কেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইজারল্যান্ড সবচেয়ে নিরাপদ দেশ?

সুইজারল্যান্ড একটি ছোট স্থলবেষ্টিত দেশ, যার চারপাশে রয়েছে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া। আপনি যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মানচিত্রের দিকে তাকান, তাহলে একটি ছোট ফুটো দেখতে পাবেন, আর এই ছোট ফুটোর মতো দেশটি হচ্ছে সুইজারল্যান্ড।

সুইজারল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য না হওয়ার পাশাপাশি এটি ন্যাটোর সদস্য নয়। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ২০১২ সাল পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘের সদস্য ছিল না। দেশটি এতটাই নিরপেক্ষ যে, গত ২০০ বছরেও তারা কারো সাথে কোনো যুদ্ধ বা সংঘাতে লিপ্ত হয়নি। দেশটি সর্বশেষ যুদ্ধে লিপ্ত হয় নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে, ১৮১৫ সালে।

মানচিত্রে চিহ্নিত অংশটুকু হচ্ছে সুইজারল্যান্ড; Image Source: YouTube

যদিও দেশটি ইউরোপের একেবারে মাঝখানে অবস্থিত এবং এর চারপাশে রয়েছে আক্রমণাত্মক মনোভাবের নীতি নিয়ে চলা বেশ কিছু দেশ, তারপরও কীভাবে সুইজারল্যান্ড এতটা নিরাপদ এবং নিরপেক্ষ? পাশাপাশি যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়, যা পৃথিবীর কেউই চায় না, তবুও কেন সুইজারল্যান্ড সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হবে?

উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে।

১. সুইজারল্যান্ডের ভূপ্রকৃতি এবং এর সীমানা

দেশটিকে প্রধানত আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি। দক্ষিণে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। এই বিশালকায় পর্বতমালা সুইজারল্যান্ডের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে এবং তা ইতালি ও অস্ট্রিয়া থেকে সুইজারল্যান্ডকে পৃথক করেছে।

সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত আল্পস অঞ্চল; Image Source: Pixabay.com

উত্তর এবং পশ্চিমে রয়েছে জুরাহ পর্বতমালা। যদিও এ পর্বতমালা আল্পস পর্বতমালা থেকে খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু তারপরও এটি ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ডে পৃথক করেছে। এই দুই পর্বতমালার মাঝে রয়েছে সুইস প্ল্যাটু, যা দেশের স্থলভাগের তিন শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে এবং সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যা মোট দুই-তৃতীয়াংশ এখানে বসবাস করে। সুইজারল্যান্ডে প্রধান তিনটি শহর জুরিখ,বার্ন এবং জেনেভা সুইস প্ল্যাটুতে অবস্থিত।

সুইস প্ল্যাটু; Image Source: Discover Switzerland

বৈদেশিক আক্রমণ নিয়ে সুইজারল্যান্ড সবসময় ভীত ছিল, কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি নিরপেক্ষ বেলজিয়ামকে আক্রমণ করে ফ্রান্সকে দখল করার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরো সুইজারল্যান্ড অক্ষশক্তি এবং নাৎসি জার্মানদের দ্বারা আক্রমণের দ্বারপ্রান্তে ছিল। যদিও নাৎসি জার্মানি আক্রমণ করেনি, কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। সুইসদের বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার কৌশলকে তারা বলে থাকে ‘দ্য ন্যাশনাল রিডাউট’। এর মানে হচ্ছে- যদি কেউ সুইজারল্যান্ড আক্রমণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে সুইজারল্যান্ডের ভূ-প্রকৃতি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে আক্রমণের কথা দুবার ভাবতে হবে।

২. বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ

১৮-৩৪ বছর বয়স্ক প্রত্যেক সুস্থ নাগরিককে ১৭০ দিনের জন্য বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস প্রদান করতে হয় এবং সেখানে তারা প্রাথমিক যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রস্তুতিগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা গ্রহণ করে। যারা মিলিটারি সার্ভিস দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদেরকে ৩০ বছর পর্যন্ত তাদের আয়ের উপর তিন শতাংশ কর প্রদান করতে হয়। বেশিরভাগ নাগরিকই এই বাধ্যতামূলক মিলিটারি প্রশিক্ষণ শেষে চলে যায়, কিন্তু তারা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবহৃত রাইফেল নিজেদের কাছে রেখে দিতে পারে। এজন্যই ব্যক্তিগতভাবে বন্দুকের মালিকানা স্বত্ব অর্জনের দিক দিয়ে সুইজারল্যান্ড বিশ্বে অন্যতম। যেকোনো প্রকার জরুরি সামরিক প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ড ৭২ ঘণ্টায় দুই লাখেরও বেশি সৈন্যকে কাজে নামিয়ে নিতে পারে।

৩. ছদ্মবেশী মরণফাঁদ এবং দুর্গ

দেশটির প্রতিটি সেতু, রেলপথ এবং টানেলগুলো এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে যেকোনো সময় শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য দূরবর্তী যেকোনো স্থান থেকে এগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। যদি শত্রুপক্ষ সড়কপথেও আসতে চায়, সেক্ষেত্রেও তাকে দুবার ভাবতে হবে। কেননা মুহূর্তেই পাহাড়গুলোকে বিস্ফোরিত করে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার মতো এ ধরনের পয়েন্ট রয়েছে প্রায় ৩,০০০। সম্ভাব্য আক্রমণের সময় সুইস প্ল্যাটু পরিহার করে পর্বত বেষ্টিত আলপাইন অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা সুইস সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। আলপাইন পর্বতমালায় তারা নির্মাণ করেছে ২৬,০০০ বাংকার এবং ছোট ছোট দুর্গ। এছাড়াও রয়েছে অ্যান্টি ট্যাংক গান, অ্যান্টি এয়ার গান এবং মেশিনগান নেস্ট।

পাথরের রূপে অ্যান্টি ট্যাংক গান; Image Source: YouTube

উপরের ছবিটিতে লাল বৃত্ত দ্বারা আবৃত যে পাথর দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, সেটি আসলে কোনো পাথর নয়, একটি ছদ্মবেশী অ্যান্টি ট্যাংক গান।

সুইজারল্যান্ডের রক্ষীঘর; Image Source: YouTube

এই ছবিটিতে যে দুটি ঘর দেখতে পাচ্ছেন, এগুলো আসলে সাধারণ কোনো ঘর নয়। বাঁ-পাশের ঘরটি মেশিনগান নেস্ট এবং ডানপাশেরটি অ্যান্টি ট্যাংক গান। এ ধরনের ঘরগুলো আবার মাটির নিচে টানেল দ্বারা সংযুক্ত। ঘরগুলো সুইজারল্যান্ডকে একটি দুর্ভেদ্য প্রাসাদে পরিণত করেছে এবং দেশটিকে নিরপেক্ষ থাকতেও সহায়তা করেছে। যদিও সুইজারল্যান্ডের এমনভাবে নিরপেক্ষ থাকাটাকে এখন অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, কেননা ফ্রান্স জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াসহ সবগুলো দেশই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত এবং কারোরই সুইজারল্যান্ডের উপর আক্রমণ চালানোর কোনো উদ্দেশ্য নেই। আবার অন্যদিকে ‘দ্য ন্যাশনাল রিডাউট’-এর কারণে তাদের তৈরিকৃত বাংকার এবং দুর্গগুলো আস্তে আস্তে জাদুঘরে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি সুইজারল্যান্ড তাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা ৮০,০০০-এ নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নিচ্ছে ইতোমধ্যেই।

৪. নিউক্লিয়ার ফলআউট শেল্টার

পারমাণবিক বিপর্যয় প্রতিরোধী বাংকার; Image Source: weheartit.com

১৯৭৮ সালের পর থেকে যে সকল বাড়ি তৈরি করা হয়েছে, সেখানে আইনত প্রত্যেকটি বাড়িকে বাধ্যতামূলক পারমাণবিক বিপর্যয় প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কেন্দ্রগুলো ৭০০ মিটার দূরবর্তী অঞ্চলের ১২ মেগাটন পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকেও নিজেদের বাঁচাতে পারবে। এখন পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডে প্রায় ৮.৬ মিলিয়ন পারমাণবিক আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। পারমাণবিক বিপর্যয়ের সময় সুইজারল্যান্ডের নাগরিকরা তাদের বাংকারে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। অনেকের মতে, পারমাণবিক যুদ্ধের সময় যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কতিপয় দেশের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধান, তেলাপোকা এবং ৮.৬ মিলিয়ন সুইস নাগরিক।

সুতরাং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি সংঘটিত হয় এবং কোনো দেশ যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, সেই পারমাণবিক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সুইজারল্যান্ডই হতে পারে সম্ভাব্য নিরাপদ জায়গা।

Related Articles

Exit mobile version