শুরুতে আমাদেরকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে হবে। যখন করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে পুরো পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়েছিল, তখন চীনা লেখিকা ফ্যাং ফ্যাং ‘উহান ডায়েরি’ নামের একটি বই লেখেন। উহানের স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করেছিলেন– এই বিষয়টি নিয়ে লেখিকা ফ্যাংয়ের বইয়ে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল। তবে চীনের কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট সরকারের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া কিংবা যে কর্তৃত্ববাদী সরকারের মদদে উহানের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এমন কাজ করার সাহস পান, তাদের সম্পর্কে কোনো সমালোচনা করা হয়নি বইটিতে। লেখিকা ফ্যাং ফ্যাং নিজে একসময় চীনের হুবেই প্রদেশের স্থানীয় লেখক সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যে সংগঠনের সাথে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং তিনি যে কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনা করবেন না, এটা অনুমিতই ছিল। করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রাথমিক পর্যায়ে চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবোতে প্রকাশিত কয়েকজন চীনা নাগরিকের প্রতিক্রিয়াও এই বইয়ে তুলে আনা হয়েছে।
এই বইটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যখন চীনা সমাজ আরেকটি বিষয় কেন্দ্র করে রীতিমতো ফুঁসছিল। লি ওয়েনলিয়াং নামের এক তরুণ ডাক্তার ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি করোনাভাইরাস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য সামনে নিয়ে এসেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে উহানের স্থানীয় প্রশাসন যেখানে তথ্য গোপন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল, সেসময় তিনি ঝুঁকি নিয়ে করোনাভাইরাসের মহামারী আকার ধারণ করার বেশ কিছু তথ্য সামনে এনেছিলেন। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের অনেক অঞ্চলে করোনাভাইরাস নিয়ে বেশ উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়, যেটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি মোটেও পছন্দ করেনি। পরবর্তীতে তাকে গুজব ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং চীনের প্রচলিত আইনানুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়। ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং পরবর্তীতে শাস্তি ভোগ করার একপর্যায়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু চীনা সমাজে বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেকে তার মৃত্যুর পেছনে সরাসরি চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে দায়ী করেন। কিন্তু চরম পর্যায়ের চীনা সরকারের নজরদারির মাঝে কেউই আসলে সরাসরি তাদের চাপা ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করতে পারেননি।
ফ্যাং ফ্যাংয়ের বই ‘উহান ডায়েরি’ প্রকাশিত হওয়ার পর এটা বেশ প্রত্যাশিত ছিল যে সেটি চীনা সমাজে বেশ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে ঠিক উল্টো। না, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চীনের অসংখ্য তরুণ-তরুণী ওয়েইবো-তে ফ্যাংয়ের কঠোর সমালোচনা করেন। তাদের দাবি ছিল- পশ্চিমারা যেমন বৈশ্বিক পরিমন্ডলে চীনের উত্থান মেনে নিতে না পেরে অযৌক্তিক সমালোচনার আশ্রয় নেয়, ফ্যাংও ঠিক সেরকমই কিছু করে আলোচনায় আসতে চাচ্ছেন। তারা আরও দাবি করেছিল, চীনের সরকার প্রাথমিক ব্যর্থতার পরও যেখানে করোনাভাইরাসের আগ্রাসন ঠেকাতে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানে এই বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ না করে ব্যর্থতার উপর আলোকপাত করা সম্পূর্ণ ‘উদ্দেশ্য-প্রণোদিত’। একজন ওয়েইবো ব্যবহারকারী বলেন,
করোনাভাইরাসের জন্য পশ্চিমারা যেখানে আমাদেরকে বিশাল অংকের জরিমানা করার জন্য মুখিয়ে আছে, লেখিকা ফ্যাং ফ্যাং সেখানে তাদের হাতে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন।
প্রথমে কেন লেখিকা ফ্যাং ফ্যাংয়ের ‘উহান ডায়েরি’ প্রকাশ ও চীনাদের দ্বারা এর কঠোর সমালোচনা, এবং ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াংয়ের মৃত্যুতে সৃষ্ট বিতর্কের বিষয়গুলো নিয়ে আসা হলো, সেটি ব্যাখ্যা করা যাক। ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াংকে যখন ‘গুজব ছড়ানোর দায়ে’ শাস্তি প্রদান করা হয়, তখন চীনের প্রায় সবাই মনে করেছিল- তিনি বোধহয় সত্যিই গুজব ছড়িয়েছেন। এজন্য তার শাস্তিতে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, করেছে তার মৃত্যুর পর, যখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে লি ওয়েনলিয়াং কোনো গুজব নয়, প্রমাণিত তথ্যই ছড়িয়েছিলেন। ফ্যাং ফ্যাং যখন উহানের স্থানীয় প্রশাসনের প্রাথমিক অবহেলার দিক তুলে আনলেন তার বইয়ে, তখন সেটি নিয়ে আলোচনার বদলে তাকে ‘চীনবিরোধী ও পশ্চিমা বিশ্বের হাতিয়ার’ আখ্যা দেয়া হলো। বাস্তবে, চীনে প্রায় এক দশকের ইন্টারনেট ফিল্টারিংয়ে এমন এক প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যাদের অবস্থা দেখলে মনে হতে পারে যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কোন গোপন চিপ বোধহয় তাদের মস্তিষ্কে সংযোজন করে দিয়েছে, যার মাধ্যমে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। চীনা সরকারের চোখে যা খারাপ, এই প্রজন্মের চোখেও তা খারাপ। চীনা সরকারের অপছন্দের যেকোনো বিষয়ের তারা কঠোর সমালোচনা করে। এসব বিষয় থেকে চীনা সরকারের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা, সেটা শতভাগ সফলতা অর্জন করেছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের ঝেইজিয়াং প্রদেশের বিখ্যাত শহর উঝেনে দেশটির দ্বিতীয় ইন্টারনেট কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। এই বিশাল কনফারেন্সে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, দেশটির সবচেয়ে উদীয়মান কয়েকজন উদ্যোক্তা, এবং অসংখ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। সেই বিশাল কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতা শি জিনপিং বলেছিলেন, “আমরা অবশ্যই প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব ভার্চুয়াল জগত উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা, সেটাকে সম্মান জানাই।” এই কথার আড়ালে তিনি একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেন, “তোমরা নিজেদের দেশের ইন্টারনেট জগত যেভাবে উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে চাও করো। সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তোমার। কিন্তু ভুলেও চীনের সাইবার জগত সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করতে এসো না।” আসলে তার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই চীনের ইন্টারনেট জগত নিয়ন্ত্রণে তার অযাচিত হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে এসেছে। উঝেন শহরে ইন্টারনেট কনফারেন্সে তার দেয়া বক্তব্য ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনার একটি জবাব। এছাড়া ভবিষ্যতে চীনের ইন্টারনেট জগতের স্বরূপ কেমন হবে, সেই সম্পর্কেও এই বক্তব্য থেকে ধারণা পাওয়া যায়।
বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১২ সালে। অভিযোগ আছে, তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চীনের ইন্টারনেট জগতে সেন্সরশিপের মাত্রা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। এই শতকের প্রথম দশকে (২০০০-২০১০) চীনের ইন্টারনেটে সেন্সরশিপের মাত্রা ছিল অনেক কম, চীনা অধিবাসীরা অসংখ্য ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারতেন, যেগুলো এখন দেশটিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া সে-সময়ে চীনা সরকার আজকের মতে এত বেশি নজরদারিও চালাতো না। কিন্তু শি জিনপিংয়ের হাতে চীনের দায়িত্ব যাওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। চীনের ইন্টারনেট জগতের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়, যার কারণে চীনে যেসব বিদেশি কোম্পানি ছিল, তারা বিপাকে পড়ে যায়। এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল এমন, যাতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভোক্তাদের বিভিন্ন তথ্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে হস্তান্তরে বাধ্য থাকে। শি জিনপিং চীনের দায়িত্ব গ্রহণের আগে চীনা সরকারের বিভিন্ন অসন্তোষজনক কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্দোলন করা ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চীনারা নির্ভয়ে নিজেদের অসন্তোষ জানাতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে এটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
অনেকে বলে থাকেন, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে বাস্তব জগত ও ভার্চুয়াল জগতের মাঝে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তার মূল লক্ষ্য দুই জগতেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং অন্য কোনো মতাদর্শ যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা। তার সময়েই চীন ইন্টারনেট জগত নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব প্রযুক্তি দরকার, সেগুলো উদ্ভাবনের জন্য কোটি কোটি ইউয়ান খরচ করেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেও চীনা জাতীয়তাবাদে প্রবলভাবে বিশ্বাসী, তাই পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেন চীনের বাজারে সুবিধা করতে না পারে, সেভাবেই আইন প্রণয়ন করেছেন তিনি। তবে চীনের ইন্টারনেট জগত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাকে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে– ইন্টারনেটের মাধ্যমে চীনা জনগণের যে উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে ও তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেটি যেন কোনোভাবে ব্যাহত না হয়।