ফলে রাশিয়ার প্রতি নিরাপত্তা ঝুঁকি কীভাবে বৃদ্ধি পাবে, সেটি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে তাদের ক্ষেপণাস্ত্রবহর মোতায়েন করলে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করতে পারবে। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে রাডার স্থাপন করলে সেক্ষেত্রে তারা উরাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে রুশ বিমানবাহিনীর গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে পারবে এবং যুদ্ধের সময় সহজেই রুশ বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য অভিযান চালাতে পারবে। সর্বোপরি, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার ওপর স্থলপথে আক্রমণ চালাতে চায়, সেক্ষেত্রে তারা ইউক্রেনকে একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
বস্তুত ১৯৯০–এর দশক থেকে ন্যাটো পূর্ব দিকে যত বেশি অগ্রসর হয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে তারা ততো বেশি সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করেছে এবং এর ফলে রাশিয়ার জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি ততো বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য রাশিয়া শুরু থেকেই ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণের তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে। রাশিয়া বারবার আলোচনার মাধ্যমে ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রোধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র) ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিষয়ে অটল ছিল এবং এমতাবস্থায় ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যেকার আলোচনা কখনোই সাফল্যমণ্ডিত হয়নি।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, কিন্তু তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্পর্শকাতরতাকে কখনো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র তুরস্কে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে এবং এক্ষেত্রে সোভিয়েত নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্পর্শকাতরতাকে তারা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। কিন্তু ১৯৬০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটবর্তী রাষ্ট্র কিউবায় পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করলে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং সোভিয়েতরা কিউবা থেকে উক্ত ক্ষেপণাস্ত্র অপসারণ না করলে সেক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরুর হুমকি দেয়। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি সমঝোতা হয় এবং সেই সমঝোতা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র অপসারণ করে নেয়।
কিউবায় সোভিয়েত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনকে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য যত বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছিল, ইউক্রেনের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তি এবং সেখানে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সম্ভাবনাকে রাশিয়া ঠিক ততো বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। তদুপরি, অতীতে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তি (যেমন: পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া, সুইডেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি) ইউক্রেনের ভূখণ্ড ব্যবহার করে রাশিয়ার ওপর আক্রমণ চালিয়েছে এবং এজন্য ইউক্রেনের ওপর শত্রুভাবাপন্ন কোনো বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে রুশদের ঐতিহাসিক ভীতি রয়েছে। পুতিনের এই ভাষণে সেটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে]
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে আমাদের বিস্তৃত দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা সচেতন। ২০০৮ সালে রাশিয়া এরকম একটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নিয়েছিল, যেটির অধীনে কোনো ইউরো–আটলান্টিক রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংগঠন অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে পারতো না। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব এই অজুহাতে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল যে, ন্যাটোর কার্যক্রমের ওপর রাশিয়াকে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে দেয়া উচিত নয়।
তদুপরি, আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছিল যে, কেবল ন্যাটো সদস্যরাই আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তা পেতে পারে।
গত ডিসেম্বরে আমরা আমাদের পশ্চিমা অংশীদারদের কাছে রুশ ফেডারেশন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তা বিষয়ক একটি খসড়া চুক্তি এবং রুশ ফেডারেশন ও ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ সংক্রান্ত একটি খসড়া চুক্তি হস্তান্তর করেছিলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো প্রত্যুত্তরে কিছু সাধারণ বক্তব্য দিয়েছে। সেগুলোতেও যৌক্তিকতার ছিঁটেফোঁটা ছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল গৌণ বিষয়াবলি সংক্রান্ত এবং প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, এটি বিষয়টিকে প্রলম্বিত করা ও আলোচনাকে বিপথে চালিত করার একটি প্রচেষ্টা।
আমরা সেই মোতাবেক জবাব দিয়েছি এবং জানিয়েছি যে, আমরা আলোচনার পথ অনুসরণ করতে প্রস্তুত, যদি রাশিয়ার মূল প্রস্তাবগুলোসহ বিষয়গুলোকে একটি প্যাকেজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেগুলোর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। প্রথমত, ন্যাটোর আরো সম্প্রসারণ রোধ করা। দ্বিতীয়ত, রুশ সীমান্তে আক্রমণাত্মক অস্ত্র মোতায়েন থেকে জোটটিকে বিরত রাখা। এবং সর্বশেষ, ইউরোপে জোটটির সামরিক সামর্থ্য ও অবকাঠামোকে সেই অবস্থানে ফেরত নিয়ে যাওয়া যেমনটা ১৯৯৭ সালে ছিল, যখন ন্যাটো–রাশিয়া ফাউন্ডিং অ্যাক্ট স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
আমাদের এই নীতিগত প্রস্তাবগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। পুনরাবৃত্তি করলে, আমাদের পশ্চিমা অংশীদাররা আবারো তাদের অতি পরিচিত বক্তব্য প্রদান করেছে যে, প্রতিটি রাষ্ট্রের মুক্তভাবে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথ বেছে নেয়ার বা কোনো সামরিক ঐক্য বা জোটে যোগদান করার অধিকার রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং আমরা ন্যাটোর কুখ্যাত ‘খোলা দরজা’ নীতির উল্লেখ শুনতে পাচ্ছি। তদুপরি, তারা আবার আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে এবং আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছে, যেটি তারা যেকোনো অবস্থাতেই করবে, যতদিন রাশিয়া তার সার্বভৌমত্ব ও সশস্ত্রবাহিনীকে শক্তিশালী করতে থাকবে। এটি নিশ্চিত যে, ইউক্রেনের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তারা আরেকবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য নতুন একটি অজুহাত বের করা বা বানানোর আগে দুইবার ভাববে না। তাদের এক ও একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ার উন্নতি রুদ্ধ করা। এবং তারা এমনটা করতে থাকবে, যেমনটা তারা আগেও করেছে কোনো আনুষ্ঠানিক অজুহাত ছাড়াই, কেবল এই কারণে যে আমাদের অস্তিত্ব আছে এবং আমরা কখনো আমাদের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ বা মূল্যবোধের ব্যাপারে সমঝোতা করব না।
আমি স্পষ্টভাবে এবং সরাসরি বলতে চাই: বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর সমানে সমানে সংলাপের জন্য আমাদের প্রস্তাবগুলোর প্রকৃতপক্ষে কোনো জবাব দেয়নি, যখন আমাদের দেশের প্রতি হুমকির মাত্রা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে, তখন রাশিয়ার তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আমরা ঠিক এটাই করব।
[ইতিপূর্বে রাশিয়া ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রোধ করার জন্য এবং ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের তীব্রতার মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে রাখার জন্য ন্যাটোকে নানা ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু ন্যাটো প্রতিটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেছে। ২০২১ সালে ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদানের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সৃষ্ট সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়া ন্যাটোর নিকট বিস্তৃত খসড়া চুক্তিপত্র পেশ করে এবং এটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করার প্রস্তাব দেয়। উক্ত চুক্তিপত্রে ৩টি মূল প্রস্তাব রাখা হয়েছিল: ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রোধ, রুশ সীমান্তে ন্যাটো কর্তৃক আক্রমণাত্মক অস্ত্র মোতায়েন স্থগিতকরণ এবং ন্যাটোর ১৯৯৭ সালের সীমানায় প্রত্যাবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো উক্ত রুশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
পুতিন তার ভাষণের এই অংশে জানান যে, ন্যাটো কর্তৃক রুশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। বস্তুত পুতিনের এই বক্তব্য ছিল ইউক্রেনের ওপর সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। ইউক্রেনের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তিকে রাশিয়া নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছিল এবং এক্ষেত্রে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় ছিল ন্যাটোয় যোগদান থেকে ইউক্রেনকে বিরত রাখা। কিন্তু ইউক্রেনের বর্তমান সরকারের তীব্র রুশবিরোধী নীতির কারণে কূটনৈতিক উপায়ে ইউক্রেনকে ন্যাটোয় যোগদান থেকে বিরত রাখা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনুরূপভাবে, ইউক্রেনে সহসা এমন কোনো সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে যেটি ইউক্রেনকে ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী নয়, এরকম কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সর্বোপরি, রাজনৈতিক যুদ্ধের (political warfare) মাধ্যমে কিংবা ইউক্রেনের রুশপন্থী শক্তিগুলোকে ব্যবহার করে অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে রাশিয়া যে ইউক্রেনে পছন্দনীয় কোনো সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে পারবে, এরকম সম্ভাবনাও ছিল না।
এমতাবস্থায় রাশিয়ার ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’র অর্থাৎ ইউক্রেনকে ন্যাটোয় যোগদান থেকে বিরত রাখার একমাত্র উপায় ছিল ইউক্রেন আক্রমণ করা এবং রাষ্ট্রটিকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করা। রাশিয়া সেই পথটিই বেছে নেয়। বস্তুত পুতিনের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রদত্ত এই ভাষণের দুই দিন পরেই রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনার ঘোষণা দেয় এবং ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ চালায়]
দনবাসের পরিস্থিতির ব্যাপারে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কিয়েভ জান্তার অভিজাতরা সেখানকার সংঘাত নিরসনের জন্য মিনস্ক প্যাকেজে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাদের অনিচ্ছার কথা খোলাখুলিভাবে বলা বন্ধ করছে না এবং তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী নয়। বরং তারা ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মতো দনবাসে একটি ব্লিৎজক্রিগ পরিচালনার চেষ্টা করছে। আমরা সকলেই জানি সেই বেপরোয়া পরিকল্পনাগুলোর ফলাফল কী হয়েছিল।
এমন একদিনও যাচ্ছে না যেদিন দনবাসের অধিবাসীদের ওপর গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে না। সম্প্রতি গঠিত বড় সামরিক বাহিনীটি অ্যাটাক ড্রোন, ভারী সরঞ্জাম, ক্ষেপণাস্ত্র, কামান ও মাল্টিপল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করছে। বেসামরিক মানুষদের হত্যা, অবরোধ, নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ জনগণের ওপর অত্যাচার পুরোদমে চলছে। এর কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে তথাকথিত সভ্য বিশ্ব, আমাদের পশ্চিমা সহকর্মীরা নিজেদেরকে যেটির একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন, এগুলো দেখছেন না, যেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ যে আতঙ্ক ও গণহত্যার সম্মুখীন সেটার আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই। কিন্তু সেগুলোর অস্তিত্ব আছে এবং এর কারণ হচ্ছে এই মানুষগুলো ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পশ্চিমা–সমর্থিত অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেনি, আর নিয়ানডার্থাল ও আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ এবং নব্য–নাৎসিবাদের দিকে অগ্রযাত্রার বিরোধিতা করেছে, যেগুলোকে ইউক্রেনের জাতীয় নীতির পর্যায়ে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। তারা নিজেদের ভূমিতে বসবাস করা, নিজেদের ভাষায় কথা বলা এবং নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করার মৌলিক অধিকারের জন্য লড়ছে।
এই দুঃখজনক ঘটনা কতদিন চলবে? এটাকে কতদিন সহ্য করতে হবে? রাশিয়া ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সবকিছু করেছে। এতগুলো বছর ধরে সে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে গৃহীত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২২০২ নম্বর প্রস্তাবের বাস্তবায়নের জন্য অটলভাবে এবং ধৈর্য্যের সঙ্গে চাপ দিয়ে গেছে, যেগুলোতে দনবাসের পরিস্থিতির নিরসনের জন্য ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে সম্পাদিত মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল।
সবকিছুই বিফল হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং রাদা সদস্যরা আসে যায়, কিন্তু কিয়েভে যে আগ্রাসী ও জাতীয়তাবাদী জান্তা ক্ষমতা দখল করেছে তারা ভিতরে ভিতরে অপরিবর্তিত রয়েছে। এটি সম্পূর্ণভাবে ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের ফল, এবং যারা তখন সহিংসতা, রক্তপাত ও অরাজকতার পথ বেছে নিয়েছিল, তারা তখনো দনবাস সমস্যার সামরিক সমাধান ছাড়া অন্য কোনো সমাধান চায়নি আর এখনো চায় না।
এমতাবস্থায় আমি একটি বিলম্বিত সিদ্ধান্ত নেয়া এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে এখনই স্বীকৃতি দেয়া দরকারি বলে মনে করছি।
আমি চাই রুশ ফেডারেশনের ফেডারেল অ্যাসেম্বলি এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করুক এবং এরপর প্রজাতন্ত্র দুইটির উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করুক। খুব তাড়াতাড়ি এই দুইটি নথি প্রস্তুত করা হবে এবং স্বাক্ষরিত হবে।
যারা কিয়েভে ক্ষমতা দখল করেছে এবং এখনো দখল করে রেখেছে, আমরা চাই তারা এখনই আক্রমণ বন্ধ করুক। অন্যথায় সম্ভাব্য রক্তপাত চলতে থাকার দায়ভার পুরোটাই ইউক্রেনের ক্ষমতাসীন জান্তার বিবেকের ওপর থাকবে।
আজ এই সিদ্ধান্তগুলো ঘোষণা করার সময় আমি রাশিয়ার নাগরিকবৃন্দ এবং দেশের দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর সমর্থন সম্পর্কে আশাবাদী।
ধন্যবাদ!
[ভাষণের একেবারে শেষ অংশে পুতিন দনবাস যুদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে ইউরোমাইদানের মাধ্যমে অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর রাষ্ট্রটির নতুন সরকার তীব্র রুশবিরোধী নীতি গ্রহণ করে এবং ফলশ্রুতিতে পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসে অবস্থিত দুইটি রুশপন্থী প্রদেশ দনেৎস্ক ও লুগানস্ক স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেনীয় সরকার স্বঘোষিত ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্ক’কে ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং দনবাসে একটি রক্তাক্ত ‘সন্ত্রাসবাদী–বিরোধী অভিযান’ পরিচালনা করে। প্রাথমিকভাবে রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে কার্যকরী সহায়তা প্রদান থেকে বিরত ছিল, কিন্তু ইউক্রেনীয় আক্রমণে দনেৎস্ক ও লুগানস্ক পুরোপুরি নির্মূল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে রাশিয়া তাদেরকে সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে।
অবশ্য রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত ছিল এবং ইউক্রেনের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে দনবাস সমস্যার সমাধানের পক্ষপাতী ছিল। ২০১৫ সালে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ইউক্রেন এবং দনেৎস্ক ও লুগানস্কের মধ্যে ‘মিনস্ক প্রোটোকল’ ও ‘মিনস্ক ২’ চুক্তি সম্পাদিত হয়। উক্ত চুক্তি অনুসারে, ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেনের অভ্যন্তরে দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং জাতিগত রুশদের অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে রাশিয়া উক্ত চুক্তির শর্তাবলি বাস্তবায়নের জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে কূটনীতি অব্যাহত রাখে, কিন্তু ইউক্রেন উক্ত চুক্তি বাস্তবায়িত করতে নারাজ ছিল এবং সামরিক উপায়ে দনেৎস্ক ও লুগানস্ক দখলের পক্ষপাতী ছিল।
দনবাস যুদ্ধের ফলে দনেৎস্ক ও লুগানস্কে কমপক্ষে ৪,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ওপর নিয়মিতভাবে গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং দনেৎস্ক ও লুগানস্কের জনসাধারণের জীবনযাত্রা ব্যাহত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ওপর বিস্তৃত মাত্রার একটি আক্রমণ চালায় এবং এটি প্রতীয়মান হয় যে, দনেৎস্ক ও লুগানস্ক নিজস্ব শক্তিতে ইউক্রেনীয় আক্রমণ মোকাবিলা করতে পারবে না। প্রজাতন্ত্র দুইটি থেকে হাজার হাজার মানুষ রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় দনেৎস্ক ও লুগানস্ক রাশিয়ার কাছে সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে। তদুপরি, এসময় ইউক্রেনীয়রা রুশ ভূখণ্ডের ওপরেও বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করে।
ইতিপূর্বে রাশিয়া ইউক্রেনকে বারবার জানিয়েছিল যে, ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ওপর আক্রমণ চালালে রাশিয়া তার জবাব দেবে। দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ওপর ইউক্রেনীয় আক্রমণের কিছু দিন আগেই রুশ আইনসভার নিম্নকক্ষ ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’য় রাশিয়া কর্তৃক দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল এবং প্রস্তাবটি অনুমোদন করার জন্য পুতিনের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। পুতিন তখন পর্যন্ত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত ছিলেন, কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন যে, রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। তিনি আরো জানান যে, শীঘ্রই রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্কের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করবে। উক্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দনেৎস্ক ও লুগানস্ক ইউক্রেনীয় আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাশিয়ার সহায়তা প্রার্থনা করতে পারতো এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আক্রমণ পরিচালনার একটি আইনগত ভিত্তি তৈরি হতো।
বস্তুত দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বীকৃতি প্রদান এবং রাষ্ট্র দুইটির সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ পরিচালনার আইনগত ভিত্তি তৈরি করছিল। পুতিনের এই ভাষণের পর উক্ত চুক্তিদ্বয় সম্পাদিত হয় এবং মাত্র দুই দিন পরেই রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্কের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরু হয়, যেটি এখন পর্যন্ত চলমান। এভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর আভাস প্রদানের মধ্য দিয়ে পুতিন তার ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণের সমাপ্তি ঘটান]
পুতিনের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণ রাশিয়ার অভ্যন্তরে ও বাইরে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি করে। ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্ব পুতিনের এই ভাষণের তীব্র নিন্দা জানায়, পুতিনকে ‘সাম্রাজ্যবাদী’, ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ ও ‘একনায়কতান্ত্রিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ এই ভাষণে পুতিন ইতিহাস বিকৃত করেছেন বলে অভিযোগ করেন। অন্যদিকে, রাশিয়ার ভিতরে ও বাইরে পুতিনের সমর্থকরা এই ভাষণটি সম্পর্কে তীব্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। বস্তুত রাশিয়ায় পুতিনের সমর্থকরা তো বটেই, পুতিনের বিরোধীদের একাংশও এই ভাষণটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। পুতিনের এই ভাষণের পর গভীর রাতেই দনেৎস্ক ও লুগানস্কের জনসাধারণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি লাভ উপলক্ষে আনন্দোৎসব শুরু করে। শীঘ্রই দনেৎস্ক ও লুগানস্ক রাশিয়ায় তাদের দূতাবাস স্থাপন করে এবং রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে।
কিন্তু দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ওপর ইউক্রেনীয় আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই অবস্থায় রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ভূখণ্ডে ‘শান্তিরক্ষী’ মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। অবশেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে পুতিন আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভাষণে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনার ঘোষণা দেন এবং একই সময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ চালায়। বর্তমানে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ পুরোদমে চলমান রয়েছে।