সাধারণত রেশমি সুতা তৈরি হয় রেশমপোকার গুটি থেকে। তবে পৃথিবীতে আরেক ধরনের রেশমি সুতার অস্তিত্ব রয়েছে, যার মূল উপাদান অর্থাৎ রেশম তন্তু পাওয়া যায়, একধরনের সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলস থেকে। সি সিল্ক বা সামুদ্রিক রেশম নামের সেই সুতা পৃথিবীর বিরলতম তন্তু। বিরলতম, কেননা, বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে কেবলমাত্র একজন কারিগরই রয়েছেন, যিনি অসম্ভব পরিশ্রম করে তৈরি করেন সামুদ্রিক রেশম এবং কখনোই তা অর্থের বিনিময়ে বিকিয়ে দেন না। ‘কিয়ারা ভিগো’ নামের মানুষটি, যেন রূপকথার সেই রাজকুমারী, যে চরকা ঘুরিয়ে কাটতে পারতো স্বর্ণের সুতা!
পুরো পৃথিবীতে কেবল ইতালির সার্দিনিয়া দ্বীপের সেন্ট’অ্যান্টিওকো নামক স্থানে দেখা মেলে সামুদ্রিক রেশমের। বিবিসি নিউজে ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেন্ট’অ্যান্টিওকোতে বসবাসরত কিয়ারা ভিগোই সামুদ্রিক রেশমের একমাত্র প্রস্তুতকারক। সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পরেই, সামুদ্রিক রেশমের একমাত্র কারিগর হিসেবে কিয়ারা ভিগোর নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। নানা দেশের নানা সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হতে থাকে সামুদ্রিক রেশমের দুষ্প্রাপ্যতা এবং কিয়েরা ভিগোর বিশেষ দক্ষতার কথা।
সামুদ্রিক রেশম এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে, এর যে অস্তিত্ব রয়েছে পৃথিবীতে, সেটিই অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না, কিংবদন্তী মনে করে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে তা বলা না গেলেও, কিয়ারা ভিগোর কল্যাণে আজও পৃথিবীতে টিকে আছে সামুদ্রিক রেশমের অস্তিত্ব। চুলের চেয়েও তিনগুণ সূক্ষ্ম, তুলোর মতো হালকা, বাদামী রঙের সামুদ্রিক রেশমের তন্তুগুলোর দেখা মেলে ইতালির সার্দিনিয়া দ্বীপে। যে ঝিনুক থেকে সামুদ্রিক রেশমের তন্তু পাওয়া যায়, তার নাম, পিনা নোবিলিস বা পেন শেল। পেন শেল ভূমধ্যসাগরে পাওয়া যায়। এ ঝিনুকগুলোর আকৃতি বিশাল, একেকটি দৈর্ঘ্যে এক গজের উপরে হয়ে থাকে। সমুদ্রের পানিতে ভাসতে থাকা ঝিনুকগুলোর শক্ত খোলস ঢাকা থাকে বাইসাস নামক একপ্রকার সূক্ষ্ম তন্তু দ্বারা। এই বাইসাস নামক তন্তু থেকেই তৈরি হয় সামুদ্রিক রেশম, পৃথিবীর বিরলতম সুতা।
৬২ বছর বয়সী কিয়ারা ভিগো সার্দিনিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের সতেরো গজেরও বেশি গভীরে সাঁতরে বেড়ান, যেখানে পানির গভীরে লুকিয়ে আছে কতকগুলো গোপন গুহা। সেখানেই দেখা মেলে পেন শেলের। ঝিনুকের শক্ত খোলস থেকে কিয়ারা ভিগো সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন বাইসাস। মাত্র এক আউন্স বা ২৮ গ্রাম পরিমাণ বাইসাস সংগ্রহ করতে তাকে সমুদ্রের গভীরে ডুব দিতে হয় একশো’বারের কাছাকাছি। সূক্ষ্ম বাইসাস তন্তুগুলো লম্বায় ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিবার ডুব দেবার আগে কিয়ারা ভিগো সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে প্রার্থনা করেন, নিজের পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করেন এবং সমুদ্রের নামে পবিত্র শপথ পাঠ করেন। এসবই তিনি করেন বাইসাসের পবিত্রতা রক্ষার্থে।
বিবিসির প্রতিবেদনে কিয়ারা ভিগোর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, সামুদ্রিক রেশম প্রস্তুতের প্রণালী একমাত্র তিনিই জানেন। কিন্তু, আমেরিকার ‘অ্যাটলাস অবস্কিউরা’ নামক একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে ২০১৭ সালে ব্রিটিশ মেরিন বায়োলোজিস্ট হেলেন স্কেলের লেখা, ২০১৫ সালে প্রকাশিত, ‘Spirals in TIme: The Secret Life and Curious Afterlife of Seashells’ নামক একটি বইয়ের মধ্য দিয়ে দাবি করা হয়, কিয়ারা ভিগোর কথা পুরোপুরি সত্য নয়, এর মধ্যে খানিকটা অসত্যতা রয়েছে। কেননা, ১৯৫০ সালের দিকেও সেন্ট’অ্যান্টিওকোতে, সামুদ্রিক রেশম উৎপাদিত হতো। সেসময়, ইটালো ডায়ানা নামক একজন নামকরা বুননশিল্পী বা সুতার কারিগর, মারা যাবার আগে তার গুটিকতক কাছের মানুষকে সামুদ্রিক রেশম উৎপাদনের পদ্ধতি শিখিয়ে যান। ইটালো ডায়ানা যাদের সামুদ্রিক রেশমের প্রস্তুতপ্রণালী শিখিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন, ইফিসিয়া মারোনি, পরলোকগত হয়েছেন ২০১৩ সালে। ইফিসিয়া মারোনির কাছ থেকে আবার সামুদ্রিক রেশম প্রস্তুতপ্রণালী শিখেছিলেন স্থানীয় কয়েকজন মানুষ, যাদের মধ্যে জুসেপ্পিনা এবং অ্যাসুন্টিনা পেস নামক দু’জন বোনের নাম জানা যায়। এরা আজ অবধি সহি-সালামতে জীবিত আছে। অবশ্য হেলেন স্কেলের লেখা সে বইয়ে এও উল্লেখ আছে যে, জুসেপ্পিনা এবং অ্যাসুন্টিনা পেস সহ আরও দু’একজন রেশম উৎপাদন পদ্ধতি জানলেও নানা ধরনের সমস্যার কারণে কেউই সামুদ্রিক রেশম উৎপাদন করেন না বর্তমানে। তাই কিয়ারা ভিগোই যে শুধুমাত্র সামুদ্রিক রেশমের প্রস্তুতপ্রণালী জানেন, একথা সত্যি না হলেও, তিনিই বর্তমানে পৃথিবীতে সামুদ্রিক রেশমের একমাত্র প্রস্তুতকারক, কথাটা পুরোপুরিই সত্যি।
হেলেন স্কেলের লেখা বইটিতে, লেখিকা সামুদ্রিক রেশম প্রস্তুতের নানা ধাপ উল্লেখ করেন, যা তিনি জানতে পারেন জুসেপ্পিনা এবং অ্যাসুন্টিনা পেস ভগ্নীদ্বয়ের কাছ থেকে। ঝিনুক থেকে রেশম তন্তু সংগ্রহ করার পরে সেগুলো প্রথমে সমুদ্রের পানি এবং পরে স্বাদু পানিতে ধুয়ে নিতে হয়। এরপর, সুঁচালো একরকমের চিরুনি দিয়ে সেই তন্তুগুলোকে ভালোভাবে আঁচড়ানো হয়। এরপর চরকার সাহায্যে সেই তন্তুগুলো থেকে সূক্ষ্ম সুতা কাটা হয়। সবশেষে, তামাটে এবং সোনালী রঙের মাঝামাঝি কোনো এক বর্ণের সুতাগুলোকে লেবুর রসে পরিষ্কার করলে সেগুলোতে চকচকে আভার দেখা মেলে। এরপরই এই সুতাগুলো থেকে তৈরি হয় কাপড় বা করা হয় বিভিন্ন কারুকাজ।
কিয়ারা ভিগো বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, সামুদ্রিক রেশম তৈরি তার পরিবারের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। গবেষকদের মতে, ১৭০০ বছর আগে পর্যন্ত সামুদ্রিক রেশমের ইতিহাস জানা যায়, যদিও এ তন্তুকে ঘিরে কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে আরও হাজার হাজার বছর আগে থেকে। রয়েছে অনেক অস্পষ্টতা, অনেক গল্প-কথা, তর্ক-বিতর্ক, অজানা কথা।
সামুদ্রিক রেশম নিয়ে ইতিহাসে কিছু জটিলতাও আছে। যেমন, প্রাচীনকালে ল্যাটিন ভাষায় ‘বাইসাস’ বলতে লিনেন এবং সামুদ্রিক রেশম দু’ ধরনের তন্তুকেই বোঝাতো। এ কারণে গবেষকদের জন্য ইতিহাসের অনেক লিখিত বাণী ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে গেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন মিশরীয় মমি যে কাপড় দিয়ে মোড়ানো হতো, সেটা অনেকসময় বাইসাসের তন্তু দিয়ে তৈরি হতো, মিশরীয় রানী নেফারতিতি পরতেন বাইসাসের তৈরী বাহুবন্ধনী, মেসোপটেমিয়ার রাজাদের কাপড়ে কারুকাজ হতো বাইসাস দিয়ে। কিন্তু সে বাইসাস কি সাধারণ কোনো রেশম তন্তু, নাকি অনন্য সাধারণ সামুদ্রিক রেশম তা ইতিহাসবিদেরা ব্যাখ্যা করতে পারেন না। আবার, খ্রিষ্টীয় এবং হিব্রু বাইবেলে অনেকবার এই বাইসাসের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। কিং সলোমন, যাকে মুসলিমরা নবী সোলায়মান বলে থাকে, তিনি বাইসাসের তৈরী পোশাক পরতেন। কিন্তু সূক্ষ্ম, পেঁয়াজের খোসার চেয়েও মিহি এই কাপড়ের তন্তু কি সামুদ্রিক কোনো প্রাণী থেকে আসতো, নাকি কোনো গাছ থেকে, তার ব্যাখ্যা পান না ইতিহাসবিদেরা। অবশ্য, সপ্তম শতাব্দী থেকে বাইসাস শব্দটি কেবল ‘পেন শেল’ নামের ঝিনুক থেকে প্রাপ্ত তন্তুকে বোঝাতেই ব্যবহার করা হয়।
একটি পুরো পোশাক বানাতে যতটা সামুদ্রিক রেশমি সুতোর দরকার, তা তৈরি করতে প্রচুর শ্রম আর সময়ের প্রয়োজন। যা কিয়ারা ভিগোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি সামুদ্রিক রেশমের পোশাক না বানিয়ে, এগুলো কেবল কাপড়ে নকশা করতে ব্যবহার করেন। পবিত্র তন্তু থেকে তৈরী বলেই তিনি কখনো এ সুতা বিক্রি করেন না। কাপড়ে কারুকাজ করে তিনি তা উপহার দিয়ে থাকেন প্রিয়জনদের। কথিত আছে, একবার এক জাপানি ব্যবসায়ী নিজের কাপড়ের এক পাশে আঠার ইঞ্চির চতুর্ভুজাকৃতির একটি নকশা এঁকে নিতে চেয়েছিলেন কিয়ারা ভিগোর কাছে। বিনিময়ে তিনি দিতে চেয়েছিলেন, ২.৯৯ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২৫১,৫৫৪,৬৮০ টাকা। তবু, ভদ্রমহিলা বিক্রি করতে রাজি হননি তার অমূল্য রেশমি সুতা। পবিত্র বলে কথা!
সামুদ্রিক রেশমের একমাত্র কারিগর কিয়ারা ভিগোর মৃত্যুর পরে কি হবে এ সুতার ভবিষ্যত, তা কেউ বলতে পারে না। ভদ্রমহিলার এক মেয়ে আছে, নাম মেডেলিনা। সে যদি মায়ের পরিবারের কয়েক পুরুষের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তবে হয়তো বেঁচে থাকবে সামুদ্রিক রেশম। নয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে চিরতরে।