“যখন ভাইরাসের মতো কোনো জিনিস যখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা বেড়ে যায়। বিভিন্ন কোম্পানি চেষ্টা করে তা পূরণ করতে। তবে প্রথমেই এটা বলা মুশকিল, কার উদ্দেশ্য সৎ আর কার অসৎ!”
Cody Zhang, একটি স্টার্ট-আপের মালিক, যিনি কোভিড-১৯ এ জীবাণুনাশক রোবট তৈরি করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য লাইসেন্স খুঁজছেন।
২০০৩ সাল। টুইন টাওয়ারে জঙ্গি বিমান হামলার দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমন করে। এ যুদ্ধে প্রাণ হারায় প্রায় পাঁচ লক্ষ বেসামরিক ইরাকি। নিহত হয় কয়েক হাজার মার্কিন সৈন্য। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই হতাহতের পরিমাণ আরো বাড়ে। ধারণা করা হয়, এই যুদ্ধের পর মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩১%। কিন্তু এত এত আহত আর মৃত মানুষের লাশের ছায়ার নিচে সে সময় আমেরিকার একটা তেলবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ‘হলিবার্টন’ এর শেয়ারের দাম বাড়ে প্রায় ৫০০%!
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসা জর্জ ডব্লিও বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ‘হলিবার্টন’ এর প্রধান ডিক চেনি। আল-কায়েদা, ওসামা বিন লাদেন আর ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা নিয়ে প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে শুরু করা এই যুদ্ধের পেছনে আসল কারণ ছিল তেলবাণিজ্য, তথা পেট্রোডলারের হিসাব নিকাশ।
যদিও বর্তমানে ‘করোনা ভাইরাস’ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সারাবিশ্বের দুঃসময়ে এই ঘটনাটা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক, তবে শত শত বছর ধরে ঘটা অসংখ্য নৃশংস মানবেতিহাসের মধ্যে ছোট্ট এই ঘটনাটি আমাদেরকে ইঙ্গিত করে- চরম অস্থিতিশীল বিশ্বমুহূর্তের আড়ালে চলা এরকম কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান বা একক ব্যক্তির শিল্পবাণিজ্যে আধিপত্যের হিসাবনিকাশ।
করোনা ভাইরাস, যার বর্তমান রূপ কোভিড-১৯; মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। গতবছরের ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশের তেরো লক্ষ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। মৃতের সংখ্যা আশি হাজার ছাড়িয়েছে। আরো কতদিন এই ভাইরাস মানবমৃত্যুর কারণ হবে, তার সঠিক সময় কারোরই জানা নেই। বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত- সবখানেই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের কারণে বিশ্বের তাবৎ মানুষকে এখন এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, যার অভিজ্ঞতা বোধহয় বিগত কোনো সময়ে মানুষের সম্মুখে আসেনি।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ব্যস্ত শহরগুলো লকডাউন, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে মানুষ যেতে পারছে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় সকল ধরনের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কোয়ারেন্টাইন অথবা স্যোসাল ডিস্টেন্সে থাকতে বলা হচ্ছে সবাইকে। পুরো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ এখন ঘরে আবদ্ধ। যেন কয়েকটা মাস স্থিরভাবে ঘরে বসে থাকতে পারাটাই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
কিন্তু কতদিনই বা এভাবে চুপচাপ বসে থাকা যায়! কর্মজীবি মানুষের জন্যে ছুটি বা কর্মবিরতী সবসময় প্রত্যাশিত হলেও ঠিক এই সময়টাতে, যখন ঘরে বসে থাকার উপর আমাদের বাঁচা মরা নির্ভর করছে, তখন তা উপভোগ্য তো নয়ই বরং প্রচণ্ড মানসিক হতাশা কিংবা অবসাদের কারণ হতে পারে। তবে ঠিক এই সময়ের চিত্রটা আমাদের আসন্ন ভবিষ্যৎ বাস্তবতার একটা দিকের সূচনা সৃষ্টি করতে পারে। সেটা হলো- এতদিন যে কাজগুলো বাড়ির বাইরে গিয়ে করতে হতো, সেগুলো ঘরে বসে করা কতটা সম্ভব, সেই নিরীক্ষাটুকু করে ফেলা। যেমন: কিছু ক্ষেত্রে অফিসের ডকুমেন্ট রেডি কিংবা মিটিং করা, পড়ালেখা বা ই-লার্নিং এবং বিনোদনের অন্য অসংখ্য মাধ্যম এখন ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব।
গত ২২ জানুয়ারি করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে প্রখ্যাত স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভো জিজেক তার My Dream of Wuhan শিরোনামের এক লেখায় বলেন,
“ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ডিস্টোপিয়াই আছে একই ধাঁচের একটা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়: যেখানে আমাদের সবাইকে বাসায় বসে থাকতে হবে, কম্পিউটারে বসে বসে কাজ করবো, ভিডিও কনফারেন্সে যোগাযোগ করবো আর বাসায় বানানো অফিস রুমের কোণায় পড়ে থাকা মেশিনে ফিটনেস মাপাবো, মাঝে মাঝে স্ক্রিনে হার্ডকোর সেক্সের ভিডিও দেখে দেখে মাস্টারবেট করে নিবো আর তারপর ডেলিভারীতে খাবারের অর্ডার করবো…।”
এখানে খেয়াল করে দেখার বিষয় হলো, ঘরে বসে থেকে বাইরের এসব কাজ করার জন্য, অর্থাৎ বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অনুসঙ্গটি মানুষের দরকার হবে, তা হলো ইন্টারনেট। এবং খুব সস্তা মানের কম গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট দিয়ে এখনকার চাহিদা অনুযায়ী সবরকম প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা। এ নিয়ে চীনের অন্যতম স্মার্টফোন উৎপাদনকারী ‘হুয়াওয়ে’ র প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেই এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“মহামারী যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী, তাতে ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। করোনা প্রতিরোধে টেলি-হেলথ, অনলাইন-লার্নিং এবং ঘরে থেকে অফিসের কাজ করার উপযোগিতার ব্যাপারে দুনিয়ার মানুষ বুঝতে শুরু করেছে। পাশাপাশি তারা অনুধাবন করতে পারছে ইন্টারনেটের গুরুত্ব। এমনকি পশ্চিমা বিশ্ব যখন এই মহামারীর তীব্রতা অনুভব করছে, তখনও আমাদের প্রজেক্টগুলো তাদের সক্ষমতাকে বাড়িতে তুলতে পারে। ইন্টারনেটের এই গুরুত্ব এবং চাহিদাকে আমাদের পূরণ করতে হবে। আমি আশা করি এই মহামারী শেষ হলে মানুষ হুয়াওয়ের প্রোডাক্টগুলোর গুরুত্ব আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে। তবে নেটওয়ার্কিংয়ের তুমুল চাহিদা আমাদের জন্যে কিছুটা উদ্বেগজনক বটে, কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে তা সরবরাহ করার ক্ষমতা আমাদের নাও থাকতে পারে। যেহেতু চীনের বাইরে অন্য দেশগুলোতে আমরা এর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখছি না, তাই সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
[South China Morning Post, 26 March, 2020]
উপরের IEEE Spectrum এর এই প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর অধিকাংশ টেক জায়ন্টগুলোর কর্মীরা বাড়িতে থেকে কাজ করার ব্যাপারে একমত পোষণ করছেন। ফলে নেটওয়ার্কিং এবং টেলিকমিউনিকেশন উপকরণ প্রস্তুত ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এখন একটা আন্তঃযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে যে- আগামী দশকগুলোতে সর্বোচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা, অর্থাৎ 5G (5th Generation) ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কে সবার আগে যাবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়, ‘হুয়াওয়ে’ পুরো বিশ্বের টেলিকম সেক্টরে সবচেয়ে এগিয়ে আছে।
১৯৮৭ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) সাবেক ইঞ্জিনিয়ার রেন ঝেংফেই হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুর দিকে হুয়াওয়ে শুধু ফোন সুইচ প্রস্তুত করতো, কিন্তু ব্যবসা বাড়ার সাথে সাথে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক তৈরি, অপারেশনাল ও কনসাল্টিং সেবা প্রদান এবং চীনের ভেতর ও বাইরে সামগ্রী সরবরাহ শুরু করে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হুয়াওয়ে’তে ১,৯৪,০০০ জনবল কাজ করে যাদের মধ্য প্রায় ৮০,০০০ জন রিসার্চ এবং ডেভলপমেন্ট বিভাগে কাজ করে, যা মোট জনবলের প্রায় ৪৫ ভাগ। বর্তমানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কলাম্বিয়া, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ, রাশিয়া এবং তুরস্কসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০ টি দেশে হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম সরবরাহ চালু আছে। [লেখাটির পরবর্তী পর্ব দেখুন এখানে]