নর্ড স্ট্রিম বিস্ফোরণের অমীমাংসিত রহস্য

ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান চলাকালীন ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বাল্টিকের বুকে নর্ড স্ট্রিম – ১, ২ পাইপলাইনে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে দুটি লাইনের চারটি পাইপলাইনের মধ্যে তিনটিই অকেজো হয়ে যায়। প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সেগুলো মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেগুলোকে সীল করে রাখা হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে কোনো একসময় সেগুলো মেরামত করা যায়।

বিস্ফোরণের খবর চাউর হবার সাথে সাথে ইউক্রেন এবং পোল্যান্ড কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই নাশকতার জন্য সরাসরি রাশিয়াকে দায়ী করে বিবৃতি দিতে থাকে। যদিও এটি বোধগম্য ছিল না রাশিয়া যে পাইপলাইনের নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করল, যেগুলো দিয়ে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে তারা আরো মাল্টিবিলিয়ন ডলার আয় করতে পারত, এবং ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানিকে তাদের উপর জ্বালানির জন্য অনেকাংশে নির্ভরশীল করে রেখেছিল- কেন সেই পাইপলাইন তারা নিজেরাই ধ্বংস করে দেবে!

অপরদিকে, সেসময় রাশিয়া সরাসরি কারো দিকে আঙুল না তুললেও পরোক্ষভাবে পশ্চিমাদের, বিশেষ করে ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে দোষারোপ করে ঘটনাটিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে উল্লেখ করে।

ভ্লাদিমির পুতিন; Image source: Al Jazeera

তখন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন ঘটনাটি অন্তর্ঘাত বললেও ইউরোপ রাশিয়ার ‘জ্বালানি অস্ত্র’ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন জ্বালানির দিকে নজর দেওয়ার এটা সেরা সুযোগ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

কে বা কারা নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে নাশকতা ঘটিয়েছিল? এটা কি কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাজ ছিল? নাকি রাষ্ট্রীয় মদদে সংঘটিত হয়েছিল এমনটা? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক নর্ড স্ট্রিম প্রজেক্ট সম্পর্কে।

Image Source: BBC

নর্ড স্ট্রিম – ১, ২ হচ্ছে রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগরের তলদেশে হয়ে জার্মানি এবং পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের অন্যতম প্রজেক্ট, যার অধিকাংশ(৫১%) শেয়ার রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকাধীন জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রমের। বাকি শেয়ারের মালিকানা জার্মানি, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডসের কয়েকটি কোম্পানির। নর্ড স্ট্রিম – ১ ২০১১ সালে চালুর পর সেটি দিয়ে বাৎসরিক ৫৫ বিসিএম (bcm) গ্যাস রাশিয়া থেকে ইউরোপে সরবরাহ করা হতো যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট গ্যাস আমদানির ৪৫ শতাংশ, এবং জার্মানির মোট গ্যাসের চাহিদার অর্ধেক ছিল। রাশিয়া থেকে ইউরোপ অভিমুখে গ্যাস সরবরাহ দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে রাশিয়া এবং জার্মানি নর্ড স্ট্রিম – ২ এর নির্মাণ শুরু করে। ২০২১ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। কিন্তু মার্কিন চাপের কারণে জার্মানি সেটির ছাড়পত্র দেওয়া থেকে বিরত ছিল এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর দুই দিন আগে জার্মানি সেটির সার্টিফিকেশন প্রসেস অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়।

Image Source: eandt.theiet.org

আমেরিকা, ইউক্রেন এবং পোল্যান্ডে বরাবরই নর্ড স্ট্রিম – ১, ২ প্রজেক্টের বিরোধিতা করে আসছিল। কেননা, আমেরিকা নর্ড স্ট্রিম – ১, ২ প্রজেক্টকে দেখত ইউরোপকে রাশিয়ার হাতের মুঠোয় আনার অস্ত্র হিসেবে। ইউক্রেন ও পোল্যান্ড বিরোধিতা করত, কারণ এই প্রজেক্টকে তারা রাশিয়ার ‘জ্বালানি অস্ত্র’ হিসেবে দেখত, এবং বাইপাস করার ফলে তারা বিপুল পরিমাণ ট্রানজিট ফি থেকে বঞ্চিত হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর দুই সপ্তাহ আগে বলেছিলেন, “যদি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তাহলে নর্ড স্ট্রিম – ২ বলে কিছু থাকবে না।

কীভাবে এটি করা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে বাইডেনের উত্তর ছিল রহস্যময় এবং সন্দেহজনক। তিনি বলেছিলেন, “আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমরা এটা করতে পারব।” এর কয়েকমাস পরেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাইপটি উড়িয়ে দেয়া হয়।

যদিও এতদিন নর্ড স্ট্রিম – ১, ২ এর নাশকতা নিয়ে আলোচনা প্রায় বন্ধ হতে চলেছিল, এর মধ্যে ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পুলিৎজারজয়ী বিখ্যাত মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক সেইমুর হার্শ নর্ড স্ট্রিম নাশকতা নিয়ে “How America Took Out The Nord Stream Pipeline” নামে এক সাড়াজাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তিনি বিস্ফোরণের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করেন।

তার সূত্রমতে, পাইপলাইনটি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, যখন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের উপস্থিতিতে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়।

তার প্রতিবেদন অনুসারে,

মার্কিন নৌবাহিনী এক নতুন কমিশন্ড সাবমেরিন ব্যবহার করে পাইপলাইনটি সরাসরি আক্রমণ করার প্রস্তাব দিয়েছিল, বিমান বাহিনীর প্রস্তাব ছিল বিলম্বিত ফিউজ সম্বলিত বোমা দিয়ে পাইপলাইন ধ্বংস করার। সিআইএ-র মতামত ছিল যা-ই করা হোক না কেন এটা করতে হবে খুব গোপনে। সংশ্লিষ্ট সকলে গোপনীয়তা নীতির সাথে একমত হয়েছিল।

সেইমুর হার্শের সূত্রমতে, যিনি কিনা কর্ম-পরিকল্পনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন, ২০২২ সালের জুনে ন্যাটোর BALTOPS 22 মহড়া চলাকালে মার্কিন নৌবাহিনীর ডুবুরি দল পাইপলাইনে বিস্ফোরক স্থাপন করে, এবং এর তিন মাস পর নরওয়ের নৌবাহিনীর একটি P-8 নজরদারি বিমান থেকে পাইপলাইনের আশেপাশে সোনার বয়া (Sonar Buoy) ফেলা হয়, যেগুলো থেকে পরবর্তীতে সংকেত পাঠিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

Image Source: Reuters

প্রতিবেদনটি হোয়াইট হাউজের নজরে আনা হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা সেটা নির্জলা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়।

সেইমুর হার্শের প্রতিবেদন প্রকাশের পর অজানা কারণে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলো সেটি একপ্রকার এড়িয়ে গিয়েছিল। এর এক মাস পর মার্চের ৭ তারিখে পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়াগুলো একটি ইউক্রেনপন্থী গ্রুপকে নাশকতার জন্য দায়ী করে একযোগে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের তিনজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক অ্যাডাম এনটোস, জুলিয়ান ই. বার্নস এবং অ্যাডাম গোল্ডম্যানের প্রতিবেদন অনুসারে,

আমেরিকার কর্মকর্তাদের হাতে আসা নতুন গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে- নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে নাশকতার জন্য ইউক্রেনপন্থী গ্রুপকে দায়ী করা যায়। কেননা, ইউক্রেন এবং তার মিত্রদের এই ঘটনা ঘটানোর যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। তারা বহু বছর ধরে এ প্রজেক্টের বিরোধিতা করে আসছে এই বলে যে এটি তাদের জন্য জাতীয় নিরাপত্তাগত হুমকি, যেহেতু এর মাধ্যমে রাশিয়া খুব সহজে গ্যাস বিক্রি করে ইউরোপকে তার তালুবন্দি করে রাখতে পারবে।

প্রতিবেদনে এটাও দাবি করা হয় যে, মার্কিন কর্মকর্তারা ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি অথবা উচ্চপদস্থ জেনারেল অথবা সরকারি উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা এই নাশকতায় জড়িত ছিল এরকম কোনো প্রমাণ পায়নি।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরই রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির সিনিয়র উপদেষ্টা এক টুইট বার্তায় বলেন,

“বাল্টিক সাগরের দুর্ঘটনার সাথে ইউক্রেন কোনোভাবে জড়িত নয়। এবং ইউক্রেনপন্থী কোনো নাশকতা সৃষ্টিকারি গোষ্ঠী সম্পর্কেও তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।”

নর্ড স্ট্রিম বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত এ দুটি তত্ত্বই সবচেয়ে জোরালো তত্ত্ব। এভাবে হয়তো ভবিষ্যতে আরো তত্ত্ব আসতে থাকবে; হয়তো সত্য উদঘাটিত হবে, হয়তো এটি আজীবন রহস্য হয়েই থাকবে!

This article is in Bengali about sabotage on Nord Stream Pipeline.

References:
1. How America Took Out The Nord Stream Pipeline - Seymour Hersh
2. US behind Nord Stream sabotage – legendary NYT journalist - RT
3. Biden vows to end German-Russian gas pipeline if Ukraine is invaded - LA Times

Related Articles

Exit mobile version