বারাণসী, বেনারস বা কাশী; ভারতের উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন এক শহরের নাম। শহরটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত বাঙালিদের কাছে এটি কাশী এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে এটি বারাণসী, বেনারস বা এর নিকটবর্তী কোনো উচ্চারণে অধিক পরিচিত। উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌ থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই শহরকে বলা হয় ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী। হিন্দুধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস, এই শহরে যদি কারো মৃত্যু হয়, তবে তিনি মোক্ষ (মুক্তি) লাভ করেন।
এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বারাণসী শহরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য উপাসনালয়, মন্দির, স্নান ঘাট, সাধু-সন্ন্যাসীদের নিবাস ইত্যাদি। এসবের সমন্বয়ে পুরো শহরটি একটি প্রকৃত আধ্যাত্মিক নগরীতে পরিণত হয়েছে। শহরে প্রবেশ করলে আপনি নিজেও সেই আধ্যত্মিক আবেশ অনুভব করতে পারবেন। পুণ্য লাভের আশায় বিভিন্নজন আপনার সামনে ‘নামাক পারা’ (খাদ্য বিশেষ) নিয়ে হাজির হবেন এবং সবিনয়ে তা গ্রহণ করে তাকে ধন্য করতে বলবেন। আপনি তা না খেতে চাইলে উল্টো তারা ব্যথিত হবেন; কেননা অন্যকে আহার প্রদান করা তাদের কাছে একটি পুণ্যের কাজ। এমনকি সেখানকার অনেক তীর্থযাত্রী নতুন কোনো মেহমান না পেলে নিজেও খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, সারা বিশ্বে মোট সাতটি পবিত্র ভূমি রয়েছে, যেখানে গেলে মানুষ মোক্ষ লাভ করতে পারেন। এর প্রত্যেকটিকে বলা হয় তীর্থভূমি এবং এই সাতটিকে একত্রে বলা হয় সপ্তপুরী। কাশী এই সপ্তপুরীর অন্যতম পবিত্র ভূমি। পাশাপাশি এই শহরটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এবং গঙ্গা নদীতে স্নান করা হিন্দু ধর্মমতে বিশেষ পুণ্যের কাজ। এজন্য হিন্দু ধর্মের সামর্থ্যবানদের বয়স যখন বাড়ে, তখন তারা কাশীতে চলে আসেন এবং সেখানে আমৃত্যু উপাসনা করেন। কেননা, কাশীতে মৃত্যুবরণ করলে তাদের সকল প্রকার পাপকর্ম মোচন হয়ে যাবে, অর্থাৎ তিনি মোক্ষ লাভ করবেন।
এমনই একজন তীর্থযাত্রীর নাম গায়ত্রী দেবী, যিনি ভারতের রাজস্থান থেকে কাশীতে এসেছেন। প্রায় পাঁচ বছর যাবত তিনি এখানে উপাসনা করছেন। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। তারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছেন। কিন্তু তারা মায়ের তেমন একটা খোঁজখবর নেয় না এবং তাকে দেখতে আসে না। এটি গায়ত্রী দেবীকে কষ্ট দেয় সত্য, তবে তিনি কখনো সন্তানদের অভিশাপ দেন না। তিনি বলেন,
বিয়ের পর সন্তানদের সব কিছু বদলে গেছে। তাদের কাছে আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। এখন আমি শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করি। আমার বিশ্বাস, আমি যখন মারা যাবো তখন সন্তানরা আমাকে শেষবারের মতো শ্মশানঘাটে নেয়ার জন্য এখানে আসবে।
শুধু গায়ত্রী দেবী নয়, তার মতো আরও অসংখ্য নারী-পুরুষ কাশীর বিভিন্ন অতিথি কক্ষে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। কেন এই অপেক্ষা? সেসব নিয়ে নানা ধর্মীয় বর্ণনা ও লোককথা প্রচলিত আছে। হিন্দু ধর্মের মহাকাব্য মহাভারতে এই শহরের বর্ণনা পাওয়া যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহাভারতের নায়ক পঞ্চপাণ্ডব তথা পাণ্ডব রাজপুত্রগণ তাদের চাচাতো ভাইদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। সেই যুদ্ধে তারা ভাইদের হত্যা করে বিজয় অর্জন করেন ঠিকই, কিন্তু ভ্রাতৃহত্যা ও ব্রাহ্মণহত্যাজনিত পাপ তাদের বিচলিত করে তোলে। এ পাপ থেকে মুক্তি লাভের আশায় তারা পরমসত্ত্বা শিবের অনুসন্ধানে নামেন এবং তাকে অনুসন্ধান করতে করতে কাশীতে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তারা শিবের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এতে হিন্দু দেবতা শিব প্রসন্ন হয়ে এই কাশী নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন। সে থেকেই এটি হিন্দু ধর্মের প্রায় সকলের কাছে তীর্থভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কাশীতে তীর্থযাত্রীদের বসবাসের জন্য যেসব কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে তাকে বলা হয় ‘মোক্ষ নিবাস’। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের অর্থায়নে এসব নিবাস গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষত, ‘কাশীবাসী’ নামক একটি দাতব্য সংস্থা এ ব্যাপারে বেশ তৎপর। এসব মোক্ষ নিবাসগুলো নির্দিষ্ট শর্তে তীর্থযাত্রীদের গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে ‘মুমুকসু ভাওন’ অতি পুরাতন একটি তীর্থযাত্রী নিবাস কেন্দ্র। এখানে প্রায় ১১৬টি কক্ষ বা মোক্ষ নিবাস রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি মোক্ষ নিবাসের ব্যায়ভার কাশীবাসী নামক সংস্থাটি বহন করে থাকে। নিবাস কেন্দ্রটির পরিচালক ভিকে আগরওয়াল বলেন,
আমরা প্রতি বছর হাজার হাজার আবেদনপত্র পেয়ে থাকি। কিন্তু আমরা নির্দিষ্ট সংখ্যক তীর্থযাত্রীকে গ্রহণ করতে পারি; কেননা আমাদের নিবাস কক্ষের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা সাধারণত অভাবী মানুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। তবে তাদের নিজ খরচ বহনের সক্ষমতা, দেখাশোনা করার জন্য কোনো আত্মীয় এখানে থাকতে পারবেন কি না এবং মৃত্যুবরণের পর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার মতো সক্ষমতা তার (উত্তরাধিকারদের) আছে কি না তা আমরা দেখে থাকি। এছাড়া আমরা সাধারণত ৬০ বছরের কম বয়সী কেউকে এখানে ভর্তির সুযোগ দেই না।
তার মানে এই নয় যে, কাশীতে যারা তীর্থযাত্রা করেন তাদের অনেক খরচ বহন করতে হয়। কেননা কাশীবাসী প্রত্যেক (যারা তাদের কাছে আবেদন করে ভর্তির সুযোগ পান) তীর্থযাত্রীকে প্রায় ১ লক্ষ ভারতীয় রুপী অর্থসাহায্য প্রদান করে থাকেন। এই সাহায্য ব্যক্তির সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে কিছুটা কম-বেশিও হতে পারে। এছাড়া তারা আমৃত্যু সেখানে থাকার জন্য রুম বরাদ্দ তো পেয়েই থাকেন। ভিকে আগরওয়াল বলেন,
আমাদের শর্তে উল্লেখ করা থাকে, খাবার খরচ নিজ দায়িত্বে বহন করতে হবে, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের খাবার খরচ বহন করা হবে না। কিন্তু কেউ যদি খাদ্য খরচ বহন করতে অক্ষম হয়ে পড়েন, তাহলে পরিচালনা কমিটি তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং আমৃত্যু তাকে সাহায্য প্রদান করেন।
এমন আরেকটি নিবাসের নাম ‘মুক্তি ভবন’। তবে এখানকার নিয়ম একটু ভিন্ন। এখানে সাধারণত সর্বোচ্চ ১৫ দিন অবস্থান করতে দেয়া হয়। এর মধ্যে কারো যদি মৃত্যুবরণের সৌভাগ্য না হয়, তবে তাকে সবিনয়ে প্রস্থান করতে বলা হয়। নিবাসটিতে তত্বাবধায়কের দায়িত্বে আছেন নারহারি সুকলা। তিনি বলেন,
অনেক ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে। পরিচালক তীর্থযাত্রীর মৃত্যুর সম্ভাবনা অতি নিকটে দেখলে তাকে অতিরিক্ত কিছুদিন এখানে অবস্থানের করার সুযোগ দেন। তবে সাধারণত এমনটি হয় না।
এরকম আরও অসংখ্য ছোট বড় নিবাস গড়ে উঠেছে কাশী নগরীতে। এসবের নিয়ম ও শর্তে রয়েছে বিভিন্নতা। অনেক নিবাস আবার পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে। সাধারণত বৃদ্ধ বয়সে অর্থাৎ যখন কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তখন তাকে তার আত্মীয়স্বজন কাশী নগরীতে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে কেউ কেউ উপাসনা ও মোক্ষ লাভের আশায় আগেভাগেই কাশী নগরীতে পাড়ি জমান। অনেকে আবার মৃত্যুমুখে এখানে আসলেও, মৃত্যুবরণ করতে অনেক সময় লেগে যায়। উদাহরণস্বরূপ সীতা দেবীর কথা বলা যায়, যিনি এখানে ৫ বছর যাবত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। এছাড়া ভিমলা দেবী নামের আরেকজন তীর্থযাত্রীর কথা বলা যায়, যিনি এখানে ৪০ বছর অপেক্ষা করার পর গত বছর মোক্ষ লাভ করেছেন।
তবে মোক্ষ লাভের বিষয়টি উপরোক্ত আলোচনায় যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা সহজ নয়। অনেকে এখানে এসে আমৃত্যু অপেক্ষা না করতে পেরে প্রস্থান করেন। অনেকে আবার এখানে আসলেও যথার্থ উপাসনা করে ঈশ্বরকে প্রসন্ন করতে ব্যর্থ হন। তবুও কাশী বা বারাণসীকে ঘিরে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের পাশাপাশি অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু মানুষ প্রতি বছর এই নগরী পরিদর্শন করতে যান। কেননা আধ্যাত্মিক নগরীর পাশাপাশি সেখানকার উপাসনালয়সমূহ স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য, হিন্দু ধর্মের স্থাপত্যের পাশাপাশি কাশীতে বেশ কিছু মুসলিম স্থাপত্যও রয়েছে। এর মধ্যে জ্ঞানবাপি মসজিদ, আলমগিরি মসজিদ, গঞ্জ-ই-শহিদান মসজিদ ও চৌখাম্বা মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুলতান আমলে এসব মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এছাড়া এখনও কাশী নগরীর জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। অনেক ঐতিহাসিক মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের দ্বারা কাশী নগরীর অনেক মন্দির ধ্বংসের অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন। তবে এখন পর্যন্ত মন্দির-মসজিদের এই সহাবস্থান আমাদের শান্তির বার্তাই প্রদান করে।