প্রায় এক দশক ধরে চলা ছাত্র আন্দোলন চিলিকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে?

অনেকটা দৃষ্টির অগোচরেই গত কয়েকবছরের সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে চিলিতে। এমন একটা সময়ে এই আন্দোলন হচ্ছে, যখন চিলি ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসন থেকে মুক্তির পর অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সেরা সময় পার করছে। চিলি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি দেশ। ‘৮০ র দশকের দিক থেকে তারা তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দেয়। ফলস্বরূপ, এখন দক্ষিণ আমেরিকার উদীয়মান শক্তিশালী দেশ হিসেবে চিলিকে দেখা হচ্ছে। এতকিছুর পরও একটা লম্বা সময় ধরে চিলিতে ছাত্র আন্দোলন চলছে, যেখানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমানভাবে রাজপথে নেমে এসেছে। এরই মধ্যে তিনবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত দাবি মেটেনি।

কী নিয়ে এত অসন্তোষ?

চিলির ছাত্রছাত্রীরা মূলত রাস্তায় নেমে এসেছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথাগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে। চিলির শিক্ষা ব্যবস্থায় গত কয়েক দশকে উন্নতি চোখে পড়ার মতো। কিউএস এডুকেশন র‍্যাংকিংয়ে চিলি দক্ষিণ আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় এক নম্বর। ঠিক মুদ্রার আরেক পিঠে অবস্থা একেবারেই উল্টো। কারণ চিলিতে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বৈষম্যপূর্ণ। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রের সময়ে আশির দশকে করা আইন অনুযায়ী চলছে। সেই আইনানুযায়ী, চিলির শিক্ষাব্যবস্থা মিউনিসিপ্যালিটি থেকে পরিচালিত হয়। শিক্ষার জন্য তাদের কোনো কেন্দ্রীয় বাজেট নেই। বরং, প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটির জন্য যে বাজেট নির্ধারিত থাকে সেখান থেকে তারা নিজেদের শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য বাজেট বরাদ্দ করে। এতে করে যেটা হয়, যে মিউনিসিপালিটি আর্থিকভাবে যত সচ্ছল তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট তত বেশি। এখানেই মূলত বৈষম্যটা শুরু হয়ে যায়।

পাই চার্টে চিলির সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র; © Education Next

সব ভাল ভাল স্কুলগুলোও ঐ এলাকাগুলোতেই অবস্থান করে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, চিলির স্কুলগুলো তিনটি পদ্ধতিতে চলে। সরকারি, আধা-সরকারি এবং বেসরকারি। যেখানে সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, কেন্দ্রীয় কোনো মনিটরিং বা রেগুলেশন না থাকায় আধা-সরকারি স্কুলগুলো বাকি টাকা যাচ্ছেতাইভাবে অভিভাবকদের থেকে আদায় করে, আর বেসরকারি স্কুলগুলো একেবারেই হিসাবের বাইরে। এভাবে চিলির শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের একটা শ্রেণীবৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে শিক্ষা মৌলিক অধিকারের একটি অংশ এবং সবার সেখানে সমান সুযোগ পাওয়ার কথা, সেখানে যারা আগে থেকে সমাজের উপরতলায় রয়েছে তারাই সবচেয়ে ভাল শিক্ষাগ্রহণের সুযোগটা পাচ্ছে। যেন তার জন্মের আগে থেকেই নির্ধারিত সে আসলে তার জীবনে কতটুকু যেতে পারবে। কারণ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি মিউনিসিপ্যালিটি এলাকার শিক্ষার মান কখনোই একটি ভাল মিউনিসিপ্যালিটি এলাকার স্কুল-কলেজের সমান হবে না। আর এখানেই একটা মৌলিক চাহিদা গ্রহণের চরম বৈষম্য শুরু হয়ে যায়।

এটা গেল স্কুল ব্যবস্থার কথা। চিলির আনুমানিক ৬০% বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রাইভেট, যেখানে টিউশন ফী আকাশছোঁয়া। অথচ, একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেন সেখানে যেকোনো পরিবেশ থেকে আসা ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চিলিতে সেটা অনুপস্থিত। এসব নিয়েই মূলত চিলির ছাত্রসমাজের ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে।

আন্দোলনের সূত্রপাত

চিলির ছাত্র অসন্তোষ প্রথম টের পাওয়া যায় ২০০৬ সালে। যখন চিলিতে কপার খনি শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছিল। প্রায় একমাস ধরে চলা এ আন্দোলন আন্তর্জাতিক বাজারে তামার সংকট তৈরি করেছিল। সেখান থেকেই সাধারণ মানুষের সরকারের প্রতি অসন্তোষ শুরু। মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে চিলির স্কুল শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে, যা গণমাধ্যমগুলোতে ‘পেঙ্গুইন রেভ্যলুশন’ নামে পরিচিত।

২০০৬ সালের শিক্ষার্থী আন্দোলন; © Media Ninja 2016

কারণ চিলির শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্মের রঙ সাদা-কালো, যা পেঙ্গুইনের প্রতীক। আর এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে স্কুল শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তারা মূলত ৬ দফা দাবি নিয়ে আসে, যার মধ্যে যানবাহনে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফ্রি পাস, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি কমানো, সামরিক আমলের শিক্ষা আইন বাতিল করা ইত্যাদি দাবিদাওয়া ছিল, যার মধ্যে প্রায় সবগুলোই মিশেল বাকেলেটের সরকার মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু সরকার খুবই ধীরগতিতে কাজ করছিল এবং মূল দাবিদাওয়াগুলো বাস্তবায়নের কোনো ইঙ্গিত ছিল না।

এরপর ২০১১ সালে চিলিতে সরকার পরিবর্তন হয়, আসে সেবাস্তিয়ান পিনেরার সরকার। এর পরপরই মূলত চিলিতে কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু হয়। এর কারণ ছিল, তৎকালীন চিলির শিক্ষামন্ত্রী আধা-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলশ্রুতিতে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের উল্লেখযোগ্য কিছু দাবি ছিল-

• পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের ভর্তুকি বাড়ানো
• ন্যায়সঙ্গত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা
• সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনামূল্যে শিক্ষা
• নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে দরিদ্র এলাকাগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা
• আইনের পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ

আন্দোলনের ডামাডোলে প্রেসিডেন্ট পিনেরার সরকার ২ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ‘গণশিক্ষা উন্নয়ন প্রজেক্ট’ প্রস্তাব নিয়ে সামনে আসে, যা শিক্ষার্থীদের মনঃপুত হয়নি। কারণ এখানে শুধুমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রেগুলেশনের আওতায় আনার কথা বলা হয়, “সমন্বিতভাবে বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা”- যেটি তাদের মূল দাবি সেই সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এরপর আগস্টে চিলিতে গণতন্ত্র ফেরার পর এযাবতকালের সবচেয়ে বড় গণজমায়েত হয়।

চিলিতে উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের জমায়েত; © marxist.pk

প্রায় ১ লক্ষ শিক্ষার্থী ‘কনফেডারেশন অব চিলিয়ান স্টুডেন্ট’ এর ব্যানারে রাস্তায় নেমে আসে এবং সরকারের বৈষম্যপূর্ণ আচরণের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান পুলিশের সাথে সংঘর্ষে সহিংসতার দিকে যেতে থাকে। এর জের ধরে শিক্ষামন্ত্রীকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের আলোচনার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এর একমাসের মাথায় পিনেরা সরকার ২১ দফাবিশিষ্ট আরেকটি প্রস্তাবনা শিক্ষার্থীদের সামনে রাখে। সেখানে শিক্ষায় আর্থিক লাভকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করার ব্যাপারে কিছু না বলায় শিক্ষার্থীরা আদৌ এ প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে।

কিন্তু অল্প করে হলেও চিলির পার্লামেন্ট ও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। যেমন- সিনেটের শিক্ষা বিষয়ক কমিটি যেকোনো আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তাকে অবৈধ ঘোষণা করে আইন পাস করেছে। চিলিতে আরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ চলছে। শিক্ষাকে সকল স্তরের মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছে দিতে সরকারের নিষ্ঠার কথা বারবার জনগণের কাছে বলা হচ্ছে।

বর্তমান অবস্থা

এতকিছুর পরও শিক্ষার্থীদের আবার রাস্তায় নামতে হয়েছে ২০১৮ সালে। এবার দুটি ভিন্ন কারণে। প্রথমটি হলো, সম্পূর্ণ নতুন একটি সমস্যার আবির্ভাব হয়েছে, যেখানে চিলির শিক্ষা ব্যবস্থাকে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক হিসেবে দাবি করা হয়েছে। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ইউনিভার্সিটি অব চিলির শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে।

নারীশিক্ষায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন; © picture-all

দ্বিতীয়টি হলো, প্রেসিডেন্ট ব্যাকেলেট দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালের আন্দোলনের মুখে একটি বিল প্রণয়ন করেছিলেন। যেখানে বিনামূল্যে সর্বস্তরের মানুষের জন্য শিক্ষা ও লাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবৈধ – স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস করা হয়েছিল, যা সম্প্রতি হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল করে দেয়া হয়েছে। মূলত, প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মালিকদের করা একটি রিটে এই আদেশ দেয়া হয়, যেখানে তারা দাবি করেছেন এরকম একটি বিল পাস করানো অসাংবিধানিক। কারণ ১৯৮৯ সালের শিক্ষা বিল অনুযায়ী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এভাবে কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আদেশটি পুনঃনির্ধারণের জন্য আপিল বিভাগে আছে। তবে এটা বলাই যায়, ১৯৮১ সালে সামরিক সরকারের প্রণীত বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষা আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিল না করা পর্যন্ত চিলির শিক্ষার্থীদের তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হতে পারে।

This is a bangla article about ongoing student protest in Chile since 2006. It has been happening over a decade now, yet the root of the problems are remaining unsolved continuously. 

Featured Image Credit : Xinhua/Jorge Vilega/IANS 

Related Articles

Exit mobile version