পেরুর সাথে জাপানের সম্পর্ক অনেক পুরনো। পেরু লাতিন আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্র, যাদের সাথে জাপান সেই ১৮৭০ সালেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে জাপানের নাগরিকদের অভিবাসী হিসেবে নিতে রাজি হয় দেশটি। লাতিন আমেরিকায় অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানি অভিবাসীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এমনকি ১৯৯০ সালে জাপানি বংশোদ্ভূত পেরুভিয়ান নাগরিক ও রাজনীতিবিদ আলবার্তো ফুজিমোরি দেশটির প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন। তার সময়েই জাপান-পেরু সম্পর্ক সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছায়। তবে তার জাপানপ্রীতি সবাই ভালোভাবে নেয়নি, যেমন- দেশটিতে সক্রিয় উগ্রবাদী বামপন্থী সংগঠনগুলো। পেরুর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি, উগ্রবাদী বামপন্থীদের দ্বারা জাপানি দূতাবাস জিম্মির ঘটনা, ঘটে রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফুজিমোরির সময়েই।
১৯৯৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর পেরুর জাপানি দূতাবাসে ছিল উৎসবের আমেজ। দেশটির কূটনৈতিক বলয়ের মধ্যে থাকা সকল ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় জাপানি কূটনীতিবিদ মোরিহিশা আওকির বাসভবনে। শুধু তারাই নন, পেরুর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা– বলা চলে দেশের উচ্চপদস্থ কোনো ব্যক্তিই দূতাবাসের আমন্ত্রণ পাওয়া থেকে বাদ যাননি। সম্রাট আকিহিতোর ৬৩ তম জন্মদিন উদযাপনে কোনো কমতি রাখতে চাননি জাপানি দূতাবাসের কূটনীতিবিদরা। সবমিলিয়ে জাপানি কূটনীতিবিদ মোরিহিশা আওকির বাসায় আগত অতিথির সংখ্যা পাঁচশো ছাড়িয়ে যায়। তখনও কোনো ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হবে।
গত শতাব্দীর আশি ও নব্বই এর দশকে পেরুতে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট মতাদর্শের বেশ কিছু বামপন্থী সংগঠন সক্রিয় ছিল, যারা পেরুর সাথে আমেরিকা ও জাপানের সুসম্পর্ক মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। এদের মধ্যে প্রধান দুটি সংগঠন ছিল টুপাক আমারু রেবেলিয়ন মুভমেন্ট ও শাইনিং পাথ। টুপাক আমারু রেবেলিয়ন মুভমেন্টের নামকরণ করা হয়েছিল টুপাক আমারু নামের এক ব্যক্তির নামানুসারে, যিনি আঠারো শতকে স্প্যানিশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এই সংগঠনগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহিংসতাকেই প্রধান উপায় হিসেবে বেছে নেয়। প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি এই সংগঠনগুলোর কীর্তিকলাপ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং এদের দমনের জন্য বিভিন্ন সফল অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে পেরুতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
জাপানি দূতাবাসে সম্রাট আকিহিতোর ৬৩ তম জন্মদিন উৎযাপন উপলক্ষ্যে দেশের অসংখ্য জনপ্রিয় ও নামকরা মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে– এই সংবাদ টুপাক আমারু রেবেলিয়ন মুভমেন্টের পৌঁছানোর পর সংগঠনটির নেতারা সিদ্ধান্ত নেন জাপানি দূতাবাসে হামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জিম্মি করা হবে। সংগঠনটির প্রায় চারশো নেতাকর্মীকে পেরুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন অভিযানে গ্রেফতার করেছিল। সংগঠনের নেতারা আরও সিদ্ধান্ত নেন, তাদের চারশো কমরেডকে যদি পেরু সরকার নিঃশর্ত মুক্তি দিতে রাজি হয়, তবে জিম্মি ঘটনায় আটকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ছেড়ে দেয়া হবে। এছাড়াও, এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেলে সংগঠনটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংগ্রাম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে ধারণা দেওয়া সহজ হবে।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখে পেরুতে অবস্থিত জাপানি দূতাবাসে ওয়েটার সেজে বেশ কিছু টুপাক আমারু রেবেলিয়ন মুভমেন্ট-কর্মী মোরিহিশা আওকির বাড়িতে প্রবেশ করে। এরপর বাড়ির সাথে যে বাগান রয়েছে, সেটার দেয়াল বোম দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে আরও কয়েকজন বিদ্রোহী প্রবেশ করেন। জাপানি কূটনীতিকের বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সাথে প্রায় চল্লিশ মিনিট বন্দুকযুদ্ধের পর বিদ্রোহী গ্রুপের চৌদ্দজন সদস্য বাসভবনের পূর্ণ দখল নিতে সমর্থ হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে নারী অতিথি ও যাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল, তাদের ছেড়ে দেয় বিদ্রোহীরা। পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরির মা ও বোন সেখানে উপস্থিত ছিল। তাদেরও ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর তাদের যে দাবি, তারা সেগুলো ফুজিমোরি বরাবর পেশ করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে পেরুর এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয়।
প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরি এই ঘটনায় বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। যদি অতিথিদের মধ্যে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটত, তাহলে তাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সমালোচনার শিকার হতে হতো। তিনি ঠান্ডা মাথায় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। জিম্মিকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে– এই ধরনের ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি ‘নেগোসিয়েশন কমিটি’ গঠন করেন। কমিটির কাজ ছিল জিম্মিকারীদের প্রতিনিধিদের সাথে জিম্মিরতদের মুক্তির দাবিতে আলোচনায় বসা ও সমঝোতা তৈরি করা। কিন্তু কমিটি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। কারণ জিম্মিকারীদের মূল দাবি ছিল চারশো কমরেডের নিঃশর্ত মুক্তি, যেটি ফুজিমোরি সরকারের পক্ষে মানা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এজন্য সব ধরনের আলোচনার ফলাফল ছিল শূন্য।
প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরি যখন দেখলেন আলোচনার মাধ্যমে কাজ হচ্ছে না, তখন তিনি কঠোরপন্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কমান্ডো বাহিনীকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। বেশ কয়েক মাস ধরে পেরুর কমান্ডো বাহিনীর ট্রেনিং চলেছিল। জাপানি কূটনীতিকের বাড়ির আদলে ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে আরেকটি বাড়ি তৈরি করা হয়। সেই বাড়িতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। প্রায় চার মাস ধরে প্রস্তুতি সম্পন্নের পর অবশেষে তারা অভিযান পরিচালনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
১৯৯৭ সালের ২২ এপ্রিল টানেল দিয়ে তারা জাপানি কূটনীতিকের বাসভবনে প্রবেশ করে। এরপর তারা সেই টানেল বোম দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এবার জিম্মিকারীদের সাথে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শেষপর্যন্ত জিম্মিকারীরা প্রত্যেকেই মারা পড়ে, কমান্ডো বাহিনীর একজন সদস্য মারা যান। যেসব অতিথিকে জিম্মি করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন মাত্র মারা যান, যিনি ছিলেন পেরুর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক। প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি ছিল প্রায় পাঁচশোজন, কিন্তু পরবর্তীতে একেবারে শেষপর্যন্ত মাত্র ৭২ জন জিম্মি ছিল। তাদের উদ্ধারের জন্যই কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করা হয়।
মুভমেন্টের সদস্যদের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের সফলভাবে, কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই উদ্ধারের জন্য পেরুর প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরি জাপান ও পেরু- দুই দেশেই নায়ক বনে যান। পেরুতে তার জনপ্রিয়তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। সেই সাথে এই মুভমেন্টের কবর রচনা হয়। এই ব্যর্থতা তাদের পতন ডেকে আনে। তাদের সমস্ত নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে ফেলা হয়। জনগণের কিছু অংশের মধ্যে এই বিদ্রোহীদের জন্য যতটুকু সহানুভূতি ছিল, সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পেরু ও জাপানের সম্পর্ক আরও গভীরতা লাভ করে।
পেরুর সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয় এই ঘটনার পর। মূলত তাদের সফল অভিযানের কারণেই শেষপর্যন্ত জিম্মি ব্যক্তিদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পেরুর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনার প্রভাব খুবই সুদূরপ্রসারী। রাষ্ট্রীয় সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সামনে যে উগ্রপন্থীরা কখনোই টিকতে পারে না- এই বিষয়টি আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যায়।