“দয়া করে আপনারা গণমাধ্যমে মামলাটির বিচার করা বন্ধ করুন। কখনোই গণমাধ্যমে একটি মামলার বিচার শুরু করে দেবেন না। এটি বিচারকদের উপর প্রচন্ড চাপ তৈরি করে। দিনশেষে কিন্তু তারাও আমাদের মতোই মানুষ।”
নির্ভয়া মামলা শুধু ভারতেই নয়, আলোড়ন তুলেছিল পুরো বিশ্বেই। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে একটি বাসে সংঘটিত এই অপরাধের রোমহষর্ক বর্ণনা পড়ে শিউরে উঠেছিল সাধারণ মানুষের শরীর৷ গণমাধ্যমে এই ঘটনা আসার পর তুমুল আলোচনা শুরু হয়। এত বেশি আলোড়ন তৈরি করে ছিল এই মামলাটি যে তখন সেই মামলার বিচারের দায়িত্বে থাকা বিচারকদের উপর প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কুরিয়ান জোসেফ উপরের এই মন্তব্য করেন। এছাড়া এই মামলার বিচারের দায়িত্বে থাকা একজন বিচারক তাকে বলেছিলেন, “আমি যদি শাস্তি না দিতাম, তারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতো। গণমাধ্যম ইতোমধ্যেই রায়ে দিয়ে ফেলেছে। যেন এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।“
বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যমের জয়জয়কার চলছে। ইতিহাসের কোনো সময়েই গণমাধ্যম পাঠক-শ্রোতার এত কাছাকাছি আসতে পারেনি। একসময় টেলিভিশন আবিষ্কারের আগে পত্রিকা এবং রেডিও ছিল মূল গণমাধ্যম। একটি ঘটনা ঘটে গেলেও পরের দিন পত্রিকা হাতে পাওয়ার আগে ঘটনা সম্পর্কে জানার উপায় ছিল না। এরপর টেলিভিশন আবিষ্কার হলে গণমাধ্যমের সাথে মানুষের যোগসূত্র আরও নিবিড় হয়ে ওঠে৷ প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় একপর্যায়ে মানুষের হাতে হাতে চলে যায় আধুনিক সব সুবিধাসম্বলিত স্মার্টফোন। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে তথ্যপ্রাপ্তির মূল উৎসে। প্রতিটি সংবাদমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপুল ব্যবহারকে কাজে লাগিয়ে সংবাদ দ্রুততম সময়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও বর্তমানে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে প্রত্যক্ষদর্শীরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করে থাকেন, যেগুলো ভাইরাসের মতো অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে যায় সবখানে।
গণমাধ্যমকে আধুনিক গণতন্ত্রের একটি খুঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খুঁটি ছাড়া যেমন কোনো জিনিস দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তেমন গণতন্ত্রও গণমাধ্যম ছাড়া টিকে থাকতে পারে না৷ সহজ ভাষায়- সংবাদমাধ্যমের কাজ হচ্ছে ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা কিংবা সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে ঘটনা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। অনেক দূরে কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা সেটি জানতে পারি গণমাধ্যমের কল্যাণে। যেমন- চীনের কোনো প্রদেশে কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে সাধারণত গণমাধ্যমের কল্যাণে আমাদের কাছে সেই খবর এসে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। অপরদিকে একটি সমাজ টিকে থাকতে অপরিহার্য একটি উপাদান হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এটি আমাদের সংবিধানের ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হয়। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার পাওয়াও একটি মৌলিক অধিকার।
গণমাধ্যম, বিচারবিভাগ ও ন্যায়বিচার– তিনটি বিষয় একটি আরেকটির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। ধরুন, একটি অপরাধ সংঘটিত হলো। এখন গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে সেই অপরাধের তথ্য অবিকৃত অবস্থায় মানুষের কাছে প্রকাশ করা। এতে মানুষজন সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে, সচেতন হতে পারবে। আবার একই অপরাধের অভিযোগ যখন আদালত তথা বিচার বিভাগের সামনে উত্থাপিত হবে, তখন আদালত তথা বিচার বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে কোনো পূর্বানুমান ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে অপরাধের বিচার সম্পন্ন করা৷ আদালত এক্ষেত্রে কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারবে না, কোনো পক্ষকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারবে না। আবার যে ব্যক্তিরা একটি মামলায় দু’পক্ষে অবস্থান করেন, তারা প্রত্যেকেই ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবিদার।
সম্প্রতি দেখা গিয়েছে যে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মামলা কিংবা কোনো বিশেষ মামলার ক্ষেত্রে জনমনে তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়। গণমাধ্যম এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মামলার বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতে থাকে। যেহেতু গণমাধ্যমের প্রকাশ করা তথ্যানুযায়ী একটি ঘটনার ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি হয়, ফলে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই গণমাধ্যমের কারণে ‘দোষী’ সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তার প্রতি মানুষের এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, যেন তিনিই অপরাধটি করেছেন। বেশ কিছু মামলায় এমন বিষয় ঘটতে দেখা গিয়েছে যে, কোনো অপরাধের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগকারী ব্যক্তি কিংবা অপরাধের শিকার হওয়ার ব্যক্তির ভাষ্য, তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের দেয়া তথ্য গণমাধ্যমে এমনভাবে স্থান পেয়েছে যে, সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ আদালতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হওয়ার আগেই গণমাধ্যমের বিচারে তিনি ‘দোষী’ সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। এর ফলে তার সুনাম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তার পরিবারের সদস্যরা হয়তো সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন।
আমাদের দেশের যেকোনো অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে যে আইনগত দর্শন অনুসরণ করা হয়, সেটি হচ্ছে– অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত একজন ব্যক্তি নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হবে (Innocent until proven guilty)। অর্থাৎ গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত কথাই বলা হোক না কেন, আদালতের সামনে একজন ব্যক্তি ‘দোষী’ সাব্যস্ত হওয়ার আগে তিনি নির্দোষ। কিন্তু গণমাধ্যমে যদি একজন অভিযুক্ত বা অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা হয়, তখন সেভাবেই জনমত গড়ে ওঠে। চারদিক থেকে গণমাধ্যম যেভাবে দেখিয়েছে, সেভাবে রায় ঘোষণার দাবি উঠতে থাকে। কোনোক্রমে যদি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশিত রায় দেয়া না হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি গণমাধ্যমেও বিচারকের তুমুল সমালোচনা করা হয়৷ এর ফলে বিচারক প্রচন্ড চাপের সম্মুখীন হন। এভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিচার বিভাগের উপর গণমাধ্যমের এই অযাচিত প্রভাব বিস্তারই মূলত ‘মিডিয়া ট্রায়ালের প্রধান নেতিবাচক দিক।
গণমাধ্যম আর বিচার বিভাগ একটি দেশের গণতন্ত্র ঠিক রাখার জন্য পাশাপাশি কাজ করে যায়। গণমাধ্যম সত্যটা মানুষের সামনে তুলে আনে, আর আদালত সত্য প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। এই দুটি কখনোই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। গণমাধ্যমের অযাচিত প্রভাবে যেন বিচার বিভাগ বিচারকাজ সম্পাদনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয়, সেটি লক্ষ্য রাখা অতীব জরুরি। জনগণের আগ্রহ কাজে লাগিয়ে কোনো ঘটনা অন্যভাবে উপস্থাপন করলে দিনশেষে ন্যায়বিচারই ব্যাহত হবে।