চোখ বন্ধ করে চলুন একবার শৈশবে ফিরে যাওয়া যাক। আমাদের বাবা-চাচা-মামাদের হাতে তখন মাত্র আসতে শুরু করেছে মোবাইল ফোন। মাঝে মাঝেই সময়ই ঘরের ভেতর নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত না, ছুটে যেতে হতো ঘরের বাইরে। “হ্যালো, হ্যালো” করতে করতে পাড়া-প্রতিবেশী পর্যন্ত জেনে যেত যে, এই বাসায় কেউ একজন কথা বলছে ফোনে!
আস্তে আস্তে সময় গড়াতে লাগলো। একদিন পেপার খুলে দেখা গেলো, থ্রি-জি (থার্ড জেনারেশন) তথা তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক আসতে যাচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ, যার মাধ্যমে নাকি ফোনের অপরপ্রান্তে বসা মানুষটির চেহারা দেখতে দেখতেই কথা বলার কাজটি সারা যাবে। আমার মতো এই দেশের আরো অনেক মফস্বলবাসী শিশু-কিশোরের কাছেই এ যেন ছিলো হলিউডী সিনেমার বাংলাদেশে আগমন।
একসময় সেটাও হলো। আসলো ইন্টারনেটের তুমুল গতি। এখন ভিডিও কলিং খুব সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। থ্রি-জিও আমাদের দেশে এখন পুরনো হয়ে গেছে। সম্ভবত এক বছর বা তার কাছাকাছি হতে চললো, বাংলাদেশ ফোর-জি তথা চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কের আঙিনায় পা রেখেছে। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে ফাইভ-জি তথা পঞ্চম প্রজন্মের আগমন নিয়েও।
এই যে ওয়ান-জি থেকে শুরু করে ফাইভ-জি, প্রতিটির বেলাতেই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে ধাপে ধাপে উন্নয়ন ঘটেছে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি চমৎকার এক মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এসব বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক একটি চিত্র নিচের সারণিতে তুলে ধরা হলো, যা দেখে আগ্রহী যে কেউই সেই সত্তরের দশকের ওয়ান-জি থেকে শুরু করে আজকের ফোর-জি, এবং বছরখানেকের মাঝে আসতে যাওয়া ফাইভ-জি প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পেতে পারেন।
আজকের লেখার উদ্দেশ্য অবশ্য মানুষকে এই যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রজন্মান্তর সম্পর্কে জ্ঞান দান করা নয়, বরঞ্চ একটি গুজবের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া, যা বিশ্বের অনেক মানুষই অজ্ঞতাবশত বিশ্বাস করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে তৈরি হয়েছে একটি গুজবের চেইন রি-অ্যাকশন।
ফাইভ-জি প্রযুক্তির পরীক্ষা চলাকালে নেদারল্যান্ডে হেগ শহরে মারা পড়েছে শত শত পাখি
“এক সপ্তাহ আগের কথা। হেগের একটি পার্কে অগণিত পাখি মরে পড়তে থাকলো। সম্ভবত আপনি এই সম্পর্কে খুব বেশি একটা জানেন না। কারণ, বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু, যখন আরো দেড় শতাধিক পাখি মারা গিয়ে মৃত পাখির মোট সংখ্যা ২৯৭ এ উন্নীত করলো, তখনই বিষয়টি কারো কারো নজরে আসা শুরু করলো।
আপনি পার্কের চারদিকে ঠিকমতো তাকালে দেখতে পাবেন, যেখানে পাখিগুলো মারা গিয়েছে, সেখানে বাড়ির ছাদের উপর আছে একটি নতুন ফাইভ-জি’র টাওয়ার। ডাচ রেলওয়ে স্টেশনের সাথে তারা এর রেঞ্জ কেমন এবং এর ফলে আশেপাশে ক্ষতিকর কোনো প্রভাব পড়ে কি না তার পরীক্ষা চালাচ্ছিলো।
ক্ষতিকর প্রভাব সত্যি সত্যিই পড়েছিলো। কিছুক্ষণ পরই গাছে বসে থাকা পাখিগুলো মরে পড়তে শুরু করে। সাঁতার কাটতে থাকা হাসগুলোও বেশ অদ্ভুত আচরণ শুরু করে দেয়। তারা বিকিরণের হাত থেকে বাঁচতে পানির নিচে মাথা ডুবিয়ে রাখতে শুরু করে। কতগুলো আবার উড়ে গিয়ে রাস্তা কিংবা খালে গিয়ে নামে।
আর, যখন প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছিলো, তখন হল্যান্ডে স্পুরে (হেগের সবচেয়ে পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন) ফাইভ-জি ট্রান্সমিটারের পরীক্ষা চালানো হচ্ছিলো।“
এতগুলো প্রাণী মারা গেলো, দায়ী করা হলো সামনের দিনের যোগাযোগ প্রযুক্তি যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে যাচ্ছে সেই ফাইভ-জি প্রযুক্তিকে, অথচ এই দাবির পেছনে তথ্যসূত্র হিসেবে দেখানো হলো একটি ফেসবুক নোটকে!
এই খবরটি প্রথম দেখা যায় এরিন এলিজাবেথ নাম্নী এক নারীর হেলথ নাট নিউজ নামক ওয়েবসাইটে। একটু আগে যে ফেসবুক নোটের কথা বলা হলো, এর লেখক জন কুহল্স নামক এক ডাচ ভদ্রলোক। ৫২ বছর বয়সী এ মানুষটির ফেসবুক প্রোফাইল ঘাঁটালেই তার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
প্রোফাইলের ‘About’ অংশে কুহল্স নিজেকে দাবি করেছেন একজন ‘ইউএফও (আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লায়িং অবজেক্ট) গবেষক’ হিসেবে, যিনি স্বেচ্ছায় এ কাজটি করে যাচ্ছেন গত ২৬টি বছর ধরে। তার ভাষ্যমতে, ১৯৯০ সালের ১৫ জুলাই সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো ইউএফও’র দেখা পান। এমনকি ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে তিনি নাকি ইউএফও’র ভিডিও পর্যন্ত ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ব্যাপারটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও কথা ছিলো, তবে কুহল্স এখানেই থেমে যাননি। সমমনাদের একত্রিত করতে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তিনি অ্যামস্টারডামে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইউএফও সম্মেলন পর্যন্ত আয়োজন করেছিলেন! আরেকটি মজার তথ্য দিয়ে কুহল্স-বন্দনা শেষ করা যাক। কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের ভয়াবহতা কোন মাত্রায় পৌঁছেছিলো, তা পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খাতিরে আমরা অনেকেই জেনেছি। কুহল্সের পরিচালিত স্টপ ফাইভ-জি পেজ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, বৃহদাকারে ফাইভ-জি ব্যবহারে ভেটো দেয়ার জন্যই অভিজাত শ্রেণীর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ হিসেবে গাছগাছালিতে আগুন দেয়ার মতো এমন কাজ করা হয়েছে কি না!
এমনই একজন ‘মানসিকভাবে বিশেষ সুস্থ’ ব্যক্তির ফেসবুক নোটের উপর ভিত্তি করে নিজের ওয়েবসাইটে লেখাটি দিয়েছিলেন এরিন এলিজাবেথ। এবার বুঝুন অবস্থা, গোড়াতেই আছে বিশাল গলদ।
কিন্তু, পাখিগুলো মরার খবরের কী হবে? সেগুলো কি আসলেই মারা গিয়েছিলো? আর মারা গেলে এর কারণই বা কী?
হ্যাঁ, পাখি ঠিকই মারা গিয়েছিলো। এ বছরের ১৯ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ মাস সময়কালে হেগের হাইগেন্সপার্কে ৩৩৭টি পাখি মারা যায়। অনুসন্ধান থেকে দেখা যায়, কোনো রকম ভাইরাল বা ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন কিংবা ইঁদুরের বিষ পাখিগুলোর মৃত্যুর জন্য দায়ী না। একইভাবে, পাখিগুলোর মৃত্যুর সময় ফাইভ-জি সংক্রান্ত কোনো রকম পরীক্ষণও চালানো হচ্ছিলো না। তাই সন্দেহের তালিকা থেকে আজকের এই গুজবকে নিশ্চিতভাবেই দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
পরবর্তীতে পৌরসভার অনুরোধে ওয়াজেনিঞ্জেন বায়োভেটেরিনারি রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে ইয়ু গাছ থেকে উদ্ভুত বিষাক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে পাখিগুলোর দেহে। অবশ্য এই গাছের ফল পাখিরা প্রায়ই খেয়ে থাকে, যা থেকে আগে তাদের মৃত্যুর ঘটনা কখনো জানা যায়নি। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণা করছে।
নভেম্বরের ১২ তারিখে পাওয়া সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, দেশটির ফুড এন্ড কনজ্যুমার প্রোডাক্ট সেফটি অথোরিটি ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস এবং উসুটু (Usutu) ভাইরাসের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। তবে এর মানে এই না যে, এর পেছনে অন্য কোনো ভাইরাস বা কোনোকিছুর বিষক্রিয়া জড়িত নেই। বিষয়টি নিয়ে আরো তদন্তে নেমেছে ডাচ ওয়াইল্ডলাইফ হেলথ সেন্টার, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি (রটারড্যাম) এবং গেন্ট ইউনিভার্সিটি।
আচ্ছা, তাহলে যে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক পরীক্ষণ নিয়ে এত কথা, সেটা কি আসলেই হয়েছিল?
হ্যাঁ, সেটা ঠিকই হয়েছিলো। তবে তা পাখিগুলোর মারা যাওয়ার কয়েকমাস আগে, এ বছরের ২৮ জুন। আর তখন পাখি মারা যাওয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। হুয়াওয়ের এ গবেষণাটি সি-ব্যাণ্ডে ৩.৫ গিগাহার্জে পরিচালনা করা হয়েছিলো। যেহেতু নেদারল্যান্ডের মোবাইল সার্ভিসগুলোর জন্য এই তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি এখনও মেলেনি, তাই মাত্র একদিনের জন্য হুয়াওয়েকে এই পরীক্ষা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল ভুরবার্গ এলাকায়। এর আগে হেগে কখনো ফাইভ-জির পরীক্ষা চালানো হয়েছে বলে জানা যায় না। যে হাইগেন্সপার্কে পাখি মারা যাওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে, গুগল ম্যাপ অনুযায়ী সেখান থেকে ভুরবার্গের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার।
হুয়াওয়ে তাদের এ পরীক্ষাটি চালিয়েছিল ডাচ ল্যান্ডলাইন ও মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি কেপিএন এর অফিস থেকে। কেপিএন এর একজন প্রতিনিধিও পরবর্তী সময়ে পাখি মারা যাবার এ খবরটিকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
পাখি মারা যাওয়া, ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের পরীক্ষণ- সবকিছু নিয়েই ধোঁয়াশা তো কাটলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। ফাইভ-জি প্রযুক্তি কি আসলেই এমন কিছু করতে সক্ষম?
না। অন্তত এতে যে তরঙ্গ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার দ্বারা এটা সম্ভব না কোনোভাবেই। ইউরোপে ফাইভ-জি তিনটি ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রামে থাকছে- ১) কভারেজ লেয়ার: ৭০০ মেগাহার্জ, ২) প্রাইমারি ব্যান্ডউইডথ: ৩.৪-৩.৮ গিগাহার্জ এবং ৩) সুপার ডাটা লেয়ার: ২৪.২৫-২৭.৫ গিগাহার্জ। এর মাঝে ২য় শ্রেণীটিই ব্যবহার করেছিল হুয়াওয়ে। তবে এই ৩ শ্রেণীর প্রতিটিই যে নিরাপদ, সেই ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করছে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রোটেকশন (আইসিএনআইআরপি)।
নেদারল্যান্ডের হেলথ কাউন্সিলের সদস্য এবং আইসিএনআইআরপি’র সভাপতি ড. এরিক ভ্যান রনজেনও ফাইভ-জি’র তরঙ্গকে নিরাপদ বলেই জানিয়েছেন। তার মতে, মোবাইল নেটওয়ার্কের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে পাখির মৃত্যুর জন্য দরকার বেশ উচ্চ তাপের, যা পাখিটি অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশনের সম্মুখীন হলেই কেবল সম্ভব। কিন্তু মোবাইল নেটওয়ার্কের অ্যান্টেনাগুলোতে যে মাত্রার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়, তা দিয়ে এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে মোবাইল নেটওয়ার্কের অ্যান্টেনা আছে অগণিত, কিন্তু এর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড পাখির মৃত্যুর কারণ হয়েছে, এমনটা শোনা যায়নি কখনোই।
হাজার শব্দের অধিক এই লেখার শেষে আমরা তাই এটাই বলতে পারি, ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’ কথাটিকে যথার্থ প্রমাণ করে আমাদের বোকা বানানোর কাজটি বেশ চমৎকারভাবেই সেরেছেন এরিন এবং তার হেলথ নাট নিউজ। কারণ, ফেসবুকে এই পোস্টের মাধ্যমে তারা কামিয়ে নিয়েছেন প্রায় আড়াইশ কমেন্ট, ছয় হাজারের কাছাকাছি শেয়ার, সেই সাথে গুজবের দরুন আসা ফলোয়াররা তো আছেই। কুহল্সের কথায় আর না যাই, যেতে ইচ্ছে করছে না আর!