২০১৮ সালে ভারতীয় পুলিশ দাবি করে, তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যা ও সরকার পতনের এক বিস্ময়কর ষড়যন্ত্র উদঘাটন করেছে। তিন বছর বাদে, ক্রমশই তথ্য-প্রমাণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, সেই কথিত ষড়যন্ত্র ছিল নিছকই কাল্পনিক, এবং সেই কল্পকাহিনী রচনায় মুখ্য ভূমিকা ছিল ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাসের। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত, সিদ্ধার্থ দেবের শ্বাসরুদ্ধকর লং-রিডের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের সামনে। আজ থাকছে তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব।
১
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে, পুলিশের একটি বিশাল বাহিনী হাজির হয় ৪৭ বছর বয়সী মানবাধিকার কর্মী রণা উইলসনের দিল্লিস্থ ফ্ল্যাটে। পুলিশ বাহিনীটি এসেছিল ভারতের পশ্চিমা রাজ্য মহারাষ্ট্রের পুনে থেকে। তাদের সঙ্গে দিল্লি পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাও অবশ্য ছিল।
উইলসনের এক কামরার ফ্ল্যাটে যখন তারা উপস্থিত হয়, ঘড়িতে সবে ভোর ছয়টা। পরের আট ঘণ্টা ধরে তারা ফ্ল্যাটজুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সন্দেহজনক সূত্র বা আলামত। উইলসনের ল্যাপটপে থাকা বিভিন্ন ফাইল তো খতিয়ে দেখেই, ঘাঁটাঘাঁটি করে তার বইয়ের স্তূপও।
বিরক্ত, নির্ঘুম উইলসন তাদেরকে বলেন, তল্লাশি চালানো শেষ হলে যেন বইগুলো ফের জায়গামতো সাজিয়ে রাখা হয়। একসময় পুলিশ তার ফ্ল্যাট ত্যাগ করে বটে, কিন্তু যাওয়ার সময় জব্দ করে নিয়ে যায় তার হিউলেট-প্যাকার্ড ল্যাপটপ, একটি স্যানডিস্ক থাম্ব ড্রাইব এবং তার মোবাইল ফোন।
সাত সপ্তাহ বাদে, পুলিশ আবারো ফিরে আসে উইলসনের ফ্ল্যাটে। এবার তারা গ্রেপ্তার করে তাকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ: তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যা, এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব অপরাধের তথ্য-প্রমাণও নাকি পাওয়া গেছে তার ল্যাপটপে।
উইলসনকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পুনেতে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় ভারতের জঙ্গীবাদ-বিরোধী আইনে, এবং তাকে করা হয় কারাবন্দি। এরপর কেটে গেছে তিন বছর। কিন্তু এখনো অবসান ঘটেনি তার বন্দিদশার।
২
প্রেস ফটোগ্রাফে দেখা গেছে ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলের উইলসনকে; সাদা পোশাকের দুজন পুলিশের মাঝে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে বসে আছেন তিনি একটি অচিহ্নিত ভ্যানের পেছনের সিটে। সেই ছবি দেখে আর যা-ই হোক, তাকে কোনো সহিংস ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে মনে হয় না।
মালয়ালামভাষী, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী উইলসনের শৈশব কেটেছে দক্ষিণী রাজ্য কেরালায়। দিল্লিতে থাকাকালীন তিনি কায়মনোবাক্যে নিযুক্ত ছিলেন রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকার বিষয়ক প্রচারণায়। একাধিকবার তিনি হাজির হয়েছেন ভারতের সবচেয়ে বড় জেলখানা, তিহার জেলে। এছাড়াও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আশায় হানা দিয়েছেন বিভিন্ন আইনজীবীর দপ্তর এবং নয়া দিল্লির ডজনখানেক গণমাধ্যমের কার্যালয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক বন্দিদের মিথ্যা মামলায় আটকে রাখা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের মাত্র কিছুদিন আগেই, উইলসন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করার জন্য আবেদন করেছিলেন সারে ইউনিভার্সিটিতে। যদি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারতেন, তাহলে হয়তো অচিরেই যুক্তরাজ্যে উড়াল দিতেন তিনি।
তথ্যচিত্র নির্মাতা সঞ্জয় কাক উইলসনকে চেনেন প্রায় দুই দশক ধরে। উইলসনের সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে একসঙ্গে প্রচারণাও চালিয়েছেন তিনি। তার মতে, উইলসন পুরোপুরি নিবিষ্ট ছিলেন এই কাজে।
“অনেকভাবেই, রণা হলেন একজন আদর্শ ভারতীয় সক্রিয় কর্মীর দৃষ্টান্ত– চুপচাপ, আত্মমগ্ন, এবং নিজের কাজে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার সঙ্গে যা হয়েছে, সেটাকে একটি ট্র্যাজেডি বলা চলে। কেননা যে যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য তিনি আজীবন খেটে গেছেন, সেই যন্ত্রের হাতেই আজ তিনি বন্দি।”
৩
২০১৮ সালের জুন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া সেই ষোলজনের একজন উইলসন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে একটি মাওবাদী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার। এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য নাকি ছিল মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের। এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে অনুষ্ঠিত এলগার পরিষদ নামক একটি উৎসব।
দুজন অবসরপ্রাপ্ত প্রগতিশীল বিচারপতি আয়োজন করেন এ উৎসবের, নিকটস্থ গ্রাম ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঐতিহাসিক দলিত বিজয়ের ২০০ বছর উপলক্ষ্যে। ১৮১৮ সালে ওই গ্রামে ব্রিটিশ রেজিমেন্টে দায়িত্ব পালনরত দলিত সৈন্যরা পরাজিত করেছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু সৈন্যদলকে।
সেই উৎসবে বক্তারা সমালোচনা করে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং তাদের আধা-সামরিক শাখা হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর। বক্তাদের অভিযোগ ছিল, এই দুটি দল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের প্রচারণা চালাচ্ছে, এবং ধ্বংস করতে চাইছে ভারতীয় সংবিধানকে, যেখানে ধর্মীয় ও জাতিগত সমতার কথা বলা হয়েছে।
এর পরদিন, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি, শুরু হয় সহিংসতা। ভীমা কোরেগাঁওয়ে সমবেত হওয়া দলিতদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’। তবে তারা কাদের প্রতিনিধি, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেননা তাদের সঙ্গে ছিল ডানপন্থী হিন্দুদের চিরপরিচিত গেরুয়া নিশান। ওই সহিংসতায় মৃত্যু হয় একজনের। এছাড়াও অনেক সম্পদ ভাংচুর করা হয়, এবং আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
প্রাথমিকভাবে এই সহিংসতার নেপথ্যে জড়িত হিসেবে যে দুজন স্থানীয় ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়, তাদের সঙ্গে দীর্ঘকালীন ডানপন্থী হিন্দুদের যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু হুট করেই তদন্তের মোড় ঘুরে যায়। এপ্রিল নাগাদ পুলিশের যাবতীয় মনোযোগের বিনিয়োগ ঘটে তথাকথিত ‘শহুরে নকশাল’-দের ষড়যন্ত্রে। এই ‘শহুরে নকশাল’ কথাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে ডানপন্থী হিন্দুরা, এবং এর মাধ্যমে তারা বুঝিয়ে থাকে সক্রিয় কর্মী এবং প্রগতিশীল ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের, যারা নাকি কাজ করছে আন্ডারগ্রাউন্ড মাওবাদী গ্রুপগুলোর মুখপাত্র হিসেবে, এবং দলিতদের জাগিয়ে তুলতে চাইছে সরকারের বিরুদ্ধে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনেতে সেদিনের কথিত বিদ্রোহে উসকানির নামকরণ করা হয় ‘ভীমা কোরেগাঁও ষড়যন্ত্র’।
৪.
এই মুহূর্তে ভারতের জেলগুলোতে রয়েছে হাজারো রাজনৈতিক বন্দি। তবে অন্য যেকোনো গণগ্রেপ্তারের চেয়ে, ভীমা কোরেগাঁও মামলাই যেন সবচেয়ে বেশি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে মোদি সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে কীভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের সমালোচকদের উপর জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে।
আসলে উইলসন কিন্তু এলগার পরিষদ আয়োজনের ধারেকাছেও ছিলেন না। এমনকি, তিনি ওই সময় মহারাষ্ট্রেও ছিলেন না। তার আইনজীবী দলের দাবি অনুযায়ী, তিনি ছিলেন দিল্লিতে। অবশ্য তার ফ্ল্যাটে প্রথমবার তল্লাশির পর পুলিশ দাবি করেছে যে উইলসনের কম্পিউটার ও থাম্ব ড্রাইভ বিশ্লেষণ করে নাকি বেশ কিছু ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে, যাতে প্রমাণ হয় তিনি আসলেই একজন অপরাধী। সেসব ডকুমেন্টের মধ্যে নাকি একটি চিঠিও ছিল, যেখানে উইলসন লিখেছেন মোদির ‘রোড-শো’-গুলোকে টার্গেট করার কথা, যেন ‘আরেকটি রাজীব গান্ধী টাইপের ঘটনা’ ঘটানো যায়, অর্থাৎ তিনি রেফারেন্স টানছিলেন ১৯৯১ সালে তামিম টাইগারের একজন সুইসাইড বোম্বার কর্তৃক ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর খুনের ঘটনাটির।
২০১৮ সালের ৮ জুন, যেদিন দিল্লিতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে উইলসনকে, সেদিন তারা ভারতের নানা প্রান্ত থেকে আটক করে আরো চারজন সক্রিয় কর্মীকে। সকলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তারা উইলসনের সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন একই ষড়যন্ত্রে। সেই চার বন্দি হলেন সুরেন্দ্র গাদলিং (৫৩), একজন দলিত আইনজীবী; সুধীর ধাওয়ালে (৫২), একজন দলিত লেখক; সোমা সেন (৬৩), একজন নারীবাদী সাহিত্য অধ্যাপক; এবং মহেশ রাউত (৩৪), একজন ভূমি অধিকার আদায়ের সক্রিয় কর্মী। উইলসনের মতোই, তাদের নামেও ইতঃপূর্বে কোনো ধরনের সহিংসতার রেকর্ড নেই।
এই অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড ছিল প্রধানত রাষ্ট্র ও ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোর বাড়াবাড়িকে চ্যালেঞ্জ জানানো, এবং সেগুলো সবই পাবলিক রেকর্ডের ব্যাপার; কেননা তারা তাদের লড়াই করে গেছেন আদালতে, প্যানেলে, মিছিলে এবং প্রেস কনফারেন্স। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সরকার পরের দুই বছরে একই ধরনের কারণ দেখিয়ে সক্রিয় কর্মীদের গ্রেপ্তার করা অব্যাহত রেখেছে। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি ও রাঁচি থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের বদৌলতে, মোট আটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬-তে।
আটককৃত ১৬ জন এখন অন্যান্য সক্রিয় কর্মী ও গণমাধ্যমের কাছে পরিচিত ‘বিকে ১৬’ নামে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আনন্দ তেলতুম্বদে, একজন দলিত বুদ্ধিজীবী যিনি বিয়ে করেছেন ভারতীয় সংবিধানের দলিত স্থপতি বিআর আম্বেদকারের নাতনিকে। এছাড়াও আছেন সুধা ভরদ্বাজ (৫৯), বস্টনে জন্মগ্রহণকারী আইনজীবী, যিনি কেন্দ্রীয় ভারতের শ্রমিক ও আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে; এবং স্ট্যান স্বামী, একজন অশীতিপর সক্রিয় কর্মী ও জেসুইট যাজক। স্বামী গ্রেপ্তার হন গত বছরের অক্টোবরে। তিনি ভুগছিলেন পারকিনসন’স ডিজিজে। কিন্তু তারপরও, তার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তাকে জামিনের আবেদন করা হলেও, বিচারক সে আবেদন নামঞ্জুর করে দেন। পরবর্তীতে জেলখানায় থাকতে তিনি কোভিড সংক্রমিত হন, এবং এ বছরের ৫ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য এই মৃত্যুতেও টনক নড়েনি মোদির; কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাননি তিনি।
৫.
উইলসনসহ একই অভিযোগে অভিযুক্ত অধিকাংশ বন্দিই বর্তমানে রয়েছেন মুম্বাইয়ের তালোজা জেলে। বিকে ১৬-এর ১৪ জনেরই জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবলই ৮১ বছর বয়সী কবি ভারাভারা রাও এবং গাদলিং। রাও গত বছর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ছয় মাসের জামিনে রয়েছেন, তবে এই মাসের শেষেই তাকে আবার জেলে ফিরতে হবে। এদিকে গাদলিংকে এক সপ্তাহের জামিন দেয়া হয়েছে, যা শুরু হবে আগামী সপ্তাহে। বাইরে বেরিয়ে মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করবেন।
আদালতে বিকে ১৬-এর প্রতিনিধিত্ব করছেন মিহির দেশাই নামের এক আইনজীবী। তিনি বলেন, এই রাজনৈতিক বন্দিদের যেভাবে দিনের পর দিন নির্বিচারে জেলে পচিয়ে মারা হচ্ছে, তা থেকে মূলত ভারতের ড্রাকোনীয় জঙ্গীবাদ-বিরোধী আইনেরই প্রতিফলন ঘটেছে। এই ‘বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন’ (ইউএপিএ অ্যাক্ট)-এর অধীনে আটককৃতদের জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর একবার যখন বিচার শুরু হবে, তা শেষে হতে পাঁচ থেকে ১০ বছর লেগে যাবে।
“তাদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে তিন বছর জেলে কাটিয়ে ফেলেছেন, অথচ বিচারকার্য শুরু হতে এখনো অনেক বাকি। প্রসিকিউশন দাবি করছে, তাদের নাকি ২০০ জন সাক্ষী রয়েছে। ভেবে দেখুন, এই ২০০ জনের সবাইকে আদালতে প্রশ্ন করতে ঠিক কতটা সময় লাগবে!”
৬.
বিকে ১৬-এর বিরুদ্ধে সরকারের মামলাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, এর বিশালত্ব। ২০০ জন সাক্ষী তো রয়েছেই, তাছাড়া বিকে ১৬-এর বিরুদ্ধে যে চার্জ ফাইল তৈরি করা হয়েছে, সেটি সর্বমোট ১৭,০০০ পাতার। আর দ্বিতীয়ত, যে-ধরনের আপাত অদ্ভুত, অসম্ভব ষড়যন্ত্রের কথা ওই ১৭,০০০ পাতায় উন্মোচিত হয়েছে।
তদন্তে যেসব ইলেকট্রনিক যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে এবং মূলধারার গণমাধ্যমে যতটুকু ফাঁস হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে উইলসন এবং অন্যান্য অভিযুক্তরা নির্দ্বিধায় একে-অন্যকে তাদের প্রথম নামে অভিহিত করে যাচ্ছেন, এবং আলোচনা করছেন অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার, অভ্যুত্থানের প্রস্তাবনা হিসেবে একটি ‘অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ফ্রন্ট’ গড়ে তোলার।
পুলিশ এবং ফেডারাল অ্যান্টি-টেরর বডি, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) যে চার্জ শিট দাখিল করেছে, সেটি অবিশ্বাস্য, অপ্রমাণিত ও সম্ভবত প্রমাণের অযোগ্য সব কথাবার্তায় পূর্ণ। যেমন তেলতুম্বদের বিরুদ্ধে দাখিল করা চার্জ শিটে লেখা হয়েছে :
“অ্যাকাডেমিক ভিজিটের নাম করে তিনি কানাডা, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতেন। ঐসব কথিত সম্মেলনে তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর সঙ্গে সিপিআই (মাওবাদী)-এর সাহিত্য ও আদর্শ, প্রশিক্ষণ ও কর্মকৌশল বিনিময় করতেন।”
চার্জশিট ও প্রমাণ তালিকাগুলোয় আরো রয়েছে ‘মোবাইল কানেক্টিভিটি চার্ট’ ও ‘ইমেইল কানেক্টিভিটি চার্ট’ প্রভৃতি শিরোনামের বিভ্রান্তিকর ডায়াগ্রাম, ‘মার্ক্স ফর বিগিনার্স’ এর একটি ফটোকপি, এবং “এমন একটি বই, যার প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে সাদা শাড়ি পরিহিত এক নারীকে, এবং তার উপরে ইংরেজিতে লেখা, ‘Accused INDIAN ARMY'”.
এছাড়াও আরো অসংখ্য প্রমাণ এসেছে অভিযুক্তদের কাছ থেকে জব্দ করা কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, সিম কার্ড ও থাম্ব ড্রাইভ থেকে। কিন্তু এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে আবিষ্কৃত তথ্যগুলো সন্দেহজাগানিয়া, এবং তা শুধু এ কারণেই নয় যে ডকুমেন্টগুলো খুব বাজেভাবে লেখা, যা অভিযুক্তদের সঙ্গে একেবারেই মানায় না, কিংবা ইমেইলে উইলসন ও এক ‘কমরেড প্রকাশ’-এর মধ্যকার খোলামেলা কথোপকথন, যা খুবই আশ্চর্যজনক। (‘কমরেড প্রকাশ’ সম্ভবত একজন আন্ডারগ্রাউন্ড জঙ্গীর কোড নেম)
৭.
বলাই বাহুল্য, অভিযুক্তদের যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের নামে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাতে যে-কেউই ভিন্ন কিছুর সন্দেহ করতে পারে। তাই তো এসবে সতর্ক হয়ে গিয়ে সক্রিয় কর্মী ও বিকে ১৬-কে মুক্ত করতে কর্মরত আইনজীবীরা যোগাযোগ করেছেন আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশনের (এবিএ) মানবাধিকার সেকশনের সঙ্গে।
এবিএ এই কেসের জুডিশিয়াল রেকর্ডগুলো খতিয়ে দেখেছে, এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে তারা যে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। তাদের মতে, তদন্তকারীদের কাজের প্রক্রিয়ায় প্রচুর অসংলগ্নতা রয়েছে, এবং তারা অভিযুক্তদের মৌলিক মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কাই করেনি।
এবিএ-র মাধ্যমে উইলসনের আইনজীবীরা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ডিজিটাল ফরেনসিক ফার্ম, আর্সেনাল কনসাল্টিং-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে, যেন এই মামলার আরো গভীরে তলিয়ে দেখা হয়।
২০২০ সালের জুলাইয়ে মুম্বাই থেকে ম্যাসাচুসেটসে আর্সেনালের অফিসে এসে পৌঁছায় একটি হার্ড ড্রাইভ, যাতে রয়েছে উইলসনের ল্যাপটপ ও থাম্ব ড্রাইভের ক্লোন কপি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্সেনাল তাদের প্রাথমিক উদঘাটনগুলোকে উপস্থাপন করে বিকে ১৬ নিয়ে তাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে।
ডিফেন্সের একজন সদস্য বলেন, “আমরা এগুলো তাদের (আর্সেনালের) কাছে পাঠিয়েছিলাম এই ভেবে যে পুলিশ হয়তো প্রথম রেইডের পর ওসব ডিভাইসে প্রমাণ প্ল্যান্ট করেছে।” কিন্তু আর্সেনাল যে ফলাফল তাদের সামনে পেশ করেছে, তাতে তাদেরকে যারপরনাই অবাক হতে হয়েছে। কেননা আর্সেনালের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, ক্ল্যান্ডেস্টাইন অপারেশনের অভিযোগে অভিযুক্তদের কম্পিউটারে অপরাধ প্রমাণ করার মতো যেসব ডকুমেন্ত পাওয়া গেছে, সেগুলো ভীমা কোরেগাঁও সহিংসতারও বহুদিন আগেই তাদের ডিভাইসে প্ল্যান্ট করা হয়েছিল।
পুলিশ উইলসনের কাছ থেকে যেসব ল্যাপটপ ও থাম্ব ড্রাইভ জব্দ করেছে, সেগুলোর ক্লোন কপি পরীক্ষানিরীক্ষা করে আর্সেনাল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, পুলিশ যেদিন উইলসনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, তারও ২২ মাস আগেই হ্যাকাররা তার ল্যাপটপে মালওয়্যার প্ল্যান্ট করেছিল। তারা কবি ভারাভারা রাওয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে উইলসনের কাছে পরপর বেশ কয়েকটি ইমেইল পাঠিয়েছিল, যে ইমেইল দেখে উইলসন মনে করেছিলেন ভেতরে হয়তো কোনো ড্রপবক্সের লিঙ্ক। কিন্তু আর্সেনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেগুলো ছিল একটি “ম্যালিশাস কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সার্ভার”। একবার উইলসনের ল্যাপটপে মালওয়্যারটি ইনস্টল হয়ে গেলে, হ্যাকাররা প্রায় এক বছর ধরে উইলসনের ল্যাপটপে ডিপোজিট করে ৩২টি ডকুমেন্ট, যার মধ্যে ছিল মোদিকে হত্যা বিষয়ক চিঠিটিও।