কোনো দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং উপনিবেশায়ন যুগপৎ ঘটে না। উপনিবেশায়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার ভেতর দিয়ে উপনিবেশের জনগণ সাংস্কৃতিকভাবে পরাধীন হয়ে পড়ে। এ সাংস্কৃতিক পরাধীনতা দেশটির চূড়ান্ত পরাজয় নির্দেশ করে। এর প্রভাব এমন গভীর যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও উপনিবেশিত দেশের পরাধীনতা বহাল থাকে। তখন দৃশ্যমান উপনিবেশ না থাকলেও মানুষের মনোজগতে ক্রিয়াশীল থাকে অদৃশ্য উপনিবেশ। প্রাক্তন উপনিবেশ নিজের চেহারা পাল্টিয়ে কর্তৃত্বের নতুন কৌশল নিয়ে ফিরে আসে।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই পৃথিবীজুড়ে ইউরোপের উপনিবেশগুলো দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। বিশেষ করে দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের ফলে উপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের উপনিবেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলন দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত দীর্ঘদিনের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে, অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসিত কেনিয়াতেও কেনিয়ান আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের উত্থানে ব্রিটিশদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে স্বাধীনতার দাবি। এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়, কিন্তু দেশগুলোতে থেকে যায় সাংস্কৃতিক উপনিবেশ। স্বাধীনতার পর ঔপনিবেশিকদের জায়গা নেয় তাদেরই হাতে তৈরি অভিজাত শ্রেণি। উপনিবেশিত সমাজে থাকা ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও জাতিভিত্তিক বৈষম্য ও বিভক্তি এই শ্রেণিকে শক্তিশালী করে।
ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংগ্রামের রেশ থেকে যায় এর পরও। এই রেশ থেকে কীভাবে মুক্ত হওয়া যাবে কিংবা স্বাধীনতার পর দেশগুলো কোন আইন-কানুন মেনে চলবে, তা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা।
উত্তর-উপনিবেশিক ভাবনা
ফরাসি উপনিবেশ মার্টিনিকে জন্মগ্রহণ করা ফরাসি-আলজেরীয় চিন্তাবিদ ফ্রাঞ্জ ফানোঁ মূলত কাজ করেছেন ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং ইউরোপীয় শাসন শেষ করতে উপনিবেশে থাকা নিপীড়িত জনগণের প্রত্যুত্তর নিয়ে। হেগেল এবং মার্ক্সের ভাবনা থেকে ধার নিয়ে ফানোঁ এগিয়েছেন তার স্বতন্ত্র নিয়মে, ব্যাখ্যা করেছেন বর্ণবাদ এবং উপনিবেশবাদকে। ভাষা এবং সংস্কৃতির সাথে রাজনীতির যোগসূত্র দেখিয়েছেন ফানোঁ, দেখিয়েছেন কীভাবে বর্ণবাদ ও অন্যান্য পক্ষপাত ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। তবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ঔপনিবেশিকতামুক্তি তত্ত্ব বা ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি লাভের প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যাকরণ, যা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকারী এবং রাজনীতিবিদদেরকে এখনো প্রভাবিত করে।
ফানোঁ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং এর ধারা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। বিশেষ করে আফ্রিকা-এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উপনিবেশে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যকে মিলিয়েছেন এবং উপনিবেশ তৈরির ফলে যে নিপীড়নের শিকার হয়েছে স্থানীয় মানুষ তার সমালোচনা করেছেন। ফানোঁ তার বই ‘অ্যা ডাইং কলোনিয়ালিজম’-এ ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সশস্ত্র আন্দোলন কীভাবে আলজেরিয়াকে স্বাধীন করেছে তা-ও তুলে ধরেছেন। উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে কী কী সশস্ত্র কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে কিংবা কী কী আদর্শের উত্থান হয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন ফানোঁ তার এই বইয়ে।
নিপীড়নের কাঠামো
ফানোঁর তত্ত্ব যতটা না বাস্তবিক, তার চেয়ে বেশি তাত্ত্বিক। মূলত ফানোঁ একটি উপনিবেশের মধ্যে কীভাবে নিপীড়ন চলে তার একটি কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। ঔপনিবেশিক নিপীড়নের মূল ভিত্তি হলো জাতিগত শ্রেণিবিভাগ তৈরি, যার ফলে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয় তা-ই নয়, একইসাথে সংস্কৃতিগত ও রাজনৈতিকভাবেও দুই শ্রেণির মধ্যে এটি পার্থক্য গড়ে দেয়।
ঔপনিবেশিক বর্ণবাদ
ফানোঁর জটিল তত্ত্বকে অতি-সরলীকরণ করে একে অনেকসময় এর অপব্যবহারও করা হতে পারে। ফানোঁর মতে, ঔপনিবেশিকতা স্বাভাবিকভাবেই একপ্রকার সহিংসতা (Violence), তবে এই সহিংসতা বিভিন্নভাবে কাজ করতে থাকে। এটি হতে পারে উপনিবেশে শাসিতদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, আবার বিভিন্ন ধরনের স্টেরিওটাইপ ও সামাজিক বাধানিষেধ তৈরি করে সমাজের স্বাভাবিক অবস্থা বাধাগ্রস্ত করা, এবং ফানোঁ একেই উপনিবেশের স্বাভাবিক জীবন হিসেবে অভিহিত করেছেন। উপনিবেশে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যকে উল্লেখ করে ফানোঁ বলেছেন, এর ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামোতে শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য যেকোনো বর্ণের ব্যক্তিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
ফানোঁর বিশ্বাস ছিল- ঔপনিবেশিক নিপীড়ন উপনিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং তার কাজগুলোর মাধ্যমে তিনি এই অভিযোগগুলোকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের উপনিবেশগুলো টিকিয়ে রাখে স্রেফ সামরিক শক্তির জোরে, এবং এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শাসিতদের কাছ থেকে নীরব বশ্যতা আদায় করে নেওয়া। উপনিবেশিতদের হাতে কেবল দুটো পথ খোলা থাকে: হয় বশ্যতা শিকার করে নেওয়া, অথবা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়া।
ইউরোপীয়দের এই নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ হিসেবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আন্দোলন, যেটি ইউরোপীয়দের দ্বারা প্রভাবিত নয়। ইউরোপীয়দের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে তাই সশস্ত্র সংগ্রাম কিংবা সহিংস বিপ্লব প্রয়োজন হয়, তবে যদি সত্যিকার বিউপনিবেশায়ন (Decolonization) না হয়, তবে এই আন্দোলনের পুরোটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
বিউপনিবেশায়ন
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশের মাধ্যমে যে প্রক্রিয়ায় উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর জ্ঞান ও ভাবজগতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করা এবং কর্তৃত্ববাদী প্রভাবকে নস্যাৎ করার পাল্টা প্রক্রিয়াই বিউপনিবেশায়ন।
শ্বেতাঙ্গরা যেহেতু শাসক হয়, তাই তারা চেষ্টা করে তাদের আদর্শ-নীতি-মূল্যবোধগুলো শাসিতদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে। এই শাসকদের আদর্শ-নীতি-মূল্যবোধ থেকে বের হয়ে আসাই ফানোঁর কাছে বিউপনিবেশায়নের লক্ষ্য। ফানোঁর মতে, শাসিতদের মধ্যে থাকা সব জাতি, বর্ণ আর শ্রেণিই বিউপনিবেশায়নের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে। তাছাড়া উপনিবেশে থাকা অনুগামী সুবিধাভোগী শাসিতরা যদি শাসকদের সাথে বিউপনিবেশায়ন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করে, তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না, আগের নিপীড়ন-নিষ্পেষণমূলক নীতিগুলোই নতুনরূপে ফিরে আসে। ফানোঁর মতে, সুবিধাভোগী শাসিতদের মন প্রকৃতভাবে বিউপনিবেশায়িত না হওয়ায় তারা তাদের প্রাক্তন প্রভুদের অনুকরণ করতে থাকে। তারা মনে করে, এই আচরণগুলোই তাদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা বিশেষ গোষ্ঠীতে পরিণত করে। বিশেষ করে, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ অনুকরণপ্রিয়তা বেশি চোখে পড়ে, তারা তাদের সম্পদ ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ঔপনিবেশিকদের অনুকরণ করা শুরু করে। ওসমান সেম্বেনের হাল্লা (১৯৭৫) চলচ্চিত্রের প্রথম সেকোয়েন্সেই এই ধরনের ঘটনা দেখা যায়, যেখানে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির পর সেনেগালের সুবিধাভোগী কৃষ্ণাঙ্গরাই ফরাসি শ্বেতাঙ্গদের স্থান দখল করে আগের নিপীড়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
এর বিপরীতে, সফলভাবে বিউপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে, সাধারণ জনগণও এই বিউপনিবেশায়নে ভূমিকা পালন করে। এর প্রথম ধাপ হিসেবে পুরো জাতির মধ্যে আগে একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধ তৈরি হয়। স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি তাদের সাহিত্য ও শিল্পমাধ্যমেও এই জাতীয়তাবোধের প্রভাব দেখা যায়, যেটি একইসাথে ঔপনিবেশিক শক্তির চেয়ে আলাদা এবং বিরোধী।
ফানোঁ তার The Wretched of the Earth বইয়ে তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কীভাবে ব্যক্তি এবং জাতির উত্থান ঘটে। তার মতে, তিনটি ধাপে এই উপনিবেশায়ন-বিউপনিবেশায়ন ঘটে। আত্তীকরণ ধাপে স্থানীয় বুদ্ধিজীবিটি প্রমাণ দেন যে তিনি দখলদারী শক্তির সংস্কৃতিকে আত্তীকৃত করেছেন। এই পর্যায়ে স্থানীয় বুদ্ধিজীবির সাহিত্যকর্মে উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশটির সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সাদৃশ্য বহন করে।
জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ধাপে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী তার প্রকৃত পরিচয়কে স্মরণ করেন এবং পূর্বের আত্তীকরণ ধাপে শেখা জ্ঞানকে অস্বীকার করেন। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে বিচ্ছিন্ন থাকায় তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে শেখা জ্ঞান ধার করেই নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় সফলতার মুখ দেখে না। জাতীয়তাবাদী ধাপ অর্থাৎ, শেষ ধাপে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে মিশে যান, এবং নিজের বুদ্ধিজীবিতার মাধ্যমে জনগণকে জেগে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় ঝাঁকুনি দেন। আর এই ধাপেই বৈপ্লবিক সহিংসতা (Revolutionary Violence) শুরু হয়।
বৈপ্লবিক সহিংসতা
ফানোঁর মতে, সহিংসতা হচ্ছে একধরনের পরিষ্কারক বল। সহিংসতা ঔপনিবেশিতদের মধ্যে ব্যক্তির মধ্যে থাকা হীনম্মন্যতা এবং অপমান ধুয়ে-মুছে সাফ করে ফেলে এবং তাকে একজন স্বাধীন পরিপুর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিতদের করা সহিংসতার ফলে তাদের মনে একটি বিশুদ্ধায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শক্তিরা দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদেরকে ‘সুপিরিয়র’ ভাবার মিথ ঔপনিবেশিতদের মনে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু যখন ঔপনিবেশিতরা রুখে দাঁড়ায়, তখন তারা দেখতে পায় যে ঔপনিবেশিকরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তাদের মতোই ছুটে পালাচ্ছে, তাদের মতোই প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে, মোটেই তারা অসাধারণ কিছু নয়। তারা ঔপনিবেশিকদের মধ্যেও নিজেদের মতো দুর্বলতা, ভয় দেখতে পায়। ফলে ‘সুপিরিয়র’-এর মিথ ভেঙে পড়ে, এবং এই পর্যায়ে ঔপনিবেশিতরা ঔপনিবেশিকদের গেলানো শিক্ষা-মূল্যবোধ বমি করে ফেলে দেয়। সে তখন নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করে।
ব্যক্তির আগের জীবনকে বস্তুর জীবনের সাথে তুলনা করেছেন ফানোঁ, যেখানে সহিংসতার পর তার জীবন শুরু হয় মানুষ হিসেবে। ব্যক্তির এই পুনর্জন্মের প্রভাব সরাসরি বিউপনিবেশায়িত রাজনীতির ওপরেও পড়ে। যে ব্যক্তি নিজে স্বাধীন হয়েছে, নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে মুক্ত করেছে, সে কখনোই পুনরায় কোনো স্বৈরশাসক কিংবা ঔপনিবেশিক শাসকের অধীনতা মেনে নেবে না, বরং তার নেতাকে তার কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য করবে। ফলে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে।
তবে এই মুক্তির জন্য সহিংসতা খুব বেশিদিন কাজ করবে না, যদি না এর সাথে রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকে। এছাড়াও ফানোঁ নিজেই স্বীকার করেছেন, সহিংসতা সর্বদা ব্যক্তিকে তার ঔপনিবেশিত মন তথা ভয় এবং হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি দেয় না, বরং এর ফলে অনেক সময় ব্যক্তির মানসিক বিকৃতি ঘটে।
বৈপ্লবিক সহিংসতার প্রতিনিধি
ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে থাকা তৃতীয় বিশ্বে ফানোঁ সমাজকে মোট চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন এবং প্রতিটি শ্রেণি বৈপ্লবিক বিউপনিবেশায়নে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। এই চারটি শ্রেণি হলো: শহুরে মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া, শহুরে শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েত, কৃষক এবং লুম্পেন প্রলেতারিয়েত।
শহুরে মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া: কার্ল মার্ক্স সামন্তবাদী সমাজ ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য বুর্জোয়াদের নেতৃত্বকে সম্মান জানালেও পুঁজিবাদী সমাজে তাদের অবস্থানের জন্য নিন্দা করেছেন। ইউরোপের বুর্জোয়াঁরা আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্প-কারখানা নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রযুক্তিবিদ্যায় অগ্রগতির জন্য নানা অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু ফানোঁর মতে, অনুন্নত দেশগুলোতে বুর্জোয়াঁরা এই অবদানটুকুও রাখেনি। অনুন্নত দেশের বুর্জোয়াঁরা নতুন কিছু আবিষ্কার বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নজর দেননি, কোনো অগ্রগতিও সাধন হয়নি তাদের দ্বারা। তারা ছিলেন মধ্যস্বত্তভোগকারী, প্রচলিত নিয়মের ব্যবসাদার, নতুন কিছু তাদের হাত দিয়ে তৈরি হয়নি। এই বুর্জোয়াঁরা কেবল ভোগ করতেই জানে, তাছাড়া নীতি-নৈতিকতার অভাবও ছিল সুস্পষ্ট।
ফানোঁর মতে, এই বুর্জোয়াদের মধ্যে উদ্ভাবন, কল্পনা বা উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষমতার মতো দক্ষতা, কোনোটাই ছিল না, যেটা বিউপনিবেশায়নের জন্য প্রয়োজন। ইউরোপের অনুকরণ করলেও তারা নিজেদের নিজস্ব দর্শন দাঁড় করাতে পারেনি। তাছাড়া জাতির উন্নয়ন কিংবা জাতিকে একত্র করতেও তারা উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপের সমাজ অনুকরণ করে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ অর্থাৎ উপনিবেশে কাজে লাগাতে গিয়ে সম্পূর্ণ প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়া এই অনুন্নত দেশের বুর্জোয়াঁরা অসহিংসতার পথ মেনে চলেন, তারা তাদের ঔপনিবেশিক মনে বিউপনিবেশায়ন ঘটানোর কোনো চেষ্টা করেন না। এমনকি, এর বাধাদানকারী উপাদান হিসেবে কাজ করেন। নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক অলসতার কারণেও তারা বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন না।
শহুরে শ্রমিক: মার্ক্স শহুরে শ্রমিক শ্রেণিকে বিপ্লবের মূল অস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কারণ তার মতে এ শ্রেণিটিই নিজেদের শ্রেণি অধিকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন (Class-Conscious), সমাজের বাকি অংশ থেকে সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন এবং সবচেয়ে সুসংগঠিত। পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্দোলনেও এই শহুরে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবে সক্রিয় অংশগ্রহণ মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রমাণ করে। কিন্তু ফানোঁ ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে এটা খাটে না বলে মত দিয়েছেন। ইউরোপের ক্ষেত্রে শহুরে প্রলেতারিয়েত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও আফ্রিকার প্রলেতারিয়েতরা বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়ে ভিন্ন।
ফানোঁর মতে, ঔপনিবেশেক কাঠামোতে শহুরে প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়াদের সহযোগী হিসেবেই কাজ করে। পুঁজিবাদী কাঠামোতে প্রলেতারিয়েতদের হারানোর কিছু নেই, একইসাথে বিপ্লবের মাধ্যমে পরবর্তীতে তারাই সবকিছু অর্জন করবে, ফলে তারা সহিংস বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু আফ্রিকার ঔপনিবেশিক কাঠামোতে এই শ্রমিকরা থাকে সুবিধাভোগী, তারাই ঔপনিবেশিক কাঠামোকে ঠিকভাবে চলতে সহায়তা করে। ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বলতে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো। ফলে তারাও বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না এবং বাধা দেয়। তাছাড়া আফ্রিকার সমাজ কাঠামোও ইউরোপের চেয়ে ভিন্ন। তারা চাকরি হারালেও একেবারে একা হয়ে পড়বে না, কারণ তাদেরক ভরণপোষণের জন্য তার আত্মীয়-স্বজনরা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও তারা নিজেদেরকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বলে মনে করে না, যেমনটা দেখা যায় ইউরোপের ক্ষেত্রে। তারা নিজেদেরকে গ্রামীণ কৃষকদের চেয়ে উন্নত স্তরের বলে ধরে নেয়। ফলে তারা নিজেদেরকে সমাজ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে না।
তবে ফানোঁর মতে, এই প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা প্রবলভাবে বিদ্যমান থাকে। স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রেও এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে নিজেদের স্বার্থের কারণেই এরা সমাজে প্রচলিত অবস্থা ধরে রাখতে চায়, পরিবর্তন ঘটাতে চায় না। সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে এদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা তৈরি করা যেতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে অবশ্য ফানোঁ কিছু উল্লেখ করেননি।
কৃষক: ফানোঁর মতে, ঔপনিবেশিক কাঠামোতে প্রলেতারিয়েতদের তুলনায় কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা আরও সহজ, কারণ তাদেরকে প্রলেতারিয়েতদের মতো ততটা বিচ্ছিন্ন হতে হয় না। তাছাড়া তারা গ্রামীণ এলাকায় থাকায় তাদের মধ্যে উপনিবেশায়ন অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তির শিক্ষাও ততটা পৌঁছাতে পারে না। শিক্ষার পশ্চিমায়ন না ঘটায় তারা নিজেদের আদিম গ্রামীণ সংস্কৃতিই লালন করতে থাকে। তারা নিজেদের নৈতিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে। ফলে তারা নিজেদের ছোটও মনে করে না, হীনম্মন্যতায় ভোগে না। তাছাড়া শহর থেকে দূরে থাকায় তাদেরকে বড় হুমকিও বলে মনে করে না ঔপনিবেশিক শক্তি। এছাড়াও, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ তৈরি থাকে এবং জাতির জন্য তারা ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকে। ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের মধ্যেও তারা ব্যক্তি হিসেবে মুক্ত থাকতে পারে। ফানোঁ এই কৃষকদেরই মনে করেছেন একমাত্র স্বতস্ফূর্ত বৈপ্লবিক শ্রেণি।
এছাড়া আফ্রিকা, এশিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য ঔপনিবেশিক কাঠামোতে কৃষকনেতারা তাদের রক্ষণশীল মণোভাব বজায় রাখেন। নিজেদের একগুঁয়ে রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে তারা পশ্চিমের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হন না, এবং ফানোঁর মতে, এই বৈশিষ্ট্যই বিপ্লবের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও তারা ব্যক্তি হিসেবে কোনোকিছু চিন্তা করেন না, বরং সমগ্র কৃষক সমাজের ভালো-খারাপ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। শহুরে লোকজনের চেয়ে কৃষক সমাজে ব্যক্তি সমাজের সাথে বেশি একাত্মবোধ অনুভব করে, এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।
কৃষকদের মধ্যে সহিংস হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে বলে মনে করেন ফানোঁ, বিশেষ করে যখন তার অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়ে। মাউ মাউ বিদ্রোহে অংশ নেওয়া কৃষক কিংবা ঘানার কোকোচাষীরা এর উদাহরণ। যদিও নিজের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়ে সহিংস হওয়া এবং বৈপ্লবিক সহিংসতা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কৃষকদেরকে বৈপ্লবিক সহিংসতায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার বিকল্প নেই।
লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত
ফানোঁর মতে, আরেকটি যে শ্রেণি বৈপ্লবিক সহিংসতার জন্য কৃষকদের সহযোগী হতে পারে, সেটি হলো লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত। শহুরে বেকার জনগোষ্ঠী এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। মার্ক্স এবং তার শিষ্যরা লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতদেরকে সমাজের জন্য বিপদজনক এবং একইসাথে বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী দল থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করলেও ফানোঁ তা মনে করেন না। লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় বিপ্লব করার মানসিকতা লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন ফানোঁ, এবং এ কারণেই তাদেরকে বৈপ্লবিক সহিংসতার অন্যতম শ্রেণি বলে রায় দিয়েছেন ফানোঁ। লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতদের হারানোর কিছু নেই, তাদের নিজস্ব পরিচয়ও নেই, তারা সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করে। এরকম অবস্থায় তারা পুরোপুরি নিজেদের বোধ-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে শহরের কঠিন পরিবেশে টিকে থাকে, এবং এভাবে টিকে থাকার জন্য সহিংসতা অবধারিতভাবেই চলে আসে। কিন্তু এই সহিংসতা বিপ্লবের পক্ষে তখনই চলে আসবে, যখন তাদেরকে সেই পথে পরিচালিত করা যাবে। শাসকগোষ্ঠীও বিপ্লব থামাতে এই লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতদেরকে ব্যবহার করতে পারে, তা হওয়ার আগেই এদেরকে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি মাধ্যমে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে আনতে হবে।