চীন? ওখানে একটা দৈত্য ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগানোর কোনো দরকার নেই। কারণ সেটি ঘুম থেকে জেগে উঠলে পৃথিবী কাঁপতে থাকবে।
আজ থেকে দুশো বছরেরও বেশি সময় আগে চীন সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছিলেন পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে মেধাবী সামরিক কমান্ডারদের একজন- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ফরাসি এই সমরনায়ক যে ঘুমন্ত দৈত্যের কথা বলেছেন, তা সম্ভবত জেগে উঠেছে। এই শতাব্দীতে চীন যেভাবে নিজেদের মহাকাব্যিক উত্থানের গল্প সুনিপুণভাবে রচনা করেছে, তাতে ‘চীনা দৈত্য ঘুমিয়ে আছে’– এরকমটা ভাবার আর জো নেই। বাকি বিশ্বের কথা বাদ থাকুক, অন্তত আমেরিকা ও তার দীর্ঘদিনের মিত্র পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকে কাঁপিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে এশিয়ার এই বৃহৎ দেশটি। দিগ্বিজয়ী ফরাসি সমরনায়ক, ওয়াটারলু যুদ্ধের ট্র্যাজিক হিরো, ইতিহাসবিখ্যাত ‘নেপোলিয়ন কোড’-এর প্রণেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দুশো বছর আগের মন্তব্য নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে– এ কথায় কোনো অত্যুক্তি নেই বোধহয়।
আড়াই হাজার বছর আগের কথা। ইতিহাসের বিখ্যাত নগররাষ্ট্র স্পার্টা আগে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তাকে টেক্কা দেয়ার মতো আরেক নগররাষ্ট্র শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এথেন্স নামের সেই নগররাষ্ট্রের উত্থানের ভীতি তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলো স্পার্টার নীতিনির্ধারকদের। তাদের মনে হতে শুরু করলো, এথেন্সকে বাধা না দিলে একসময় তাদের পতন হবে। তাই যুদ্ধের যথাযথ প্রস্তুতি নিতে বলা হলো সৈন্যদলকে। যুদ্ধ বেধেও গেল। এই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ থুকিডাইডিস। তিনি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখলেন, দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সম্পর্ক যদি এমন হয় যে, একটি রাষ্ট্র আগে থেকেই শক্তিশালী, এবং আরেকটি রাষ্ট্র ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তবে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সংঘাত অনিবার্য। তার এই পর্যালোচনাকে ‘থুকিডাইডিসের ফাঁদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গত পাঁচশো বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, ১৬ বারের মধ্যে ১২ বারই পূর্বে প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী রাষ্ট্র ও উদীয়মান রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সংঘাত বেধেছে।
গত শতাব্দীতে দুটো বিশ্বযুদ্ধেই জয়ী পক্ষে থাকা আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তার মতাদর্শিক শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সমানে পাল্লা দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার প্রায় তিন দশক ধরে কোনো শত্রু ছিল না। শত্রু ছিল না বললে ভুল হবে, ‘সমানে পাল্লা দেয়ার মতো শত্রু’ ছিল না। গত তিন দশক ধরে চীনের অবিস্মরণীয় উত্থান ঘটেছে। একটি দুর্বল কৃষিনির্ভর দেশ থেকে চীন যেভাবে নিজের উত্তরণ ঘটিয়ে শিল্পনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে, তা রীতিমতো রূপকথার মতো শোনায়। তবে চীনের এই উত্থানে ‘থুকিডাইডিসের ফাঁদ’ আরও একবার প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। চীন যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই ঘটিয়েছে, তা কিন্তু নয়। চীন তার হাতের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ঘটিয়েছে, নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে সামরিক বাহিনীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একসময় পররাষ্ট্রনীতিতে পিছিয়ে থাকা চীনের সাথে আজ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে আলোচনায় বসতে হয়, ডুবতে থাকা অর্থনীতির দেশগুলোর শেষ ভরসা আজ ‘দীর্ঘমেয়াদী চীনা লোন’।
আমেরিকা ও চীন– দুটি দেশেরই পারমাণবিক বোমা বানানোর সক্ষমতা রয়েছে। আমেরিকার তুলনায় চীনের তৈরিকৃত পারমাণবিক বোমার সংখ্যা অনেক কম। ধারণা করা হয়, আমেরিকার অস্ত্রভান্ডারে যেখানে ছয় হাজারেরও বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে, সেখানে চীনের পারমাণবিক বোমার সংখ্যা ২২০-৩৫০। চীন প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতিসাধন করেছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তাদের সামরিক বাজেটে। ভারত, রাশিয়া ও জাপানের সম্মিলিত সামরিক বাজেটের তুলনায় চীনের সামরিক বাজেট বেশি হলেও এখনও সেটি আমেরিকার অর্ধেকেরও কম। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি যেখানে এক অর্থবছরে সামরিক বাজেট রাখে ৩২০ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে, সেখানে আমেরিকার সামরিক বাজেট থাকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখনও আমেরিকার কাছাকাছি যেতে সময় লাগবে চীনের। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার সৈন্যরা নিয়মিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতেই এখনও চীনের উপস্থিতি খুব জোরালো নয়। যেকোনো যু্দ্ধের ক্ষেত্রে সৈন্যদের পূর্বের অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পদাতিক সৈন্যের ক্ষেত্রে চীন আমেরিকার চেয়ে বেশ এগিয়ে আছে, এবং যুদ্ধে সময়-সুযোগমতো তাদের কাজে লাগাতে পারলে যুদ্ধের চেহারা পাল্টে দেয়া সম্ভব।
ইতিহাসে দেখা যায়, চীন তখনই কোনো শত্রুকে আক্রমণ করে, যখন শত্রু তার ভূখন্ড দখলের সম্ভাবনা তৈরি করে। এমনকি যদি এমনও হয় যে, যুদ্ধে চীনের জয়ের শতভাগ সম্ভাবনা কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে নিজের সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কারণ তার ভয় ছিল হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজয়ী আগ্রাসী আমেরিকা শেষ পর্যন্ত কোরিয়াকে ব্যবহার করে চীনের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাবে। ঠিক একই কারণে চীন ভিয়েতনাম যুদ্ধেও নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। অপরদিকে আমেরিকা বরাবরই উদীয়মান শক্তিগুলোর সাথে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছে সবসময়। গত শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের সাথে উদীয়মান আমেরিকার কোনো সামরিক সংঘাত তৈরি হয়নি। দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা, যুদ্ধের পরিকল্পনাকারী রাষ্ট্র জার্মানির সাথে সবধরনের সংঘাত এড়িয়ে চলেছে, দিনশেষে অবশ্য দুটি যুদ্ধেই আমেরিকাকে জড়াতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে সাড়ে চার দশকের স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে, এই সময়েও আমেরিকা নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সামরিক সংঘাত এড়িয়েছে। সেদিক থেকে একটা একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, চীন, তার প্রশাসনিক অঞ্চল তাইওয়ানের উপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কী হবে? চীন কখনোই চাইবে না তাইওয়ান আমেরিকার পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত হোক, আবার আমেরিকা ইতোমধ্যে তাইওয়ানে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চয়ই চাইবেন না তাদের একটি আদর্শিক মিত্র হারিয়ে যাক।
আমেরিকা ও চীন– দুটো দেশকেই যুদ্ধে জড়ানোর আগে দশবার এর পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমানে আমেরিকা হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র, যেটি করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আমেরিকার যে একাধিপত্য ছিল এতদিন, সেটিও দিন দিন ম্রিয়মাণ হচ্ছে। করোনার জন্য আমেরিকার অর্থনীতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটি একেবারে ভেঙে পরার মতো অবস্থা হয়নি। অপরদিকে চীন করোনাভাইরাসের আগ্রাসন সফলভাবে সামলালেও এখনও বিশ্বে শক্ত অবস্থান তৈরি করার জন্য অনেক সময় বাকি। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে ‘বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, সেটির অধীনে ইতোমধ্যে বিশাল অংকের বিনিয়োগ করে ফেলা হলেও এখনও অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা বাকি। চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ‘মালাক্কা প্রণালী’ ব্যবহার করতে হয়। চীনের ধারণা- আমেরিকার সাথে সংঘাত শুরু হলে মালাক্কা প্রণালী বন্ধ হওয়া সময়ের ব্যাপার, এজন্যই চীন তড়িঘড়ি করে বিকল্প পথ হিসেবে ‘বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। এছাড়া এখন যুদ্ধে জড়ালে চীনকে বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে লড়তে হবে, যেটি বেশ চীনের জন্য স্বল্পমেয়াদে সমস্যা তৈরি না করলেও দীর্ঘমেয়াদে বিপদজনক হয়ে দাঁড়াবে।
যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে দুটো বিবদমান পক্ষকে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। চীন যদি এই সময়ে যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে তাকে যুদ্ধে বিশাল অংকের অর্থ খরচ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে সরে আসতে হবে। এছাড়া দেশটির উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে তার বিশাল বৈদেশিক বাণিজ্য যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া যুদ্ধ চলাকালীন শত্রুপক্ষের অন্যতম লক্ষ্য থাকে অপরপক্ষের শিল্পস্থাপনাগুলো যেন ধ্বংস করে দেয়া যায়। আমেরিকার পারমাণবিক হামলায় চীনের বিভিন্ন উন্নত শিল্পস্থাপনাসমৃদ্ধ শহর একের পর এক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে– এই দৃশ্য কল্পনা করলে যেকোনো চীনা নাগরিকের গায়ের রোম শিউরে উঠবে। এর ঠিক বিপরীতটাও একজন আমেরিকান নাগরিককে দুঃসহ অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমেরিকা ও চীনের যুদ্ধে যে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের ঘটনা ঘটবে, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। সবচেয়ে বড় কথা, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সেটি আর শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আরও অনেক দেশ জড়িয়ে পড়বে।
এখনও পর্যন্ত বলা যায়, আমেরিকা ও চীন সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু পরিস্থিতি কখন বদলে যায়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইতোমধ্যে কিন্তু দুই দেশের মধ্যে একধরনের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে আমরা দুটি দেশের বাণিজ্যযুদ্ধও দেখেছি। যদি যুদ্ধ হয়, তাতে নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেডের ব্যবহার হবে, এবং পুরো পৃথিবীতে যে সেটি মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর মানুষের চেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে বেসামরিক মানুষের ক্ষেত্রে। তাই শান্তিকামী একজন নাগরিক হিসেবে আপনি এটি প্রত্যাশা করতেই পারেন যেন সামরিক সংঘাত কখনও বেধে না যায়।