২০২৩ সালের ২২ মে রাশিয়ার ইউক্রেনীয়-অধ্যুষিত বেলগরোদ প্রদেশে একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রদেশটির ভূখণ্ডে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বিলহরোদ’ (Bilhorod People’s Republic) নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। গত সোমবারে যখন রুশ–ইউক্রেনীয় সীমান্তবর্তী রাশিয়ার বেলগরোদ প্রদেশের কিছু অংশে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে একদল সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রবেশ করে, তখন ইউক্রেনীয়রা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম প্রচারণাই চালাচ্ছিল। কিন্তু ঘটনাটি সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রচারণার সঙ্গে এটির বাস্তব বিবরণের পার্থক্য বিশদ।
বেলগরোদ প্রদেশ: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বেলগরোদ পশ্চিম রাশিয়ায় অবস্থিত একটি সীমান্তবর্তী প্রদেশ। প্রদেশটির আয়তন ২৭,১৩৪ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ। প্রদেশটির জনসংখ্যার ৯৭.৩% জাতিগত রুশ এবং মাত্র ২.৮% জাতিগত ইউক্রেনীয়, সুতরাং প্রদেশটি ইউক্রেনীয়-অধ্যুষিত, এরকমটি মনে করার কোনো সুযোগ নেই। প্রদেশটির সঙ্গে ইউক্রেনের খারকভ/খারকিভ ও সুমি প্রদেশের এবং রুশ-অধিকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের ৫৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই প্রদেশটি অত্যন্ত সামরিকায়িত, এবং যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনীয় সৈন্যরা বহুবার প্রদেশটির ভূখণ্ডে আর্টিলারি, হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করে আক্রমণ চালিয়েছে।
বেলগরোদ প্রদেশে ইউক্রেনীয় আক্রমণ
২০২৩ সালের ২২ মে ‘ফ্রিডম অফ রাশা লেজিয়ন’ এবং ‘রাশান ভলান্টিয়ার কোর’ নামক দুইটি ইউক্রেনীয় সামরিক সংগঠনের সদস্যরা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে রাশিয়ার বেলগরোদ প্রদেশের গ্রায়ভরোন জেলায় অনুপ্রবেশ করে। তারা ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ফাইটিং ভেহিকল, পিকআপ ট্রাক, ড্রোন প্রভৃতি ভারী সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত ছিল। তারা একজন রুশ সীমান্তরক্ষীকে খুন করে এবং গ্রায়ভরোন জেলার কোজিনকা, গোরা-পদোল ও গ্লোতোভো গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়। একই সময়ে তারা গ্রায়ভরোন জেলার অন্যান্য গ্রামের ওপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং গ্রায়ভরোন জেলার কেন্দ্রবিন্দু গ্রায়ভরোন শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
এই আক্রমণের সময় ইউক্রেনীয় সৈন্যরা একটি রুশ বিটিআর-৮২এ আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার দখল করে নেয়। তাদের আক্রমণের ফলে অন্তত দুইজন রুশ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ১৩ জন আহত হয়, এবং অন্তত ৫০০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময় ইউক্রেনীয়রা ড্রোন ব্যবহার করে বেলগরোদ প্রদেশের রাজধানী বেলগরোদ শহরে অবস্থিত রুশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমভিডি) এবং রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির কার্যালয়ের ওপর বোমাবর্ষণ করে।
বেলগরোদ প্রদেশে উক্ত আক্রমণের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনীয়রা ও ইউক্রেন-সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে একটি বিস্তৃত প্রচারণা অভিযান শুরু করে। তারা এরকম একটি বিবরণ প্রচার করতে থাকে যে, রুশ সরকারবিরোধী কিছু আধা-সামরিক সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে বেলগরোদ প্রদেশে বিদ্রোহ করেছে। তারা সেখানে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বিলহরোদ’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম প্রচারণাও চালানো হয়, যেটি ছিল অনেকাংশে ব্যঙ্গাত্মক। উল্লেখ্য, বিলহরোদ হচ্ছে বেলগরোদের নামের ইউক্রেনীয় সংস্করণ। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের দনেৎস্ক ও লুগানস্ক প্রদেশদ্বয়ে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্ক’ নামক দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, এবং কিছু কিছু ইউক্রেনীয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বিলহরোদ’ প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করে সেই ঘটনাটিকে ব্যঙ্গ করছিল।
ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতির কার্যালয় প্রধানের উপদেষ্টা মিহাইলো পদোলিয়াক বেলগরোদের ওপর পরিচালিত আক্রমণে ইউক্রেনের সম্পৃক্ততার কথা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। কিন্তু ইউক্রেনীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এইচইউআর-এর মুখপাত্র আন্দ্রি ইয়ুসোভ মন্তব্য করেন যে, ফ্রিডম অফ রাশা লেজিয়ন ও রাশান ভলান্টিয়ার কোরের সদস্যরা ‘ইউক্রেনীয় বেসামরিক জনসাধারণকে নিরাপত্তা প্রদানে’র উদ্দেশ্যে একটি ‘নিরাপত্তা করিডোর’ স্থাপনের জন্য বেলগরোদে উক্ত আক্রমণ পরিচালনা করেছে। অর্থাৎ, তিনি পরোক্ষভাবে উক্ত আক্রমণে ইউক্রেনের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেন।
ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রুশ ইউনিট
বস্তুত ফ্রিডম অফ রাশা লেজিয়ন এবং রাশান ভলান্টিয়ার কোর ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীরই অংশ। ২০২২ সালের মার্চে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে ফ্রিডম অফ রাশা লেজিয়ন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। ইউক্রেনীয় প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য অনুসারে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনীয়দের হাতে বন্দি অল্প কিছু রুশ সৈন্য পক্ষ পরিবর্তন করে ইউক্রেনের সঙ্গে যোগ দিতে সম্মত হয় এবং ফ্রিডম অফ রাশা লেজিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। আনুষ্ঠানিকভাবে, এটি ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লেজিয়নের অংশ। ইউক্রেনীয়দের ভাষ্যমতে, এটির সদস্যরা রুশ নাগরিক এবং তারা বর্তমান রুশ সরকারকে উৎখাত করতে আগ্রহী। কিন্তু কার্যত সংগঠনটির সদস্যদের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় না এবং এজন্য ধারণা করা হয় যে, সংগঠনটির সদস্যরা আসলে প্রধানত ইউক্রেনীয় নাগরিক এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা যুদ্ধের অংশ হিসেবে তারা এই সংগঠনটি সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে, ২০২২ সালের আগস্টে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে রাশান ভলান্টিয়ার কোর প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা দেনিস নিকিতিন রুশ নাগরিক, কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে তিনি ইউক্রেনীয় নব্য-নাৎসি সামরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। নিকিতিনের ভাষ্যমতে, রুশ সরকারবিরোধী প্রবাসী রুশ স্বেচ্ছাসেবকরা তার সংগঠনের সদস্য এবং তাদের উদ্দেশ্য বর্তমান রুশ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। অবশ্য এই সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যেও কিছু ইউক্রেনীয় নাগরিক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে, এটিও ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লেজিয়নের অংশ। সংগঠনটিকে নব্য-নাৎসি ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সেটি ‘রাশান লিবারেশন আর্মি’র প্রতীকগুলো ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মান-নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণকালে রাশান লিবারেশন আর্মি অক্ষশক্তির পক্ষ নিয়ে সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।
অর্থাৎ, ফ্রিডম অফ রাশা লেজিয়ন ও রাশান ভলান্টিয়ার কোর সংগঠন দুইটি নিজেদেরকে রুশ সংগঠন হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু তারা আইনগতভাবে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত এবং বিশ্লেষকদের মতে, তাদের প্রায় ১,০০০ সদস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইউক্রেনীয় নাগরিক। সুতরাং, ইউক্রেন বেলগরোদে পরিচালিত আক্রমণের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও কার্যত এই আক্রমণটি যে তারাই পরিচালনা করেছে, এই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বেলগরোদে রুশ যৌথবাহিনীর ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ অভিযান
রুশ সরকার বেলগরোদ প্রদেশে ইউক্রেনীয় আক্রমণকে একটি ‘সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেলগরোদের গভর্নর ভিয়াচেস্লাভ গ্লাদকভ প্রদেশজুড়ে ‘কাউন্টার-টেরোরিস্ট অপারেশন রেজিম’ ঘোষণা করেন। রুশ জরুরি পরিস্থিতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বেলগরোদ প্রাদেশিক সরকার ইউক্রেনীয়দের দ্বারা আক্রান্ত গ্রামগুলো থেকে স্থানীয় অধিবাসীদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে শুরু করে। রুশ সশস্ত্রবাহিনী, এফএসবির বর্ডার সার্ভিস, ন্যাশনাল গার্ড ও পুলিশ আক্রমণকারী ইউক্রেনীয় ইউনিটগুলোর বিরুদ্ধে একটি যৌথ অভিযান শুরু করে। এসময় রুশরা ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। রুশ স্থলবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ কর্নেল-জেনারেল আলেক্সান্দর লাপিন এই অভিযানে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
ইউক্রেনীয়দের পক্ষে এই অভিযানে সাফল্য অর্জনের (অর্থাৎ অধিকৃত গ্রামগুলোকে ধরে রাখার) কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ২৩ মের মধ্যে রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনীয়দের দ্বারা অধিকৃত গ্রামগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং আক্রমণকারী ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর ইউনিটগুলোর অবশিষ্ট সদস্যরা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে পশ্চাৎপসরণ করে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, এই ঘটনার ফলে অন্তত ৭০ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত হয়েছে, এবং ইউক্রেনীয়দের ৪টি আর্মার্ড ভেহিকল (যেগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি মার্কিন-নির্মিত এম১১৫২এ১ আর্মার্ড কার্গো কার, একটি পোলিশ-নির্মিত জিক-২ ইনফ্যান্ট্রি মোবিলিটি ভেহিকল ও একটি ইউক্রেনীয়-নির্মিত ক্রাজকোবরা আর্মার্ড কার), ৫টি পিকআপ ট্রাক এবং একটি ড্রোন ধ্বংস হয়েছে। তদুপরি, রুশরা ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে অন্তত দুইটি মার্কিন-নির্মিত এম১২২৪ ম্যাক্সপ্রো মাইন-রেজিস্ট্যান্ট অ্যাম্বুশ-প্রোটেক্টেড ভেহিকল এবং অন্তত দুইটি মার্কিন-নির্মিত এম১১৫১ এনহ্যান্সড আর্মামেন্ট ক্যারিয়ার দখল করে নিয়েছে।
ইউক্রেন কেন এরকম পদক্ষেপ নিলো?
বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বেলগরোদে আক্রমণ চালিয়ে ইউক্রেনীয়রা কার্যত কিছুই অর্জন করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে তারা কেন এরকম একটি আক্রমণ পরিচালনা করলো?
প্রথমত, সম্প্রতি মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে যে, ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি বেশ কিছুদিন ধরেই মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় রুশ-ইউক্রেনীয় সীমান্তের নিকটে অবস্থিত রুশ প্রদেশগুলোয় আক্রমণ পরিচালনার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আসছেন। ইউক্রেনীয় সরকারের ধারণা, তারা কিছু রুশ ভূখণ্ড অধিকার করতে পারলে রুশ সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ও নিজস্ব জনসাধারণের কাছে অপমানিত হবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার সময় ইউক্রেন বিশেষ সুবিধা লাভ করবে।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনীয়দের দৃষ্টিকোণ থেকে বেলগরোদের গ্রায়ভরোন জেলা ছিল আক্রমণ পরিচালনার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান। গ্রায়ভরোন জেলার একদিকে ভরস্কলা নদী, আরেকদিকে গ্রায়ভরোনকা নদী এবং বাকি দুই পাশে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড অবস্থিত। সুতরাং, ইউক্রেনীয়দের ধারণা ছিল, তারা অঞ্চলটি দখল করে নিলে রুশদের জন্য এটি পুনর্দখল করা তুলনামূলকভাবে কঠিন হবে। তদুপরি, গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট বেন ওয়ালেস মন্তব্য করেছিলেন যে, রুশ সশস্ত্রবাহিনীর ৯৭% সদস্য বর্তমানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এটি মূলত প্রচারণামূলক বক্তব্য, কিন্তু এর থেকে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে এরকম একটি ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে যে, বেলগরোদ প্রদেশ রক্ষা করার জন্য রাশিয়ার কাছে পর্যাপ্ত সৈন্য নেই।
তৃতীয়ত, গত ২০ মে রুশ মার্সেনারি সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যরা গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্কের আর্তিয়োমভস্ক (ইউক্রেনীয় নাম: বাখমুৎ) শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। প্রায় ১০ মাসব্যাপী তীব্র শহুরে যুদ্ধের (urban warfare) পর রুশ মার্সেনারিরা শহরটি অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৪–২০১৫ সালের দনবাস যুদ্ধের পর থেকে ইউক্রেনীয়রা শহরটিতে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল-জেনারেল ওলেক্সান্দর সিরস্কি শহরটিকে ‘অভেদ্য দুর্গ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি ঘোষণা করেছিলেন যে, ইউক্রেনীয়রা কখনো শহরটি থেকে পশ্চাৎপসরণ করবে না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুশ মার্সেনারিরা ‘একবিংশ শতাব্দীর স্তালিনগ্রাদ’ এবং ‘মিটগ্রাইন্ডার’ হিসেবে পরিচিতি অর্জনকারী আর্তিয়োমভস্ক/বাখমুৎ শহরটি অধিকার করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তদুপরি, এই যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: এই প্রথম ন্যাটো কর্তৃক অস্ত্রসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত একটি সশস্ত্রবাহিনী একটি প্রচলিত যুদ্ধে একটি মার্সেনারি সংগঠনের কাছে পরাজিত হয়েছে। এজন্য ইউক্রেন ও ন্যাটোর জন্য এই পরাজয় অবমাননাকর। এমতাবস্থায় বিশ্বের দৃষ্টি আর্তিয়োমভস্ক/বাখমুৎ থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য বেলগরোদে পরিচালিত আক্রমণ ছিল একটি আদর্শ প্রচারণামূলক স্টান্ট।
সর্বোপরি, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো রাশিয়াকে খণ্ডবিখণ্ড করার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বেলগরোদের ওপর পরিচালিত আক্রমণে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে, কিন্তু তাদের প্রদত্ত বিবৃতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই আক্রমণের পশ্চাতে তাদের মৌন সমর্থন রয়েছে। এই আক্রমণ পরিচালনার সময় ইউক্রেনীয় সৈন্যরা ব্যাপকভাবে মার্কিন ভারী সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে। ১৯১৮–১৯২২ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি (যুক্তরাষ্ট্রসহ) কর্তৃক রাশিয়ায় পরিচালিত আক্রমণের পর এই প্রথম রুশ ভূখণ্ডের ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য মার্কিন ভারী সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হলো। এর প্রতীকী তাৎপর্য ব্যাপক।
রুশ সৈন্যরা এক দিনের মধ্যেই বেলগরোদ প্রদেশ থেকে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। এই অভিযানে তাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। সুতরাং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, রুশরা যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু এরপরেও কিছু কিছু রুশ ও রুশপন্থী সামরিক ব্লগার বেলগরোদে ইউক্রেনীয় আক্রমণের প্রতি রুশ সামরিক প্রতিক্রিয়াকে অপর্যাপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনীয় সৈন্যরা যখন সীমান্ত অতিক্রম করে বেলগরোদে অনুপ্রবেশ করে, তখন রুশ রিকনিস্যান্স ড্রোন ইউক্রেনীয় কলামটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। রুশরা স্ট্রাইক ড্রোন ব্যবহার করে সহজেই কলামটিকে ধ্বংস করতে পারতো। কিন্তু রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের আগে রুশ সরকার স্ট্রাইক ড্রোন নির্মাণের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়নি এবং রাশিয়ার যে অল্প কয়েকটি স্ট্রাইক ড্রোন রয়েছে সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন রয়েছে। রুশরা এই যুদ্ধে প্রচুর সুইসাইড ড্রোন ব্যবহার করছে, কিন্তু গতিশীল লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য সেগুলো উপযুক্ত নয়। রুশদের পর্যাপ্ত সংখ্যক স্ট্রাইক ড্রোন থাকলে তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই অভিযান শেষ করে দিতে পারতো।
সামগ্রিকভাবে, বেলগরোদের ওপর পরিচালিত ইউক্রেনীয় আক্রমণের সামরিক বা কৌশলগত তাৎপর্য সামান্যই। কিন্তু আক্রমণটির প্রচারণামূলক ও প্রতীকী তাৎপর্য ব্যাপক, এবং এই আক্রমণটি চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ ও রুশ–ন্যাটো প্রক্সি যুদ্ধে একটি নতুন ধাপ সংযোজিত করেছে।