(পর্ব ৫-এর পর থেকে)
২০২১ এর ডিসেম্বরে এনএসও আমেরিকার কালো তালিকায় চলে আসার মাত্র দুই সপ্তাহ পর হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ইসরায়েলে সফর করেন। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সাথে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির সবচেয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। সেটা হচ্ছে ইরানের সাথে নতুন পারমাণবিক চুক্তি করা। তিন বছর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূল চুক্তিটি বাতিল করে দেন।
তার এই সফর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। ২০১২ সালে সুলিভান ছিলেন প্রথম আমেরিকান কর্মকর্তাদের একজন যিনি ইরানি কর্মকর্তাদের সাথে সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসরায়েলের কাছে এই বৈঠকের ব্যাপারটা গোপন করেছিলেন। তার ভয় ছিল ইসরায়েলিরা এই সমঝোতা আলোচনা ভেস্তে দিতে পারে। ইসরায়েল পরবর্তীতে এ ব্যাপারে জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বছর দশেক পর সুলিভান জেরুজালেমে পৌঁছান ইরান কূটনীতির ব্যাপারে ইসরায়েলের সাথে সমন্বিত আলোচনার জন্য।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা আরো একটি ব্যাপারে আলোচনা করতে চাইছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা এনএসওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করতে চাইছিলেন। তারা সুলিভানকে এনএসওর কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণ জানার ব্যাপারে চাপ দেন। তারা হুমকি দেন এনএসও দেউলিয়া হয়ে গেলে তাদের জায়গা দখল করে নেবে রাশিয়া আর চীন। তারা হয়তো এমন সব দেশের কাছে হ্যাকিং সফটওয়্যার বিক্রি করতে পারে, যেখানে ইসরায়েল বিক্রি করা অনুমোদন করছে না।
আমেরিকা এনএসওকে কালো তালিকাভুক্ত করার পর ফেসবুকও আরো কয়েকটি ইসরায়েলি সাইবার অস্ত্র কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান উন্না মনে করেন এটা সাইবার অস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রভাব হ্রাস করার বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই গভীর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উড়িয়ে দেন। তারা জানান, এনএসও নিয়ে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র একটা বিপজ্জনক কোম্পানির লাগাম টেনে ধরার জন্য। এটা ইসরায়েল-আমেরিকা সম্পর্ককে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তারা আরো বলেন, একটা হ্যাকিং কোম্পানির পরিণতির চেয়ে এই কয়েক দশকের পুরোনো সম্পর্কের মাধ্যমে আরো অনেক কিছু অর্জনের সুযোগ আছে। ইসরায়েলে কাজ করা সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্টিন ইন্ডিকও এ ব্যাপারে একমত। তিনি বলেন,
এ প্রসঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে সোজাসাপ্টা। এনএসও বিভিন্ন দেশের কাছে তাদের প্রযুক্তি করছে নিজেদের জনগণের ওপর নজরদারি করার জন্য। এটা ইসরায়েলের নিরাপত্তার কোনো বিষয় নয়। এখানে এমন বিষয় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে এনএসওর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমেরিকান প্রযুক্তির ওপর এর নির্ভরশীলতার পাশাপাশি কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সম্ভাব্য ক্রেতা আর কর্মীদেরও হারাতে পারে এনএসও। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে জড়িত বেশ কিছু আমেরিকান কোম্পানি এনএসওকে কিনে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এরকম কিছু হলে এনএসওকে হয়তো আমেরিকান নীতিতে পরিচালনা করা হবে। তখন হয়তো এর পণ্যগুলো সিআইএ, এফবিআইসহ এই অস্ত্র কিনতে আগ্রহী অন্যান্য আমেরিকান এজেন্সিগুলোর কাছে বিক্রি করা হবে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখন এনএসওর এই কৌশলগত কর্তৃত্ব দখল নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এতে অস্ত্র কোথায় ও কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার কর্তৃত্ব হয়তো অন্য কোনো কোম্পানি বা দেশের হাতে চলে যাবে। এক জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি কর্মকর্তা অবশ্য এমন কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন। তিনি জানান, ইসরায়েল কখনো এ ধরনের কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবে না। বিদেশি মালিকানায় সমস্যা নেই। তবে এর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে ইসরায়েলের হাতে। কোম্পানির যেকোনো বিক্রয়মূলক কার্যক্রম ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
কিন্তু ইসরায়েলের এই মনোপলির যুগ শেষ হয়ে গেছে, অথবা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। হ্যাকিং সফটওয়্যার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আগ্রহের বিষয়টা এনএসওর সম্ভাব্য আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বিদের নজর এড়িয়ে যায়নি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সাইবার অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানি বোলডেন্ড তাদের ব্যাপারে অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানি রেথিওনের কাছে উপস্থাপন করে। ওই প্রেজেন্টেশন থেকে জানা যায় এই কোম্পানি গঠন করা হয় আমেরিকান সরকারি সংস্থাগুলোকে নিজস্ব সাইবার অস্ত্র সরবরাহ করা জন্য, যেন তারা সেলফোন ও অন্যান্য ডিভাইসগুলো আক্রমণ করতে পারে।
এক স্লাইড থেকে সাইবার অস্ত্র ব্যবসার এক জটিল প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য উঠে আসে। সে স্লাইডে দেখা যায় বোলডেন্ড দাবি করছে তারা হোয়াটসঅ্যাপের তথ্য হ্যাক করতে সক্ষম। কিন্তু পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপের একটা হালনাগাদ করা হলে তারা সেটা আর করতে সক্ষম হয় না। তাদের এই দাবি একটা গুরুত্ব বহন করে। বোলডেন্ডের প্রধান বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা ফাউন্ডারস ফান্ড। কোম্পানিটি পরিচালনা করেন বিলিয়নিয়ার পিটার থিয়েল। তিনি ফেসবুকের প্রথম দিকের বিনিয়োগকারীদের একজন। ফেসবুকের বর্তমান বোর্ড সদস্যদেরও একজন তিনি। অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপের মালিকানাও ফেসবুক বা মেটার অধীনে। ওই প্রেজেন্টেশন অনুযায়ী বর্তমানে বোলডেন্ডের হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাক করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এটা সক্রিয় করার ব্যাপারে আগ্রহী।
২০১৯ এর অক্টোবরে হোয়াটসঅ্যাপ এনএসওর বিরুদ্ধে মামালা করে। তারা অভিযোগ তুলে, এনএসওর সফটওয়্যারের কারণে হোয়াটসঅ্যাপের সেবা প্রদানে দুর্বলতা তৈরি করে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১,৪০০ ফোনে আক্রমণ করা হয়েছে। কে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, তার চেয়ে এই মামলায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল কে এই আক্রমণ করেছে তার ব্যাপারে। এনএসওর আত্মপক্ষ সমর্থনে বলা বিবৃতি দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করে আসা অন্য যেকোনো অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানিদের মতোই ছিল। তারা জানায়, এনএসও তাদের প্রযুক্তি শুধু বিদেশি সরকারদের কাছে বিক্রি করে। কোনো নির্দিষ্ট বক্তিকে লক্ষ্য করে কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা নেই বা এর জন্য তারা দায়ী নয়।
ফেসবুক দাবি করে এনএসওর এই অবস্থান একেবারেই মিথ্যা। তাদের মামলায় দাবি করে কিছু হ্যাকিংয়ের ঘটনায় এনএসওর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তারা প্রমাণ হিসাবে দেখায় হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্ট হ্যাক করার জন্য এনএসও তাদের বেশ কিছু কম্পিউটার সার্ভার ভাড়া দেয়। ফেসবুক যুক্তি দেখায় এনএসওর সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া তাদের অনেক ক্রেতাই ফোন হ্যাকিংয়ে সফল হতে পারত না।
ফেসবুকের আইনজীবীরা যখন এনএসওর বিরুদ্ধে তাদের মামলা নিয়ে প্রথম কাজ করা শুরু করেন, তাদের ধারণা ছিল ইসরায়েলি কোম্পানিটি যে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে ইসরায়েল সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ফোন নাম্বার হ্যাক করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার দিয়ে থাকে, তা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেন। আদালতের নথিতে ফেসবুকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওয়াশিংটন অঞ্চলে অন্তত একটা ফোন নাম্বারে এনএসওর পক্ষ থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। স্পষ্টতই কেউ একজন একটা আমেরিকান নাম্বারে নজরদারি করার জন্য এনএসও স্পাইওয়্যার ব্যবহার করছিল।
কিন্তু টেক জায়ান্টটি তখনকার সামগ্রিক চিত্রটি দেখতে পায়নি। ফেসবুক যেটা জানত না, আমেরিকান ফোন নাম্বারে আক্রমণের ব্যাপারটা শুধু একটা বিদেশি কোম্পানির হস্তক্ষেপই ছিল না। এটা ছিল এনএসওর পক্ষ থেকে এফবিআইয়ের জন্য তৈরি করা ফ্যান্টম প্রকল্প। এনএসও আমেরিকান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সিগুলোর জন্য এই সিস্টেম ডিজাইন করেছিল দেশটির স্মার্টফোনগুলোকে ‘তথ্যের সোনার খনি’তে রূপান্তরের জন্য।