গত শতাব্দীর সবচেয়ে অভাবনীয় দিক হচ্ছে চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট পরবর্তী চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০৩০ সাল পরবর্তী চীন একক বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় বৃহৎ শক্তির মধ্যকার প্রতিযোগিতাকে সামনে নিয়ে আসছে।
চীন দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক ব্যবস্থার সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে। এই লক্ষ্যে তার সাংস্কৃতিক, অর্থনীতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ভূ-কৌশল প্রতিযোগিতায়, ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বৈশ্বিক মার্শাল প্লান ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ ঘোষণা চীনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ শুরুতে বিপর্যয় ডেকে আনলেও এটাকে এখন কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে চীন। চীন করোনার দখল সামলে আক্রান্ত দেশগুলোকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের সাথে যুক্ত দেশগুলোকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। আমেরিকার ঘরে ও বাইরে করোনা সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতা চীনকে আরো আগ্রাসী করবে, যা আমেরিকার নেতৃত্বের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র মিত্র দেশগুলোও আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় করে এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষমতার বণ্টন নির্ভর করে আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা এবং বৈশ্বিক জোটবদ্ধতার ওপর। করোনাভাইরাস মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চীনের এখনো বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই। চীনের রপ্তানি বাজারের অর্ধেকেরও বেশি বন্ধ এবং আভ্যন্তরীণ সেবাখাত এখনও অচল, যা মোট জিডিপির ৬০ ভাগ। বৈশ্বিক লেনদেনের ৯০ ভাগ হয় ডলারে। ২০০৮-০৯ আর্থিক সংকট পরবর্তী বৈশ্বিক স্টক মার্কেটে আমেরিকার শেয়ার বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাস এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেললেও এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
এশিয়ায় চীনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান, কিন্তু আস্থার সংকট আছে এই অঞ্চলে। ফেব্রুয়ারিতে পিউ রিসার্চের জরিপ অনুসারে, এশিয়ায় আমেরিকার প্রতি আস্থা সবার চেয়ে বেশি। চীনের অবস্থান এই অঞ্চলের অন্যতম শক্তি জাপানেরও নিচে। করোনা মোকাবিলায় সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এশিয়ায় চীন বৃহৎ শক্তির ইমেজ তৈরির চেষ্টা এবং আমেরিকা ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরদার মিডিয়া প্রচারণা চালাচ্ছে। এ বিষয়টি অনেক অঞ্চলে চীনের ইমেজ তৈরি– বিশেষত ইতালি, স্পেন, সার্বিয়া, ইরানে ইতিবাচক প্রচারণা পেয়েছে। মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের ওপর এর কতটুকু প্রভাব পড়বে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এশিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে করোনার প্রভাবকে এককভাবে বিবেচনা করলে কয়েকটি সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে পারে।
কৌশলগত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি
করোনার প্রভাবে এশিয়ার আঞ্চলিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন না হলেও দুই বৃহৎ শক্তি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন আসবে। ইতোমধ্যে উহানে ভাইরাস ছড়ানোর জন্য মার্কিন সেনাদের দায়ী করা, আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারণা– এশিয়ায় চীনের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়। মার্কিন প্রশাসন চীনের প্রচারণার বিরুদ্ধে আরো কঠোর হবে, যার সম্ভাব্য পরিণতিস্বরূপ চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের ব্যাপকতা- ৫জি থেকে শুরু করে মেডিকেল যন্ত্রপাতি, ফার্মাসিউটিক্যাল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
বৃহৎ শক্তির মধ্যকার কৌশলগত প্রতিযোগিতা এশিয়ার অন্যান্য দেশকে ওয়াশিংটনের প্রচেষ্টার সাথে ঐক্যবদ্ধ করবে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে, তা বলা যাবে না। জাপান এশিয়ায় চীনের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধবাদী হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সন্দিহান। আমেরিকা চীনের ফার্মগুলোর ৫জি মার্কেটে প্রবেশের ওপর এবং যারা এসব ফার্মে অন্যান্য যন্ত্রাংশ যোগান দেয়, তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এতে আমেরিকার অনেক মিত্র দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। টিপিপি থেকে একতরফা প্রত্যাহার এশিয়ায় মার্কিন নীতির ক্ষেত্রে মিত্র দেশগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা বাড়িয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের সাথে সামরিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার পূর্বে চীন-মার্কিন কৌশলগত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এ অঞ্চলের অন্যতম নিরাপত্তা ঝুঁকি। করোনা পরবর্তী প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেলেও এ অঞ্চলের দেশগুলো কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করবে। ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে সুযোগ তৈরি করবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে।
বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান তৈরি
সংকট সবসময় সম্ভাবনার দুয়ারকে উন্মোচন করে। ২০০৪ সালে সুনামির প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া চার দেশ নিয়ে চতুষ্টয় গঠন করে। কোরিয়া মিসাইল সংকট থেকে ছয় দলের সংলাপ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। ‘৯৭-৯৮ আর্থিক সংকট পরবর্তী সাংহাই ইনিশিয়েটিভ নেয়া হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কেউই করোনা মহামারি প্রতিরোধে প্যান-প্যাসিফিক আঞ্চলিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতার পদক্ষেপ নেয়নি। এ অঞ্চলের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে সদস্য, পারস্পরিক সহযোগিতায় করোনা প্রতিরোধে একটি সাধারণ প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশনকে (এপেক) এক্ষেত্রে জোরদার করা যেতে পারে। ১৯৭৩ সালে তেল সংকট পরবর্তী পেট্রোলিয়াম রিজার্ভের মতো কৌশলগত মেডিকেল যন্ত্রপাতির রিজার্ভ করা যেতে পারে। দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার হবে। এশিয়া-প্যাসিফিকের বৃহৎ শক্তি চীন-যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে করোনার মতো মহামারি প্রতিরোধে আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একসাথে কাজ করতে পারে।
আঞ্চলিক শক্তির কর্তৃত্ব
চীন, রাশিয়া, ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিসমূহ আরো শক্তিশালী হবে। চীনের বস্তুগত ও আদর্শিক বাধা থাকলেও চলমান সংকটে মার্কিন ও উদারনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার সুযোগ চীন নেবে। চীন আরো বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হবে; বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে। তবে বিগত শতাব্দীতে ব্রিটেনকে যেমন আমেরিকা শান্তিপূর্ণভাবে বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, চীনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। হার্ভার্ড স্কলার গ্রাহাম অ্যালিসন তার ‘ডেস্টিনড ফর ওয়ার’ গ্রন্থে চীন-আমেরিকার আসন্ন সংঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
সংশোধনবাদী শক্তিসমূহ নিজেদের অবস্থানকে আরো বেশি দৃঢ় করবে- চীন এশিয়ায়, রাশিয়া মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে এবং ইরান পারস্য উপসাগরে। ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার অ্যান্ড স্ট্রাটেজির ডিরেক্টর থমাস জে. রাইট তার ‘অল মেজারস শর্ট অভ ওয়ার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সংশোধনবাদী শক্তিসমূহ শক্তি সঞ্চয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়ে আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত হবে।
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো এককেন্দ্রিক থেকে বহুকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। জটিল প্রতিযোগিতাপূর্ণ বৈশ্বিক সম্পর্কে সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের বাইরে ক্ষমতার বণ্টন হচ্ছে। অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী, বিশেষত আঞ্চলিক সংগঠন, আর্থিক সংগঠন, সশস্ত্র সংগঠনগুলো আরো বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব আরো বেশি বিশৃঙ্খল হবে, কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস একে উল্লেখ করেছেন ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ডিজঅ্যারে’ হিসেবে।
এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে করোনা প্রভাব আঞ্চলিক ও বৃহৎ শক্তিসমূহের মধ্যকার প্রতিযোগিতা বাড়াবে। এক্ষেত্রে যুদ্ধকে এড়িয়ে দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বার্থকে নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে শক্তি প্রয়োগ বিদ্যমান বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে আরো বেশি ভঙ্গুর ও দুর্বল করবে, যা নিঃসন্দেহে এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।