২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ (special military operation) পরিচালনা করতে শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়ে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরুর প্রায় সাত মাস পর ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রুশ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত একটি ভাষণে রাশিয়ায় ‘আংশিক সৈন্য সমাবেশে’র (partial mobilization) ঘোষণা দেন এবং একই দিনে এই বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। পুতিনের ভাষণের পর রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু রুশ প্রচারমাধ্যমকে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে জানান যে, উক্ত ‘আংশিক সৈন্য সমাবেশে’র অংশ হিসেবে রাশিয়া তিন লক্ষ সৈন্যকে ডেকে পাঠাবে।
ইউক্রেনে রুশ ‘সীমিত যুদ্ধ’
রুশ দৃষ্টিকোণ থেকে, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে পরিচালিত রুশ ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ ছিল একটি ‘সীমিত যুদ্ধ’ (limited war), যেটিতে রুশরা তাদের পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেনি। রুশ সশস্ত্রবাহিনী, রুশ ন্যাশনাল গার্ড, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ ও অন্যান্য রুশ মার্সেনারি সংগঠন এবং রুশ–সমর্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের সশস্ত্রবাহিনী ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। রুশ সশস্ত্রবাহিনীর যেসব সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তারা হয় চুক্তিবদ্ধ সৈনিক (contract soldier), নয়তো স্বেচ্ছাসবী সৈন্য (volunteer soldier)। রুশ তরুণদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে এক বছর রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে হয়, কিন্তু উক্ত ‘কনস্ক্রিপ্ট’ সৈন্যরা এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। অনুরূপভাবে, রুশ ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা এবং ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ ও অন্যান্য সংগঠনভুক্ত মার্সেনারিরা প্রধানত স্বেচ্ছাসেবী।
অন্যদিকে, ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের মধ্যে বিস্তৃত সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরপরই ১৯ ফেব্রুয়ারি (অর্থাৎ, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পাঁচ দিন আগে) প্রজাতন্ত্র দুইটি পূর্ণ সৈন্য সমাবেশ (general mobilization) আরম্ভ করে। অর্থাৎ, যেসব দনেৎস্ক ও লুগানস্ক সৈন্য ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ, স্বেচ্ছাসেবী ও কনস্ক্রিপ্ট সব ধরনের সৈন্যই রয়েছে। অনুরূপভাবে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন পূর্ণ সৈন্য সমাবেশ শুরু করেছে এবং এখন পর্যন্ত কয়েক ধাপে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েনকৃত সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।
কার্যত রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ভূখণ্ডে সংঘটিত সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিন্তু রাশিয়া কর্তৃক আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা প্রদানের আগ পর্যন্ত রাশিয়া এই যুদ্ধটিকে একটি ‘সীমিত যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচালনা করেছে। বস্তুত এতদিন ইউক্রেন, গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের জন্য এটি ছিল একটি ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ (total war), কিন্তু রাশিয়ার জন্য এটি ছিল একটি ‘সীমিত যুদ্ধ’। রাশিয়া যে এতদিন এই যুদ্ধটিকে ‘সীমিত যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচালনা করেছে, সেটি তাদের নিম্নোক্ত কার্যক্রম থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এখন পর্যন্ত রুশরা ইউক্রেনীয় বেসামরিক জনসাধারণের ক্ষয়ক্ষতি যতদূর সম্ভব সীমিত রাখার চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে রুশরা বেসামরিক জনসাধারণের পাশাপাশি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও সীমিত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কারণ তাদের ধারণা ছিল ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ দিলে সেক্ষেত্রে তারা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবে না (কিন্তু রুশদের এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে)। খারকভে সাম্প্রতিক ইউক্রেনীয় প্রতি–আক্রমণের আগ পর্যন্ত রুশরা ইউক্রেনীয় বেসামরিক অবকাঠামোগুলোর (যেমন: বেসামরিক শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি বিশোধন কেন্দ্র, সরকারি–বেসরকারি কার্যালয় প্রভৃতি) ওপর আক্রমণ পরিচালনা থেকে যতদূর সম্ভব বিরত থেকেছে এবং প্রধানত ইউক্রেনীয় সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।
অনুরূপভাবে, রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর কৌশলগত বোমাবর্ষণ (strategic bombing) পরিচালনা থেকে বিরত থেকেছে। এর পাশাপাশি রাশিয়া নিজস্ব সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা যতদূর সম্ভব সীমিত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং এই উদ্দেশ্যে অত্যন্ত ধীরগতিতে ও প্রধানত আর্টিলারির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নিজেদের আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অভ্যন্তরীণ জনমত যেন রুশ সরকারের প্রতি বিরূপ না হয়, সেজন্য রুশ সরকার কনস্ক্রিপ্ট সৈন্যদেরকে এই যুদ্ধে প্রেরণ করা থেকে বিরত থেকেছে এবং রুশ জাতীয়তাবাদী ও যুদ্ধবাজদের বারংবার আহ্বান সত্ত্বেও এতদিন আংশিক বা পূর্ণ সৈন্য সমাবেশ করেনি।
রাশিয়ায় আংশিক সৈন্য সমাবেশের কারণ
কিন্তু বিগত সাত মাসে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইউক্রেন এবং ইউক্রেনের পশ্চিমা ‘মিত্র’ রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করতে ইচ্ছুক। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা যে কেবল ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাই নয়, তারা বারবার রুশ মূল ভূখণ্ডে (উদাহরণস্বরূপ, বেলগরোদ ও কুরস্ক প্রদেশে এবং ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র ও সেভাস্তোপোলে) অবস্থিত বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছে এবং ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রুশ–অধিকৃত ভূখণ্ডের পাশাপাশি খোদ মস্কোতেও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও অর্থ সরবরাহ করছে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোয় ইউক্রেনীয় সৈন্যদের ন্যাটোর মান অনুসারে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, পশ্চিমা কৃত্রিম উপগ্রহ ও গোয়েন্দা বিমানগুলো ইউক্রেনকে রুশদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করছে, পশ্চিমা সামরিক উপদেষ্টারা ইউক্রেনের সামরিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছে এবং ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধরত বিদেশি মার্সেনারিদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হচ্ছে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর প্রাক্তন সৈন্য। সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে এবং পশ্চিমা মার্সেনারিদের ও গোয়েন্দা তথ্যের সহায়তায় খারকভ/খারকিভ অঞ্চলে রুশদের বিরুদ্ধে একটি সাফল্যজনক পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এমতাবস্থায় রুশদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘সীমিত যুদ্ধ’ পরিচালনার মাধ্যমে এই যুদ্ধে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।
এমতাবস্থায় রুশ সরকারের জন্য দুইটি বিকল্প ছিল: হয় এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে, নয়তো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউক্রেন রুশ শর্তাবলি মেনে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করতে ইচ্ছুক নয় এবং ইতিপূর্বে রুশ–ইউক্রেনীয় শান্তি আলোচনা পশ্চিমা হস্তক্ষেপের কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তদুপরি, পুতিন কর্তৃক রুশ ‘বিশেষ সামরিক অভিযানে’র ঘোষিত লক্ষ্য (দনেৎস্ক ও লুগানস্কের ‘মুক্তি’ এবং ইউক্রেনের ‘বেসামরিকীকরণ’ ও ‘বিনাৎসীকরণ’) এখনো পুরোপুরিভাবে অর্জিত হয়নি, সুতরাং এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বন্ধ করা রাশিয়ার জন্য রাজনৈতিকভাবে ‘পরাজয়’ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ফলে একদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে রুশ সরকারের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাশিয়া তাদের ‘মহাশক্তি’র (great power) মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং রুশ সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর পরিবর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়ায় আংশিক সৈন্য সমাবেশ উক্ত নীতিরই প্রতিফলন।
রাশিয়ায় আংশিক সৈন্য সমাবেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ায় বর্তমানে যে সৈন্য সমাবেশ চলছে, সেটি পূর্ণ সৈন্য সমাবেশ নয়, বরং আংশিক সৈন্য সমাবেশ। পুতিনের ভাষ্য অনুসারে, এই সৈন্য সমাবেশের অংশ হিসেবে কেবল তাদেরকেই ডেকে পাঠানো হবে, যারা রুশ সশস্ত্রবাহিনীর রিজার্ভের অংশ, যারা ইতিপূর্বে রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে কাজ করেছে এবং যাদের কোনো ধরনের সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’–এর ২০২১ সালের হিসেব অনুসারে, রুশ সশস্ত্রবাহিনীর রিজার্ভে প্রায় ২০ লক্ষ সৈন্য রয়েছে। তদুপরি, রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর মতে, রাশিয়ায় প্রায় আড়াই কোটি এমন মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো না কোনো ধরনের সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং, তার মতে, এদের মাত্র ১.২%–কে সৈন্য সমাবেশের অংশ হিসেবে ডেকে পাঠানো হচ্ছে।
পুতিনের ভাষ্যমতে, সৈন্য সমাবেশের জন্য যাদেরকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে, তাদেরকে প্রথমে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে এবং এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হবে। উল্লেখ্য, ২০ সেপ্টেম্বর পুতিন রুশ সমরাস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং সামরিক উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউক্রেনে প্রেরণের আগে নতুন সৈন্যদেরকে পূর্ণরূপে অস্ত্রসজ্জিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
স্বাভাবিকভাবেই, রাশিয়ায় আংশিক সৈন্য সমাবেশের বিষয়টি রাশিয়ার অভ্যন্তরে ও বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের সমর্থকরা, রুশ জাতীয়তাবাদীরা ও রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের রুশ সমর্থকরা রুশ সরকারের এই সিদ্ধান্তে উল্লসিত হয়েছে এবং তারা রুশ আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণাকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায়’ (Special Military Operation 2.0) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। রুশ জাতীয়তাবাদী ও যুদ্ধবাজদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার শ্লথ অগ্রগতি ও রুশ সরকারের যুদ্ধ পরিচালনার ধরন নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল, এবং ধারণা করা হচ্ছিল যে, উক্ত শ্রেণিটি রুশ সরকারের তিক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। কিন্তু পুতিন কর্তৃক আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণার পর এই সম্ভাবনা আপাতত হ্রাস পেয়েছে। প্রাক্তন রুশ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্কের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইগর স্ত্রেলকভ রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে রুশ সরকারের যুদ্ধ পরিচালনার ধরনের কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং ইতিপূর্বে তিনি রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি পর্যন্ত রুশ আংশিক সৈন্য সমাবেশকে একটি ‘সঠিক পদক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এটির প্রশংসা করেছেন।
রুশ সরকার কর্তৃক আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা রুশ জনসাধারণের মধ্যে বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। স্বাভাবিকভাবে, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কেউই চায় না যে, তাকে বা তার ঘনিষ্ঠ কাউকে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিতে হোক। সুতরাং রুশ জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সের্গেই মারকভের ভাষ্যমতে, রুশ জনসাধারণ সামগ্রিকভাবে আংশিক সৈন্য সমাবেশের বিষয়ে খুব বেশি উৎসাহী নয়, কিন্তু যাদেরকে সৈন্য সমাবেশের অংশ হিসেবে ডেকে পাঠানো হচ্ছে, তারা সাধারণভাবে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সৈন্য সমাবেশ কেন্দ্রগুলোতে ডেকে পাঠানো রিজার্ভ সৈন্যদের ভিড় দেখা গেছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজগুলো থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, রিজার্ভ সৈন্যরা তুলনামূলকভাবে উৎসাহের সঙ্গে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে।
কেবল সাধারণ রুশ নাগরিকরাই নয়, রুশ অভিজাত শ্রেণির একাংশও সৈন্য সমাবেশের আহ্বানে সোৎসাহে সাড়া দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রুশ আইনসভার নিম্নকক্ষ ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র চারজন সরকার দলীয় সদস্য (ভিতালি মিলোনভ, দিমিত্রি সাবলিন, দিমিত্রি খুবেজভ এবং সের্গেই সোকোল) রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদানের জন্য রুশ সরকারি দল ‘ইয়েদিনায়া রাসিয়া’র সচিব আন্দ্রেই তুরচাকের কাছে দরখাস্ত করেছেন। রুশ ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র সদস্য ইউরি শভিৎকিনকে আংশিক সৈন্য সমাবেশের অংশ হিসেবে ডেকে পাঠানো হয়েছে এবং তিনি রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। ক্রিমিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান সের্গেই আক্সিয়োনভের ছেলে ওলেগ আক্সিয়োনভ, কামচাৎকা সীমান্ত প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর সের্গেই মিরোনভ এবং প্রধান কেন্দ্রীয় পরিদর্শক ইয়েভগেনি মাকারভকে আংশিক সৈন্য সমাবেশের অংশ হিসেবে ডেকে পাঠানো হয়েছে এবং তারা রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মারকভের মতে, মস্কোসহ রাশিয়ার বড় বড় শহরগুলোয় জনমতের একটি বড় অংশ (৩০%–এর কাছাকাছি) আংশিক সৈন্য সমাবেশের বিরুদ্ধে, কিন্তু রাশিয়ার দূরবর্তী প্রদেশগুলোয় জনমতের একটি ক্ষুদ্র অংশ (১০% থেকে ১৫%) আংশিক সৈন্য সমাবেশের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, মারকভের মতে, রুশ জনসাধারণের সিংহভাগ আংশিক সৈন্য সমাবেশের পক্ষপাতী। কিন্তু রুশ জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আংশিক সৈন্য সমাবেশের বিপক্ষে, এবং এটি রুশ সরকারের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
আংশিক সৈন্য সমাবেশের বিরোধীরা মস্কো, সেইন্ট পিটার্সবার্গ, ইর্কুৎস্ক, উলান–উদে, তমস্ক, চিতা, খাবারোভস্ক, সারাতভ, মাখাচকালা প্রভৃতি বড় বড় শহরে বিক্ষোভ করেছে এবং মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’–এর প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, অন্তত ৭৪৫ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদুপরি, রুশ সরকার কর্তৃক আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা প্রদানের পর হাজার হাজার রুশ নাগরিক আকাশপথে ও স্থলপথে রাশিয়া ত্যাগ করেছে। রুশ সরকারের ভাষ্য অনুসারে, রুশ সশস্ত্রবাহিনীর রিজার্ভে থাকা ব্যক্তিদের বাদে অন্য কাউকে সৈন্য সমাবেশের জন্য ডেকে পাঠানোর কথা নয়, কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে এরকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে সামরিক অভিজ্ঞতাবিহীন/প্রশিক্ষণবিহীন কিছু ব্যক্তিকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার ইয়াকুতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান আয়সেন নিকোলায়েভ জানিয়েছেন, ইয়াকুতিয়ার বেশকিছু মানুষকে ‘ভুলবশত’ সৈন্য সমাবেশের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদেরকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রের এই ধরনের অকর্মণ্যতা জনসাধারণের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ও প্রকারান্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি করবে, সেটি স্বাভাবিক।
বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য সমাবেশের জন্য বিস্তৃত অবকাঠামো সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশ সরকার এই দিকটিতে ব্যাপক অবহেলা দেখিয়েছে এবং এর ফলে সোভিয়েত আমলে সৃষ্ট সৈন্য সমাবেশ সংক্রান্ত অবকাঠামো বহুলাংশে ক্ষয়ে গেছে। এর ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে সৈন্য সমাবেশ (আংশিক হলেও) ঘটানো রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। অকর্মণ্যতা, দুর্নীতি, পর্যাপ্ত তথ্যের অপ্রতুলতা, সরকারি নির্দেশনাকে অগ্রাহ্যকরণ – রুশ আংশিক সৈন্য সমাবেশের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে এবং এর ফলে রুশ জনসাধারণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় প্রচারণা। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, পশ্চিমা বিশ্ব যে কোনো মূল্যে রাশিয়াকে ইউক্রেনে পরাজিত করতে ইচ্ছুক এবং এজন্য রুশ সৈন্য সমাবেশে বিঘ্ন ঘটানো পশ্চিমা স্বার্থের জন্য লাভজনক। রাশিয়া কর্তৃক আংশিক সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা প্রদানের পর থেকেই পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম এটির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছে। রাশিয়ায় আংশিক সৈন্য সমাবেশের ফলে যেসব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, সেগুলোকে তারা অতিরঞ্জিত করে সম্প্রচার করছে। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম রুশ সৈন্য সমাবেশে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য সরাসরি রুশ জনসাধারণকে উৎসাহিত করছে। ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি পরপর তিন দিন রুশ ভাষায় ভাষণ দিয়ে রুশ জনসাধারণকে উক্ত সৈন্য সমাবেশে বাধা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউক্রেন রুশ আংশিক সৈন্য সমাবেশকে ইচ্ছাকৃতভাবে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে।
১৯১৪ সালের ৩০ জুলাই অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি কর্তৃক সার্বিয়ার ওপর পরিচালিত আক্রমণের প্রত্যুত্তরে রাশিয়া সৈন্য সমাবেশ শুরু করেছিল এবং এর ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১৯১৭ সালের মার্চে রোমানভ রাজবংশকে রাশিয়ার ক্ষমতা থেকে অপসারণের ক্ষেত্রে রাশিয়ার তদানীন্তন রাজধানী পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেইন্ট পিটার্সবার্গে) অবস্থানরত সমাবেশকৃত সৈন্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যদি রাশিয়া তাদের আংশিক সৈন্য সমাবেশ কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সহজতর হবে। কিন্তু অন্যদিকে, যদি রাশিয়া তাদের আংশিক সৈন্য সমাবেশের ক্ষেত্রে বড় রকমের কোনো ভুল করে ফেলে, সেক্ষেত্রে রুশ সরকার ও রুশ রাষ্ট্রের জন্য এর পরিণতি মারাত্মক বিপর্যয়কর হতে পারে।