সাম্প্রতিক বিশ্বের একটি অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে তুরস্কের সামরিক ও রাজনৈতিক উত্থান। ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি তুরস্ক রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে একটি বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, এবং সিরিয়া, ইরাক, পূর্ব ভূমধ্যসাগর, লিবিয়া ও আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে অনেক বিশ্লেষকেরই ধারণা হয়েছে যে, তুরস্ক একটি ‘নব্য ওসমানীয় সাম্রাজ্য’ সৃষ্টি করতে আগ্রহী। তুর্কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সোনের চাগাপ্তায়ের মতে, এরদোয়ান ইতোমধ্যেই একটি ‘ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছেন। সাইপ্রাসভিত্তিক ‘উত্তর সাইপ্রাস তুর্কি প্রজাতন্ত্র’, সিরিয়াভিত্তিক ‘সিরীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’, ইরাকভিত্তিক ‘কুর্দিস্তান অঞ্চল’, লিবিয়াভিত্তিক ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’, আজারবাইজান– এগুলোর প্রত্যেকেই হয় তুরস্কের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল অথবা তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এর বাইরে কাতার, সোমালিয়া, তিউনিসিয়া, মালি, আলবেনিয়া, বসনিয়া–হার্জেগোভিনা, কসোভো, জর্জিয়া ও ইউক্রেনসহ বেশকিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্ক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
যেকোনো বৃহৎ শক্তির সামর্থ্য নির্ণয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হচ্ছে বহির্বিশ্বে সেই শক্তিটির সামরিক উপস্থিতি। এদিকে থেকেও তুরস্ক পিছিয়ে নেই, এবং বহির্বিশ্বে তাদের সামরিক উপস্থিতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ অঞ্চল থেকে বলকান পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রে তুরস্কের স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। চলুন, জেনে নেয়া যাক, সেই ঘাঁটিগুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত।
সাইপ্রাস
১৫৭১ থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত সাইপ্রাস ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ১৮৭৭–৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধের পর ব্রিটেন কার্যত সাইপ্রাস দখল করে নেয় এবং ১৯১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সাইপ্রাসকে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে। ১৯৬০ সালে সাইপ্রাস স্বাধীনতা লাভ করে, এবং তখন থেকেই সাইপ্রাসের তুর্কি সাইপ্রিয়ট সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রটিতে তুর্কি সামরিক উপস্থিতি ছিল। ১৯৭৪ সালে গ্রিক–সমর্থিত একটি সামরিক অভ্যুত্থানে সাইপ্রিয়ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তুরস্ক সাইপ্রাস আক্রমণ করে এবং তুর্কি সৈন্যরা রাষ্ট্রটির ৩৬.২% ভূমি (৩,৩৫৫ বর্গ কি.মি.) দখল করে নেয়। ১৯৮৩ সালে সাইপ্রাসের তুর্কি অধিকৃত অঞ্চলে তুর্কি সাইপ্রিয়টরা ‘উত্তর সাইপ্রাস তুর্কি প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, কিন্তু তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র উত্তর সাইপ্রাসের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি, এবং এটি কার্যত তুরস্কের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র।
উত্তর সাইপ্রাসে তুরস্কের একটি বৃহৎ সৈন্যদলকে স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হয়েছে, যেটি ‘সাইপ্রাস টার্কিশ পিস ফোর্স কমান্ড’ নামে পরিচিত। এই কমান্ডের অধীনে প্রায় ৩০,০০০ তুর্কি সৈন্য উত্তর সাইপ্রাসে মোতায়েনকৃত রয়েছে। উত্তর সাইপ্রাসের গির্নে শহরে এই বাহিনীটির সদর দপ্তর অবস্থিত। এই বাহিনীটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুর্কি সেনাবাহিনীর ‘ঈজিয়ান আর্মি’র অংশ (যেটির সদর দপ্তর ইজমির শহরে), কিন্তু কার্যত এটি সরাসরি আঙ্কারায় তুর্কি জেনারেল স্টাফের অধীনস্থ। এর বাইরে সম্প্রতি তুরস্ক উত্তর সাইপ্রাসের গেচিৎকালে বিমানবন্দরে একটি ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করেছে, যেটির মূল উদ্দেশ্য লিবিয়ায় সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করা। তদুপরি, সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও সাইপ্রাসের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে তুরস্ক উত্তর সাইপ্রাসের গাজিমাউসা বন্দরে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ইরাক
১৫৩৪ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ইরাকের সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন ইরাক দখল করে নেয়। ১৯৮০–এর দশক থেকে তুরস্ক তুর্কি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল ‘পার্তিয়া কারাকেরেন কুর্দিস্তানে’র (পিকেকে) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত এবং ১৯৯০–এর দশকে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থিত পিকেকের ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানতে শুরু করে। এসময় ইরাকি কুর্দিস্তানের দুটি প্রধান দল ‘কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি’ (কেডিপি) ও ‘প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অফ কুর্দিস্তান’ (পিইউকে) পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। তুরস্ক পিকেকেকে দমন করার উদ্দেশ্য কেডিপির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে, অন্যদিকে পিকেকে পিইউকে–এর সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ১৯৯৬ সালে তুরস্ক কেডিপি–নিয়ন্ত্রিত দোহুক প্রদেশে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপন করে, এবং এর মধ্য দিয়ে ইরাকি কুর্দিস্তানে তুরস্কের স্থায়ী সামরিক উপস্থিতির সূচনা হয়।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আক্রমণের পর থেকে ইরাকি কুর্দিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে তুরস্ক সেখানে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। এর মধ্যে ইরাকের মসুল শহর থেকে ১০ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত বাশিকা ঘাঁটিটি উল্লেখযোগ্য, কারণ এখানে তুর্কি সৈন্যরা ইরাকি কুর্দি সৈন্য ও ইরাকি সুন্নি যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এটি ছাড়াও ইরাকি কুর্দিস্তানে কমপক্ষে ২৫টি সামরিক ও গোয়েন্দা ঘাঁটি রয়েছে, এবং এগুলো এরবিল ও দোহুক প্রদেশে অবস্থিত। এরবিলে ৭টি তুর্কি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, এবং দোহুকে তুর্কিদের ১৪টি সামরিক ঘাঁটি ও ৪টি গোয়েন্দা ঘাঁটি রয়েছে।
আলবেনিয়া
১৪২০ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত আলবেনিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, কিন্তু ১৯১২–১৯১৩ সালের প্রথম বলকান যুদ্ধের পর আলবেনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯২ সালে আলবেনিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটার পর আলবেনিয়া তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয় এবং তুরস্কের সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে অবস্থিত আলবেনিয়ার ভ্লিওরে বন্দরে অবস্থিত পাশা লিমান নৌঘাঁটির সংস্কার সাধন করে। এই নৌঘাঁটিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল।
১৯৯৭ সাল থেকে আলবেনীয় নৌবাহিনীর পাশাপাশি তুর্কি নৌবাহিনীও পাশা লিমান নৌঘাঁটি ব্যবহার করে আসছে। ঘাঁটিটিতে তুর্কি উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র। তুর্কি নৌবাহিনীর প্রায় ২৫০ নাবিক এবং ২টি ফ্রিগেট ঘাঁটিটিতে স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা আছে। কিন্তু চুক্তি অনুসারে প্রয়োজন হলে তুরস্কের এই ঘাঁটিটিতে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে।
কাতার
১৮৭১ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত কাতার ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বাধীনে ছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৫ সালে ব্রিটেন অঞ্চলটি দখল করে নেয় এবং একে একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করে। একবিংশ শতাব্দীতে তুরস্ক ও কাতার নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং আরব বিশ্ব জুড়ে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে সমর্থন প্রদান করেছে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তুরস্ক প্রথম কাতারে সৈন্য মোতায়েন করে এবং এটি ‘কাতার–তুরস্ক কম্বাইন্ড জয়েন্ট ফোর্স কমান্ড’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কাতারের রাজধানী দোহার সন্নিকটে তারিক বিন জিয়াদ সামরিক ঘাঁটিতে কাতারে মোতায়েনকৃত তুর্কি সৈন্যদলটি অবস্থান করছিল, এবং ধারণা করা হয়, সেসময় প্রায় ৩,০০০ তুর্কি সৈন্য কাতারে মোতায়েনকৃত ছিল। ২০১৭ সালে সৌদি আরব ও ইমারাতের নেতৃত্বে যখন কাতারের ওপর অবরোধ আরোপিত হয়, তখন রিয়াদ ও আবুধাবী অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য অন্যান্য শর্তের পাশাপাশি কাতার থেকে তুর্কি সৈন্য অপসারণের শর্তও আরোপ করেছিল।
কিন্তু কাতার থেকে তুর্কি সৈন্য অপসারণ তো হয়ইনি, বরং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদসমৃদ্ধ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিতে তুর্কি সামরিক উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান তুর্কি সামরিক উপস্থিতির জন্য কাতারে ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’ নামক একটি নতুন বৃহৎ সামরিক ঘাঁটি নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে কাতারে প্রায় ৫,০০০ তুর্কি সৈন্য মোতায়েনকৃত আছে বলে ধারণা করা হয়, এবং সেখানে তুর্কি নৌ ও বিমানবাহিনীরও উপস্থিতি রয়েছে।
সিরিয়া
১৫১৬ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সিরিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স সিরিয়া দখল করে নেয়। ২০১১ সালে সিরীয় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর থেকে তুরস্ক সিরীয় বিদ্রোহীদের সক্রিয়ভাবে সমর্থন প্রদান করে আসছে এবং উত্তর সিরিয়ায় সিরীয় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রভাব হ্রাস করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছে। ২০১৬ সালে তুরস্ক সিরিয়ার অভ্যন্তরে প্রথম বড় মাত্রার সামরিক অভিযান চালায় এবং তখন থেকেই কার্যত তুর্কি সৈন্যরা সিরিয়ায় অবস্থান করছে। বর্তমানে তুরস্ক উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পো ও ইদলিব প্রদেশদ্বয়ের অংশবিশেষ নিয়ে ‘উত্তর সিরিয়া নিরাপত্তা বেল্ট’ (৮,৮৩৫ বর্গ কি.মি.) গড়ে তুলেছে, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত ‘সিরীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে’র অধীনস্থ, কিন্তু কার্যত তুর্কি সামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন।
তুরস্ক উত্তর সিরিয়ায় কমপক্ষে ৬টি স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি (আল–বাব, আল–রাই, আখতারিন, জারাবলুস, আৎমে, দারাৎ ইজ্জা) স্থাপন করেছে, এবং এগুলোতে ৫,০০০–এর বেশি তুর্কি সৈন্য মোতায়েনকৃত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে উত্তর সিরিয়া জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু সংখ্যক তুর্কি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত তুর্কি সেনা ও বিমানবাহিনী সংখ্যাগত দিক থেকে সিরিয়ায় অবস্থানরত রুশ সৈন্যদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী।
আজারবাইজান
১৯১৮ সালে ‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সহায়তায় গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, এবং কার্যত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের ফলে ওসমানীয়রা আজারবাইজান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং ১৯২০ সালে আজারবাইজানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং তুরস্কের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
২০১৬ সালে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী আজারবাইজান তুরস্ককে নিজ ভূমিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ প্রদান করে। আজারবাইজানের গিজিল শার্গ সামরিক শহর এবং হাজি জেয়নালাব্দিন তাগিয়েভ বিমানবন্দরে তুর্কি সেনা ও বিমানবাহিনীর ক্ষুদ্র উপস্থিতি রয়েছে, এবং তুর্কিরা প্রয়োজনে এই উপস্থিতি বাড়াতে পারবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ আছে। এর পাশাপাশি তুরস্ক তুর্কি–আজারবাইজানি সীমান্তে অবস্থিত আজারবাইজানের অন্তর্গত ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’ একটি বৃহৎ সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে আগ্রহী। উল্লেখ্য, নাখচিভান অঞ্চলটি আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নাখচিভান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী স্থানে আর্মেনীয় ভূমি অবস্থিত।
সোমালিয়া
সোমালিয়াকেন্দ্রিক আজুরান সালতানাত ও আদাল সালতানাতের সঙ্গে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল, কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে আদাল সালতানাতের পতনের পর এই অঞ্চলে ওসমানীয়দের প্রভাব হ্রাস পায়। বর্তমানে সোমালিয়াকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং রাষ্ট্রটি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদ, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়সহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এরই মধ্যে তুরস্ক ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ ও লোহিত সাগর অঞ্চলে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে সোমালিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে একটি বৃহৎ তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে।
এই ঘাঁটিটি ‘ক্যাম্প তুর্কসোম’ নামে পরিচিত এবং আয়তনের দিক থেকে বহির্বিশ্বে সর্ববৃহৎ তুর্কি সামরিক ঘাঁটি। ঘাঁটিটিতে প্রায় ১,৫০০ তুর্কি সৈন্য মোতায়েন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ঘাঁটিটি যুগপৎ একটি সামরিক ঘাঁটি এবং একটি সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তুর্কি সামরিক প্রশিক্ষকরা ঘাঁটিটিতে সোমালি সেনা ও নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। সম্প্রত তুরস্ক সোমালিয়ার লোহিত সাগর উপকূলে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
লিবিয়া
১৫৫১ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত লিবিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্বাধীনে ছিল, কিন্তু ১৯১১–১২ সালের ইতালীয়–ওসমানীয় যুদ্ধের পর ইতালি লিবিয়া দখল করে নেয়। ২০১১ সালে লিবীয় গৃহযুদ্ধে তুরস্ক লিবীয় বিদ্রোহীদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং লিবিয়ায় ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে চলমান লিবীয় গৃহযুদ্ধে তুরস্ক ত্রিপোলিকেন্দ্রিক ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’কে (জিএনএ) সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিচ্ছে এবং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জিএনএ–এর পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।
তুর্কি সামরিক সহায়তার বিনিময়ে জিএনএ তুরস্ককে লিবিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেছে। তুরস্ক লিবিয়ার আল–ওয়াতিয়া বিমানঘাঁটিতে একটি স্থায়ী বিমানঘাঁটি এবং মিসরাতা বন্দরে একটি স্থায়ী নৌঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পশ্চিম লিবিয়ার আরো বেশকিছু স্থানে তুর্কি সৈন্য মোতায়েনকৃত রয়েছে, যদিও লিবিয়ায় বর্তমানে অবস্থানরত তুর্কি সৈন্যের সংখ্যা কত সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
উপরে উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোর বাইরে সুদানে একটি তুর্কি নৌঘাঁটি রয়েছে বা ছিল বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু তুরস্ক ও সুদান উভয়েই একে অস্বীকার করেছে। কসোভো, বসনিয়া–হার্জেগোভিনা, লেবানন, মালি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও আফগানিস্তানে তুর্কি সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু সেসব স্থানে তুর্কি সৈন্যরা স্বতন্ত্রভাবে নয়, বরং জাতিসংঘ বা ন্যাটোর অধীনে নিয়োজিত রয়েছে। তাছাড়া, এই রাষ্ট্রগুলোতে তুর্কি সামরিক উপস্থিতি এখনও স্থায়ী নয়।
যে রাষ্ট্রগুলোতে বর্তমানে তুর্কি সামরিক উপস্থিতি রয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিই একসময় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিংবা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। ১৯২০–এর দশকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের এক শতাব্দীর মধ্যেই আবার এই রাষ্ট্রগুলোতে তুর্কিদের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। তাহলে কি সত্যি সত্যিই একটি ‘নব্য ওসমানীয় সাম্রাজ্যে’র সৃষ্টি হতে যাচ্ছে?