আমি নিয়মিতভাবে আমার মুনিব দ্বারা ধর্ষিত হতাম। একপর্যায়ে মুনিবের ছেলেও আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলো। আমি সেই ছেলের মাধ্যমেই গর্ভবতী হয়ে পড়ি।
– হাবি মুরতাবা, মৌরিতানিয়া
গত শতকে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ থেকে আইনিভাবে অথবা মানবিক বিবেচনায় দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ায় এখনো দাসপ্রথা বিদ্যমান আছে- যেখানে এখনো নারীদের যৌনদাসী বানানো হয়। তেমনই একজন নারী হাবি মুরতাবা। তিনি তার জীবনের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
প্রতিদিন আমি সবার শেষে ঘুমাতে যাই, আবার আগে আমি ঘুম থেকে উঠি। তবুও আমার উপর কাজ না করার অজুহাত দেখিয়ে নির্যাতন করা হয়, মারা হয়, অপমানিত করা হয়।
এটি শুধুমাত্র হাবি মুরতাবার একার জীবনের বাস্তবতা নয়। মৌরতানিয়ায় এখনো তার মতো আরও প্রায় ৬,০০,০০০ মানুষ আছেন, যারা জন্মগতভাবে দাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছেন। হাবির মা একজন ‘মুনিব’ দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলেন এবং হাবি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, তখন তিনি আর দশজন দাস-দাসীর মতো একটি বৃহৎ দাস পরিবারের সদস্য হয়েছিলেন।
হাবি যখন কৈশোরে উপনীত হলেন, তখন থেকেই মৌরিতানিয়ার অন্যান্য দাস-দাসীর জীবনের মতো তিনি তার মুনিবের পশুপালন, গৃহস্থালি কাজ, পানি সরবরাহ ও খাদ্য প্রস্তুতের কাজে নিযুক্ত হয়ে গেলেন। হাবি জানান, তিনি নিয়মিত মুনিব দ্বারা ধর্ষিত হতেন। দৈহিক মিলনে রাজি না হলে ছুরি দেখিয়ে হুমকির মুখে তাকে ধর্ষণ করা হত। শুধু মুনিবের অমানবিক আচরণেই ঘটনার শেষ নয়। একপর্যায়ে মুনিবের ছেলেও তাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলো। হাবি বলেন-
আমাদের মধ্য থেকে কেউ কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। আমাদের কারো কোনো আত্মপরিচয় নেই। আমাদের কোনো নাগরিক পরিচিতি বা জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয় না। কেউ আমাদের সাহায্যে করতে এগিয়ে আসে না। আমরা কখনো কারো সহযোগিতা পাইনি। আমরা পুরোপুরি আমাদের মুনিবের অনুগ্রহে বেঁচে থাকি।
মৌরিতানিয়া সরকার ১৯৮১ সালে দাস প্রথা অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ২০০৭ সালের আগপর্যন্ত এটি ‘ক্রিমিনাল ল’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং কখনো প্রয়োগও করা হয়নি। দাসপ্রথা বিরোধী এনজিও ‘সস’-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশটিতে এখনো ৬,০০,০০০ জন বা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ দাস-দাসী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ।
মৌরিতানিয়ার এই দাসপ্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং পারিবারিক প্রথা অনুসারে সন্তানদের উপর তা শিরোধার্য হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তারা জন্মগতভাবে দাস-দাসী হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করছেন- যেমন হাবি মুরতাবা জন্মসূত্রে একজন দাসী। যেসব পরিবারে প্রথাগতভাবে এই দাসপ্রথা চলে আসছে তারা সকলেই জানে বা মেনে নিয়েছে যে, এছাড়া তাদের আর কোনো পথ খোলা নেই।
দাস মুনিবদের মধ্যে এমন রেওয়াজ খুব দুর্লভ যে, তারা কোনো দাস-দাসীকে মুক্ত করে দিয়েছেন, হোক সে বড় কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা আদালতের কোনো জজ সাহেব। বরং তারা গৃহপালিত পশুর মতো একে অন্যের মধ্যে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিযোগীতা করেন।
মুনিবের ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম এ দাস-দাসীরা করে থাকে, যেমন- রান্না করা, ঘর পরিস্কার করা, শুষ্ক মরুভূমিতে ছাগল চড়ানো, উট প্রতিপালন করা অথবা দূরবর্তী কোনো এলাকায় মুনিবের উট চালক হিসেবে গমন করা।
এমন দুঃসহ জীবন হওয়া সত্ত্বেও দাস-দাসীরা তা মেনে নিচ্ছেন। সেই হিসেবে হাবি মুরতাবা একজন সৌভাগ্যবতী বটে! তিনি তার মুনিবের হাত থেকে রক্ষা পেতে সক্ষম হয়েছেন। ঘটনাক্রমে তিনি স্থানীয় স্থানীয় দাসপ্রথা বিরোধী কর্মী বিরাম দাহ আবেদির সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। তার শেখানো কৌশলে হাবি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পালিয়ে আসার সকল ব্যবস্থাপনা করে দিয়েছিলেন তার ভাই বিলাল, যিনি আগেই নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিরাম দাহ আবেদি বর্তমানে কোনো অভিযোগ ছাড়াই দেশটির নোয়াখোটট কেন্দ্রীয় কারাগার আটক রয়েছেন। এ পর্যন্ত ছয়বার শুনানি হলেও তাকে মুক্তি দেয়নি দেশটির আদালত। অবশেষে গত সপ্তাহে বাধ্য হয়ে তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতি একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি জানান, বিচারের নামে তার ওপরে কী বীভৎস নির্যাতন করা হচ্ছে। চিঠিতে আবেদি বলেন, তাকে ঘুমাতে দেয়া হচ্ছে না, নিয়মিত অমানবিক পরিবেশে রাখা হচ্ছে, প্রচণ্ড মশার আক্রমণে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এমনকি আইনি সহায়তা নেয়ার জন্য আইনজীবীদের সাথে তাকে পর্যাপ্ত দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। এবং বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তিনি লেখেন-
গত দুই সপ্তাহ যাবত আমাকে একটি আবদ্ধ বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো ছাদ বা বৃষ্টি প্রতিরোধক নেই।
এমনটিই হলো মৌরিতানিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের বর্তমান বাস্তবতা। এই দাস ব্যবস্থা দেশটির মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। একদল দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত উচ্চশ্রেণী, যারা বারবার বাইদান জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এরা দেশের সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ। আরেকদল হারাতাইন আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যাদেরকে দাস-দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
প্রথাগতভাবে, মৌরিতানিয়ার জনগণের আয়ের প্রধান উৎস গৃহপালিত পশুর গোশত ক্রয়-বিক্রয়। দেশটির ৯০ শতাংশ জমি সাহারা মরুভূমির অন্তর্ভুক্ত। এ মরুভূমিতেই পশু লালন-পালন করা হয়। কিন্তু মরুভূমির প্রায় সব জায়গার মালিকানা উচ্চশ্রেণীর বাইদানদের দখলে, যা একসময় হারাতাইন আদিবাসীদের আবাসভূমি ছিল। যুগের পর যুগ অত্যাচার করে এসব কালো সাব-সাহারাইন আফ্রিকানদের জমি বাইদানরা দখল করে নিয়েছে। আর সেসব উদ্বাস্তু আদিবাসীরা বেঁচে থাকার তাগিদে দূরে কোথাও গিয়ে আবাস গড়ে নিয়েছে। অথবা ফের বাইদানদের দ্বারা তাদের আক্রান্ত হতে হয়েছে।
প্রায়ই বাইদানদের দ্বারা হারাতাইন আদিবাসী সদস্যরা অপহৃত হয়ে থাকেন। এমন অমানবিক প্রথা এই আধুনিক যুগেও চালু আছে। একটি জটিল বর্ণবাদ পদ্ধতি টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে উচ্চশ্রেণীর বাইদান ও তাদের উত্তারাধিকারীরা হারাতাইন আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল করে নিয়েছে।
মৌরিতানিয়ার স্বৈরাচারী শাসক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওউলদ আবদেল আজিজও একজন বাইদান। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক মিত্ররাও সকলে বাইদান। এমনকি সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া ওউলদ হেদিমাইনও একজন বাইদান। এমন বৈষম্য সব জায়গাতেই বিদ্যমান। হারাতাইন আদিবাসীরা এখনো ক্ষমতা, সম্পদ, ভূমি, চাকরিক্ষেত্রসহ সকল পর্যায়ে এমন নগ্ন বৈষম্যের শিকার।
তবে আশার দিক হচ্ছে, সম্প্রতি এই দাস পরিবারগুলোতে সামান্য পরিমাণে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ রাজনৈতিক পরিসরে সক্রিয় হচ্ছে। কেউ কেউ আবার আইন-আদালতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। ‘এন্টি স্লেভারি ইন্টারন্যাশনাল’-এর এক মুখপাত্র মি জাকুব সোবিক বলেন-
ক্ষমতার দম্ভে এরা অন্ধ হয়ে গেছে- কেননা তারা প্রথাগতভাবে সমস্ত সম্পদের মালিক এবং দাস-দাসীদের মুনিব। তাছাড়া এখন পর্যন্ত তারা দেশ পরিচালনায় একচেটিয়া ভূমিকা রেখে আসছে।
আবেদি মনে করেন, সদ্য সমাপ্ত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তিনি একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয় লাভ করাই তাকে গ্রেফতার করার কারণ। কেননা এতে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাসদের অধিকার আদায় আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। তিনি লেখেন-
আমাকে তারা জাতীয় পরিষদে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে চায়, কেননা ২০১৯ সালে যে অধ্যাদেশ পাশ হবে, তাতে আমার পক্ষ থেকে কোনো চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ না থাকলে, সেটি তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়।
আটক আবেদির সমর্থকগণ গত মঙ্গলবার তার মুক্তির দাবিতে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে। কিন্তু পুলিশ সেখানেও পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতে আহত হয়ে কমপক্ষে ৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এর মধ্যে আবেদির স্ত্রী লাইলা আহমেদও রয়েছেন।
মৌরিতানিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের এই সমস্যার পাশাপাশি সেখানে আরও রয়েছে অবৈধভাবে বিদেশ গমন ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যক্রম, যা ব্রিটিশ সরকার ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা বরাবর সমালোচিত হয়ে আসছে।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও স্পেন এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন যাবত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ বছর জি-৫ এ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুদান আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। জি-৫ এর অন্যতম দেশ মৌরিতানিয়া। এজন্য এ বছর ৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগের বড় একটি অংশ যাবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশ গমন প্রতিরোধে করতে। আবেদি বলেন-
মৌরিতানিয়াতে দাসপ্রথা বিলুপ্তির একমাত্র উপায় হলো ইউরোপ, আমেরিকার ও অন্যান্য সকল দাতাগোষ্ঠী কর্তৃক এই সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করা।
ইতিমধ্যে, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো মৌরিতানিয়া থেকে তাদের প্রায় সকল কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এখন শুধুমাত্র আবেদির মতো কিছু স্থানীয় উদ্যোগ এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বারকাম তুসাকিমের বর্তমান বয়স ৩০ বছর। তার বয়স যখন মাত্র ৫ বছর তখন তার মা তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে এক মুনিবের কাছে বিক্রি করে দেয়। তিনি টেলিগ্রাফকে বলেন,
তারা আমাকে নিয়মিত ধর্ষণ করত। একপর্যায়ে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়ি এবং আমার প্রথম সন্তান হয়। যখনই তাদের মনে চাইতো তখনই তারা আমাকে ধর্ষণ করত।
বারকাম কাঁদতে কাঁদতে আরও জানান-
আমার মেয়ের বয়স যখন ৫ বছরও পার হয়নি, তখনই তারা আমার মেয়েকে জোর করে নিয়ে যায়- ঠিক আমার জীবনের শুরুতেও যেমনটি ঘটেছিল।
তিনি আক্ষেপ করতে করতে বলেন-
এই অবস্থার পরিসমাপ্তি হওয়া দরকার। সকল দাসের এর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলা দরকার। বিশ্বের সকল মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা শুরু করা দরকার। তাহলেই শুধু এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব- এভাবে আর চলতে পারে না।
সূত্র:
১। The African nation living under the shadow of slavery, The Daily Telegraph
২। The unspeakable truth about slavery in Mauritania, The Guardian