বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র রাশিয়া বা রুশ ফেডারেশন প্রশাসনিকভাবে ৮৫টি অঞ্চলে বিভক্ত। এই অঞ্চলগুলো সামগ্রিকভাবে ‘সুবইয়েক্তি ফেদেরাৎসি’ (কেন্দ্রীয় অঞ্চল) নামে পরিচিত এবং এই কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলো ‘রেসপুবলিকা’ (প্রজাতন্ত্র), ‘ক্রাই’ (সীমান্ত প্রদেশ), ‘ওব্লাস্ত’ (প্রদেশ), ‘আভতোনোমনায়া ওব্লাস্ত’ (স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ), ‘আভতোনোমনি ওক্রুগ’ (স্বায়ত্তশাসিত জেলা) ও ‘গরোদ ফেদেরালনোগো জনাচেনিয়া’ (কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর)– এই ভাগে বিভক্ত। এদের মধ্যে প্রজাতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং স্বায়ত্তশাসিত জেলাগুলো রাশিয়ার জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত। সোভিয়েত শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের উদ্দেশ্যে এই প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো গঠন করা হয়েছিল। বর্তমানে রাশিয়ায় ২২টি প্রজাতন্ত্র, ১টি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং ৪টি স্বায়ত্তশাসিত জেলা রয়েছে।
রাশিয়া ইউরোপ ও এশিয়া উভয় মহাদেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। পশ্চিমে বাল্টিক সাগর থেকে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এবং উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর ও ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত। রাশিয়ার প্রায় ৮১% অধিবাসী জাতিগত রুশ, প্রায় ৭১% অধিবাসী রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী এবং সিংহাভাগ অধিবাসী রুশ ভাষায় কথা বলে, যেটি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু জাতিগত রুশদের এই সুনিশ্চিত সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও রাশিয়া একটি বহুজাতিক, বহুধার্মিক এবং বহুভাষী রাষ্ট্র। সুবৃহৎ এই রাষ্ট্রটিতে কমপক্ষে ১৮৫টি অ-রুশ জাতি বসবাস করে এবং বিভিন্ন ধর্ম ও ভাষা রাষ্ট্রটিতে প্রচলিত। রুশ সংবিধানে রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের পাশাপাশি ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্মকে রাশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং রাশিয়ায় মোট ৩৫টি আঞ্চলিক রাষ্ট্রভাষা প্রচলিত রয়েছে।
বহুজাতিক রাশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এরকমই একটি অ-রুশ কেন্দ্রীয় অঞ্চল ‘তাতারস্তান’ বা ‘তাতারিয়া’। তাতারস্তানের পূর্ণ নাম ‘তাতারস্তান প্রজাতন্ত্র’ (তাতার: Татарстан Республикасы, ‘তাতারস্তান রেসপুবলিকাসি’; রুশ: Респу́блика Татарста́н, ‘রেসপুবলিকা তাতারস্তান’)। মস্কো থেকে প্রায় ৮০০ কি.মি. পূর্বে অবস্থিত এই জাতিগতভাবে মিশ্র প্রজাতন্ত্রটি পূর্ব ইউরোপীয় সমভূমি এবং ইউরোপীয় রাশিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত। ভোলগা ও কামা নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত প্রজাতন্ত্রটি পূর্বদিকে উরাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এর প্রায় ১৮% ভূমি বনাঞ্চল। প্রজাতন্ত্রটি রুশ ফেডারেশনের অন্যান্য প্রশাসনিক অঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত এবং এর সঙ্গে অন্য কোনো রাষ্ট্রের সীমান্ত নেই। এর রাজধানী কাজান রাশিয়ার ‘তৃতীয় রাজধানী’ এবং ‘ক্রীড়া রাজধানী’ নামে পরিচিত এবং শহরটিতে প্রাচ্যীয় ও রুশ সংস্কৃতির এক বিচিত্র সংমিশ্রণ লক্ষণীয়।
৬৭,৮৪৭ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট তাতারস্তান আয়তনের দিক থেকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে ৪৪তম (শ্রীলঙ্কার চেয়ে সামান্য বড়)। ‘তাতারস্তান’ শব্দটির অর্থ ‘তাতারদের দেশ/ভূমি’। তাতাররা বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি জাতি এবং তারা তাতার ভাষায় কথা বলে। তাতাররা প্রধানত ধর্মগতভাবে সুন্নি মুসলিম, কিন্তু তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষও রয়েছে। বর্তমানে তাতারস্তানে জাতিগত তাতাররা নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। তাতারস্তানের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩৯ লক্ষ এবং এদের মধ্যে ৫৩% জাতিগত তাতার, ৩৯.৭% জাতিগত রুশ, ৩% জাতিগত চুভাশ ও বাকিরা অন্যান্য জাতিভুক্ত। অর্থাৎ, তাতারস্তান জাতিগত তাতারদের আবাসভূমি হলেও সেখানে তাদের সংখ্যা অর্ধেকের কিছু বেশি। তাতারস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে ৪৮.৮% ইসলাম, ৩৫.৫% অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং বাকিরা অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুর্কি জাতি এবং বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠী এক নয়। তুর্কি (Turkish) জাতি (বর্তমান তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি) বৃহত্তর তুর্কি (Turkic) জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি জাতি, এবং তুর্কিদের পাশাপাশি তাতার, বাশকির, উজবেক, কাজাখ, তুর্কমেন প্রভৃতি জাতিও বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
প্রাচীন প্যালিওলিথিক যুগ থেকেই বর্তমান তাতারস্তানের ভূমিতে মানুষের বসবাস ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে অঞ্চলটিতে প্রথম সংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ‘ভোলগা বুলগেরিয়া’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। এটির আয়তন ছিল বর্তমান তাতারস্তানের তুলনায় অনেক বেশি এবং এটির অধিবাসীরা ‘বুলগার’ নামে পরিচিত ছিল, ‘তাতার’ নামে নয়। রাষ্ট্রটিতে বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত বুলগারদের পাশাপাশি ফিনিক (Finnic), উগ্রিক (Ugric) ও পূর্ব স্লাভ (Eastern Slavic) জনগোষ্ঠীর মানুষরাও বসবাস করত এবং একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে রাষ্ট্রটি পরিচিতি লাভ করে। দশম শতাব্দীতে বুলগাররা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং এর ফলে তাদের সংস্কৃতিতে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব দেখা দেয়।
দ্বাদশ শতাব্দীতে রুশ–অধ্যুষিত নভগরোদ ও ভ্লাদিমির রাষ্ট্রদ্বয়ের সঙ্গে ভোলগা বুলগেরিয়ার বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয় এবং এর ফলে রাষ্ট্রটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ১২২৩–১২২৪ এবং ১২২৯–১২৩৪ সালে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সঙ্গে বুলগাররা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১২৩৬ সালে মোঙ্গল নেতা বাতু খান রুশভূমি আক্রমণ করেন এবং এর অংশ হিসেবে মোঙ্গলরা ভোলগা বুলগেরিয়া আক্রমণ করে। বুলগারদের তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও মোঙ্গলরা তাদেরকে পরাজিত করে অঞ্চলটি দখল করে নেয়। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং যুদ্ধপরবর্তী গণহত্যায় ভোলগা বুলগেরিয়ার প্রায় ৮০% অধিবাসী নিহত হয়। অঞ্চলটি মোঙ্গল ‘গোল্ডেন হোর্ড’ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অঞ্চলটি (এবং অন্যান্য রুশ রাষ্ট্রগুলো) মোঙ্গল শাসনাধীনে ছিল। এ সময় মোঙ্গলদের সঙ্গে বুলগারদের বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে উভয় জাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মিশ্রণ ঘটে এবং গোল্ডেন হোর্ডের শাসকশ্রেণি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় এই প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়। এই সময় থেকে বুলগাররা ‘তাতার’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে রুশরা ‘তাতার’ বলতে মোঙ্গলদের বুঝাতো। রুশ ইতিহাসে রাশিয়ায় গোল্ডেন হোর্ডের শাসনামল ‘মোঙ্গল–তাতার জোয়াল’ হিসেবে পরিচিত।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৪৩৮ সালে উলুঘ মুহাম্মদ নামক চেঙ্গিস খানের একজন বংশধরের নেতৃত্বে কাজান শহরকে কেন্দ্র করে তাতাররা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যেটি ‘কাজান খানাত’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান তাতারস্তান, মারি এল, চুভাশিয়া ও মর্দোভিয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং উদমুর্তিয়া ও বাশকোরতোস্তানের অংশবিশেষ কাজান খানাতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী ১০০ বছর ধরে মস্কোকেন্দ্রিক রুশ রাষ্ট্র মাস্কোভির সঙ্গে কাজান নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এই দ্বন্দ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে কাজানের আধিপত্য থাকলেও পরবর্তীতে মাস্কোভি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে এবং ১৫৫২ সালে রাশিয়ার জার চতুর্থ ইভান (‘ইভান দ্য টেরিবল’ বা ‘ভয়ঙ্কর ইভান’ নামে সমধিক পরিচিত) কাজান দখল করে নেন।
রুশরা কাজান দখল করে নেয়ার পর তাতারদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা তেমন সাফল্য অর্জন করে নি এবং তাতারদের একাংশ অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও অধিকাংশ তাতার ইসলাম ধর্মকেই তাদের জাতিসত্তার অংশ হিসেবে বজায় রাখে। একই সময় কাজান খানাতের ভূমিতে জাতিগত রুশদের বসতি স্থাপন শুরু হয় এবং অন্যদিকে তাতাররা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৭০৮ সালে জার প্রথম পিওতর (‘পিটার দ্য গ্রেট’ নামে সমধিক পরিচিত) ‘কাজান খানাত’কে আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্ছেদ করে এটিকে ‘কাজান গুবের্নিয়া’তে পরিণত করেন এবং তখন থেকে একজন রুশ গভর্নর জেনারেল কাজান শাসন করতেন। কাজান ক্রমশ রাশিয়ার একটি অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে।
রুশ শাসনামলের প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক শোষণ প্রভৃতি কারণে তাতাররা বেশ কয়েকবার রুশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ১৫৫২–১৫৫৬, ১৬১৬ এবং ১৭৫৫–১৭৫৬ সালে তাতাররা রুশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ১৬০৬–১৬০৭ সালের ইভান বোলোতনিকভের বিদ্রোহ ও ১৭৭৩–১৭৭৫ সালের ইয়েমেলিয়ান পুগাচেভের বিদ্রোহেও তাতারদের একাংশ যোগদান করে। কিন্তু তাদের প্রতিটি বিদ্রোহই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৭৭৩ সালে রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় একাতেরিনা (‘ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট’ নামে পরিচিত) তাতারসহ রুশ মুসলিমদের বিস্তৃত অধিকার প্রদান করেন এবং তাতার অভিজাতদের রুশ অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নেন। এর মধ্য দিয়ে তাতারদের রুশ জাতির সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তাতারদেরকে রুশ সেনাবাহিনীতে নেয়া শুরু হয় এবং ১৮০৩–১৮১৫ সালে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে তাতাররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাজানে কিছু কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং রাশিয়া জুড়ে একটি তাতার বণিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। ১৮৬০–এর দশকে রুশ সম্রাট দ্বিতীয় আলেক্সান্দরের গৃহীত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার এবং ১৯০৬–১৯১১ সালে রুশ প্রধানমন্ত্রী পিওতর স্তোলিপিনের গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে কাজানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়।
একই সঙ্গে তাতারদের মধ্যে ‘জাদিদ’ নামক একটি সংস্কার কর্মসূচি আরম্ভ হয় এবং তাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার সৃষ্টি হয়। ১৯০৫ সালের ব্যর্থ রুশ বিপ্লবের পর যে রুশ আইনসভার সৃষ্টি করা হয় সেটিতে তাতারদেরও প্রতিনিধিত্ব ছিল। একই সময়ে তাতারদের একটি অংশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণাও বিস্তার লাভ করে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়া জুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেটি তাতার–অধ্যুষিত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের ১ মার্চ তাতার জাতীয়তাবাদীরা বর্তমান তাতারস্তানে ‘ইদেল–উরাল রাষ্ট্র’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, কিন্তু ২৮ মার্চ তাতার বলশেভিকরা এই রাষ্ট্রটিকে উচ্ছেদ করে সেখানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯১৮ সালের আগস্টে বলশেভিকবিরোধী শ্বেত ফৌজ চেকোস্লোভাক সৈন্যদের সহযোগিতায় কাজান দখল করে নেয়, কিন্তু শ্বেত ফৌজের নেতারা রুশ মুসলিমদের স্বায়ত্তশাসন প্রদানে রাজি ছিল না বিধায় তাতাররা সক্রিয়ভাবে তাদের বিরোধিতা করে। তাতারদের সহযোগিতায় বলশেভিক লাল ফৌজ কাজান পুনর্দখল করে নেয় এবং ১৯২০ সালের ২৭ মে ‘তাতার স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১–১৯২২ সালে রাশিয়া জুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং এর ফলে প্রজাতন্ত্রটিতে কমপক্ষে ৫ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ১৯২০–এর দশকে তাতাররা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এবং তাতার ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্প–সাহিত্যের বিশেষ উন্নতি ঘটে।
১৯৩০–এর দশকে সোভিয়েত সরকার তাতার প্রজাতন্ত্রটিতে ব্যাপক হারে রাজনৈতিক দমনপীড়ন চালায়, কিন্তু একই সঙ্গে অঞ্চলটি শিল্পায়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি অর্জন করে। অঞ্চলটিতে খনিজ তেলের আবিষ্কার অঞ্চলটির অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহু শিল্পকারখানা তাতার প্রজাতন্ত্রে স্থানান্তর করা হয়। ৫,৬০,০০০ জাতিগত তাতার সৈন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে যুদ্ধ করে এবং প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ হারায়। যুদ্ধোত্তর কালে প্রজাতন্ত্রটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকে এবং এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে ১৯৯০ সালে তাতারস্তান একটি ‘সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালের ২১ মার্চ তাতারস্তানে স্বাধীনতার ওপর একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ৬০% এর বেশি মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু একই সময়ে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে তাতারস্তানের নেতৃবৃন্দের আলোচনা চলছিল এবং দীর্ঘ আলোচনা শেষে ১৯৯৪ সালে তাতারস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে ‘ফেডারেশন চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে তাতারস্তান রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু বিস্তৃত স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। রাশিয়ার অন্যান্য কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মতো তাতারস্তানের নিজস্ব পতাকা, প্রতীক ও রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত রয়েছে এবং নিজস্ব রাষ্ট্রপতি, সরকার ও আইনসভাও রয়েছে। শুধু তাই নয়, তাতারস্তানের নিজস্ব অর্থনৈতিক পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তাতারস্তানে অর্থনৈতিক কার্যালয় স্থাপন করেছে।
তাতারস্তান অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত উন্নত। তাতারস্তানের মোট দেশজ উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান ৪৫। পেট্রোকেমিক্যাল, যন্ত্রাংশ নির্মাণ, ভারী যানবাহন নির্মাণ, পোশাক এবং খাদ্যদ্রব্য ও কাঠ বাজারজাতকরণ তাতারস্তানের শিল্পগুলোর মধ্যে প্রধান। রাশিয়ার বিখ্যাত ট্রাক–নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘কামাজ’ তাতারস্তানে অবস্থিত। রাশিয়ার অন্যতম প্রধান রাসায়নিক দ্রব্য নির্মাতা কোম্পানি ‘কাজানোর্গসিন্তেজ’ তাতারস্তানে অবস্থিত। তাতারস্তানে ‘টিইউ–২১৪’ যাত্রীবাহী বিমান ও হেলিকপ্টারও নির্মিত হয় এবং ‘কাজান হেলিকপ্টার প্ল্যান্ট’ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম হেলিকপ্টার নির্মাণ কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তাতারস্তানের পর্যটন শিল্পও বেশ সমৃদ্ধ। সর্বোপরি, তাতারস্তান খনিজ তেলে সমৃদ্ধ। প্রতি বছর প্রজাতন্ত্রটিতে ৩ কোটি ২০ লক্ষ টন তেল উৎপাদিত হয় এবং সেখানে মোট ১০০ কোটি টন তেল মজুদ আছে বলে ধারণা করা হয়।
তাতারস্তানের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির কারণে রাষ্ট্রটির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব তীব্র হয়েছিল। ১৯৯২ সালের গণভোটে প্রজাতন্ত্রটির প্রায় ৬১% অধিবাসী স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল এবং এদের মধ্যে জাতিগত তাতার ও রুশ উভয়ই ছিল। ১৯৯৪ সালের ‘ফেডারেশন চুক্তি’ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রটি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয় ঠিকই, কিন্ত এটির স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকে। ১৯৯৯ সালে প্রজাতন্ত্রটির সরকার তাতার ভাষা লেখার জন্য সিরিলিক লিপির পরিবর্তে ল্যাটিন লিপি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯০–এর দশকে রাশিয়া ছিল অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং চেচনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করতে গিয়ে মস্কো শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এজন্য তাতারস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কোনো চেষ্টা মস্কো সেসময় করেনি।
কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলো দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তার পূর্বসূরী বোরিস ইয়েলৎসিনের সঙ্গে তার পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। ইয়েলৎসিন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের একজন মূল কারিগর, সুতরাং আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদ বা স্বায়ত্তশাসন তার জন্য অনেকটাই সহনীয় ছিল। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ‘বিংশ শতাব্দীর বৃহত্তম ভূরাজনৈতিক দুর্যোগ’ হিসেবে বিবেচনা করেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতি সহনশীল নন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ২০০২ সালে রুশ কেন্দ্রীয় সরকার তাতারস্তানের সংবিধান থেকে ‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দটি অপসারণ করে এবং সিরিলিক লিপিতে তাতার ভাষা লেখা বাধ্যতামূলক করে। কিছু তাতার জাতীয়তাবাদী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও তাতারস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে এবং মস্কো ক্রমশ তাতারস্তানকে রাশিয়ার অন্যান্য প্রদেশের মতো একটি প্রদেশে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু পুতিনের শাসনামলের প্রথম দিকে রাশিয়ার বিপুল অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো তাতারস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি ঘটে, ফলে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদ জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
২০০৮ সালে রুশ–জর্জীয় যুদ্ধের পর রাশিয়া জর্জিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্র ‘দক্ষিণ ওসেতিয়া’ ও ‘আবখাজিয়া’কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর ফলে তাতার জাতীয়তাবাদীরা দাবি করে যে, তাতারস্তানকেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। ২০০৮ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘মিল্লি মজলিস’ নামক একটি সংগঠন তাতারস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানায়। কিন্তু রুশ কেন্দ্রীয় সরকার, জাতিসংঘ কিংবা তাতারস্তানের জনসাধারণ কোনো পক্ষই এই ঘোষণাকে গুরুত্ব সহকারে নেয়নি।
২০১৩–২০১৪ সালে ইউক্রেনে পশ্চিমা–সমর্থিত ‘ইউরোমাইদান বিপ্লবে’র ফলে ইউক্রেনের মস্কোপন্থী রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং একটি কট্টর রুশবিরোধী সরকার তদস্থলে অধিষ্ঠিত হয়। প্রত্যুত্তরে রুশ–অধ্যুষিত ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে একটি বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে। এর ফলে তাতার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত তাতারস্তানের স্বাধীনতা সংক্রান্ত গণভোটের প্রসঙ্গ টেনে আনে এবং রুশ কেন্দ্রীয় সরকারকে দ্বিমুখী আচরণের দায়ে অভিযুক্ত করে। যথারীতি এবারও মস্কো তাদেরকে উপেক্ষা করে।
২০১৭ সালে রাশিয়া ও তাতারস্তানের মধ্যে ১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত ‘ফেডারেশন চুক্তি’র মেয়াদ শেষ হয় এবং এরপর মস্কো প্রজাতন্ত্রটির স্বায়ত্তশাসনের ওপর আরেক দফা আঘাত হানে। মস্কো এই চুক্তিটি নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তাতারস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাতার ভাষার ওপর শিক্ষা প্রদানের বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত যে আইন ছিল সেটি বাতিল করে। কিন্তু তাতারস্তানের সরকার এই নির্দেশনা আপাতদৃষ্টিতে উপেক্ষা করলে মস্কো তাতারস্তানে একটি তদন্তকারী দল প্রেরণ করে এবং তারা নতুন নির্দেশনাটি বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা সেটি পর্যবেক্ষণ করে। তাতার জাতীয়তাবাদীরা এটিকে তাতার সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে এবং এটি প্রজাতন্ত্রটির অভিজাতদের মধ্যেও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তাতারস্তানের প্রধান মুফতি প্রজাতন্ত্রটির মসজিদগুলোতে তাতার ভাষায় প্রার্থনা পরিচালনার মাধ্যমে তাতার ভাষাকে রক্ষা করার আহ্বান জানান। কিন্তু এই অসন্তোষ বড় ধরনের কোনো আন্দোলনে রূপ নেয়নি এবং এখন পর্যন্ত মস্কো তাতারস্তানের ওপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
বস্তুত প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই তাতারস্তানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে।
প্রথমত, তাতারস্তান ভৌগোলিকভাবে অন্যান্য রুশ অঞ্চল দ্বারা পরিবেষ্টিত। সুতরাং স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্থলবেষ্টিত তাতারস্তানকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমুদ্রে প্রবেশাধিকারের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে এবং রুশরা চাইলেই অবরোধ আরোপের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রটির অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারবে। এমতাবস্থায় রাশিয়ার সঙ্গে তিক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন তাতারস্তানের সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করবে। এজন্য তাতারস্তানের ক্ষমতাসীন অভিজাত সম্প্রদায় বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়, বরং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন লাভেই বেশি আগ্রহী।
দ্বিতীয়ত, তাতারস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামের ইদানীংকালের কোনো ঐতিহ্য নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুগাচেভের বিদ্রোহের পর থেকে তাতাররা আর রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি এবং তাতারস্তানের জনসাধারণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব তীব্র নয়। ‘মিল্লি মজলিস’ এবং ‘অল–তাতার সিভিক সেন্টারে’র মতো কিছু কিছু জাতীয়তাবাদী সংগঠন তাতারস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী, কিন্তু তাদের জনসমর্থন এখন পর্যন্ত সীমিত। এ পর্যন্ত তাতার জাতীয়তাবাদীরা তাতারস্তানে কোনো বড় ধরনের জনবিক্ষোভের আয়োজন করতে পারেনি এবং এমনকি বাধ্যতামূলক তাতার ভাষা শিক্ষা তুলে দেয়ার পরও তাতারস্তানের জনসাধারণ তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
তৃতীয়ত, তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রটি জাতিগত তাতারদের জন্য নির্ধারিত হলেও রাশিয়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ তাতার তাতারস্তানের বাইরে বসবাস করে। রাশিয়ায় বসবাসকারী প্রায় ৫৩ লক্ষ জাতিগত তাতারের মধ্যে মাত্র ২০ লক্ষ তাতার তাতারস্তানের অধিবাসী। এর ফলে তাতারস্তান যদি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়, সেক্ষেত্রে রাশিয়ায় থেকে যাওয়া তাতাররা জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হতে পারে। বস্তুত রুশ–নিয়ন্ত্রিত তাতারস্তান রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তাতারদের জন্য রক্ষাকবচ স্বরূপ।
চতুর্থত, তাতারস্তানের জনসংখ্যা জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে মিশ্র। তাতারস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৪০% জাতিগত রুশ। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া ব্যতীত অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রে থেকে যাওয়া লক্ষ লক্ষ জাতিগত রুশ নানা ধরনের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। সুতরাং তাতারস্তান তাতার জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হোক এটি আপাতদৃষ্টিতে সেখানকার জাতিগত রুশরা চাইবে বলে মনে হয় না।
পঞ্চমত, তাতাররা ধর্মগতভাবে মুসলিম হলেও দীর্ঘ ৩৫০ বছরব্যাপী রুশ শাসনের ফলে তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং পরবর্তী ১০০ বছরব্যাপী সোভিয়েত/রুশ শাসনে মুসলিম তাতারদের মধ্যেও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বস্তুত তাতারদের মধ্যে ‘রুশীকরণ’ এমনভাবে ঘটেছে যে অধিকাংশ তাতার নিজেদের ভাষার পরিবর্তে রুশ ভাষায় কথা বলে। এদিকে তাতার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে ১৯৯০–এর দশকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ কর্মীদের প্রাধান্য ছিল, এখন আর তেমন নেই, বরং বর্তমানে তাতার জাতীয়তাবাদীরা ক্রমশ ধর্মকে বেছে নিচ্ছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। স্বভাবতই ধর্মনিরপেক্ষ ও খ্রিস্টান তাতাররা এবং তাতারস্তানের ‘অ–তাতার’ জাতিগুলো এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে না।
ষষ্ঠত, তাতারস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতরা সাধারণভাবে মস্কোর প্রতি অনুগত। তাতারস্তানে বর্তমান রাষ্ট্রপতি রুস্তাম মিন্নিখানভ, প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই পেসোশিন এবং ১০০ সদস্যবিশিষ্ট আইনসভা ‘দেভলেত সোভিয়েতি’র স্পিকার ফারিদ মুখামেতশিন তিনজনই রাশিয়ার ক্ষমতাসীন দল ‘সংযুক্ত রাশিয়া’র সদস্য। তাতারস্তানের অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতরাও নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার্থে মস্কোর প্রতি অনুগত। এমতাবস্থায় মস্কোর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কোনো ব্যক্তিত্ব তাতার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে নেই।
সপ্তমত, তাতারস্তানের আঞ্চলিক অভিজাতদের মতো রাশিয়ার কেন্দ্রীয় অভিজাতদের মধ্যে তাতার ব্লকের স্বার্থও তাতারস্তান রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকার মধ্যেই নিহিত। রাশিয়ার বর্তমান নির্মাণ ও আঞ্চলিক উন্নয়ন বিষয়ক উপপ্রধানমন্ত্রী মারাত খুনসুল্লিন, ডিজিটাল উন্নয়ন, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিষয়ক মন্ত্রী মাকসুত শাদায়েভ এবং রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট এলভিরা নাবিউল্লিনা– এরা সকলেই জাতিগত তাতার। রুশ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান মুফতি রাভিল গাইনুৎদিন একজন জাতিগত তাতার। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪% জাতিগত তাতার এবং সেই অনুপাতে রুশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতদের মধ্যে তাতারদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাতারস্তান রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের তাতার অভিজাতদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং তারাও চেষ্টা করবে তাতারস্তানকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য।
অষ্টমত, ষোড়শ শতাব্দীতে যখন জার চতুর্থ ইভান রাশিয়াকে একটি একত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করেন, তখন থেকেই বর্তমান তাতারস্তান রুশ রাষ্ট্রের অন্তর্গত। ৪৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একত্রিত থাকার ফলে তাতারদেরকে রুশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তদুপরি, তাতারস্তান রাশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং রাশিয়ার হৃদভূমিতে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের সৃষ্টি প্রান্তিক রুশ প্রদেশগুলোর ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলবে। এজন্য মস্কো কোনোক্রমেই তাতারস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেবে না।
নবমত, অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ তাতারস্তানকে হারালে সেটি হবে মস্কোর জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধে এবং কোভিড–১৯ মহামারীতে বিপর্যস্ত রাশিয়ার জন্য এটি হবে একটি নতুন বিপর্যয়। রুশ জাতীয়তাবাদীরাও নতুন করে রাশিয়ার বিভাজনকে ইতিবাচকভাবে দেখবে না। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে রুশ সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে এবং পতন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেবে। সুতরাং, ইয়েলৎসিনের অনুরূপ কিছু পশ্চিমাপন্থী বাদে কোনো রুশ রাজনৈতিক দলই তাতারস্তানের মতো তেলসমৃদ্ধ ও শিল্পোন্নত অঞ্চল হাতছাড়া করতে চাইবে না।
সর্বোপরি, যেকোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামের জন্য বিদেশি সমর্থন আবশ্যক। পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্রগুলোর গণমাধ্যম তাতারস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন জানিয়েছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোও রাশিয়ার বিভাজনে অনাগ্রহী হবে না। কিন্তু তাতারস্তানে যদি সত্যি বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম শুরু হয়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে অস্ত্র বা রসদপত্র দিয়ে সহায়তা করা তাদের জন্য কঠিন হবে, কারণ তাতারস্তানের সঙ্গে কোনো আন্তর্জাতিক সীমান্ত নেই। এমতাবস্থায় তাতারস্তানের সম্ভাব্য যে কোনো বিদ্রোহের সাফল্য নির্ভর করবে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর তাতার সৈন্যদের এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণের ওপর। এক্ষেত্রে মনে রাখা আবশ্যক, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালেও সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর অ–রুশ সৈন্যরা মস্কোর প্রতি অনুগত ছিল এবং বাকু, আলমাতি বা ভিলনিয়াসে জনসাধারণের ওপর গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি। সেক্ষেত্রে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর তাতার সৈন্যরা এরকম কোনো বিদ্রোহে যোগ দেবে সেই সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আর যতক্ষণ পর্যন্ত রুশ সশস্ত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্রেমলিনের হাতে থাকবে এবং ক্রেমলিনে পুতিন বা অনুরূপ কোনো রাষ্ট্রনায়ক শাসনক্ষমতায় থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাতারস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদ সফল হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।
বস্তুত, এখন পর্যন্ত তাতারস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন অত্যন্ত দুর্বল ও অসংগঠিত। তাতার অভিজাত সম্প্রদায় ও জনসাধারণের সিংহভাগ এখনো মস্কোর প্রতি অনুগত। সুতরাং স্বল্প মেয়াদে রাশিয়া থেকে তাতারস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কী হবে সেটি আন্দাজ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালেও কেউ আন্দাজ করতে পারেনি যে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যে মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটবে। তেমনই, আজ থেকে ১০, ২০ বা ৩০ বছর পর রুশ ফেডারেশন এবং তাতারস্তানের ভাগ্যে কী ঘটবে, সেটি কেবল ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির ওপরেই নির্ভর করবে।