রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি সকলের কাছেই অনেক পরিচিত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার মাধ্যমে শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কুখ্যাত জাতিগত নিধন। মালামাল লুট, ধর্ষণ, নির্বিচারে হত্যায় মেতে ওঠে তারা। অরাজকতা ও অমানবিক নির্যাতনের সীমা পার করায় প্রাণ বাঁচাতে দেশ নিজ দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ যখন এই রোহিঙ্গাদের ধকল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন বিশ্বের শক্তিশালী মহলগুলোকে অনেকটা নিশ্চুপই দেখা যায়।
আর মিয়ানমারের তো না তখন, না এখন এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব হয়নি, সেটাই বারবার বলে দিচ্ছে নিষ্ক্রিয় শক্তিশালী মহলগুলোর অবস্থা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ নতুন নয়। তবে ২০১৭ সালের পর থেকে তা একেবারে সীমার বাইরে চলে গেছে।
১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার দেশের স্বীকৃত জনগোষ্ঠীদের তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে দিলে তারা রাষ্ট্রীয় পরিচয় সঙ্কটে পড়েন। আদি ভিটা ছাড়তে ও নিজ দেশ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয় মিয়ানমার। একটি জাতি উন্নতির শিখরে উঠতে চাইলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে এবং নিজস্ব সামরিক শক্তি থাকতে হবে। তবে সেগুলো সম্পন্ন করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয় রোহিঙ্গাদের। নির্যাতন ও সহিংসতার গণ্ডি পেরিয়ে নিজবলে শিক্ষিত হওয়া এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা রোহিঙ্গাদের বারবার হেনস্তার শিকার হতে হয়, বিতাড়িত হয় নিজের দেশ থেকে। কখনো আবার হারাতে হয় নিজের জীবনটাই।
দেশের অভ্যন্তরীণ কোলাহলের জেরে একসময় দেশ ছেড়েছিলেন রোহিঙ্গা আইনজীবী ড. কিয়াও হ্লা অং। বর্তমানে তিনি নেদারল্যান্ডসে বসবাস করছেন। ৮০ বছর বয়সী কিয়াও গত ৪২ বছর ধরে নিজ জাতি রোহিঙ্গার মানুষদের অধিকারের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। মানবতায় অবদান রাখার কারণে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক সম্মাননা ‘অরোরা পুরস্কার’-ও পান কিয়াও হ্লা অং। পুরস্কারের সাথে প্রাপ্ত ১১ লাখ ডলারের বেশিরভাগই দান করে দেন রোহিঙ্গাদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য কাজ করা সংগঠনগুলোকে।
তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এই অর্থ ব্যবহারের তাগিদ দেন। এখনও তিনি স্বপ্ন দেখেন রোহিঙ্গাদের বিজয়ের, তাদের পুনর্বাসনের, রাষ্ট্রীয় পরিচয় পাওয়ার অধিকারের। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের অমানবিক জীবনের বিপরীতে তিনি স্মৃতি রোমন্থন করেন এমন একটা সময়ের, যখন মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধবাদ ব্যবহার করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর কোনো প্রকার অত্যাচার করা হতো না। বয়সের কারণে সময়ের সাথে মিয়ানমারের পরিবর্তনের ক্রমধারা ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন কিয়াও। পুরস্কার পাওয়ার পর এই নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে হতাশাও প্রকাশ করেন তিনি।
১৯৬০ সালে রাখাইনের রাজধানী সিত্তের প্রাদেশিক কোর্টে কেরানি হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। তার ভাষ্যমতে, সেই সময়ে মিয়ানমারে এত ধর্মীয় ও জাতিগত ভেদাভেদ ছিল না। রোহিঙ্গা মুসলিমরা সরকারি অফিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী, ডাক্তার ছিল। সময়টা বেশ ভালোই ছিল। তবে সত্তরের দশক থেকে শুরু হয় সহিংসতার। দিন যত বাড়তে থাকে, নির্যাতনের পরিমাণও তত বাড়তে থাকে। বর্তমানে মায়ানমার তো দূরের কথা, রাখাইন প্রদেশেও রোহিঙ্গা মুসলিমদের কোনো ভালো পদ বা অবস্থায় দেখা যায় না। একসময় এই রাখাইন প্রদেশই ছিল রোহিঙ্গা মুসলিমদের মূল আবাসস্থল ও কর্মক্ষেত্র।
এ ভেদাভেদের কীভাবে শুরু হয়, এমন প্রশ্ন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে কিয়াও হ্লা অংকে করা হলে তিনি তার অভিমত ব্যক্ত করেন। তার মতে, ভেদাভেদের মূল উৎস ছিল এই ধারণা থেকে যে, অনবরত বাড়তে থাকা রোহিঙ্গারা আসলে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীর দল। এরকম বিশ্বাসের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে চাকরিতে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। তবে পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাছাড়া যারা চাকরি করতেন, তাদের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা শুরু করে সরকার।
রোহিঙ্গারা কোনো অভিযোগ করলে তা কোনো গুরুত্বই পেত না রোহিঙ্গা বিদ্বেষী মায়ানমার পুলিশদের কাছে। মিয়ানমারে প্রত্থম জাতিগত নিধন করা হয় ১৯৭৮ সালে। এই নিধনের ভয়ে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সেই সময়ে কোনোভাবে পার পেয়ে যান কিয়াও।
কিয়াও হ্লা তার কর্মজীবনের শুরুতে কোর্টে শ্রুতিলেখক হিসেবে কাজ করতেন। এই জাতিগত নিধনের চেষ্টার পর কাজের সুবাদে বিচারকদের সাথে রাখাইন প্রদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগও পান তিনি। রোহিঙ্গাদের ওপর হওয়া অন্যায় ও নির্যাতনের কারণে তিনি মনস্থির করেন যে, তার কিছু একটা করতে হবে। আর সে লক্ষ্য পূরণেই আইনজীবী হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হন। সেই লক্ষ্য পূরণও করেন। অর্জনের সেই স্বীকৃতি বলতে আজ শুধু ডিগ্রির ডকুমেন্টই আছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব থেকে কিয়াও হ্লা অং-ও ছাড় পাননি। ২০১২ সালের দাঙ্গায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় তার বাড়ি। যার ফলে তার সব সম্পদ ও সার্টিফিকেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
কিয়াও আইনজীবী হিসেবে তার প্রথম মামলা পান ১৯৮৬ সালে। সরকার একদল মুসলিম কৃষককে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হলে কিয়াও এর বিরোধিতা করেন। এজন্য তিনি আপিল করেন। সেই কৃষকদের আইনী সহায়তা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। বেআইনিভাবে তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিলো সরকারের। যেখানে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের পড়ার বা চাকরির সুযোগ দেওয়া হতো না। আর সেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের জমির ন্যায্য মূল্যও দেওয়া হচ্ছিল না। সাহায্যের মানসিকতা থাকলেও পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না।
সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মিথ্যা মামলার ঝামেলা তাকেও পোহাতে হলো। নিজ জাতির মানুষদের অধিকার রক্ষার্থে ও স্বার্থে কাজ করার ‘দোষে’ তাকে জেলেও যেতে হলো। জেলে কিয়াওকে রাখা হয় অমানবিক অবস্থায়। অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে সেলে তাকে রাখা হয় ও খাবার হিসেবে শুধু পচে যাওয়া সেদ্ধ সবজিই জোটে। তার ভাষ্যমতে, শুনানির দিনগুলোতে ৪০-৫০ জন কয়েদিকে এমন একটি ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হতো, যেখানে সর্বোচ্চ ১০ জনের থাকা সম্ভব। দুই বছরে তাকে ১০০ বার কোর্টে যেতে হয়। জেলের টয়লেটের অবস্থাও ছিলো শোচনীয়।
এর মধ্যে বাত ও গ্যাস্ট্রিকের কারণে তার পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হয়। তা-ও চিকিৎসা মেলেনি জেলে থাকা অবস্থায়। দুই বছর নিজের মামলা নিজেই লড়ে যাওয়ার পর ১৯৮৮ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
ছাড়া পাওয়ার পর কিয়াও তার পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ফর হিউম্যান রাইটস’। এর লক্ষ্য ছিলো বৈধ উপায়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার সংরক্ষণ করা।
তবে কিছুদিন পর এক জেনারেলের আদেশে তাকে আবারও গ্রেফতার করা। রোহিঙ্গাদের ভালো কিছু করতে দেখার বা রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দেখার মতো সহ্যশক্তি মিয়ানমারের খুব কম মানুষের মধ্যেই তখন ছিল বা এখনও আছে। পরে ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে এক ঘণ্টার শুনানির পর এবং একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের সাপেক্ষে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জেলে যাওয়ার পর তিনি আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যে, রোহিঙ্গাদের সাথে কত বেশি অন্যায় করা হচ্ছে; যখন তিনি আট ও নয় বছরের রোহিঙ্গা শিশুদেরকেও তুচ্ছ অপরাধের কারণে বছরের পর বছর জেল কাটার শাস্তি পেতে দেখেন। চার বছর জেলে থাকার পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে অবশেষে জেল হাসপাতালের একটি প্রাইভেট রুমে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু, ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তার বাড়ি ও লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়ে তাকে আবারো গ্রেফতার করা হয়। দু’মাস পর ছাড়া পেলেও এক বছর পর আবারো জেলে যেতে হয় তাকে। পরবর্তী সময়ে জেল থেকে বের হওয়ার পর নিজের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করতে বা যোগাযোগ করতে বেগ পেতে হয় তাকে। কিয়াও রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করছিলেন বিধায় তার পরিবারকেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অভাবে দিন কাটাতে তার পরিবারকে।
এত অত্যাচারের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রবাসে থেকেও তাদের অধিকারের জন্য লড়ছেন। রোহিঙ্গাদের প্রবীণ এই বীর এখনো স্বপ্ন দেখেন, রোহিঙ্গাদের বসবাসের একটি নিরাপদ স্থানের, একটি শান্তিপূর্ণ জীবনের।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো-
১) রোহিঙ্গা রঙ্গ – রোহিঙ্গা ইতিহাস বাস্তবতা ভবিষ্যৎ
২) রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস
৩) রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যু