২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর একটি তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ আনম্যানড কমব্যাট এরিয়াল ভেহিকল (ইউসিএভি) থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে রুশ–সমর্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্কের সশস্ত্রবাহিনীর একটি সোভিয়েত–নির্মিত ১২২ মিলিমিটার ‘ডি–৩০’ হাউইটজার ধ্বংস হয়। এটি ছিল দনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন কর্তৃক প্রথমবারের মতো তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহার, এবং এর ফলে দনবাসের পরিস্থিতি নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তদুপরি, ইউক্রেন কর্তৃক তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ব্যবহারের ফলে রুশ–ইউক্রেনীয় ও রুশ–তুর্কি সম্পর্কে নতুন করে একটি সঙ্কট সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
দনবাসে রুশ–ইউক্রেনীয় দ্বন্দ্বের পটভূমি
রুশ ও ইউক্রেনীয়রা উভয়েই বৃহত্তর ‘পূর্ব স্লাভিক’ জাতিগোষ্ঠীর অংশ ও প্রধানত অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী, এবং তাদের মধ্যে অত্যন্ত বিস্তৃত ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সংযোগ বিদ্যমান। ইউক্রেনের কিয়েভকে রুশ রাষ্ট্র ও সভ্যতার উৎপত্তিস্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রুশ সাম্রাজ্যের সময়ে বর্তমান রুশ ভূখণ্ডকে ‘বৃহৎ রাশিয়া’ ও ইউক্রেনকে ‘ক্ষুদ্র রাশিয়া’ হিসেবে অভিহিত করা হতো, এবং সোভিয়েত আমলে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও ভ্রাতৃসুলভ প্রজাতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বস্তুত রাশিয়ার নিকট ইউক্রেনের গুরুত্ব এত বেশি বলে বিবেচনা করা হয় যে, পোলিশ–মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিবিগন্যু ব্রেজেজিনস্কি এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, “ইউক্রেনকে ছাড়া রাশিয়া আর একটি সাম্রাজ্য থাকে না!”
কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিভাজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বস্তুত ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেন রুশ রাষ্ট্রের এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মোঙ্গল আক্রমণের ফলে রুশ ভূমি প্রায় দুই শতাব্দীর জন্য অস্থিতিশীলতা ও অরাজকতায় নিমজ্জিত হয় এবং এসময় বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড রুশদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর হস্তগত হয়। এসময় থেকে স্বতন্ত্র ইউক্রেনীয় জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ বর্তমান ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের সিংহভাগ রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু ততোদিনে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি বিকাশ লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো ইউক্রেনীয়দের মধ্যেও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে এবং রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো (বিশেষত অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও জার্মানি) রাশিয়াকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার বিস্তারে সহায়তা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রুশ ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং রাশিয়ার অধীনস্থ ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড (বর্তমান ইউক্রেনের সিংহভাগ) ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অধীনস্থ পশ্চিম ইউক্রেনের সমন্বয়ে একটি ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড গৃহযুদ্ধ, বিদেশি আক্রমণ, জাতিগত দাঙ্গাসহ নানান অরাজকতায় নিপতিত হয় এবং সোভিয়েত রুশ বলশেভিকদের সহায়তায় ইউক্রেনীয় বলশেভিকরা ইউক্রেনের শাসনক্ষমতা হস্তগত করে। ১৯২০–১৯২১ সালের পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউক্রেন পোল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয় এবং পশ্চিম ইউক্রেন পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং বলশেভিকদের গৃহীত ‘ইউক্রেনীয়করণ’ নীতির ফলে ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের ফলে পশ্চিম ইউক্রেন ও ট্রান্সকার্পেথিয়া ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৯১ সালে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তখন থেকেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি অস্বস্তিকর সহাবস্থানমূলক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা পেন্ডুলামের মতো মার্কিন–নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্কের মধ্যে দোদুল্যমান ছিল। ইউক্রেনের প্রথম রাষ্ট্রপতি লিওনিদ ক্রাভচুক (১৯৯১–১৯৯৪) সাধারণভাবে পশ্চিমামুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন, কিন্তু ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি লিওনিদ কুচমা (১৯৯৪–২০০৫) পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেন। ২০০৪–২০০৫ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত পশ্চিমা–সমর্থিত ‘কমলা বিপ্লব’/অভ্যুত্থানের ফলে ভিক্তর ইয়ুশ্চেঙ্কো (২০০৫–২০১০) ইউক্রেনের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হন এবং তিনি সম্পূর্ণ পশ্চিমাপন্থী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন।
ইউক্রেনের চতুর্থ রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ (২০১০–১৪) পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করেন, কিন্তু ২০১৩–১৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত পশ্চিমা–সমর্থিত ‘ইউরোমাইদান বিপ্লব’/অভ্যুত্থানের ফলে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ইউক্রেনে একটি অত্যন্ত পশ্চিমাপন্থী ও রুশবিদ্বেষী সরকার ক্ষমতাসীন হয়। ইউক্রেনের পরবর্তী তিনজন রাষ্ট্রপতি (ওলেক্সান্দর তুর্চিনভ, পেত্রো পোরোশেঙ্কো এবং ভলোদিমির জেলেনস্কি) সম্পূর্ণ পশ্চিমাপন্থী ও রুশবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছেন।
ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইউক্রেন মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’তে যোগদান করতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে ও অন্যান্য কারণে রাশিয়া ইউক্রেনে একধরনের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ পরিচালনা করতে শুরু করে। ২০১৪ সালের মার্চে রাশিয়া প্রায় বিনা রক্তপাতে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং এপ্রিলে পূর্ব ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় সরকার ও সরকারবিরোধী পূর্ব ইউক্রেনীয়দের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনীয়দের সহায়তা করতে শুরু করে। রুশ সহায়তায় পূর্ব ইউক্রেনীয় ইনসার্জেন্টরা পূর্ব ইউক্রেনের দনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশদ্বয়ের অংশবিশেষ দখল করে নেয় এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক’ নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিকভাবে দনেৎস্ক, লুহানস্ক ও এর আশেপাশের কয়লাসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, এবং এজন্য পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ ‘দনবাস যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেন, দনেৎস্ক, লুহানস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে ‘মিনস্ক প্রোটোকল’ নামক একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু ২০১৫ সালের জানুয়ারি নাগাদ যুদ্ধবিরতি অকার্যকর হয়ে পড়ে ও নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুধ্যমান পক্ষগুলোর মধ্যে ‘মিনস্ক ২’ চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং এরপর এতদঞ্চলে উভয় পক্ষের অধিকৃত ভূখণ্ডের পরিমাণ আর খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি, কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে ক্ষুদ্র মাত্রায় সামরিক সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। ইউক্রেনীয় সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধের ফলে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে অন্তত ৪,৫৬৪ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত, অন্তত ৭০ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিখোঁজ এবং ৯,৫০০ থেকে ১০,৫০০ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য আহত হয়েছে। অন্যদিকে, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে প্রজাতন্ত্র দুইটিতে সামরিক ও বেসামরিক মিলিয়ে অন্তত ৬,৩১২ জন নিহত হয়েছে।
ইউরোমাইদান, রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল ও দনবাস যুদ্ধের ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেন পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষত ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ব্যাপক রুশবিরোধী নীতির প্রবর্তন করেছে। তারা ইউক্রেনের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা থেকে রুশ ভাষাকে অপসারণ করেছে, রুশ অর্থোডক্স চার্চ থেকে ইউক্রেনীয় অর্থোডক্সদের আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র ‘ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ’ সৃষ্টি করেছে, ইউক্রেনীয় ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখে ইউক্রেনীয় সভ্যতাকে রুশ সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তীব্র রুশবিরোধী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও নব্য নাৎসি গ্রুপগুলোকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দিচ্ছে এবং ইউক্রেনীয় জনসাধারণের রুশপন্থী অংশের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন শুরু করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করেছে এবং ইতিপূর্বে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত রুশ ও ইউক্রেনীয় অর্থনীতিকে পৃথক করে ইউক্রেনের ওপর রুশ অর্থনীতির নির্ভরশীলতা শূণ্যে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরে সেরকমভাবে কোনো ইউক্রেনীয়বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বস্তুত, রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষ্যমতে, ইউক্রেন ধীরগতিতে কিন্তু নিশ্চিতভাবে রাশিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী রাষ্ট্রে রূপ নিচ্ছে, যেটিকে পুতিন অভিহিত করেছেন এক ধরনের ‘প্রতি–রাশিয়া’ (Anti-Russia) হিসেবে। সম্প্রতি রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রুশ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘রাশান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলে’র পরিচালক আন্দ্রেই কোর্তুনভ ইউক্রেনকে ‘রাশিয়ার পাকিস্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার ভাষ্যমতে, পাকিস্তান যেমন মূল ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারতের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ও ভারতের প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রে রূপ নিয়েছে, ২০১৪–পরবর্তী ইউক্রেন অনুরূপভাবে (১৯৯১ সালে) মূল রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ও রাশিয়ার প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রে রূপ নিচ্ছে।
দনবাস যুদ্ধে তুর্কি ড্রোনের অনুপ্রবেশ
২০২১ সালে দনবাস যুদ্ধ বিগত বছরের তুলনায় তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনীয় সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, চলমান বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ দনেৎস্ক ও লুহানস্ক সৈন্যদের হাতে অন্তত ৫২ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত হয়েছে, যেখানে ২০২০ সালে সব মিলিয়ে ৫০ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত হয়েছিল। তদুপরি, ২০২১ সালের এপ্রিলে রাশিয়া রুশ–ইউক্রেনীয় সীমান্তের কাছে প্রায় ১ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করেছিল এবং এর ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া পরবর্তীতে রুশ–ইউক্রেনীয় সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া ও বেলারুশের ভূখণ্ডে প্রায় ২ লক্ষ রুশ ও বেলারুশীয় সৈন্য ‘জাপাদ–২০২১’ নামক একটি যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। এই মহড়াটির মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল ন্যাটো, কিন্তু রাশিয়া ও বেলারুশের প্রতিবেশী এবং ন্যাটোপন্থী ইউক্রেন উক্ত মহড়াকে নিজেদের প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখেছে।
এই পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর ইউক্রেনীয় সৈন্যরা তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোনের মাধ্যমে পরিচালিত একটি ড্রোন স্ট্রাইকে দনেৎস্কের একটি ‘ডি–৩০’ হাউইটজার ধ্বংস করে। ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফের ফেসবুক পেইজে প্রকাশিত একটি পোস্ট অনুযায়ী, দনেৎস্ক সৈন্যরা উক্ত হাউইটজারটি ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় সরকার–নিয়ন্ত্রিত গ্রানিৎনোয়ে গ্রামের কাছে মোতায়েনকৃত ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ৯৩তম মেকামাইজড ব্রিগেডের ওপর গোলাবর্ষণ করছিল এবং তাদের গোলাবর্ষণের ফলে ১ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত ও ২ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য আহত হয়। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভালেরি জালুঝনির নির্দেশে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনী উক্ত হাউইটজারটির অবস্থানের ওপর ড্রোন আক্রমণ পরিচালনা করে এবং হাউইটজারটি ধ্বংস করে দেয়।
উল্লেখ্য, উক্ত ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে দনেৎস্কের হাউইটজারটি ধ্বংস হয়, কিন্তু হাউইটজারটির ক্রুদের হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফের ভাষ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোনটি দনবাসের যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করেনি এবং ইউক্রেনীয়–নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমা থেকে উক্ত আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এটি ছিল দনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন কর্তৃক প্রথমবারের মতো তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোনের ব্যবহার। এক্ষেত্রে তুর্কি–ইউক্রেনীয় সম্পর্ক এবং ইউক্রেনের নিকট তুরস্ক কর্তৃক কমব্যাট ড্রোন রপ্তানির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তুর্কি–ইউক্রেনীয় মৈত্রী এবং রুশ–ইউক্রেনীয় দ্বন্দ্বে তুর্কি ভূমিকা
১৪৭৫ থেকে ১৭৭৪ সাল পর্যন্ত চেঙ্গিস খানের বংশধরদের দ্বারা শাসিত ও ক্রিমিয়ান তাতার–অধ্যুষিত ক্রিমিয়ান খানাত ছিল ওসমানীয় রাষ্ট্রের একটি ‘আশ্রিত রাষ্ট্র’ (protectorate) এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ইউক্রেনের অংশবিশেষ ওসমানীয় শাসনাধীনে ছিল। এই প্রেক্ষাপটে তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তুরস্ক ছিল ইউক্রেনকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি এবং রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংযোগ স্থাপিত হয়। তুরস্ক বিশেষ করে ক্রিমিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে উৎসাহী ছিল। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মতো তুরস্কও রাশিয়ার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। তারা ক্রিমিয়াকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকে, কিন্তু একইসঙ্গে বিভিন্ন তুর্কি কোম্পানি ক্রিমিয়ায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। অনুরূপভাবে, ক্রিমিয়া ও দনবাসকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর যে বিস্তৃত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তুরস্ক তাতে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানায়।
২০১৫ সালের নভেম্বরে তুর্কিরা তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে একটি রুশ সামরিক বিমান ভূপাতিত করে এবং এর মধ্য দিয়ে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে এক নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ক্রিমিয়ান সরকার তুরস্কের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সংযোগ ছিন্ন করে। অন্যদিকে, এই ঘটনার পর তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পশ্চাতে মূল কারণ ছিল উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব। ইউক্রেন তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার সিদ্ধান্তকে জোরালোভাবে সমর্থন করে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করতে উদ্যোগী হয়।
এদিকে ২০১৬ সালের জুনে রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য তুরস্ক রাশিয়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তুরস্কে সংঘটিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমা বিশ্বের আগে রাশিয়া তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে এবং এর ফলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে পরিপূর্ণ মৈত্রী স্থাপনের সুযোগ নেই, কারণ বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যুতে তাদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। এজন্য ২০১৬ সালের পরবর্তী সময়ে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের জটিল সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যেটিকে বিশ্লেষকরা ‘প্রতিযোগিতামূলক সহযোগিতা’ (competitive cooperation) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত সিরিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ ককেশাস, মধ্য এশিয়া – প্রতিটি অঞ্চলেই রাশিয়া ও তুরস্ক একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, কিন্তু এই প্রতিযোগিতা যাতে সরাসরি সংঘাতে রূপ না নেয়, সেজন্য উভয় পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে থাকে।
প্রাথমিকভাবে তুরস্ক ইউক্রেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি, কারণ দনবাসে সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ইচ্ছা বা সামর্থ্য তুরস্কের ছিল না। এজন্য ইউক্রেনের প্রতি তুরস্কের সমর্থন ক্রিমিয়া ইস্যুতে ইউক্রেনীয় অবস্থানের প্রতি মৌখিক সমর্থন প্রদান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তুরস্ক ক্রমশ তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার প্রচেষ্টা চালায় এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তুর্কিদের দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেনের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একদিকে তারা রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও তাদের সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাতে পারবে, কারণ তুরস্ক কর্তৃক রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাপন্থী ইউক্রেনকে সমর্থন প্রদানকে পশ্চিমা বিশ্ব ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করবে। তদুপরি, তুরস্ক ইউক্রেনকে তাদের ক্রমবর্ধমান সামরিক শিল্পখাতের একটি বাজারে পরিণত করতে এবং ইউক্রেনের কাছ থেকে কিছু প্রযুক্তি (যেমন: ইঞ্জিন) সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক।
ইউক্রেনের তুর্কি ড্রোনপ্রীতি
এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষত ড্রোন, বিক্রি করতে শুরু করে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক প্রায় ৬ কোটি ৯০ লক্ষ (বা ৬৯ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূল্যে ইউক্রেনকে ৬টি ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ ড্রোন, ৩টি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন ও ২০০টি ‘স্মার্ট অ্যামিউনিশন’ সরবরাহ করবে। দুই মাসের মধ্যে তুরস্ক উক্ত সরঞ্জাম ইউক্রেনের কাছে সরবরাহ করে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে তুরস্ক ইউক্রেনীয় নৌবাহিনীর নিকট ৬টি ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ সরবরাহ করে এবং এর মধ্য দিয়ে মোট ১২টি তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ইউক্রেনীয় নৌ ও বিমানবাহিনীর হস্তগত হয়।
প্রচারমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন প্রায় ৫০টি তুর্কি–নির্মিত বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ক্রয় করতে ইচ্ছুক। শুধু তাই নয়, ইউক্রেন নিজস্ব ভূখণ্ডে উক্ত ড্রোন উৎপাদন করতেও আগ্রহী। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি তারান এবং তুর্কি কোম্পানি ‘বায়কার মাকিনা’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হালুক বায়রাক্তার ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে একটি যৌথ ড্রোন প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এই স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি মন্তব্য করেন যে, তারা দীর্ঘ সময় ধরে এই মুহূর্তের প্রতীক্ষা করে আছেন এবং এটি তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ২০২১ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম ইউক্রেনের লভিভ শহরে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোলুর সঙ্গে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময় ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা জানান যে, ইউক্রেন তুর্কি ড্রোন উৎপাদনের জন্য একটি কারখানা স্থাপন করবে এবং যে ভূমিতে কারখানাটি স্থাপিত হবে সেটি ইতোমধ্যে বাছাই করা হয়েছে।
বস্তুত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও তুরস্কের মিত্ররা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ কমব্যাট ড্রোন ব্যবহার করেছে। বিগত বছরগুলোতে তুরস্কভিত্তিক কুর্দি মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘পিকেকে’র বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার জন্য তুর্কি সৈন্যরা উক্ত ড্রোন ব্যবহার করেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি–আগস্টে তুর্কি ও তুর্কি–সমর্থিত ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ডে’র (জিএনএ) সৈন্যরা উক্ত ড্রোন ব্যবহার করে ইমারাতি–সমর্থিত ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ সৈন্যদের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে এবং এলএনএর ত্রিপোলি অবরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে তাদেরকে পশ্চিম লিবিয়া থেকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করতে সক্ষম হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি–মার্চে তুর্কি সৈন্যরা উক্ত ড্রোন ব্যবহার করে সিরিয়ার ইদলিবে সিরীয় সৈন্য ও ইরানি–সমর্থিত মিলিশিয়াদের এবং বিশেষত সিরীয় আর্মার্ড বহরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর–নভেম্বরে তুর্কি ও আজারবাইজানি সৈন্যরা উক্ত ড্রোন ব্যবহার করে আর্মেনিয়া ও আর্মেনীয়–সমর্থিত আর্তসাখের সশস্ত্রবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে এবং তাদেরকে পরাজিত করে আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের সিংহভাগ অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়।
উল্লিখিত যুদ্ধগুলোর কার্যত প্রতিটিতেই রাশিয়া ও তুরস্ক পরস্পরের বিরুদ্ধে ছিল। লিবিয়ায় রাশিয়া এলএনএকে সমর্থন দিচ্ছে এবং রুশ মার্সেনারি সংগঠন ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ এলএনএর পক্ষে যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে তুরস্ক জিএনএর পক্ষে যুদ্ধ করছিল। সিরিয়ায় রুশ সৈন্যরা সরাসরি সিরীয় ও ইরানি সশস্ত্রবাহিনী এবং ইরানি–সমর্থিত মিলিশিয়াদের পক্ষে যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে তুরস্ক ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র (এসএনএ) পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত। আর্মেনিয়া রাশিয়ার সামরিক মিত্র ও রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য, অন্যদিকে আজারবাইজান তুরস্কের সামরিক মিত্র। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ প্রক্সিরা পর্যুদস্ত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তুর্কি–নির্মিত কমব্যাট ড্রোন বিশেষত পুরনো সোভিয়েত–নির্মিত সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকরী।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনীয় সরকার ধারণা করছে যে, তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ব্যবহার করে দনবাসে চলমান যুদ্ধের চাকা অনুরূপভাবে ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব। দনেৎস্ক ও লুহানস্ক রুশ প্রক্সি এবং তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের একটি বড় অংশ সোভিয়েত আমলে নির্মিত। এমতাবস্থায় ইউক্রেনীয় সরকার দনবাসকে ‘লিবিয়া ২.০’ বা ‘কারাবাখ ২.০’–এ রূপান্তরিত করতে আগ্রহী। সম্প্রতি দনেৎস্কের ওপর পরিচালিত ইউক্রেনীয় ড্রোন স্ট্রাইককে ইউক্রেনীয় সরকারের অনুরূপ ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু দনবাস কি সত্যিই তুর্কি–নির্মিত ড্রোনের বদৌলতে ‘লিবিয়া ২.০’ বা ‘কারাবাখ ২.০’–এ রূপান্তরিত হবে? পরবর্তী পর্বে এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।