নাইজেরিয়া এবং ইসরাইলের একটি যৌথ গোপন ডিপ্লোম্যাটিক মিশন ছিল ডিক্কো এফেয়ার। যাকে নিয়ে ঘটনা, জনাব উমারু ডিক্কো ছিলেন একসময়কার নাইজেরীয় মন্ত্রী। তাকে অপহরণের যে চেষ্টা সেটিই ডিক্কো এফেয়ার নামে পরিচিত। এটি ছিল সচরাচর ঘটা অপহরণের চেয়ে একদমই ভিন্নরকম ঘটনা। আর এই ঘটনাটি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে।
ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৬১ এর ধারা ২৭ (৩) অনুযায়ী এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রেরিত কূটনৈতিক ব্যাগ কোনোভাবেই কেউ খুলে চেক করতে পারবে না। এমনকি ইমিগ্রেশন, কাস্টমসের উপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমন ব্যাগ খুলে দেখার ব্যাপারে। আন্তর্জাতিক আইনের এই প্রয়োগ এক দেশের গোপনীয় নথি এবং জিনিস চলাচলে বাধা প্রাপ্ত হতে বিশেষ সুরক্ষা লাভ করে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নথিপত্রের গোপনীয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বজায় থাকে।
আন্তর্জাতিক এই আইনের বিশেষ এই সুবিধাকে অপপ্রয়োগ করার চেষ্টা করে একজন আপাদমস্তক মানুষকে ব্যাগে করে ভরে নিয়ে সেটিকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ হিসেবে চিহ্নিত করে অপহরণের চেষ্টার ঘটনা তাজ্জব করার মতোই ঘটনা।
দুইটি বিখ্যাত ঘটনা এভাবে করার চেষ্টা হয়েছিল। একটি ডিক্কো এফেয়ার্স নামে পরিচিত এবং আরেকটি ক্রায়িং সুটকেস নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো এই দুটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। এ রকম ঘটনা সবার নজরে আসে। আর এমন ঘটনা সফল হয়ে থাকলে তা নজরে আসার সম্ভাবনা ছিল না।
ডিক্কো এফেয়ার্সটি মোসাদ এবং নাইজেরিয়ার জন্য একটি লজ্জাজনক ঘটনা যার চূড়ান্ত মূল্য নাইজেরিয়াকে দিতে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের মাধ্যমে।
উমারু ডিক্কো ছিলেন একসময়কার নাইজেরিয়ান পরিবহন মন্ত্রী। তার মন্ত্রিত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট শেহু শাগারি সাগাই এর সময় এবং ডিক্কো ছিলেন সাগাই এর ভায়রা ভাই। ১৯৮৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেহেরু সাগাই সরকার উৎখাত হয়। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে প্রেসিডেন্ট হন তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মুহাম্মদু বুহারি।
ক্ষমতায় আসার দ্বিতীয় দিনই প্রেসিডেন্ট বুহারি আগের সরকারের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীর তালিকা প্রণয়ন করেন যাদের তিনি বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হিসেবে বিচারের সম্মুখীন করতে চান। উমারু ডিক্কো ছিলেন সেই তালিকার প্রথম সারির একজন।
ডিক্কোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি জাতীয় তেল সংক্রান্ত সম্পদ এবং জাতীয় ট্রেজারি থেকে মোট প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন। ডিক্কো ইংল্যান্ডে পালিয়ে গিয়ে গোপনে বর্তমান সরকারের সমালোচক হিসেবে তার নির্বাসিত জীবন কাটাতে থাকেন।
যদিও তৎকালীন সময়ে ইসরাইল এবং নাইজেরিয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি তথাপি নাইজেরিয়া ছিল ইসরাইলের জন্য তেল আমদানির একটি অন্যতম উৎস। অন্যদিকে ইসরাইল ছিল নাইজেরিয়ার জন্য অস্ত্র আমদানির উৎস। এই সম্পর্কের মূল্যায়নে ইসরাইলের মোসাদ এবং নাইজেরিয়ার ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিস যৌথ উদ্যোগে ডিক্কোকে নাইজেরিয়ায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।
ডিক্কো গোপনে নাইজেরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়াতে তার অবস্থান সম্পর্কে ধোঁয়াশা থেকে যায়, আর তাই মোসাদের মতো বিচক্ষণ গোয়েন্দা সংস্থাও ডিক্কোর অবস্থান নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়। তৎকালীন মোসাদ ডিরেক্টর জেনারেল নাহোম আডমোনি ধারণা করেন যে ডিক্কো লন্ডনের কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন কারণ লন্ডনেই তৎকালীন নাইজেরিয়া থেকে নির্বাসিত সমালোচক গোষ্ঠীর আনাগোনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এই ধারণা যাচাই করতে মোসাদ এজেন্ট কাটসাস এবং নাইজেরিয়ান আর্মির অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং নাইজেরিয়া সিকিউরিটি সার্ভিসের এজেন্ট মেজর মুহাম্মদ ইউসুফুর নেতৃত্বে দুটি দল লন্ডনে যায়। নাইজেরিয়ান টিমটি নিজেদের রিফিউজি হিসেবে পরিচয় দিয়ে লন্ডনের ক্রমওয়েল রোডের একটি এপার্টমেন্টে অবস্থান নেয়। আর মোসাদের টিমটি ট্যুরিস্টদের ক্যাটারিংয়ের সাথে নিজেদের যুক্ত করে নেয় এবং নিজেদের বিধর্মী বিরোধী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়।
আলাদা এই দুইটি দল আলাদাভাবে নিজেদের খোজ শুরু করে এবং পশ্চিম লন্ডন হতে হাইড পার্ক পর্যন্ত এলাকায় অবস্থানরত নাইজেরিয়ার নির্বাসিত প্রত্যেক নাগরিককে পর্যবেক্ষণ করে ডিক্কোর খোজ করতে থাকে। কিন্তু তাদের এত প্রচেষ্টাও একটা সময় পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যদস্ত হয়।
৩০শে জুন ১৯৮৪-তে একজন মোসাদ এজেন্ট দৈবাৎ ডিক্কোর খোঁজ পান। এজেন্টটি ডিক্কোর অবস্থানের জায়গাটি শনাক্ত করেন এবং মোসাদ ডিরেক্টর জেনারেল আডমোনিকে ডিক্কোর কথা অবগত করেন। আডমোনি তার এজেন্টকে ডিক্কোর অবস্থানের জায়গাটি নজরে রাখতে বলেন। নাইজেরিয়ান টিমটিও ডিক্কোর অবস্থান জানার পর লন্ডনের নাইজেরিয়ান হাই কমিশনকে বেস হিসেবে ব্যবহার করে ডিক্কোকে অপহরণের পরিকল্পনা করে।
এ সময় মোসাদ একজন ইসরাইলি ডাক্তার লেভি-অরি শাপিরোকে লন্ডনে পাঠান যিনি ছিলেন ইসরাইলের হাশারন হাসপাতালের আই.সি.ইউ উইংয়ের পরিচালক এবং একজন কনসাল্টেন্ট এনেস্থেসিয়ান। শাপিরোর কাজ ছিল ডিক্কোকে একটি বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করা যাতে ডিক্কো অজ্ঞান থাকেন এবং অপহরণরত অবস্থায় যেন অসুস্থ না হয় সেদিকে নজর রাখা।
৩ জুলাই ১৯৮৪ এর সন্ধ্যায় নাইজেরিয়ান এয়ারওয়েজ এর বোয়িং ৭০৭ একটি বিমান লন্ডনের স্টান্সটেড এয়ারপোর্টে অবতরণ করে যেটি ছিল সম্পূর্ণ খালি। বিমানের পাইলট এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষকে জানান যে তিনি এই বিমানে করে নাইজেরিয়ান এম্ব্যাসি থেকে একটি বিশেষ ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ নিয়ে যেতে এসেছেন।
বিমানে কয়েকজন নাইজেরিয়ান সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন যারা প্রকাশ্যেই নিজেদের পরিচয় দেয় এবং সেই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তারা দায়িত্বে আছেন বলে জানান। তাদের অবস্থান এবং অবস্থানের কারণ এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে অবহিত করে।
তার ঠিক পরের দিনই ডিক্কোকে তার বাড়ির সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। ডিক্কো তখন হাটতে বেরিয়েছিলেন। অপহরণের দায়িত্বে থাকা নাইজেরিয়ান টিমের প্রধান ইউসুফু একটি গাড়ি নিয়ে আসেন এবং গাড়িতে থাকা তার সঙ্গীরা ডিক্কোকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেন। গাড়িতেই তাকে চেতনা-নাশক ওষুধ প্রয়োগ করেন শাপিরো।
কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য যে অপহরণ দৃশ্যটি ডিক্কোর সেক্রেটারি এলিজাবেথ হায়েস দেখে ফেলেন এবং তিনি সাথে সাথে কর্তৃপক্ষকে তা জানান।অপহরণকারীরা দুটি ১.২*১.২*১.৬ সাইজের বাক্স আগে থেকে তৈরি রাখে। একটিতে অজ্ঞান ডিক্কো এবং ডাক্তার শাপিরো। আরেকটিতে অন্য দুজন মোসাদ এজেন্ট ঢুকে বাক্সগুলো বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়।
এখানে জানার একটি বিষয় হলো কোনো ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগকে চেকিং থেকে রক্ষা করতে এম্ব্যাসি থেকে কিছু বিশেষ কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। এই বিশেষ কাগজগুলো ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৬১ এর আর্টিকেল ২৭ (৪) এর রক্ষাকবচ। অর্থাৎ ধারা ২৭ (৪) অনুযায়ী কোনো ব্যাগকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে এই কাগজ এবং অনুমতিপত্রগুলো লাগবে। অন্যথায় সেই ব্যাগেজগুলো চেকিংয়ের আওতায় পড়বে।
এদিকে ডিক্কোর সেক্রেটারির কাছ থেকে ডিক্কোকে অপহরণের খবর পেয়ে লন্ডন পুলিশ লন্ডনের সকল এয়ারপোর্টে রেড এলার্ট জারি করে দেয়।কিন্তু অপহরণকারী টিমে এই দুই বাক্সকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাদের তাড়াহুড়ো, আগে থেকে রেড এলার্ট জারি আর বাক্স দুটির সন্দেহজনক আকার দেখে এয়ারপোর্টের কাস্টম অফিসারদের সন্দেহের উদ্রেক করে। এদিকে বাক্স দুটি নেওয়ার জন্য আসা বিমান টি টেক-অফের জন্য তৈরি হচ্ছিল।
রেড এলার্ট জারির ফলে সিকিউরিটির কড়াকড়িতে কাস্টমস অফিসারদের আদেশে এয়ারপোর্ট পুলিশ সেই দুইটি কাঠের বাক্স খুলে দেখতে চায়। নাইজেরিয়ানরা বাক্স দুইটিকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ হিসেবে বলে সেগুলো খোলা অবৈধ বলে পুলিশদের নিরস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ নাছোড়বান্দা হয়ে বাক্স দুটি খুলে দেখে। তাতে উন্মোচিত হয় অকল্পনীয় অপহরণ চেষ্টার কাহিনী।
ডিক্কোকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং তিনি সেখানে সুস্থ হয়ে উঠেন। অন্যদিকে ডিক্কোকে অপহরণের চেষ্টায় আটককৃত নাইজেরিয়ান টিম লিডার ইউসুফু, ইসরাইলি ডাক্তার শাপিরো সহ আরো দুই মোসাদ এজেন্টকে বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং প্রত্যেকে ৬-৮ বছর সাজাপ্রাপ্ত হয়।
এদিকে ইংল্যান্ড নাইজেরিয়ার কাছে এই অপহরণ চেষ্টার জবাবদিহি চাইলে নাইজেরিয়া এবং ইসরাইল সরকার তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার লন্ডনের নাইজেরিয়া হাইকমিশনের হাইকমিশনার সহ দুই জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ইংল্যান্ড থেকে বহিষ্কার করে।
জবাবে নাইজেরিয়া নাইজেরিয়ায় অবস্থানরত দুই জন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারকে প্রাইভেট জেট চুরির দায়ে ১৪ বছরের সাজা দেয়। নাইজেরিয়ান এয়ারওয়েজের সিইওকে ব্রিটিশ পুলিশ প্রায় গ্রেফতার করে নিয়েছিল।
এই ঘটনার পর প্রায় দুই বছর নাইজেরিয়া এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন থাকে। পরবর্তীতে নাইজেরিয়া সরকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে ডিক্কোকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানায় এবং ব্রিটিশ সরকার তা নাকচ করে। একই সাথে নাইজেরিয়া সরকারের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নির্বাসিত ব্যক্তিত্বকে হস্তান্তরের অনুরোধও ব্রিটিশ সরকার নাকচ করে দেয়।
এই ঘটনার পর নাইজেরিয়ার বুহারি সরকারের দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপও দুর্বল হয়ে পড়ে। ডিক্কো লন্ডনে থেকেই তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এবং Solidarity Group of Nigeria (SGN) নামে তার নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ২০১৪ সালে লন্ডনে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।