এই বুঝি মহামারীর অবসান হলো!
প্রাণচঞ্চল শহরগুলো যখন ঝিমিয়ে আছে লকডাউনে, থমকে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার চাকা, ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে শত-সহস্র মানুষ, তখন অন্য সবার মতো আপনিও হয়তো এভাবেই করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হওয়ার প্রহর গুনছেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো, কেমন হবে যদি কখনোই আবিষ্কৃত না হয় কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন? বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও এই সম্ভাবনা কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনে করে দেখুন, চার দশকের মতো সময় জুড়ে প্রায় বত্রিশ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ যে এইচআইচভি, বিশ্ববাসী কিন্তু এখনও তার ভ্যাক্সিনের অপেক্ষায় আছে।
ইতোমধ্যেই ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাস ভ্যাক্সিনের তৈরি প্রক্রিয়া এবং মানুষের ওপর এর প্রাথমিক প্রয়োগের তোড়জোড় শুরু হলেও সবচেয়ে খারাপ যে সম্ভাবনাটি তা বিশেষজ্ঞদের নজর এড়িয়ে যায়নি। আর তাই সম্প্রতি সিএনএন-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধেও বলা হয়েছে মুদ্রার এই অপর পিঠের কথা। সেই লেখাটিরই চুম্বক অংশ রোর-বাংলার পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
“এমন কিছু ভাইরাস আছে যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উপযুক্ত ভ্যাক্সিন এখনো আমরা আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি”, বলছিলেন ড. ডেভিড নাবারো, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্লোবাল হেলথ বিভাগের একজন প্রফেসর, যিনি বর্তমানে কোভিড-১৯ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন বিশেষ দূত।
ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হবেই- এ কথাটি আমরা একেবারে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, কিংবা হলেও সেটি যে সঠিক কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করবে এবং নিরাপত্তার সবগুলো ধাপ একবারেই অতিক্রম করে ফেলবে, এমনটিও বলা যায় না। বরঞ্চ এই সময়ে এমনভাবে নিজেদের প্রস্তুত করা জরুরি যাতে করোনাভাইরাসকে মাঝে রেখেই আমরা আমাদের সামাজিক জীবন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পারি।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। কিন্তু সেই শুভ ক্ষণটি ঠিক কবে নাগাদ আসবে? ড. অ্যান্থনি ফাউচি ধারণা করছেন একবছর বা আঠারো মাসের মধ্যেই তা সম্ভব। কিন্তু ড. পিটার হূটেজ, যিনি সার্স ভ্যাক্সিন তৈরিতে কাজ করেছিলেন, তিনি বলছেন ভিন্নকথা,
আমরা এর আগে কখনোই এত কম সময়ে কোনো ভ্যাক্সিন তৈরি করতে সক্ষম হইনি। আমি বলছি না এটি অসম্ভব, কিন্তু যদি তা আসলেই করা যায়, তবে নিঃসন্দেহে এটি হবে বেশ বীরত্বপূর্ণ একটি অর্জন।
যখন ভ্যাক্সিন কাজ করে না
চলুন একটু ফিরে দেখি। ১৯৮৪ সালে আমেরিকার হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিস বিভাগের সেক্রেটারি মার্গারেট হেকলার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যেই এইচআইভি প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করা সম্ভব বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। বরঞ্চ এর পরেও প্রায় অনেক বছর ধরে এইচআইভি মানেই ছিলো নিশ্চিত মৃত্যু। নিকটাত্মীয়রাও পরিত্যাগ করতেন এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের, এমনকি তাদের চিকিৎসা করবেন কি না এই নিয়েও অনেক চিকিৎসক প্রশ্ন তুলেছিলেন।
সেই ভ্যাক্সিনের খোঁজ আশির দশকেও শেষ হলো না। উপরন্তু ১৯৯৭ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন গোটা আমেরিকাকে আগামী এক দশকের মধ্যে এইচআইভি ভ্যাক্সিন তৈরি করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। ২০০৬ সালে এসেও বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আমরা এখনো প্রায় দশ বছর পিছিয়ে আছি। কিন্তু এমনটি হওয়ার কারণ কী?
পল অফিট, একজন শিশুরোগ ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং রোটাভাইরাস ভ্যাক্সিনের অন্যতম আবিষ্কারক, এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেছেন,
সাধারণ ইনফ্লয়েঞ্জা ভাইরাস পরিবর্তিত হতে এক বছর থেকে পরের বছর পর্যন্ত সময় নেয়। কিন্তু প্রতিবার সংক্রমণেই এইচআইভির গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। আপনার দেহে সংক্রমিত হতে হতেই এর অতিদ্রুত মিউটেশন ঘটতে থাকে। অর্থাৎ আপনি আসলে আক্রান্ত হচ্ছেন এই ভাইরাসেরই হাজারখানেক ভিন্ন পরিবর্তিত স্ট্র্যান্ড দ্বারা। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, নিজে পরিবর্তিত হতে হতেই এটি আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
নতুন এই করোনাভাইরাস কিন্তু এমন ছলনাময়ী নয়। আর তাই বিশেষজ্ঞরাও এর ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে এত বেশি আশাবাদী।
রিনোভাইরাস এবং অ্যাডেনোভাইরাসের বেলাতেও ভ্যাক্সিন তৈরি করা দুঃসাধ্য। এই ভাইরাসগুলোও সাধারণ সর্দি-জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ করে। বর্তমানে অ্যাডেনোভাইরাসের শুধুমাত্র দুটি স্ট্রেইনের ভ্যাক্সিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা এখনও বাজারজাত করা হয়নি।
আবিষ্কারের পরেও অনেক ভ্যাক্সিন আবার বিজ্ঞানীদের নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। ২০১৭ সালে ডেঙ্গু প্রতিরোধী এক ভ্যাক্সিনকে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়, কারণ তা ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণগুলোকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
ড. নাবারো যথার্থই বলেছেন,
মনে রাখতে হবে, আমাদের লড়াইটা জৈবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়ার উপর।
ভিন্ন পরিকল্পনা
ভেবে দেখুন, যদি এইচআইভি ভ্যাক্সিনের দেখানো পথেই হাঁটতে থাকে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন, তাহলে কিন্তু এই রোগটিকে সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। পল অফিটের ভাষায়,
বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা এইচআইভি চিকিৎসার একটি কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি, যেমনভাবে ক্যান্সার নিয়েও অনেকে স্বচ্ছন্দে বহুদিন বেঁচে থাকছে। এই রোগগুলো হওয়া মানেই এখন আর মৃত্যু পরোয়ানা নয়।
তাই ভ্যাক্সিনের চলমান ট্রায়াল এন্ড এররের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা এমন চিকিৎসাকাঠামো দাঁড় করানোর কাজটিও থামিয়ে রাখছেন না। কোভিডের বিকল্প ওষুধ হিসেবে খন্ডে খন্ডে পরীক্ষা চলছে ইবোলা প্রতিরোধী ওষুধ রেমডেসিভির (Remdesivir) নিয়ে, চলছে রক্তে প্লাজমা পরীক্ষার কাজটিও। এর মাঝেই আবার হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল, কিন্তু মারাত্মকভাবে অসুস্থ রোগীদের বেলায় এটি প্রয়োগে কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণকে সমাজ থেকে একেবারে নির্মূল করে দেবে না। এতে হয়তো আরোগ্য লাভ কিছুটা দ্রত হবে, কিংবা মহামারীর গ্রাস হয়তো ধীরে ধীরে কমে আসবে, কিন্তু ভাইরাসটি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে আরো বহু বছর।
ভ্যাক্সিন ছাড়া কেমন হবে আমাদের জীবনযাত্রা?
ভাবুন তো এমন একটি পৃথিবীর কথা, যেখানে অনবরত চলছে কনট্যাক্ট ট্রেসিং, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে প্রতিদিন আপনাকে কিছু সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে আপনার আশেপাশের প্রতিটি এলাকা। কোথাও করোনাভাইরাসের ক্লাস্টার পুঞ্জীভূত হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা পাওয়া মাত্রই সেটুকু জায়গায় লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে। এমনকি কিছুদিন পর পরই পুরো দেশকেই আবার হয়তো চলে যেতে হচ্ছে লকডাউনে।
সাধারণ হাঁচি-কাশিকে তোয়াক্কা না করে অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করার দিন এখন আর নেই। এমন কিছু হলে সাথে সাথেই আপনাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। এমনও হতে পারে সপ্তাহে কয়েকটি দিন প্রত্যেকেরই মিলবে বাড়িতে বসে কাজ করার অনুমতি। কিংবা অফিস বা দোকানপাটে কাজ চলবে কয়েকটি শিফটে যাতে একসাথে অনেক মানুষের সমাগম না হয়।
হয়তো চালু করে দেওয়া হবে খেলাধুলার ইভেন্টগুলো, যেখানে খেলোয়াড়দের নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষা চলবে আর দর্শকদের অনুমতি মিলবে নিরাপদ দূরত্বে বসে উপভোগ করার অথবা আদতে না-ও মিলতে পারে। রেস্তোরাঁ কিংবা ভোজনশালাগুলোর পরিণতিও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে না।
ধারণা করা হচ্ছে শীতের দিনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। সময়ে সময়ে হয়তো মহামারীর প্রকোপও আসতে পারে, আর এদিকে বাড়তেই থাকবে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর হার, যেমনটি হয়েছিল হামের ক্ষেত্রে। ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের পূর্বে প্রতি বছর অন্তত দুই থেকে তিন মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতো।
যত সময় পার হবে, মানুষ হয়তো তত বেশি ঝুঁকে পড়বে হার্ড ইমিউনিটির দিকে, অবশ্যই যখন মোট জনসংখ্যার সত্তর থেকে নব্বই শতাংশ মানুষের এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাবে। তবে এই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে এখনও মানুষের তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই।
কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই দিনের পর দিন অর্থনীতির চাকা থামিয়ে রেখে লকডাউনে বন্দি থাকা সম্ভব নয়, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবেও তা অসম্ভব, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও। তাই ড. নাবারোর মতে,
কোভিডের সাথে লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়েই আমাদের ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে হবে। এমন এক সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে যেখানে আমাদের জীবনের দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে। আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে কিংবা কোভিডের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই স্বেচ্ছায় নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
তবুও এত সব ধারণার পেছনে আশার আলো কিন্তু থেকেই যায়, ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হবেই। ততদিন পর্যন্ত যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে করোনার ভয়কে জয় করেই পথ চলার জন্য আপনি প্রস্তুত তো?