২০২০ সালে তিনটি যুদ্ধক্ষেত্রে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ অ্যাটাক ড্রোন বিশেষ কার্যকারিতার পরিচয় দিয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি–মার্চে সিরিয়ার মিলিট্যান্ট–নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী ও তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টরা সিরীয় আরব সশস্ত্রবাহিনী ও সিরীয় সরকারপন্থী মিলিশিয়াদের আক্রমণ রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ–জুনে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী ও তুর্কি–সমর্থিত লিবীয় ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ডে’র (জিএনএ) সৈন্যরা ত্রিপোলিতে লিবীয় ‘হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস’ সরকারের সমর্থনপুষ্ট ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র (এলএনএ) আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং পশ্চিম লিবিয়া থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বশেষ, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর–নভেম্বরে নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধে তুর্কি–সমর্থিত আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী আর্মেনীয় ও আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীকে পরাজিত করে আর্তসাখের বিস্তৃত অংশ অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে তুর্কি ও তুর্কি–সমর্থিত পক্ষগুলোর সামরিক সাফল্যের ক্ষেত্রে তুর্কি–নির্মিত ড্রোন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
স্বাভাবিকভাবেই, যুদ্ধক্ষেত্রে তুর্কি ড্রোনের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করে বেশ কিছু রাষ্ট্র এই সামরিক সরঞ্জাম হস্তগত করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তুর্কি সামরিক বিশ্লেষক জান কাসাপোলুর ভাষ্যমতে, কিছু কিছু রাষ্ট্রের জন্য তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ‘জনপ্রিয় কৌশলগত সামরিক সম্পদ’ এবং ‘সামরিক আধুনিকায়নের সস্তা সমাধানে’ পরিণত হয়েছে। বিশেষত নাগর্নো–কারাবাখে বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্তসাখ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্জিত আজারবাইজানি সামরিক সাফল্যে তুর্কি ড্রোনের ভূমিকা সেইসব রাষ্ট্রকে এই ড্রোন সংগ্রহ করতে উৎসাহিত করছে, যাদের নিজেদের ভূখণ্ডে এরকম বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্র/আন্দোলন রয়েছে। তদুপরি, আর্মেনিয়া প্রধানত রুশ/সোভিয়েত–নির্মিত সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে, এবং আর্মেনীয়দের ব্যবহৃত রুশ/সোভিয়েত–নির্মিত সামরিক সরঞ্জামের বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোনের সাফল্যের ফলে সেই রাষ্ট্রগুলো তুর্কি ড্রোন ক্রয় করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, যারা রুশ সামরিক–রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিহত করতে আগ্রহী।
রুশ সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র হিসেবে আজারবাইজান তুর্কি ড্রোন ক্রয় করেছে এবং ইতোমধ্যে সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় রুশ সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেন নিজস্ব সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর জন্য তুর্কি অ্যাটাক ড্রোন ক্রয় করেছে এবং তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে ড্রোন উৎপাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনে রুশ–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রদ্বয় দনেৎস্ক ও লুগানস্ক/লুহানস্ক পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে ইউক্রেন তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করতে আগ্রহী। তদুপরি, ২০১৪ সালে ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিয়া উপদ্বীপ হারিয়েছে এবং অঞ্চলটি যুদ্ধের মাধ্যমে পুনর্দখল করার ইচ্ছা ইউক্রেনীয় সরকার এখনো পরিত্যাগ করেনি। এক্ষেত্রেও তারা তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করতে আগ্রহী।
রুশ সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে পোল্যান্ড তুর্কি ড্রোন ক্রয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং আরেকটি রুশ সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র লাতভিয়া তুর্কি ড্রোন ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, পোল্যান্ড মার্কিন–নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক জোটের প্রথম সদস্য রাষ্ট্র, যারা তুর্কি ড্রোন ক্রয় করেছে, এবং লাতভিয়াও ন্যাটোর সদস্য। তুর্কি বিশ্লেষক ওমের ওজকিজিলজিকের মতে, পরবর্তীতে ন্যাটো সদস্য রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া এবং ন্যাটো–বহির্ভূত কাজাখস্তানও তুর্কি ড্রোন ক্রয় করতে পারে। অবশ্য কাজাখস্তান রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য এবং হাঙ্গেরি ন্যাটোর সদস্য হলেও বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার কোনো প্রকাশ্য ভূখণ্ডগত বিরোধ নেই এবং এই রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডে রুশ–সমর্থিত কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্র/আন্দোলনও নেই। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে শেষোক্ত রাষ্ট্রগুলোর সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তীব্র রুশবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে থাকে এবং ‘রুশ হুমকি মোকাবিলার’র উদ্দেশ্যে তুর্কি ড্রোন ক্রয় এই প্রক্রিয়ারই অংশ।
তুর্কি বিশ্লেষক ওমের ওজকিজিলজিকের ভাষ্যমতে, ২০২০ সালের উক্ত তিনটি যুদ্ধে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, কোনো রাষ্ট্র রুশ প্রভাব প্রতিহত করতে চাইলে সেজন্য আর তাদের জন্য পশ্চিমা সহায়তা লাভ করা আবশ্যক নয়। তার মতে, রুশ প্রভাব প্রতিহত করতে আগ্রহী রাষ্ট্রগুলো এখন পশ্চিমা বিশ্বের পরিবর্তে তুরস্কের ওপর নির্ভর করতে পারে এবং এই পরিস্থিতির কারণে রুশ কৌশলগত ক্যালকুলাসে একটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। তুর্কি সামরিক বিশ্লেষক জান কাসাপোলুও মনে করেন যে, রুশ সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর কাছে ড্রোন বিক্রির মধ্য দিয়ে তুরস্ক কার্যত রুশ সশস্ত্রবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক জেলাদ্বয়কে তুর্কি ড্রোনযুদ্ধের হাতিয়ার দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেলেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আঙ্কারা রাশিয়ার সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা অর্জন করতে পারে।
কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, উপরে যে তিনটি যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোতে তুরস্ক, লিবিয়ার ‘জিএনএ’ সরকার এবং আজারবাইজানের প্রতিদ্বন্দ্বীরা রুশ/সোভিয়েত–নির্মিত সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত ছিল ঠিকই, কিন্তু রাশিয়া সরাসরি তুরস্ক বা তুর্কি–সমর্থিত পক্ষগুলোর বিপক্ষে যুদ্ধ করেনি। রাশিয়া সিরীয় সরকারের জোরালো সমর্থক এবং ২০১৫ সালে রুশরা সিরীয় গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, কিন্তু ইদলিবে সিরীয় আরব সশস্ত্রবাহিনীর পরিচালিত আক্রমণে মস্কোর সক্রিয় সমর্থন ছিল না এবং এজন্য ইদলিবে তুর্কি ও সিরীয় সৈন্যদের মধ্যেকার লড়াইয়ে মস্কো সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি।
অনুরূপভাবে, লিবীয় গৃহযুদ্ধে মস্কো হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস–সমর্থিত এলএনএকে সমর্থন দিচ্ছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এলএনএর পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি। অবশ্য রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ মার্সেনারিরা এলএনএর পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে মস্কো তুর্কি–সমর্থিত জিএনএর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখেছে। ত্রিপোলিতে এলএনএর পরিচালিত আক্রমণাভিযানে মস্কোর সক্রিয় সমর্থন ছিল না এবং এজন্য ২০২০ সালে এলএনএর বিরুদ্ধে পরিচালিত তুর্কি–জিএনএ অভিযানে মস্কো হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত ছিল।
একইভাবে, আর্মেনিয়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামরিক–রাজনৈতিক মিত্র এবং রুশ–নিয়ন্ত্রিত জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য, কিন্তু আজারবাইজানের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান এবং আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্বে রাশিয়া বরাবরই অন্তত বাহ্যিকভাবে উভয় পক্ষ থেকে সমদূরবর্তী অবস্থান বজায় রেখেছে। তদুপরি, আর্মেনিয়ার বর্তমান পশ্চিমাঘেঁষা সরকার ক্রমশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং এজন্য বেশকিছু বিশ্লেষকের ধারণা, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধের সৃষ্টি করার পশ্চাতে মস্কোরও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। ফলে স্বভাবতই যুদ্ধের সময় মস্কো আর্মেনিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত ছিল।
অর্থাৎ, সিরিয়া, এলএনএ এবং আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ সকলেই ব্যাপকভাবে রুশ/সোভিয়েত–নির্মিত সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে এবং তুর্কি–নির্মিত অ্যাটাক ড্রোনের হাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু এই যুদ্ধগুলোর কোনোটিতেই রাশিয়া সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। তুর্কি সৈন্য এবং তুর্কি–সমর্থিত সৈন্য/মিলিশিয়া/মার্সেনারিদের যুদ্ধ করতে হয়েছে মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরীয় আরব সশস্ত্রবাহিনী, কতিপয় আঞ্চলিক মিলিশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত এলএনএ এবং পুরনো সোভিয়েত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আর্মেনীয়/আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোনের সাফল্য অর্জন যতটা সহজ ছিল, সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করে অতটা সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সিরিয়া, এলএনএ এবং আর্মেনিয়া/আর্তসাখের তুলনায় রাশিয়ার সামরিক সামর্থ্য বহুগুণ বেশি।
তুর্কি বিশ্লেষক কাসাপোলু এই দিকটির ওপর আলোকপাত করেছেন এবং এই বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধকে তিনি উদাহরণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং রুশ সীমান্তবর্তী অন্যান্য রাষ্ট্র (বিশেষত ইউক্রেন) তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করে আর্মেনিয়া/আর্তসাখের বিরুদ্ধে আজারবাইজানিদের অর্জিত সাফল্যের অনুরূপ সাফল্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্জন করতে পারবে কিনা, সেই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। এগুলো হচ্ছে: আর্মেনীয়/আর্তসাখ সৈন্যরা রুশ যুদ্ধরীতি কতটুকু কার্যকরভাবে অনুকরণ করেছিল, আজারবাইজানের তুর্কি–নির্মিত ড্রোনগুলোর বিরুদ্ধে তারা কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, এবং আজারবাইজানিরা তাদের নতুন সামরিক সরঞ্জামাদি কীভাবে আর্তসাখের গভীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে ব্যবহার করেছে?
ঐতিহ্যগতভাবে আর্মেনীয় ও আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনী সোভিয়েত/রুশ সমরনীতি অনুকরণ করে এসেছে। ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধ চলাকালে আর্মেনীয়/আর্তসাখ ইউনিটগুলো আজারবাইজানি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থানে সৃষ্ট ব্যাপকভাবে সুরক্ষিত ও স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান, শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য আক্রমণপথে বিপুল সংখ্যক মাইন স্থাপন এবং পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত বিপুল গোলাবারুদ সংবলিত ‘স্ট্রং পয়েন্টে’র ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। এর পাশাপাশি আর্মেনীয়/আর্তসাখ সৈন্যরা আজারবাইজানি আক্রমণকারী ইউনিটগুলোকে তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর পাল্লায় আনার জন্য দূরপাল্লার অস্ত্রশস্ত্র (বিশেষত ১.৫ কি.মি. পাল্লাবিশিষ্ট ‘ওরসিস টি–৫০০০’ স্নাইপার রাইফেল) ব্যবহার করেছে। এই ধরনের সমরনীতি ক্লাসিক সোভিয়েত/রুশ সমরনীতির অনুরূপ।
আর্মেনীয়/আর্তসাখ সৈন্যদের সামরিক সরঞ্জাম ছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে রুশ/সোভিয়েত–নির্মিত। আজারবাইজানিদের ব্যবহৃত তুর্কি (এবং ইসরায়েলি) ড্রোনগুলো সাফল্যের সঙ্গে আর্মেনীয়/আর্তসাখ সৈন্যদের ব্যবহৃত মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম, আর্টিলারি পিস, মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং এমনকি ব্যালিস্টিক মিসাইল ট্রান্সপোর্টার–ইরেক্টর–লঞ্চারও ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধের সময় আর্মেনীয়রা শত শত আর্মার্ড প্ল্যাটফর্ম হারিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘টি–৭২’ ট্যাঙ্কের বিভিন্ন প্রকরণ এবং কৌশলগত ‘এস–৩০০’ সিস্টেমসহ বিভিন্ন ধরনের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। বস্তুত এই যুদ্ধে বাস্তবিকই প্রমাণিত হয়েছে যে, তুর্কি ড্রোন বেশ সাফল্যের সঙ্গে রুশ/সোভিয়েত–নির্মিত সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করতে সক্ষম।
কিন্তু তুর্কি–নির্মিত অ্যাটাক ড্রোনের ব্যবহার আর্মেনিয়া/আর্তসাখের পরাজয়ের একমাত্র কারণ ছিল না। ‘দ্য পোলিশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে’র সদস্য আন্না মারিয়া দিনের ও আর্কাদিউসজ লেজিয়েসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আর্মেনিয়া/আর্তসাখের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুতর ত্রুটি ছিল। তাদের পর্যাপ্ত ড্রোন–বিধ্বংসী ও বৈদ্যুতিক যুদ্ধের সরঞ্জাম (বিশেষত আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ ও স্ক্যানিংয়ের সরঞ্জাম) ছিল না, তাদের কাউন্টার–ইন্টেলিজেন্স শিল্ড ছিল অপর্যাপ্ত এবং যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গভীর ছিল না। তদুপরি, যুদ্ধের সময় আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের সশস্ত্রবাহিনী তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারেনি, আর্মেনিয়া তাদের পূর্ণ সামর্থ্য ব্যবহার করে পুরোপুরি সৈন্য সমাবেশ করেনি এবং তাদের বিমানবাহিনী ও কৌশলগত ধ্বংসাত্মক অস্ত্রশস্ত্র (যেমন: রুশ–নির্মিত ‘ইস্কান্দার–ই’ ট্যাকটিক্যাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র) তারা সঠিকভাবে ও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে, আর্মেনিয়া/আর্তসাখের পরাজয়ের পশ্চাতে তুর্কি ড্রোনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু একইসঙ্গে আরো নানাবিধ কারণ তাদের পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে।
অনুরূপভাবে, আজারবাইজানিদের বিজয়ে তুর্কি–নির্মিত ড্রোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, কিন্তু এটি বাকুর বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে একমাত্র উপাদান ছিল না। আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী সংখ্যাগত দিক থেকে ছিল আর্মেনীয়/আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীর চেয়ে বড়, আজারবাইজানের সামরিক ব্যয় ছিল আর্মেনিয়ার মোট বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি এবং তুর্কি সৈন্য, স্পেশাল ফোর্স সদস্য, ড্রোন অপারেটর, সামরিক উপদেষ্টা ও তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় মার্সেনারিরা সক্রিয়ভাবে আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তদুপরি, তুর্কি–নির্মিত অ্যাটাক ড্রোনের পাশাপাশি ইসরায়েলি–নির্মিত ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোন এবং রুশ মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম আজারবাইজানিদের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তবে তুর্কি বিশ্লেষক কাসাপোলুর ভাষ্যমতে, আজারবাইজানিদের বিজয় কেবল কোনো একক সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী কেবল তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোন ক্রয়ই করেনি, একইসঙ্গে তারা তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোনযুদ্ধের ‘কনসেপ্টস অফ অপারেশন্স’ও (কনঅপ্স) আত্মস্থ করেছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে:
(১) তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি, লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণ ও যুদ্ধপূর্ব পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থলভিত্তিক ফায়ার সাপোর্ট ইউনিটগুলোর সঙ্গে ড্রোনগুলোর অঙ্গীভূতকরণ;
(২) শত্রুপক্ষের ফায়ার সাপোর্ট ও আর্মার্ড ইউনিটগুলোকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ড্রোনগুলোর নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার;
(৩) তথ্যযুদ্ধের উপাদান হিসেবে ড্রোন থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের ব্যবহার; এবং
(৪) শত্রুপক্ষের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো ধ্বংস করার জন্য ড্রোনের ব্যবহার।
আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী প্রধানত দুটি কারণে ড্রোনযুদ্ধ সংক্রান্ত এই তুর্কি ডকট্রিন আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলো হচ্ছে:
(১) যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় আজারবাইজানে একটি শক্তিশালী ও বিস্তৃত তুর্কি সামরিক মিশন উপস্থিত ছিল; এবং
(২) দীর্ঘদিনব্যাপী তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ এবং তুর্কি সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে আজারবাইজানি সৈন্যরা তুর্কি ড্রোনযুদ্ধের ডকট্রিন পূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে প্রস্তুত ছিল।
কাসাপোলুর মতে, বস্তুত নিয়মিতভাবে যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ ও বিস্তৃত মিথষ্ক্রিয়ার কারণে তুর্কি ও আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী কার্যত ‘দুই রাষ্ট্র, এক সশস্ত্রবাহিনী’তে পরিণত হয়েছে এবং উভয় সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই আজারবাইজানিরা তুর্কি ড্রোনযুদ্ধের ডকট্রিন সম্পূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু রুশ সীমান্তবর্তী অন্যান্য যেসব রাষ্ট্র (বিশেষত ইউক্রেন) তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আগ্রহী, তাদের সশস্ত্রবাহিনীগুলোর সঙ্গে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই এবং এজন্য তাদের পক্ষে তুর্কি ড্রোনযুদ্ধের ডকট্রিন পুরোপুরি আত্মস্থ করা এতটা সহজ হবে না।
শুধু তা-ই নয়, রুশ সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক যে কোনো সশস্ত্রবাহিনীকে রুশদের পরস্পর সংযুক্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক যুদ্ধের সামর্থ্যের মোকাবিলা করতে হবে। সিরিয়া, এলএনএ বা আর্মেনিয়া/আর্তসাখের নিকট এসব অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ছিল না, ফলে এই সরঞ্জামগুলোর বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোন কতটুকু কার্যকর হবে, সেটি নিশ্চিত নয়। তদুপরি, রুশরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের সামরিক মহড়াগুলোতে ড্রোন–বিধ্বংসী যুদ্ধ পরিচালনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে এবং ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ‘কাভকাজ ২০২০’ ও ‘আনব্রেকেবল ব্রাদারহুড ২০২০’ মহড়াদ্বয়েও তারা তাদের ড্রোন–বিধ্বংসী সরঞ্জামাদি পরীক্ষা করেছে। সর্বোপরি, রুশ সামরিক–শিল্পখাত বেশ কিছুদিন ধরেই ড্রোন–বিধ্বংসী সরঞ্জামাদি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং একইসঙ্গে নিজস্ব ড্রোন উৎপাদনের প্রতিও মনোনিবেশ করেছে।
সুতরাং, কাসাপোলু এই মর্মে উপসংহার টেনেছেন যে, রুশবিরোধী রাষ্ট্রগুলো যদি মনে করে থাকে যে, তুর্কি ড্রোন ক্রয় করলে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুশদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে পারবে, সেটি তাদের জন্য ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে না। দীর্ঘদিনব্যাপী সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি অমনোযোগী থাকার কারণে ইউক্রেন, পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর সশস্ত্রবাহিনীর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ইউক্রেনীয় নব্য নাৎসি মিলিশিয়াগুলো ব্যতীত ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যরা দনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্রগুলো বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বিশেষ আগ্রহী নয়। অনুরূপভাবে, ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত একটি সামরিক মহড়ার ফলাফল অনুযায়ী, রাশিয়া যদি পোল্যান্ড আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে পোলিশ সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে এই আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভবপর হবে না। বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর সশস্ত্রবাহিনী অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা কোনোক্রমেই টিকতে পারবে না।
এমতাবস্থায় রুশ সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো কেবল তুর্কি ড্রোন ক্রয় করে রাশিয়াকে প্রতিহত করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে না। তারা যদি সত্যিই রাশিয়াকে প্রতিহত করার সামর্থ্য অর্জন করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে একটি বিস্তৃত সামরিক–শিল্পখাত গড়ে তুলতে হবে, সশস্ত্রবাহিনীর ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে হবে এবং ড্রোনযুদ্ধের ডকট্রিন কার্যকরভাবে আয়ত্ত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেন ছাড়া রুশ সীমান্তবর্তী অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রের রাশিয়ার সঙ্গে ভূখণ্ডগত বিরোধ নেই। সুতরাং, রাষ্ট্রগুলোর নেতৃবৃন্দ মৌখিকভাবে যা-ই বলুন না কেন, আগ বাড়িয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে তারা আগ্রহী হবেন না। সুতরাং, রুশ সীমান্তবর্তী যে একমাত্র রাষ্ট্রটি তুর্কি ড্রোন নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারে, সেটি হচ্ছে ইউক্রেন। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক–সামরিক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন এরকম কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে কিনা, সেটি দেখার বিষয়।