সপ্তদশ শতকে ইউরোপের এক পরিচিত পখির নাম নর্দার্ন ব্যাল্ড আইবিস। এই পাখি ওয়ালড্রাপ নামেও পরিচিত। এক সময় উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য ইউরোপের অনেক অঞ্চলে নর্দার্ন ব্যাল্ড আইবিস পাখির অবাধ বিচরণ ছিল। বর্তমানে পাখিটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
আইবিস পাখির বৈশিষ্ট্য
অন্যান্য পাখির মতো এই পাখি গাছে বাস করতে পছন্দ করে না। পরিযায়ী পাখি হিসেবে পরিচিত পাখিটি জঙ্গলে, মরুভূমির কিছু কিছু শুষ্ক অঞ্চলে, পাথরে এবং কোনো পুরনো কেল্লার খোপে বাসা বাঁধে।
নর্দার্ন ব্যাল্ড আইবিস আকারে বেশ বড়, ওজনেও ভারি। এর সারা দেহ কুচকুচে কালো, আবার গায়ের কোথাও কোথাও লালা ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। মুখমণ্ডল লাল আর মাথার দিকে কালো ঝুঁটি রয়েছে। এর পাগুলো ছোট এবং হালকা লাল রঙের। গলাও তত লম্বাটে নয়। প্রাপ্তবয়স্ক আইবিস পাখির লম্বা বাঁকানো ঠোঁট, পালকে নীল-বেগুনি ভাব থাকে। এরা ৭০-৮০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়, পাথরে খাঁজে বা কোনো পরিত্যক্ত দুর্গের কোটরে বছরে ২-৩টি ডিম পাড়ে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, টিকটিকি জাতীয় ছোট ছোট প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য।
পাখির আদি নিবাস
ইয়েল এনভায়রনমেন্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডের মতো ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অঞ্চলে এই পাখি দেখতে পাওয়া যেতো। ১৫৫৭ সালে সুইস প্রকৃতিবিদ কনরাড জেসনার তার পাঁচ খণ্ডে রচিত ‘হিস্ট্রি অব অ্যানিমেলস’ বইয়ে উল্লেখ করেন যে, প্রচুর সংখ্যায় জেরোনটিকাস এরেমিতা বা আইবিস পাখিকে আল্পস পর্বতের চূড়ায় উড়তে দেখা গেছে। পাখিটি বর্তমানে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে দক্ষিণ মরক্কোতে এই প্রজাতির ৫০০টির মতো পাখি রয়েছে। ২০০২ সালে সিরিয়াতে ১০টির মতো নর্দার্ন ব্ল্যাডের ছোট্ট একটি প্রজনন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে লেবাননের দ্য সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অফ নেচার কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আইএস-এর আক্রমণের পর থেকে এই পাখিদের কোনো প্রজাতি সিরিয়ার কোনো অঞ্চলেই আর দেখা যায়নি।
বিরল প্রজাতির এই পাখি ইউরোপ থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণ
৪০০ বছর আগে হঠাৎই পাখিটি ইউরোপ থেকে হারিয়ে যায়। এরপর ইউরোপের কয়েকটি স্থানীয় চিড়িয়াখানায় তাদের দেখতে পাওয়া যেতো। ইউরোপ থেকে এই পাখি হারিয়ে যাওয়ার পিছনে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। পরিযায়ী পাখি হিসেবে ইউরোপে ফিরে আসার পথটি ভুলে যাওয়ার কারণে তারা আর ইউরোপে ফিরে আসতে পারেনি বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। আবার আর একদল বিজ্ঞানীর মতে, পথ চিনতে ভুল গেছে এটি একটি কারণ হলেও মূলত আবহাওয়া ও মানুষের কারণে পাখিটি ইউরোপ থেকে হারিয়ে যায়। মানুষের নির্বিচারে শিকার এবং মারাত্মক শীতল আবহাওয়ার কারণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই পাখির প্রজাতি আর ইউরোপে ফিরে আসতে চায়নি।
পাখিটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে
আইবিসের বংশবৃদ্ধি এবং তাকে আবার ইউরোপের ‘ওয়াইল্ড লাইফ’-এ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন করিন্না ইস্টেরার নামে এক পাখি বিশারদ এবং তার সাথে থাকা অন্য বিজ্ঞানীরা। এজন্য বিজ্ঞানীরা ‘ওয়ালড্রাপ’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।
এই প্রকল্পের আওতায় পাখিদের বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে তাদেরকে কীভাবে পুনরায় ইউরোপে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। বর্তমানে ইউরোপের একটি চিড়িয়াখানায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই পাখির সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৮৪টির মতো আইবিস পাখি রয়েছে।
‘ওয়ালড্রাপ’ প্রকল্পের আওতায় পাখিদের পথ চিনিয়ে ইউরোপে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ২০০১ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন জীববিজ্ঞানী জোহানেস ফ্রিৎজ। তার নেতৃত্বে এক দল স্বেচ্ছাসেবক পাখিগুলোর পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব নিয়েছেন। চিড়িয়াখানায় জন্মানো পাখিগুলোকে ইউরোপের বন্য জীবনধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বিজ্ঞানী ফিৎজ ও তার দলের একমাত্র লক্ষ্য।
প্রথমবার ২০০১ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনরাড লোরেনজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে আইবিস পাখির একটি দলকে ইউরোপের দক্ষিণে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ফিৎজ লক্ষ করলেন পাখিদের যাত্রাপথটি ভুল দিক নির্দেশ করছে।
পাখিদের পরিযায়ী পথ তৈরি করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। কারণ পাখিরা তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য কোন পথটি ব্যবহার করবে, তা প্রমাণিত নয়। তখনও আইবিস পাখির পরিযায়ী পথ কোনটি, তাও নির্দিষ্ট করতে পারছিলেন না ফ্রিৎজ ও ওয়ালড্রাপ প্রকল্পের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা। ২০০৪ সালে এসে তারা সফল হন। এই সময় ফ্রিৎজ ও তার দল আইবিস পাখির একটি পালকে পথ চিনিয়ে ইউরোপে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। শেষ পর্যন্ত সেই পরিযায়ী পথটি আইবিস পাখিদের পরিযায়ী পথ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
পাখিদের এই পথ চিনিয়ে দেয়ার কাজে আধুনিক প্রযুক্তির মাইক্রোলাইট বিমান ব্যবহার করা হয়। এই বিমানগুলো পাখিদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে। এই পথ ব্যবহার করে পাখিগুলো যেন পাড়ি দিতে পারে ইতালি, সুইজারল্যান্ড সহ ইউরোপের অন্যান্য শহরগুলোয় তার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কোনও পাখি পথ হারিয়ে অন্যত্র যাতে চলে না যায়, তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে জিপিএস ট্র্যাকার। কিন্তু জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেক বিজ্ঞানী।
কিছু পাখি মাইক্রোলাইট বিমানের পথ অনুসরণ করে তার গন্তব্যে ফিরে যেতে পেরেছে, আবার কিছু পাখি পুনরায় তার পূর্বের জায়গায় ফিরে এসেছে। বিজ্ঞানীরা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। উড়ে যাওয়ার সময় বিদ্যুতের তার, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদির হাত থেকে আইবিস পাখিদের বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত মনিটরিং করে যাচ্ছেন। এভাবে বেশ কিছু পাখিকে ইউরোপে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
২০১১ সালে একটি আইবিস পাখি তাসকেনিয়ার পথে উড়ে যেতে সক্ষম হয় এবং সে আবার সেখান থেকে দক্ষিণ জার্মানির বার্গোসেনে ফিরেও আসে। ২০১২ সালে এক শিকারি পাখিটিকে মেরে ফেলে। কিন্তু পাখির এই পরিযায়ী পথটি সঠিক ছিল বলে প্রমাণিত হয়। ২০১০ সালে ২৯টি পাখিকে পৃথকভাবে মাইক্রো ফ্লাইটের সাহায্যে তার গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এভাবে ফিৎজ ৮৪টি পাখিকে পথ চিনিয়ে অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
প্রকল্পটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছিল। ফিৎজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে প্রকল্পটি আবার নতুনভাবে চালু করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেন, যাতে করে ৫০০ আইবিস পাখিকে ২০৫৭ সালের মধ্যে ইউরোপে স্থানান্তর করা যায়। হয়তো এভাবে অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠবে নর্দার্ন আইবিস ব্ল্যাডের আবাসস্থল। আবারও আল্পস পাহাড়ের চূড়োয় আইবিস পাখির ঝাঁককে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য দেখতে পাবেন বলে পাখিপ্রেমীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
ওয়ালড্রাপ প্রকল্পের সাফল্যের পরও কথা থেকে যায়। অনেক সংরক্ষণবাদী এই প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। সংরক্ষণবাদীদের অনেকরই অভিমত, আইবিস পাখি প্রকৃতপক্ষে কখনোই আল্পস বা ইউরোপের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না। তারা উষ্ণ জলবায়ুর কারণে পরিযায়ী পাখি হিসেবে দক্ষিণ ও মধ্য ইউরোপের কিছু অঞ্চলে কিছু সময়ের জন্য তাদের আবাস গড়ে তুলতো। তাই প্রকল্পটি কোন রকম সুফল বয়ে আনবে না। তার পরিবর্তে আইবিসের প্রজনন স্থল মরক্কো বা তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে কীভাবে নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র গড়ে তোলার মাধ্যমে তার বংশবৃদ্ধি এবং নিরাপদ আবাসভূমি গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে কর্মকাণ্ড চালালে আরও বেশি সুফল পাওয়া যেত বলে তাদের অভিমত। আর অনেক গবেষকদের মতে, আল্পসের শিখরে আইবিস পাখির ঘুরে বেড়ানোর কথা বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখায় খুঁজে পাওয়া গেলেও তা আসলে আল্পাইন প্রজাতির কাক, যার ঠোঁটগুলো ছিল লাল।
গত বছর নভেম্বরের দিকে বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল থেকে জানানো হয় যে, পশ্চিম মরক্কোর আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে নর্দার্ন ব্যাল্ড আইবিসের দুটি প্রজনন ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে এই পাখির বংশবৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মরক্কো সরকার দেশটির মধ্যে বসবাসরত আইবিস পাখির সুরক্ষার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন বলে মরক্কোর সরকারি মহল থেকে জানানো হয়েছে। অনেক জীববিজ্ঞানী এবং সংরক্ষণবাদীরা এই খবরে উৎসাহিত হয়েছেন। তার আশা করছেন, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে এই বিপন্ন প্রজাতির পাখিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
ফিচার ইমেজ- willemkruger.wordpress.com