করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র

পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র নভেল করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে ভয়াবহ রকমের বিপর্যস্ত। কয়েকদিন আগেও করোনাভাইরাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র  ঝুঁকিমুক্ত দেশের তালিকায় ওপরের দিকে ছিল। অথচ এখন বিশ্বে করোনাভাইরাসের আক্রমণের এক কেন্দ্রস্থলই যুক্তরাষ্ট্র। পুরো যুক্তরাষ্ট্র এখন মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা চিকিৎসাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দেশটি বর্তমানে সবচেয়ে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি পার করছে। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই আজ তারা প্রচণ্ড প্রকোপে নিমজ্জিত।

ফাঁকা নিউ ইয়র্ক; Image Source: Reuters

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের আক্রমণ

ওয়াশিংটনে কোভিড-১৯ এর প্রথম রোগী পাওয়া যায় ২০শে জানুয়ারি। আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান থেকে এসেছিলেন। বর্তমানে আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যসহ ৫৫টি অঞ্চলে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। ২৯শে ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে সর্বপ্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান এক ব্যক্তি। নিউ ইয়র্কে প্রথম শনাক্ত হয় মার্চের ১ তারিখে। সেই আক্রান্ত ব্যক্তি ইরান থেকে এসেছিলেন। এখন নিউ ইয়র্কই যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের আক্রমণের কেন্দ্রস্থল এবং মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক এই শহরের বাসিন্দা।

সতর্ক অবস্থা, তবু জনসমাগম থেমে নেই; Image Source : the guardian

করোনা মহামারী রূপে আবির্ভাবের কারণ

ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা

ওয়াশিংটনে ২০ জানুয়ারি প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করার পর মার্কিন প্রশাসন ৬৫ দিন সময় পেয়েছিল করোনাভাইরাসের লাগাম টেনে ধরার জন্য। গত মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন চীনকে দোষারোপ করে যাচ্ছিল, ভাইরাসটি নিয়ে উদ্বেগের তেমন কোনো লক্ষণ ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ আখ্যা দিয়েছিলেন। জনগণ যাতে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় না পড়ে এবং অর্থনীতি যাতে স্থবির হয়ে না যায়, সেজন্য মার্কিন প্রশাসন এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য প্রকাশ নিয়ে অনেক লুকোছাপা করে; পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে জনগণ যথেষ্ট ধোঁয়াশার মধ্যে ছিল।

এজন্য মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মার্কিন জনগণের করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। ট্রাম্প তার বক্তৃতায় করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। তার বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ভাইরাসের সংক্রমণকে গুরুত্বই দেননি। তবে ট্রাম্প জানুয়ারির ৩১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রে অন্য দেশের নাগরিকদের প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ জারি করেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রবেশ অবারিত ছিল। তিনি জনগণকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে বিভ্রান্ত করে রাখেন।

২৯ ফেব্রুয়ারি এক বক্তৃতায় তিনি বলেন,

আমরা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবচেয়ে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছি, এগুলো যেকোনো দেশে নেওয়া পদক্ষেপের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী

করোনাভাইরাসের বিশ্বজুড়ে মারাত্মক সংক্রমণ সত্ত্বেও ট্রাম্প ও তার প্রশাসন এ নিয়ে অনবরত মিথ্যা আশার বাণী শোনাচ্ছিল মার্কিন জনগণকে। ৯ মার্চ ট্রাম্প আবারও মার্কিন জনগণকে আশ্বস্ত করেন এই বলে,

গত বছর সাধারণ ফ্লুতে ৩৭,০০০ আমেরিকান মারা গিয়েছে। কিছুই বন্ধ হবে না, জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি সবই চলবে।

তিনি বারবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেন এবং উল্টো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দোষারোপ করে বলেন,

তারা সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না।

ট্রাম্প ও তার প্রশাসন মার্চের শেষ সপ্তাহের আগপর্যন্ত করোনা ভাইরাসকে প্রকৃত অর্থে কোনো গুরুত্বই দেননি। তাদের হেঁয়ালি আচরণ ও খামখেয়ালি পদক্ষেপের কারণে আমেরিকা আজ করোনা ভাইরাসের আক্রমণের প্রধান কেন্দ্রস্থল। করোনা আক্রান্তের হারের দিক দিয়ে আমেরিকা চীন, ইতালি, স্পেনকে হটিয়ে এখন সারা পৃথিবীতে প্রথম।

ট্রাম্পের আশ্বাসের বন্যা থামছে না; Image Source : আল জাজিরা

আমেরিকান রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) ব্যর্থতা

সিডিসি প্রথম থেকেই পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছিল, আমেরিকায় করোনাভাইরাস তেমন প্রভাব ফেলবে না, অন্যান্য দেশ থেকে আমেরিকায় আক্রমণের সম্ভবনা অনেক কম। সিডিসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, আমেরিকায় অত্যধিক গরমের কারণে করোনাভাইরাস তেমন সুবিধা করতে পারবে না। আমেরিকায় যেকোনো রোগ বা স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সিডিসির ভাষ্য গ্রহণ করে থাকে আমেরিকান প্রশাসন। সাধারণত সিডিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে আমেরিকান জনগণ প্ৰয়োজনীয় সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সিডিসির পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত হওয়ায় পরিস্থিতি ট্রাম্প প্রশাসনের নাগালের বাইরে চলে যায় এবং পুরো যুক্তরাষ্ট্রে রোগটি মহামারির রূপ ধারণ করে। সিডিসির দেওয়া নির্ভার পূর্বাভাসের কারণে সরকার তেমন কোনো অগ্রিম ব্যবস্থা নেয়নি। ফলস্বরূপ, এখন পুরো যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সংকট, হাসপাতালগুলো অপ্রস্তুত অবস্থায় চিকিৎসা দেয়া শুরু করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ও সিডিসির বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের কারণে আমেরিকার জনসাধারণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আমেরিকায় সাধারণ জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল। জনসমাগম বা কর্মক্ষেত্রে সাধারণ প্রাণচাঞ্চল্য বিদ্যমান ছিল। কারণ, করোনাভাইরাস দানবীয় রূপ ধারণ করার আগপর্যন্ত, অর্থাৎ মার্চের শেষ সপ্তাহের আগপর্যন্ত আমেরিকায় কলকারখানা, গণপরিবহন, অফিস, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, উপাসনালয় সবই চালু রাখার নির্দেশনা ছিল; যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মার্চের ২০ তারিখের মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়।

ট্রাম্প করোনা ভাইরাসকে গুরুত্ব না দিয়ে সগর্বে বলেছিলেন,

আমাদের দেশ বন্ধ হওয়ার সৃষ্টি তৈরি হয়নি।

তার এ দাম্ভিক আচরণ করোনাভাইরাস বেশি দিন টিকতে দেয়নি। পরিস্থিতির সামাল দিতে না পেরে ট্রাম্প মার্চের ২৯ তারিখে আমেরিকায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেন এবং কার্যত যুক্তরাষ্ট্র অবরুদ্ধ করে দেন। কিন্তু এখনও পুরোপুরি অবরোধ কার্যকর হয়নি প্রশাসনের শিথিলতার কারণে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৩২টি নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু বাকি অঙ্গরাজ্যগুলো এরূপ কোনো নির্দেশনা দেয়নি।

কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা; Image Source : আল জাজিরা

চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সংকট

যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে প্রচুর পরিমাণ চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট চলছে। ভেন্টিলেটর, স্যানিটাইজার, গ্লাভস, মাস্ক, পিপিই কিটের প্রচণ্ড সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার লাফিয়ে বাড়ায় হাসপাতালগুলো পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন তিন থেকে চার মিলিয়ন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের আশঙ্কা  করেছে এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সঙ্কটের অাশঙ্কা করছেন। ট্রাম্প সম্প্রতি বাংলাদেশ, চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া সহ অন্যান্য দেশের কাছে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সাহায্য চেয়েছেন।

ইতোমধ্যে রাশিয়ার একটি সামরিক বিমান চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে  যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে। চীন সরকারও রাজনীতি ভুলে আমেরিকার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা ১ লাখ ৩০ হাজার এন-৯৫ মাস্ক, ১৮ লাখ সার্জিক্যাল মাস্ক ও গাউন, ১০.৩ মিলিয়ন গ্লাভস এবং  ৭০,০০০ থার্মোমিটার নিয়ে একটি বিমান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

বর্তমান অবস্থা

ইতালি ও স্পেনের সম্মিলিত যোগফলের চাইতে আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আক্রান্তের সংখ্যা তিন লক্ষ  এবং মৃতের সংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়েছে। প্রাদুর্ভাব এতটাই ভয়াবহ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি তিন মিনিটে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যাচ্ছে এবং ১৭ জন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন এক লক্ষ লোকের লোকের করোনা টেস্ট করা হচ্ছে এবং প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লোকের টেস্ট ইতোমধ্যে সম্পন্ন, তারপরও তা প্ৰয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

এ মাসেই দেশটিতে একদিনে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতদের মধ্যে আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিও। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সি সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত অঞ্চল। সব মিলিয়ে পুরো যুক্তরাষ্ট্র করোনার আক্রমণে বিপর্যস্ত। একদিকে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সঙ্কট, অন্যদিকে দ্রুতবেগে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, পুরো অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখন অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

সেখানে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা যেন এক লাখ থেকে দুই লাখের মধ্যে যেন থাকে, সেই চেষ্টাই করবে বলে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। গবেষকরা ধারণা করছেন, জনগণ যদি নিয়মকানুন না মানে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক মারা যেতে পারে এবং ১ কোটি লোকের বেশি আক্রান্ত হতে পারে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য মার্কিন নৌবাহিনীর ১,২০০ শয্যার হাসপাতাল; Image Source: The New York times

ট্রাম্প প্রশাসন এখন আশা করছে, করোনা পরিস্থিতি জুলাই-আগস্টের মধ্যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে। চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সংকট, হাসপাতালগুলোতে আসন সংকট- এত সংকটের মধ্যে সরকার তড়িঘড়ি করে যতই ব্যবস্থা নেক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস সঙ্কট এত সহজে নিরসন হচ্ছে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তারপরও উন্নত বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড়িয়ে এই সরকার আগামীতে কী পদক্ষেপ নেয়, তা জানতে পারা এখন সময়ের ব্যাপার।

Related Articles

Exit mobile version