আপনার কেমন লাগবে, যদি আপনাকে কোথাও থাকতে হলে অপারেশন করতে হয়? ব্যাপারটা এমন না যে আপনি অসুস্থ এবং অপারেশন না করালে আপনার রক্ষা নেই। তবে তা আপনাকে করতেই হবে। সবার জন্য একদম কঠোর নিয়ম! শরীর থেকে ‘অ্যাপেনডিক্স’ নামক অংশটি কেটে ফেলে দিতে হবে, যাকে অ্যাপেনডেকটমি বলা হয়।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস কিংবা অ্যাপেনডিক্সের অন্য কোনো সমস্যা না থাকলেও এটি অপারেশন করে ফেলে দেওয়া রীতিমতো বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে এন্টার্কটিকার একটি গ্রাম, যার নাম ভিলাস লাস এস্ট্রেলাস। নিতান্তই কয়েক দিন, সপ্তাহ কিংবা এক-দুই মাসের জন্য এই অপারেশন আবশ্যকীয় নয়। তবে এর থেকে অধিক সময়ের জন্য এখানে থাকতে চাইলে এই নিয়ম আপনাকে মানতেই হবে। এমনকি একজন নাবালককেও এই কাটাকাটির ঝামেলায় পড়তে হয়। অবশ্য শিশুদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ছয় বছর বয়সের অধিক হলেই তার জন্য অ্যাপেনডিক্স অপসারণ করা কিংবা অ্যাপেনডেকটমি করা প্রযোজ্য। বিষয়টি আসলে জোরজবরদস্তির নয়, বরং প্রয়োজনের তাগিদেই এই পদক্ষেপ। বড় ধরনের কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পেতেই এই নিয়ম।
এন্টার্কটিকার কিং জর্জ দ্বীপের অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন একটি শহর এই ভিলাস লাস এস্ট্রেলাস। ভৌগলিক দিক থেকে এর অবস্থানই আসলে প্রতিকূলে। যাতায়াত ব্যবস্থার ঝামেলা, যথেষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব কিংবা প্রয়োজনীয় দোকান এবং জিনিসপত্রের যোগান না থাকার কারণে শহরটিতে বাস করা বেশ কষ্টকর ব্যাপার।
চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে শুধুমাত্র কয়েকজন ডাক্তার রয়েছেন এই এলাকায়। তবে তাদের মধ্যে কেউ তেমন একটা দক্ষ নন। হাসপাতাল তো অনেক পরের কথা। আর শীতকালে তো একজন ডাক্তার সেখানে পাওয়াও ভাগ্যের বিষয়। সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটি শহর থেকে প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার তথা ৬২৫ মাইল দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ জরুরি অবস্থায় সহায়তা পাওয়ার মতো বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। আর এজন্যই এখানে বসবাসরত অল্প সংখ্যক মানুষের জন্য অ্যাপেনডিক্সের অপসারণ অত্যন্ত জরুরি একটি পদক্ষেপ।
যদিও কম-বেশি সকলেই এই অ্যাপেনডিক্স, অ্যাপেনডিসাইটিস এবং অ্যাপেনডেকটমি নামগুলোর সাথে পরিচিত, তা-ও এগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো।
অ্যাপেনডিক্স হলো আমাদের দেহে থাকা চার ইঞ্চির চিকন একটি নল। এর অবস্থান সাধারণত তলপেটের একটু নিচে, ডান দিকে। এর প্রয়োজনীয়তা কিংবা কার্যকারিতা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একটি তত্ত্ব মতে, অ্যাপেনডিক্স মাঝে মাঝে ‘ভালো ব্যাকটেরিয়া’র ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। কিছু রোগ, বিশেষ করে ডায়রিয়া সেরে যাওয়ার পর পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতা পুনরায় ফেরত আনার জন্য অ্যাপেনডিক্স কাজ করে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
অ্যাপেনডিসাইটিস একটি জরুরি অবস্থা, যখন হঠাৎ করেই অ্যাপেনডিক্সে অসম্ভব ও অসহ্যকর ব্যথা ওঠে। অ্যাপেনডিসাইটিস হওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার ভেতরে যদি অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করে অপসারণ না করা হয়, তাহলে এর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে কিংবা ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। আর এতে করে এর ভেতরে থাকা সংক্রামক উপাদান এবং জীবাণু তলপেটে ছড়িয়ে পড়ে, যা ধীরে ধীরে সারা দেহে ছড়িয়ে যায়। কেন এমনটা হয় কিংবা কীভাবে হয় সেই সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কোনো যুক্তি নেই। তবে সময়মতো অপারেশন না করলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
দেহ থেকে একে অপসারণ করার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় অ্যাপেনডেকটমি। কোনো কারণ ছাড়া যে কেউ হঠাৎ করেই প্রত্যন্ত ভিলাস গ্রামে থাকাকালীন এই অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ফলশ্রুতিতে, মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া এই অঙ্গ দেহে থাকার বিশেষ কোনো উপকারিতাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই যেকোনো ধরনের বিপদ এড়াতে আগেই একে অপসারণ করার পরামর্শ দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
এন্টার্কটিকার বিচ্ছিন্ন একটি গ্রামে হঠাৎ অ্যাপেনডিসাইটিসের আক্রমণ যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তার বাস্তব উদাহরণও রয়েছে। ১৯৬১ সালে লিওনিড রোগোজোভসহ মোট ১২ জন এন্টার্কটিকায় অবস্থিত নতুন একটি রাশিয়ান ঘাঁটিতে কাজ করতে যায়। তখন ছিল বছরের মার্চ মাস। প্রচণ্ড শীতের একটি সময়। এমন অবস্থায় এক মাসের মাথায় হঠাৎ করেই ২৭ বছরের রোগোজোভ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একজন দক্ষ ডাক্তার হিসেবে তার বুঝতে সময় লাগেনি যে, তিনি অ্যাকিউট অ্যাপেনডিসাইটিসে ভুগছেন। আর তিনি এটাও জানতেন যে, সময়মতো অপারেশন না করলে অকালে তাকে মরতে হবে। পুরো দলটির মধ্যে শুধুমাত্র তিনিই সার্জন ছিলেন।
তাছাড়া চিকিৎসা বিষয়ক যেকোনো সাহায্য পেতে হলে তাকে যেতে হবে কয়েকশো মাইল দূরে, যা আবহাওয়ার কারণে সেই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। নিরুপায় হয়ে নিজের অপারেশন নিজেই করে বসেন এবং সেই যাত্রায় বেঁচেও যান। একবারের জন্য চিন্তা করুন তো; সেই ডাক্তারের অবস্থায় অন্য কোনো ব্যক্তি হলে কেমন হতো যার এসব সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই? কিংবা ডাক্তার হলেই যে নিজের অপারেশন করতে সক্ষম হবেন তা ভাবাও সঠিক হবে না। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতেই অ্যাপেনডেকটমি করা হয়।
অপারেশনের ঝঞ্ঝাটের কথা শুনে আপনি ভাবতে পারেন, এসব ঝামেলার কারণে হয়তো কেউ ভিলাস লাস এস্ট্রেলাস গ্রামটিতে যায় না। তবে এখানেও মানুষ বসবাস করে। তবে বেশিরভাগই অস্থায়ীভাবে। এখন কথা হলো, কারা এই বিচ্ছিন্ন এবং সংকটাপন্ন দ্বীপের শহরটিতে বাস করে, যেখানে মৌলিক সুযোগ-সুবিধাগুলো পর্যন্ত পাওয়া যায় না? চিলির অধীনে থাকা ভিলাস লাস এস্ট্রেলাসে বাস করছে প্রায় ১০০ জন। সংখ্যাটি সবসময়ই পরিবর্তনশীল। বসবাসরত মানুষেরা আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানী, গবেষক এবং চিলির সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা।
ভিলাস আসলে একটি মিলিটারি ঘাঁটি। আর এই অঞ্চলটি অনেকটা জনশূন্য বলে গবেষণার কাজ করা বেশ ভালো। তাছাড়া চিলির এসব বাহিনীর সদস্যদের অনেক দিন পর্যন্ত এসব এলাকায় থাকতে হয়। তাই মাঝে মাঝে তারা নিজেদের পরিবার নিয়েও এখানে অধিক সময়ের জন্য অবস্থান করেন। তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ১৪টি বাড়ি। শহরটিতে একটি স্কুল, লাইব্রেরি, ডাক অফিস, রেডিও স্টেশন, ব্যাংক, সুপার মার্কেট এবং আরো অল্প কিছু প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরকম নির্জন একটি স্থানে এগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন চিলির রাজনৈতিক নেতা এডুয়ার্ডো ফ্রেই মন্টালভা।
তবে প্রকৃতির কারণে শহরটিতে বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। শীতকালে প্রায়ই এখানকার তাপমাত্রা অনেক বেশি কমে যায়। -৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা আরো কম। এই সময়ে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে মানা করা হয়। কেননা, জীবনের ঝুঁকি থাকে। স্থানটির বার্ষিক গড় তাপমাত্রা -২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই বলে গ্রীষ্মকালে যে এখানে একটু আরামে থাকতে পারবেন ব্যাপারটা কিন্তু সেরকমও নয়। গরমের দিনে আবার সূর্যের আলো সারাক্ষণ একই রকম থাকে। গ্রীষ্মে এমন একটা স্থানে আপনার থাকতে হয়, যেখানে অন্ধকার হয় না, তথা রাত হয় না। হলেও অল্প কিছু সময়ের জন্য মাত্র। ফলে এই সময়েও শহরটিতে অবস্থান করা বেশ কষ্টকর। আর এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ফলমূল ও শাক-সবজিরও ফলন ভালো হয় না। তাই বছর জুড়েই এখানে তাজা সবজির তথা খাদ্যের অভাব লেগেই থাকে। যা পাওয়া যায় তা সবই অন্য শহর কিংবা দেশ থেকে আমদানি করা।
ভিলাসে এই আমদানির বিষয়টি কষ্টসাধ্য বিধায় খুব হিসেব করে তা ব্যবহার করা হয়। সময় ও প্রাপ্যতার উপর ভিত্তি করেই খাওয়ার কাজটা সেরে নিতে হয়। আপনি যদি কুকুর পছন্দ করেন কিংবা কুকুর পালতে চান, তাহলে এই শহর নিশ্চয়ই আপনার জন্য নয়। এটা স্থানটির আরেকটি নেতিবাচক দিক। অ্যাপেনডিক্সের পাশাপাশি কুকুরের উপরও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এর পেছনেও আছে আলাদা যুক্তি। কুকুরেরা সেই অঞ্চলের স্থানীয় বন্য পশুদের মধ্যে রোগবালাই ছাড়াতে পারে। তাই পুরো এলাকায় কুকুর নিষিদ্ধ।
অবশ্য, আপনি যদি গৃহপালিত পশু হিসেবে কুকুর ছাড়া অন্য কিছু মেনে নিতে পারেন, তাহলে আপনার জন্য এখানে আছে অ্যাডেলেই পেঙ্গুইন এবং এলিফ্যান্ট সীল। শহরটিতে প্রচুর পরিমাণে পেঙ্গুইন ও সীল আছে। তবে এরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে ভালোমতোই ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে। শিকার হওয়ার কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘুরে বেড়ায় এসব পেঙ্গুইন।